শামসুর রাহমানের কবিতায় উচ্চারণের ঔজ্জল্য
মিজান বিন মজিদ
শামসুর রাহমান বাংলা কবিতার এক অজর নাম। এই যে একজন কবির প্রতি নান্দনিক পক্ষপাত প্রকাশ করলাম রচনার প্রারম্ভে ; তা প্রমাণের অপেক্ষা রাখে। আমরা সাধারণত যে কারো শংসামত্ত হই আবেগে, অগভীর পঠনপাঠনে। আবার নিন্দামন্দও একই ধারাতে প্রবহমান। বিশেষ করে সাহিত্যের ওজস্বিতা পরিমাপের চেয়ে স্তুতি বা ব্যঙ্গবিন্যাসে আমাদের পারঙ্গমতা বিশ্বসাহিত্যের সম্পদ ও বিপদ! বাংলা কবিতায় নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেবার চেষ্টা করেছেন অযুত কবি। তাদের অনেকেই স্বয়ংক্রিয় অক্ষমতায় তামাদি হয়েছেন, অনেকেই সময়ের তীব্র স্রোতে ভেসে গেছেন। কবিতায়-সাহিত্যে ‘টেকসই’ শব্দটা কতটা যুৎসই হবে জানি না। জানি ও মানি চাইলে ‘কবি’ হওয়া যায় না । কবি তকমা ব্যবহারের অধিকার আমরা অনেকেই রাখি না! শামসুর রাহমান এই নামের সঙ্গে ‘কবি’ ছাড়া অন্য কোন বিশেষণ উপাধি পেশাগত পদবী একদমই বেমানান ।
কবিতার আলোচনায় কবিতার শব্দ ছন্দ অনুপ্রাস তত্ত্ব ইত্যাদি নানাবিধ ব্যঞ্জনা কাজ করে। কবিতার শব্দ যেমন বোমার মতন শক্তিমান তেমনি জ্যোৎস্নার মতন স্নিগ্ধও । কবির জীবনকাল কবিতার বিষয়কে প্রভাবিত করে। তিনি কী সরোবরস্বচ্ছ নিস্তরঙ্গ জীবনে ছিলেন না উত্তাল তরঙ্গ পাড়ি দিয়ে দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছালেন । শামসুর রাহমান ছিলেন বিপ্রতীপ সময়ের বিরল ভাষ্যকার। দেখেছেন দেশভাগের দুঃসহ যাতনা, ভুগেছেন পরাধীনতায় আর সয়েছেন বৈষম্যের খরতাপ । তাই তাঁর কলম ঝলসে ওঠে অবিনশ্বর ভঙ্গিমায় ,
“ তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা,
তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায় ?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন ?”
—তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা ।
কবিতায় শামসুর রাহমান কতটা জড়তাহীন স্পষ্টবাক আমাদের অনেকেরই জানা। তাঁর অবস্থান ও অবদান নিয়েও বিবাদ নেই। কিন্তু গভীর অনুধাবনের অভাব আছে। ‘বাইবেলের কালো অক্ষরগুলো’ কবিতায় যে বৈশ্বিকবোধ তুলে এনেছেন কবি তা একই সঙ্গে চিত্তোদ্দীপক ও তার স্বতন্ত্র স্বরের অনন্য স্মারক। আমার এই কবিতার প্রতি বিশেষ অনুরাগ রয়েছে!
“যদিও আমি তোমাকে দেখিনি জো,
তবু বাইবেলের কালো অক্ষরের মতো তোমার
দু’ফোঁটা চোখ
তোমার বেদনার্ত মুখ বারংবার
ভেসে ওঠে আমার হৃদয়ে,তোমার বেদনা
এশিয়া,আফ্রিকা আর লাতিন আমেরিকায়
ব্যাপ্ত, জো।
পুরো কবিতাটা যারা পাঠ করেননি তাদের বোঝানো কঠিন, কী করে বিশ্বের সবকালের বেদনাকে একটি মাত্র কবিতায় তুলে ধরা সম্ভব । শোষক আর শোষিতের লড়াইয়ে শোষিতের পক্ষে কবির অবস্থান কতটা প্রোজ্জ্বল এই একটি কবিতায় প্রকাশিত। অজানা অচেনা জো-কে কবির মনে হয় একান্ত আপন কেউ ।
কতটা সংবেদী সম্বোধন কবির—
“ জো, যখন তোমার পোয়াতি বউ হায়েনাদের
দৃষ্টি থেকে পালানোর জন্যে দৌড়–তে দৌড়ুতে
মাঝপথে হুমড়ি খেয়ে পড়ে,
জো. যখন তোমার সহোদরকে ওরা
লটকিয়ে দ্যায় ফাঁসিতে,
তখন কাঁচা দুধের ফেনার মতো ভোরের শাদা
আলোয়
বাইবেলের কালো অক্ষরগুলো আর্তনাদ
করতে করতে
হঠাৎ বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।”
আমাদের বিশ্বাস, কবি শামসুর রাহমানের কবিত্বের যে দীপ্তি আর তাঁর উচ্চারণের যে ঔজ্জল্য, উদ্ধৃত দুইটি কবিতার সামান্য অংশে তা প্রতিভাত হয়েছে । বিশেষ করে স্বদেশ স্বাজাত্য ও মানুষের অধিকারের প্রশ্নে তাঁর কবিতার যে স্বকীয় আবেদন, পাঠকের সেটা উদ্ধার করতে সামান্য মনোযোগই যথেষ্ট। আমাদের দাবি কতটা প্রাসঙ্গিক ও নৈয়ায়িক তাঁর কবিতা পাঠ করেই দেখুন না!
মিজান বিন মজিদ : সহকারী অধ্যাপক, বাঙলা, মীর্জাপুর ক্যাডেট কলেজ।