সময়েই সময়ের গান গাহি ।। ফজলুর রহমান

সময় নিয়ে কয়েকভাবে গান গাওয়া যায়।
এক. ‘সময় যেন কাটে না।’
দুই. ‘সময় গেলে সাধন হবে না।’
তিন. ‘ সবাই বলে বয়স বাড়ে, আমি বলি কমেরে..।’ চার. ‘এই দিন দিন নয়, আরো দিন আছে।’
পাঁচ. ‘যদি আরেকটু সময় পেতাম…।’

যে কেউ ইচ্ছে মতো গলা ছাড়তে পারে। তবে সময় নামের মহাসম্পদের মালিকরা যেভাবেই গানটি ধরে সেভাবেই জীবন রচনা হয় কালে কালে।

পিথাগোরাসকে প্রশ্ন করা হয়েছিল- সময় কি? তিনি জবাব দিয়েছিলেন, ‘সময় হল এ পৃথিবীর প্রাণ।’ আসলেই এরচেয়ে দামী আর কিইবা হতে পারে! এটিই তো প্রাণশক্তি।

এখন এই মহামূল্যবান সম্পদের মালিকানা কার কতটুকু? আসলে এখানে অনেকটা সাম্যবাদ দেখি আমরা। এটিই হয়তো একমাত্র বড় ধন যেটি সকলের জন্য সমান। সমভাবে বন্টিত। সবচেয়ে ক্ষমতাধর কিংবা বিপুল বিত্তশালীর জন্য যেমন ২৪ ঘন্টা, তেমনি অসহায় বা হতদরিদ্রের জন্যাও ১ সেকেন্ড কম নয়। এক কথায় বলা যায়, জগতের সকলের সামনে ‘সময় সমান হয়ে উপস্থিত।’ 

কেউ এই সময়কে অবহেলা করে বিলাসে। অপচয় করে মুঠোতে পেয়েও। অনাদরে রেখে অনুতাপে দগ্ধ হয় ।

আবার কেউ সময়ের সঠিক ব্যবহার করে জীবন সাজায়। মূল্যায়ন করে সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকে। রুটিন কাজের অতিরিক্ত আত্ননিয়োগ করে সুফসল ফলিয়ে যায়। 

কবি সুইনবার্গ বলেন, ‘Life is a vision of a watch between a sleep and sleep. অর্থাৎ দুই প্রান্তেই ঘুম, ঘুমের মতো অন্ধকার, মাঝে একটু বেঁচে থাকাই হলো জীবন।

বাংলার লোক কবিদের কন্ঠেও গীত হয়, ‘এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা, মাঝখানে চর’ অর্থাৎ এপারে জন্ম ওপারে মৃত্যু, মাঝখানে সীমাবদ্ধ জীবন। জীবনের এই সীমাবদ্ধতার জন্যই সময় আরো বেশি মূল্যবান।

এক ব্যক্তিকে মহানবী(সাঃ) উপদেশ দেওয়ার সময় বলেছিলেন, “তুমি পাঁচটি বিষয়ের পূর্বে পাঁচটি বিষয়কে গুরুত্ব দাও।
১. বার্ধক্য আসার পূর্বে তোমার যৌবনে গুরুত্ব দাও
২. অসুস্থতার পূর্বে তোমার সুস্থতাকে গুরুত্ব দাও
৩. দারিদ্রতা আসার আগে তোমার স্বচ্ছলতাকে গুরুত্ব দাও
৪. তোমার ব্যস্ততার পূর্বে তোমার অবসরতার প্রতি গুরুত্বারোপ করো
৫. এবং তোমার মৃত্যু আসার আগেই তোমার জীবনের গুরুত্ব দাও।” [মুসতাদরিক ৭৮৪৬]।

বিশিষ্ট সূফি সাধক শামস তাবরেজী সময়ের মর্মবাণী উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছিলেন। একদিন তিনি বাজারে গিয়ে শুনতে পেলেন এক বিক্রেতার চিৎকার-
‘হে লোক সকল, আমার মূলধন পানি হয়ে যাচ্ছে।’ সামনে গিয়ে দেখেন, তিনি একজন বরফ ব্যবসায়ী। অর্থাৎ তার বরফ দ্রুত গলে পানি হয়ে যাচ্ছে। এভাবে তার মূলধনও হারিয়ে যাচ্ছে। এখানে গলে যাওয়ার মূলে সময়। সঠিক সময়ে বিক্রি হলে রক্ষা হয়। 

এভাবে বরফ খণ্ডের মতো গলে যায় জীবন। সেই জীবন নামের বরফ খণ্ডের ঠাণ্ডা জলে তৃষ্ণা মিটানোর মতো করে চাইলে কাজে লাগানো যায়। অথবা পথের মাঝে অহেতুক বরফখণ্ড গলিয়ে কাদাময় করে অপচয় করাও যায়। 

ইংরেজী কবি বলেন, ‘Time and tide wait for none’. অর্থাৎ সময় এবং স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। এরপরও মানুষ চায় তার স্বল্প জীবনায়তনের মধ্যে অসংখ্য কর্মের উদযাপন। কিন্তু সময় তা মঞ্জুর করে না। ফলে হিসেবের গরমিল রেখে বিদায়ের ডাক শুনতে হয়। 

এজন্য মহামতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলে গেছেন 
“হায়রে এ হৃদয়, তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে, নিশান্তে শুধু পথ প্রান্তে 
ফেলে যেতে হয়
নাই, নাই নাই যে সময়।”

তাহলে কী করতে হবে? 
কোকো শ্যানেল (বিশ্বখ্যাত ফ্রেঞ্চ ব্র্যান্ড ‘শ্যানেল’ এর প্রতিষ্ঠাতা) এর উক্তিটি মানতে পারি-“দেয়ালের দিকে তাকিয়ে সময় নষ্ট করো না।  সেখানে একা একা দরজা জন্মাবে না।  ওপাশে যেতে চাইলে দরজা বানাতে শুরু করো।”

আইরিশ লেখিকা মারিয়া এজগ্রোথ বলেছেন, ‘আমরা যদি সময়ের যত্ন নিই, তবে সময় আমাদের জীবনের যত্ন নেবে। ‘আমেরিকান দার্শনিক মেসন কোলেই বলেছেন, ‘আগের নষ্ট করা সময়ের জন্য এখন আফসোস করলে, এখনকার সময়ও নষ্ট হবে’।

কেবল গানেই পড়ে থাকে “এই দিন দিন নয় আরো দিন আছে, এই দিনকে নেব আমরা সেই দিনেরও কাছে।” বাস্তবে আসলে সময় কারো জন্য থেমে থাকে না। ২৪ ঘন্টাকে কে কিভাবে ব্যবহার করছেন তার উপর নির্ভর করে সাফল্য এবং ব্যর্থতা দুটোই। জীবন একটাই। 

সবশেষে একটু পড়ি বিশ্ববিখ্যাত রুশ সাহিত্যিক লিও টলস্টয়ের লেখা ‘থ্রি-কোশ্চেন’ শীর্ষক একটি ছোট গল্প। যেখানে সময় ও কর্ম ফুটেছে গল্পের ছলে।

একজন রাজার গল্প। কয়দিন ধরে বিনিদ্র রজনী যাপন করছেন রাজা। তিনটি প্রশ্ন তার মগজে কিলবিল করছে সারাক্ষণ। প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি। দরবারে ডেকেছেন উজির নাজির পাত্র মিত্রসহ সব সভাসদ। সবার কাছে রাখলেন প্রশ্ন তিনটি।

ঘোষণা করলেন- যে ব্যক্তি প্রশ্নগুলোর সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারবে, রাজ্যের অর্ধেক অংশ দান করে দেবেন তাকে। একেকজন একেক রকম উত্তর দিয়ে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করল রাজাকে। 

কোনো উত্তরই মনঃপূত হলো না তার। রাজ্যের পণ্ডিতদেরও ডাকলেন তিনি। তারাও সন্তুষ্ট করতে পারল না রাজাকে। অবশেষে একদিন প্রত্যুষে ছদ্মবেশে দ্বাররক্ষীর চোখ ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে গেলেন রাজপথে।

প্রশ্ন তিনটির উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত ফিরবেন না রাজপ্রাসাদে। দিনভর হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পড়লেন রাজা। দুপুর-বিকাল গড়িয়ে নেমে এলো সন্ধ্যা। দুশ্চিন্তায় তিনি। রাতে থাকার জন্য একটু আশ্রয় দরকার তার। এমন সময় নজরে পড়ল এক অশীতিপর বৃদ্ধ। রাস্তার ধারে একটি কুঁড়েঘরের সামনে বসে আছেন তিনি। বৃদ্ধের কাছে এক রাতের জন্য আশ্রয় প্রার্থনা করলেন রাজা।

সানন্দে সম্মতি দিয়ে বৃদ্ধ বললেন- আমার সংসার বলতে কিছু নেই, আছে শুধু ছোট্ট একটি কুঁড়েঘর। তুমি কি থাকতে পারবে দরিদ্র কুটিরে? রাজা বিনয়ভরা কণ্ঠে বললেন- আপনি যদি দিনের পর দিন থাকতে পারেন তাহলে আমি কেন পারব না একটি রাত থাকতে। রাতের খাবার হিসেবে বৃদ্ধের ঘরে আছে শুধু একটি শুকনা রুটি। অর্ধেক রুটি তুলে দিলেন অতিথির হাতে। তারপর আগন্তুকের আপাদমস্তক অবলোকন করে তিনি বললেন- বাবা, তোমাকে দেখতে মনে হয় রাজপুরুষ। তোমার মতো মানুষ কেন আশ্রয় নিলে আমার পর্ণ কুটিরে! কোত্থেকে এসেছ, কোথায় যাবে, কিইবা তোমার লক্ষ্য?

প্রত্যুত্তরে রাজা বললেন- তিনটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমি ছুটে চলেছি অনিশ্চিত গন্তব্যে। বৃদ্ধ বললেন, প্রশ্ন তিনটি কি শুনতে পারি আমি?

রাজা বললেন,
প্রথম প্রশ্নটি হলো- ‘গুরুত্বপূর্ণ সময় কোনটি?’
বৃদ্ধ হেসে বললেন, প্রশ্নটি কি আরও কাউকে করেছ তুমি?
রাজার উত্তর, হ্যাঁ অনেককেই জিজ্ঞাসা করেছি আমি। তারা কি বললেন তোমাকে?
কেউ বলেছেন সকাল, কেউ বলেছেন বিকাল, কেউ মধ্যরাত, কেউবা ভোররাত।

গম্ভীর কণ্ঠে বৃদ্ধ বললেন- কেউ ঠিক বলেনি তোমার প্রত্যাশিত উত্তর। সঠিক উত্তর হলো- ‘বর্তমান সময়। যে ব্যক্তি বর্তমান সময়ের সদ্ব্যবহার করে তার ভবিষ্যৎ হয় সুন্দর।’ উত্তর শুনে খুশি হলেন রাজা। 

বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করলেন দ্বিতীয় প্রশ্নটি কি?
রাজা সানন্দে বললেন- দ্বিতীয় প্রশ্নটি হলো- ‘গুরুত্বপূর্ণ কাজ কোনটি?’
বৃদ্ধ সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিয়ে বললেন- ‘হাতের কাজটিই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’ যে কাজটি হাতে কিংবা হাতের কাছে আছে সেটা ফেলে রাখবে না, দ্রুত শেষ করে শুরু কর পরবর্তী কাজ। এ উত্তরটিও পছন্দ হলো রাজার। 

এরপর তৃতীয় প্রশ্নটি জানতে চাইলেন বৃদ্ধ।
রাজা বললেন তৃতীয় প্রশ্নটি হলো- ‘পৃথিবীতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি কে’?
সঙ্গে সঙ্গে রাজার দিকে তর্জনী উঁচিয়ে বৃদ্ধ বললেন- ‘তুমি’।
থতমত খেয়ে গেলেন রাজা এবং মনে মনে ভাবলেন, তাহলে কি আমাকে চিনে ফেলেছে বৃদ্ধ! নিজেকে সামলে নিয়ে অতি বিনীতভাবে রাজা বললেন, আপনি কি জানেন আঙ্কেল আমি কে?

প্রত্যুত্তরে বললেন বৃদ্ধ- তুমি কে জানার দরকার নেই আমার। হতে পার রাজা কিংবা প্রজা অথবা হতে পার হতদরিদ্র নিঃস্ব মানুষ কিংবা ধনী ব্যক্তি। যে স্তরের মানুষই তুমি হও না কেন তোমাকে সম্মান, সেবা এবং খুশি করা আমার কর্তব্য। মনে রেখ, যে পর্যায়েরই মানুষ তোমার সঙ্গে থাকবে অথবা তোমার কাছে আসবে তাকে তুমি দিও তার প্রাপ্য মর্যাদা, মেটাতে চেষ্টা কর তার ন্যায্য চাহিদা, সর্বোপরি তাকে খুশি করার চেষ্টা কর তুমি। নয়তো পরিণামে ক্ষতি হতে পারে তোমার। 

ফজলুর রহমান: কবি, কথাকার । সহকারী রেজিস্ট্রার, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন