গুচ্ছ কবিতা।। ফুয়াদ হাসান

লেডি ম্যাকবেথের হাত

“All the perfumes of Arabia will not sweeten this little hand”– Lady Macbeth (Macbeth–William Shakespeare)  
বারবার হাত ধুয়ে নিচ্ছি 
তোমার মতো  
হাত ধৌত করছি বারবার

সাবান
লিকুইড সোপ
ওয়াশিং পাওডার
পারলে হারপিক দিয়েও…
প্রতিক্ষণ হ্যান্ড সেনিটাইজার মেখে  
হাত ঘষে ঘষে 
ম্লান করে ফেলছি আয়ুরেখা
ঘরে-বাইরে 
বাজারে-মাজারে
মসজিদ-গির্জায়
ধুমআড্ডা-চা-খানা-শপিং মল
জনসভা-থিয়েটার-হলঘর 
ঘিঞ্জি শহর ছেড়ে দূরতম কোন গ্রাম
টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া 
এশিয়া হতে আফ্রিকা 
ইউরোপ বা আমেরিকা
পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে শেষবিন্দু
রাস্তায় নামা সর্বহারা 
ছাপোষা মধ্যবিত্ত
সুবিধাবাদী ধনী
কেউ বাকি নেই
সকলে হাত ধুয়ে নিচ্ছে বারবার
মুছে ফেলতে চাইছে 
লোহিতকণার মতো অদৃশ্য বীজাণুর দাগ
আমি, তুমি ও সে
আমরা সকলে 
যাচ্ছে না তা কোন ভাবে
এ কেমন পাপ 
পৃথিবীর সকল মানুষ কী তবে
তোমার চেয়েও অপরাধী!

সংখ্যাতত্ত্ব

রোল কত 
মাইনে কত পাও
কোন শতকের
অসংখ্য সংখ্যার সংমিশ্রণে সমষ্টিবদ্ধ জীব

সুবর্ণরেখা

আবারও উঠে গেলাম রাস্তায়
এখানেই শুরু হয়েছিল একদিন
যেখান থেকে যাত্রা হয়েছিল
যেখানে হারিয়ে ফেলেছিলাম পথ
আমরাতো রাস্তার লোক
রাস্তাবাড়ি সে কখনও
ফিরিয়ে দেয় না

হরবোলা

কে হে হরবোলা
বলে হরি বল
প্রিয় মনভোলা
বলে বাড়ি চল
বাড়ি কই, আছে–
ঘর, হারাধণ
চল যাই উড়ে
দূরে হিরামন
মনও ভোতা, দেবে
নাকি কোকাকোলা
সকলের মাঝে
বহু হরবোলা

সর্বহারা

তোর মায়ের সাথে আদতে
কে শুয়েছিল
হোচিমিন না চেগুয়েভারা
সব থেকেও শ্রেণিবিহীন
দাবি করিস সর্বহারা

মানুষ মাত্রই মেরুদণ্ডহীন

মানুষ মাত্রই মেরুদণ্ডহীন
শির উঁচু ভাবে অর্থহীন
আছে তবে একখানা শিরদাঁড়া
মাঝেমধ্যে সেও হয় খাঁড়া
বেশিরভাগ সময় সে বাঁকা
ভেতরটা মগজহীন ফাঁকা
অথবা যা একদমই ভঙ্গুর
যাবে আর তা দিয়ে কদ্দূর
সোজা থাকার আপ্রাণ চেষ্টা
করে — বাঁচাতে পারে না শেষটা
ধুলায় গড়ানো সরীসৃপ
মনেকরে কী সজীব জীব
আদতে সে এককোষী এমিবা
আর কার আছে এ প্রতিভা
মানুষ মাত্রই মেরুদণ্ডহীন
ঘাড় গুঁজে কাটে প্রতিদিন

উৎসব

মৃত্যু তাহলে কী একটা উৎসবেরই নাম!
শহিদ মিনারে লোক জমায়েত জমে
বিউগল বাজে — একশত একটি তোপধ্বনি,
ফুল কিনে আনে সাদা, হলুদ, খয়েরি
জানাজায় শেষবার দেখা হয় আমাদের

উইথোকা

মাটির ওপর ফুটে রয়েছে উইথোকা
খানিক সজাগ করলে গন্ধগ্রন্থি, ঢিবি
থেকে হালকা ঘ্রাণ পাবে — একপশলা বৃষ্টির
পর ভূতল সিথানে খুঁজে দেখো সেই
পুরানো পরিখা, কেউ পুরা মোহরভর্তি
ঘড়ার আশায় দূরে যেতে গিয়ে আর
কখনও ফিরবে না। কাটা শেষে বিন্নাঘাস
দিয়ে পাহাড় কতটা ধরে রাখবে তবু
গোপনে অট্টালিকার কোণায় বিচিত্র
নগরপোকা তৈরি করবে বল্মীক মন্দির

দায়িত্ব ও কর্তব্য

ককপিট থেকে এইমাত্র এয়ারহোস্ট্রেসের মতো বেশ সুরেলা গলায় কোপাইলট জানিয়ে দিলেন, বিমানের একটি ইঞ্জিন বিকল, জ্বালানি শেষ, যেকোনো মুহূর্তে আগুন লাগতে পারে, জরুরি অবতরণের আগেই তিনহাজার ফুট থেকে সে নামছে বিদ্ধস্ত হবে বলে, বিশেষ দরজা দিয়ে এখন তুমি কি মুক্তবেগে লাফ দিবে।
দুচোখ বন্দি কুয়াশায়, পাশ দিয়ে এক ডাইনোসর আকৃতির কার্গোজাহাজ যেতে আচমকা একদল ঢেউ এসে উল্টে দিল নৌজানটিকে, এখন তুমি সাঁতার ভুলে গিয়ে থাকলেও ঝাপ দিবে বরফজলে মাঝসাগরে।
অটোরিকশা রেললাইনের উপর উঠতেই হঠাৎ চলা বন্ধ হয়ে গেল, কুঝিকঝিক করে অজগরের মতো সাইরেন দিয়ে এগিয়ে আসছে ট্রেন, কোনদিক না তাকিয়ে তবে কি তুমি বাংলা ছবির নায়কের মত ঝাপিয়ে পড়বে রাজপথে।
স্বপ্নটা না ভাঙলেই সবকিছু শেষ হয়ে যেত।

কুকুরছানা, শুয়োরছানা

অফিস যাওয়ার পথে কুকুরের বাচ্চাকে দেখে নিজের সন্তানকে মনেপড়ে যায়।
রাস্তায় হাঁটতে-হাঁটতে ময়লা নর্দমায় শুয়োরের
বাচ্চাদের খেলতে দেখে
নিজের সন্তানদের মনেপড়ে যায়
শব্দগুলোর কত অপচয় না করেছি।

সাতসকালে পথে নামতেই
শুনতে পেলাম একটি শব্দ — কুত্তার বাচ্চা!
প্রথমবার পাত্তা দেইনি
আবারও শুনলাম, স্পষ্ট — কয়েকবার
জানতে চাইলাম — এসব কোথায় শিখলে?
নিশ্চই খারাপ ছেলেদের সাথে মিশছ আজকাল!
আচ্ছা করে কান মলে দিলাম সঙ্গে চরথাপ্পরও পড়াশোনা করে গরুছাগল হচ্ছো, চল বাড়ি চল,
আর স্কুলে যেতে হবে না
একটি কুকুরছানাও আমাদের পায়ে-পায়ে বাড়ি ফিরে আসে।

ইস্পাতের সেক্সোফোন

ইস্পাতের সেক্সোফোন
ঝুলে রয়েছে দেয়ালে
মরীচিকার মরীচি
আজ বেঁধেছে সংসার
যন্ত্রটির কানে ঢুকে মশা
তৈরি করতে চাইছে কোন সুর

অমানিশাকাল

প্রাচীনকালে মানুষ অনেক আদিম ছিল
মধ্যযুগে মধ্যোযুগীয়
আধুনিককালে এসে হয়েছে যান্ত্রিক

ফুয়াদ হাসান: দ্বিতীয় দশকের কবি। পেশা : শিক্ষকতা। সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, পতেঙ্গা সিটি কর্পোরেশন মহিলা ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম। প্রকাশিত গ্রন্থ : তিনটি।মানুষ মানুষ নয় হোমোসেপিয়ানস (২০০৪), রাফখাতার কাটাকুটি (২০১০),অ্যা জার্নি বাই অ্যাম্বুলেন্স (২০১৮)। 

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন