গুচ্ছ কবিতা

শাহিদ হাসান

পরম্পরা

কত আগে মাঠে মাঠে প্রণম্য সবুজ ঘিরে পাখির কুজন
আর বকুলের গন্ধে প্রজাপতি ডানা মেলে সুনিপুণ ছন্দে।
ডালে ডালে তারে ডাকে সমূলে ব্যাকুল হয়ে তাহার স্বজন।
নীরব থাকে না কভু নদীর বিরহ জল,বহে মৃদু-মন্দে
অদূরে যাবার তরে প্রগাঢ় কাজল মেখে ছায়ায় ছায়ায়।
দিনের প্রখর আলো বৃক্ষের পেছনে চুপ,তার খুব নিচে
চলে গেলো বহু দূরে ক্লান্ত এই মেঠো পথ অপার মায়ায়।
শ্বশুরের পিছে পিছে বউ হাঁটে ভীরু পদে কিছু নয় মিছে।

সব কিছু দ্রুত সরে সারি সারি প্রাণহীন দালানের ভিড়ে।
তপ্ত রোদে ফুটপাত,পিচ গলে ধীরে ধীরে আর ছোটদের
অন্ন কেড়ে দেখে নাকো অতীতের কোন কিছু আজবের তীরে।
সহস্র অহং গেলো করোনায় চিরতরে,আপন তাদের
ছিলো না নিকটে জানি,কার তরে এইসব বিশাল প্রকাশ
খালি হাতে চলে গেলো কলেরার মহাকালে হাজার সাহস।

প্রাণহীন বালুচর

যখন এখান থেকে সরে যাবে কেউ দূরে, হাটে-মাঠে-ঘাটে
পাবে না কখনো দেখা দু’পায়ের দৃঢ় ছাপ। বুঝে নিও ফুল-
ফল-লতা আর পাতা কত আগে স্বর তার স্তব্ধ এই তটে
কত ব্যথা প্রাণে সয়ে হেঁটে গেলো কত পথ পেলো নাকো কূল।
থাকার আকুতি ছিলো প্রিয় পৃথিবীর কোলে আরো কিছু দিন
চুপচাপ টেনে নিলো চাঁদের আকুল ঘ্রাণ সুদীর্ঘ শীতের
রাতে করোনার সাথে। কত কথা রেখে গেলো ছিলো নাকো ঋণ
তাজা কামনার কাছে অল্প সময়ের ভিড়ে। ব্যাকুল পথের
মোড়ে মোড়ে উহানের শত রেণু যায় নাকো দেখা কভু চোখে
নিঠুর স্বার্থের তরে ঝরে আগামীর রোদ চণ্ডালের হাতে
তাদের কারণে আজ দিনে-রাতে হাহাকার ধরণীর বুকে,
নীরবতা নামে ধীরে তীরে তীরে দৃঢ়তায় আঁধারের সাথে।
বিশাল বটের তলে ছায়া নড়ে একা একা ফেলে দীর্ঘশ্বাস
মূলত পাবে না জানি প্রাণহীন বালুচরে কখনো আশ্বাস।

সপ্রাণে হবে না দেখা

কচি পাতা ঝরে গেলো অকারণে পথে পথে এই অবেলায়
কেন জানি বারবার তাদের নরম মায়া মনের মুকুরে
স্মৃতি হয়ে পিছু ডাকে শ্রাবণের জলে ভেজা অনড় ছায়ায়।
কত দিন এক সাথে জানালার শিক ধরে অমন দুপুরে
রক্তের বাঁধন মিলে তরুণ বৃষ্টির ছন্দে নানা প্রকরণে
বেলা যায় ধীরে ধীরে, তারা আজ গতদের সাথে চিরঘুমে
মিশে আছে বহু দূরে, সপ্রাণে হবে না দেখা আগের ধরনে
কখনো এখানে আর। আমার প্রথম কলি মেডিকেল রুমে
শুয়ে ছিলো চারদিন, তারপর রুস্তমের চির হাহাকার
আমার ভেতর বাজে দিনে-রাতে ঘুমে আর নিত্য জাগরণে।
ছাড়ে না আমাকে তারা, নিজের সত্তার মাঝে মিশে একাকার,
চিরকাল রয়ে যাবে অখণ্ড অম্লানভাবে নিখুঁত স্মরণে।
কারো জানি আসে নাকো অমন নিয়তি আর কোন কালে কভু
নিঠুর বেদনা সয়ে বিক্ষত হৃদয় নিয়ে যেতে হবে তবু।

আসে না সেদিন আর

বিগত বেলার কথা মনে পড়ে ভাঁজে ভাঁজে কেন অবিরাম!
সেসব দুরন্ত আজ তোলে নাকো কোন রব,কাঁচাপাকা চুলে
হয়তো বা এবেলার ম্লান রোদে চুপচাপ,অরামবিহীন
গৃহের নির্দয় চাপে কোন এক অভাজন সবকিছু ভুলে।

কত দিন সিনেমার রঙিন পোস্টার দেখে মঈনের সাথে
কেটে গেলো অগণন সোনালি আভার কাল স্বভাবের তালে।
বৃষ্টির প্রাচুর্য ধারা পুরনো টিনের চালে দিনে আর রাতে,
কাক তার ডানা ঝাড়ে সবুজ পাতার ফাঁকে জলে ভেজা কালে।

চৈতন্য গলির পথে হাঁকডাক আর ভোর সারাবেলা ঘিরে,
তরুণ মজুর যারা রংবাজ ছবি দেখে জমে অনুরাগ
শ্রীমতির মুখে খোঁজে কবরীর মিঠা হাসি। স্বপ্নময় তীরে
তার সাথে কথা বলে চোখে মুখে রাজ্জাকের অনন্য আবেগ।
ঘুম যবে যায় ভেঙে ধীরে চলে আড়তের দিকে
অমন সময় আর আসে নাকো কূলে কূলে আজ সব ফিকে।

গফুর আমিনা

এখানে শোনে না কেউ ব্যাকুল আকুতি কভু, রয়ে যায় ভাঁজে
ভাঁজে সব অগোচরে, বেদনার শত ধারা বাজে কত সুর।
চিরান্ধ দেখে না চোখে, কত সাধ শুষ্ক প্রায় প্রকাশে মাঝে
রোদে দগ্ধ কালো পথে তিলে তিলে পাতা ঝরে, সব আশা দূরে।

কত কাল পাশাপাশি কেউ কারো নয় জানি ভূগোলের বুকে
সরে যায় জনে জনে নিজেদের প্রয়োজনে বেলায় বেলায়।
জানে না শরৎ বাবু, কেঁদে কেঁদে রাজলক্ষ্মী রং মাখে মুখে
দাঁড়ায় পথের মোড ক্লান্ত বিকেলের পরে আঁধার-খেয়ায়।

মর্চে পড়া তরবারি, তাজ নেই পুতি আর ধুলোর চাদরে
ম্লান পোশাকে জরি। তবু কেন মোড়ে মোড়ে সবুজ নিশান
তলে এত হাহাকার। হাটে-মাঠে-ঘাটে আর নগরে-বন্দরে
মুখোশে আবৃত মুখ পায় না ত্রাণের চাল অলি-গলি ঘুরে
গফুর-আমিনা আর, বসে থাকে ফুটপাতে বস্তি বহু দূরে।

নগর

প্রাণহীন নগরের পিচ ঢালা দীর্ঘ পথে ডানে আর বামে
দেখি আজ সারি সারি কলের রঙিন যান যায় ধোঁয়া ছেড়ে…
সামনে-পেছনে সব ইটের দালান আর ছোট ছোট থামে
লাল-সাদা বাতিগুলো নেভে-জ্বলে অবিরাম সারা পথ ধরে।

অলি-গলি ঘুরে ঘুরে কটি শিশু হাত পাতে জনতার ভিড়ে
চায় না কখনো ফিরে ধাঁধার চক্করে পড়ে কেউ কারো পানে।
রঙ ভরা এইখানে ছোটদের অন্ন কেড়ে নিখুঁত গম্ভীরে
অম্লান চাতুর্য ঘিরে কথা বলে আর দামি সিগারেট টানে।

সুকঠিন ফুটপাতে কত ফুল দিনে-রাতে অবেলায় ঝরে
উজালা প্রাসাদ ঘিরে অধিক সঞ্চয়ী সব উদ্ধত দানব,
দারুন রসিকতায় করে সদা পদাঘাত অনেকের ঘরে।
অসভ্যের ঘ্রাণ মেখে দূরে থাকে চুপচাপ কালের মানব।
ঢোকে না শীতল বায়ু,এইখানে সব অন্ধ গলির নরক
চিরকাল বহমান চেতনার কোষে কোষে অমন মড়ক।

অম্লান শৈশব

ছায়া ঘেরা পথে পথে সুরের নতুন ধারা কে- যেন ছড়ালো
হয়তো গোপনে আজ। রিনিঝিনি রিনঝিন সোনার কাঁকন
বাজে তার দুটি হাতে, দূরের সকল ক্লান্তি এখানে ফুরালো।
কে-আজ আমাকে ডাকে সকাল-দুপুর-সাঁঝে,যখন-তখন
নিখিল ব্যাকুল করে প্রিয় সেই নাম ধরে কত দিন পরে,
আম-কাঁঠালের বনে ঘুরে ঘুরে কথা বলে,হাসে অনিবার
কারো বউ হবে নাকি,অথবা বেজোড় রবে চিরকাল ধরে?
পুকুরে সাঁতার কেটে, ঝিলের শালুক তুলে বেলা যাবে তার?

জানে না কখন কবে কেটে যাবে সব ফাঁড়া মুছে যাবে ব্যথা,
ডালে ডালে উড়ে আর বসে পাখি,ধীরে নড়ে পাতা আর ফুল
দিন যায় রাত আসে ঘুমের বাগানে দোলে লিকলিকে লতা।
টানা টানা দুটি চোখে কাজলের গাঢ় রেখা কানে প্রিয় দুল,
শাড়ি পরে হাঁটে ঘরে চপল এ-মন তার কার জানালায়
মেঘগুলো উড়ে যায় শাদা-কালো ডানা মেলে দূর অজানায়।

মালেকা বানুর হিয়া

বাতাসের সাথে নাচে মাঠে মাঠে ধানপরী নিজস্ব মুদ্রায়,
টুপটাপ পাতা ঝরে মালেকা বানুর দেশে মাত্রায়,অক্ষরে
আর স্বরে।নম্র রোদে নিকুঞ্জের ছায়াতলে বিনীত শ্রদ্ধায়
শান্ত হলো ধীরে ধীরে রেখার ব্যাকুল শিরা।নদীর কিনারে
মনোযোগী মাছরাঙা,শাদা বক ডানা মেলে ঠোঁটে তার খড়।
বিজন দুপুর মগ্ন চেনা বাউলের সুরে।পাড়ে পাড়ে ভিড়ে
পাল তোলা শত তরী। লাল পেড়ে শাড়ি পরে সখি বাঁধে ঘর,
দৃঢ় রবে দু’জনের অম্লান আবেগ ধারা প্রীতি দিয়ে ঘিরে।

কড়া নাড়ে জোরে জোরে অপরের গৃহদ্বারে ধূর্ত মনু মিয়া
তার সাথে শির সোজা,একরোখা শত শত লাঠিয়াল খাড়া।
ঘোরার তৈলাক্ত লাঠি,কাঁপে নাতো মালেকার দৃঢ়চেতা হিয়া!
সাহসে দুয়ার খোলে মুখোমুখি বলে তারে’ফিরে যাও খোঁড়া,
কত রাজা ফিরে গেলো কালে কালে ভাঙা হাতে,তোমার অধীন
কেউ নয় জানে পাড়া, ভাদ্রের কুকুর আজ অক্ষরবিহীন।

বিলুপ্ত উচ্ছ্বাস

যেখানে নদীর জলে পাল তোলে শত শত তরী,
যে দেশে প্লাবন শেষে নতুনের বিবিধ সম্ভার
দেখে নড়ে নাকো চোখ। সবুজপাঠের শাদা পরী,
দূর থেকে মনে হয় সাহসের অসীম দূর্বার।

কুঁচের বরণ কনে দৃঢ় স্বপ্নে পাখা মেলে ধীরে
অম্লান ছায়ার তলে,মৃদু-মন্দ কত কিছু দোলে।
দূর থেকে আরো দূরে তাল-শাল-বটবৃক্ষ ঘিরে
কমল দিঘির পাড়ে চুপে চুপে কথা শুধু বলে।

অপার প্রকৃতি লুপ্ত,মাঠে মাঠে পাষাণের ভাষা,
চেঙ্গিসের অশ্বধ্বনি আম-জাম-কাঁঠালের বনে
চিরকাল থাকে ঘিরে,ঘাটে ঘাটে খেলে তারা পাশা,
থাকে না এখানে আর কাক-চিল আঁধারের সনে।
সতর্কে সেখানে যাবে,বৈশাখের বিলুপ্ত উচ্ছ্বাস
অদৃশ্য ফণার তরে,শাখে শাখে বিষাক্ত নি:শ্বাস।

জনশূন্য ছায়াতল

মরে গেল কত রোদ,বুড়ো পৃথিবীর
পাড় থেকে আরো যাবে।অবেলায় আজ
কারো কারো কথামালা চিরতরে শেষ!
অশনি কালের স্মৃতি আগামীর তরে
বলে গেলো বারবার নিখিল- মনীষী।

তারুণ্যের তাপে তপ্ত এক ইকারুস
বারণ মানেনি আজ।মোমের নির্মিত
ডানা ধীরে ধীরে মেলে জীবাণু-আকাশে।
অত:পর ক্ষীপ্রতায় আপন স্বভাবে
সীমানা পেরিয়ে যায় দুর্বার চৈতন্যে।

নামে না প্রদীপ্ত যুবা।ডাকে ডেডেলাস
মাঠ থেকে অনিবার, শোনে নাকো আর
অবোধ সন্তান তার।অসভ্য বাতাসে
ছায়াহীন সর্বনাশ শ্বাস-প্রশ্বাসের
পথ ধরে চলে যায় ভেতর মহলে।

হাঁচি ও কাঁশির শব্দ ধীমান পিতার
কানে বাজে ক্ষণে ক্ষণে,বিব্রত উজির,
নাজির,হাকিম আর হেকিম সাহেব।
অচল শ্বাসের ক্রিয়া, বিপত্র বৃক্ষের
জনশূন্য ছায়াতলে শেষ আয়োজন।

শাহিদ হাসান:কবি,কথাশিল্পী ও প্রাবন্ধিক।পেশা: সাংবাদিকতা।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন