গুচ্ছ কবিতা

মাঈন উদ্দিন জাহেদ

ইতিহাস স্কেচ

একাত্তরের সূর্যোদয়ের পর
চুয়াত্তরের মন্বন্তর আসে;
হাহাকার আর হাহাকার করে,
আজও ইতিহাস করুণভাবে হাসে,
সময় ফুঁড়ে রক্তে পঁচাত্তর ভাসে।

বেড়ে উঠতেই জলপাই রঙ দু:খ,
অন্ধকার… লেফটরাইট…
লেফটরাইট…
লেফটরাইট…
দিনে নেমে আসে বুট-জুতা-গান গেয়ে
পিঠে তকতকে ক্ষত সময় চিহ্ন নিয়ে
গণতন্ত্র মুক্তি পাক…
মুক্তি পাক…
নূর হোসেন…
নূর হোসেন…
স্বৈরচার নিপাত যাক
জেহাদ…
জেহাদ…
হেঁটে যায়, হেঁটে যায় অজস্র শহীদ মহাকালে…।

অবোধ দ্রোহের ঝাণ্ডা উড়ালো যারা
সময় গায় তাদের স্মরণসংগীত,
হাতে হাত রেখে জীবনের কথা বলে,
জয় হোক আজকের এই ভাদ্রগীত।

পুঁই পুঁই করে জমিয়ে রাখা বোধ,
মুক্তি পাবে তাবৎ গ্লানির শোক
মহাকালের শিরস্ত্রাণে জ্বলবে হিরক রেখা;
সব চুলোয় যাক,
মন ভালো থাক মধ্যবিত্ত স্বাপ্নিক বিপ্লবে।

গার্হস্থ্য বাতাস বয় ।
এখনও ফর্শাকাশে চাঁদোয়ায় জাজিম বিছানো
দুধেল পাত্রভেবে শিশুর মত হাত বাড়ানো।
বিমূর্ত আকাশে এলোমেলো করে ছুঁয়ে যায়
আতীব্র সংসার…দু:খের ছবি আঁকা,
আহা! শহীদ এতো শোক তোমাকে কিভাবে ঢাকা ?

কেমন আছো বন্ধু, জীবনের ওপারে?
কেমন আছে এই মাতৃকুল- লৌহশিকে রাখা;
ক’ইঞ্চি পুরু হয়েছে এ চর্মকুল-
সবিই আজ মেদভুড়ি মাংসের চাদরে ঢাকা।

জনগণতন্ত্র- শিশু-কৈশোর কি পেরোলো?
কবে যে তারুণ্য কিংবা পৌরুষ ছোঁয়াবে?
ওসব জানবে না কেউ, কোনো কালে;
ইতিহাস স্কেচ আঁকা শুধু যাপন ইজেলে।

স্মারক

বয়সের চিহ্ন ফোটে ওঠে দাড়ি ও গোঁফে
আর কত লুকাবে ব্লেডের প্রকোপে?
দৃষ্টিও কমে যায়, চর জাগে মাথার উপর-
স্মৃতিতে হাতড়ানো কিশোলয় কৈশোর।

দূরন্ত বেলার ঘাম, নামে যাপনে তোমার;
বেলা শেষ, এ কোন খেলা প্রৌঢ় বেলার?
এলোচুল হাতড়ানো যেনো মেঘের নূপুর,
টিএসসি, অপরাজেয় বাংলা, ঘাসের দুপুর।

স্নানে ঘ্রাণে প্রাণে থাকে মুগ্ধতার সৌরভে;
স্মৃতিরা ফিরে তারুণ্যের যু্গল ভেলাতে।
এসব রোমন্থন সময়ের তাড়া খেয়ে যাওয়া;
সব মেঘ ঝড়ে যায়, বয়সী আগুণ সওয়া।

নিরবধি

বন্ধুরা সব তোমাকে নিয়ে মুগ্ধ ছিলো,
মুগ্ধ ছিলো কাব্যকথার বাচিক সভায় অমন তোমার স্বরশীলনে,
মুগ্ধ ছিলো রবির গানে, তোমার প্রাণে
উছল গীতি ক্বণন সুরে।
বন্ধুদের সব বন্ধুতা ছিলো, এমনতো নয়;
কারো চোখে ক্ষুধা ছিলো- জ্বলজ্বলে চোখ জ্বিহবা অধিক।
কারো দেহে কুইকুই ভাব- ঢলাঢলির আভাস ছিলো।
পদ্যকথার সুক্ষ্ম সুতোয় কেউতো তখন প্রীত ছিলো।
হঠাৎ তখন কে যেনো তোমায় মুগ্ধ করে?
হঠাৎ তুমি অমন করে সব কিছুতে গুটিয়ে নিলে!
হঠাৎ তুমি ম্যাুরাল ছায়ায় কাকে দেখে-
পদ্যপ্রেমে কার মায়াতে জড়িয়ে রেখে-
আড়াল দিলে?
তোমার না হয় সিঁদুর মেঘের ভীতি আছে;
কষ্ট তবু দুমড়ে দেয়া পষ্ট করা দীপ্তি আছে;
কিন্তু যে ছায়াটা তোমার চোখে আলো আলোয় জ্বলতে ছিলো;
যে মায়াটা তোমার গুনে গুনগুনিয়ে একটি স্বপ্ন দেখতে ছিলো;
সে ছায়াটার কোন হেয়ালি খেলায় তুমি আড়াল নিলে?
সে মায়াটা হয়তো এখন আপন প্রেমে নার্সিসাস-আত্মভোলা।
সে ছায়াটা হয়তো তাতেই থেমে থেমে সরিয়ে ফেলে ক্ষরণ জ্বালা।
এরপরও চারপাশটা সুনসান ঠিক আগের মতোই,
গৌরীনদী নিরবধি বইতে থাকে
আপন দোলায় সইতে থাকে
কালস্রোতে হাওয়ায় মিলায় হৃদয় দোলা।

সার্চইঞ্জিন

শাপলার বৈজ্ঞানিক নাম খুঁজতে খুঁজতে
ছোট কন্যা সকাল থেকে নাকাল;
মোবাইলে এ সার্চইঞ্জিন ওপেন হয়তো, ওটা হয় না।
শেষমেষ ফলাফল যা দাঁড়ায়, নেটেই ডাটা শেষ।
ইন্টারনেট ঘাটতে ঘাটতে বাচ্চারা এখন
সব উদ্ধার করে ফেলছে।
এই সেদিন তারা, রাস্তা বন্ধ করে-
রাস্ট্র মেরামতের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছিলো।
আর আমি স্মৃতি হাতড়াতে হাতড়াতে
তোমার আশল নামটাই ভুলে গেলাম, শাপলা!
অথচ তোমার আমার নামে কত রটনা।
তার কিয়দংশ সত্য হলে
তোমাকে হারিয়ে যেতে হতো না বাংলা কবিতা থেকে।া
তোমার ঐ টানা চোখ জোড়া নিয়ে এতোদিনে হয়ে যেতো!
কতো পংক্তি, কতো গান, কতো কথকতা।
তোমার টোল পড়া কপোল জুড়ে কতো বিমূর্ত উষ্ণতা ছুঁয়ে যেতো তারুণ্যের ভরা ভাদরে।
কিন্তু ভেঙ্গে যাওয়া বন্ধনের ক্ষতে দাগ লাগুক চাইনি বলে,
ওসব কথকতা-ইশারার ব্যাখ্যা চাইনি কারো কাছে।
কোনো এক মানবিক বোধ,
স্বজাতি পুরুষের প্রতি আছে বলে,
তোমাকে বলিনি,
শাপলা! তোমাকে ভালোবাসি।
শুধু কোনো এক জমপেশ আড্ডায় কৌতুক ছলে বলেছি,
শাপলা, মিশরীয় সভ্যতার প্রেমের প্রতীক ছিলো;
প্রেমিক পুরুষ তার দয়িতা কে নিবেদন করতো
প্রিয় ফুল শাপলা দিয়ে;
আর তাতেই রটিয়ে দিলো তোমার আমার মাঝে মিশরীয় পুরাণ রসায়ন।

আশলেই বাঙালি এক প্রেমিক জাতি-
এক সাগর রক্তের বিনিময়ে
তারা পুরো জাতিকেই এনে দিলো একটি প্রিয় ফুল-
‘শাপলা’ সেই থেকে আমার তালুতে মুদ্রার পিঠে জ্বলজ্বল করে আছে।
অমর পুরাণ হয়ে আছে বাণিক বাঙালি হৃদয়ে।
যদিও অনেক বাঙালি এখনো একবারও শাপলা খায়নি।
তবুও আমার প্রিয় আহার ছিলো, শাপলা ইলিশের ঝোল,
কিংবা কড়া রসুনের ভাঁজা শাপলা-ব্যঞ্জন।
আহা! কতকাল মায়ের হাতের এ অমৃত মুখে তুলি নি।

বাঙালির নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস মিশরীয়দের সাথে
কোন এক স্তরে মিলেছিলো বুঝি?
এ এক নান্দনিক অহং, শাপলা! তোমায় মুগ্ধ হওয়া!
তোমার ডাকনাম শাপলা ছিলো;
মুল নামটাই এতোকাল ভুলেই গেছি,
কেটে গেছে সুবর্ণ বছর;
ভুলেই গেছি তোমাদের পদ পদবী পরিবার।
নিন্দুকেরাও হারিয়ে গেছে কালের করাতে,
নাম-ধাম-রূপ-রস সবকিছু মুছে গেছে লৌকিক স্রোতে।
অথচ হঠাৎ সার্চইঞ্জিন থেকে বের হয়ে আসছে সব,
তোমার বৈজ্ঞানিক নাম, ইতিহাস, মায়া, স্মৃতি এবং রটনা পুরাণ।
প্রজন্মের নির্মম বোধের চাদরে
এক এক করে পষ্ট হয়ে উঠছে তোমার আশল নামও,
রাষ্ট্রের নাড়িভুঁড়ি, সমস্ত গোপন সম্পর্ক, টাকশালের বেহিসাবি হিসাব।
তারা হয়তো আবার রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে ঝুলিয়ে দেবে আরেকটি সাইনবোর্ড-
‘রাষ্ট্র মারা গেছে, কোনো এক বিষুদবারে তার জানাজা হবে, কোনো এক করোনা কালে।

বোধ-কাম-প্রেম নামধাম কীর্তি ঘোলা জলে ভাসে;
আমরা এখন অযোগ্য পুরনো বাতুল মাল, রাবিশ!
শুধু দাঁড়িয়ে আছি রাজদণ্ড লোভে খাটাশ-খবিশ।

চন্দ্রমল্লিকার সাথে দেখা

অদ্ভুত মায়াবী চোখ, চোখের পেছনে মায়া
কে তুমি হৃদয় আড়াল করে চিত্তে ফেলো ছায়া?
মেলার কোনো এক ফাঁকে,
ছবির আলোছায়া বাঁকে,
কে যেনো বলে যায় রাজহংসী গ্রীবায়- হাই!

তোমাকে লাগছে খুউব- শাদাকালোবেশ-হরিণী!
আমাদের পৌরুষহাটে চিত্তচাঞ্চল্য ছোটে,
উপমা-উৎপ্রেক্ষা ফোটে কবিতা পাড়ায়।
কে এলো? কে এলো?
অমন সুকেশী, আলতা রঙের সম্পূর্ণিমায়?
একরাশ অন্ধকার পেছনে ঠেলে, হেলে,
হেঁটে যায়, হেঁটে যায়, হেঁটে পৌরুষ ছায়ায়;
হরিণী ত্রস্তত বোধ,
ছোটো শান্ত-ধীর লয়ে ইটের চাতালে,
জেগে থেকে ষষ্ঠইন্দ্রিয় পাড়ায় পাড়ায়।

নিয়ত যায় বেলা,
মধুছায়া করে খেলা,
দাগ কাটে নাগরিক শিলান্যাসে।
কে তুমি অমন করে,
আউলা করো বাউল বাতাসেরে,
নিয়ত জাগো চন্দ্রমল্লিকা!
নি:ঘুম- দ্বন্দ্ব কায়ামায়া,
বাজিয়ে ভোরের রাগিণী,
যেনো অপেক্ষার যোগীন-যোগিনী।

এমনো যায় বেলা
নিয়ত সুর-অসুর খেলা,
রোদপুরে জেগে ওঠে যাপনের সর্পিনী।
সান্ধ্যো আকাশে বাজে বিরহী সানাই;
সানাইয়ের সুর-
বেদনা বিদুর;
ছড়িয়ে থাকে শুধু অনাঘ্রাত ঘ্রাণ,
পড়ে থাকে পাতা-কাণ্ড-ডাল চন্দ্রমল্লিকা;
আহা! বড় অসময়ে হলো দেখা!

মাঈন উদ্দিন জাহেদ: নব্বই দশকের কবিতাকর্মী, প্রাবন্ধিক ও বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন