কাট্টনের ডাক

আজাদ বুলবুল

তুলাবান মুড়ার নিরিবিলি ছায়া এখন আনন্দের হাটবাড়ি। হেডম্যান অমিয় খীসার আম লিচুর বাগান জুড়ে কলহাস্য হুমড়ি খায়। বাঁশ বেতির ছোটখাটো ছাউনি গুলো রূপকথার স্বপ্নপুরী হয়ে আলো ছড়ায়। বাগানে পানির ব্যবস্থা আগে থেকেই ছিলো। হেডম্যান বাবু আস্ত একটা সোলার প্যানেল বসিয়েছেন লকডাউনে থাকা লোকেদের সুবিধার কথা ভেবে। সেকারণে চট্টগ্রাম ইপিজেড থেকে আসা শিল্পকর্মীদের গ্রামের বাইরের বসবাসকাল যে নিরানন্দের না হয়ে উল্লাসমূখর কাটবে এতে মোটেও সন্দেহ নেই।

রূপকারী, তুলাবান, বাবুপাড়া, তালুকদার পাড়াসহ অন্যান্য গ্রামে শহর থেকে ফেরা চাকুরেদের থাকতে দেয়া ঠিক হবে না এ সিদ্ধান্ত ময়-মুরুব্বীরা আগেই নিয়ে রেখেছিলো। মহামারীর কারণে গ্রামবন্ধের আইন মানতে বাধ্য সবাই। শহরের অপিস কারখানায় যারা চাকুরি করে তাদের কথা ভেবে খীসা বাবুর ফলবাগানে গাবুজ্জ্যা দেবানরা (চাকমা যুবসমাজ) ম্যালেয়া (সমবেত শ্রম) দিয়ে ইতোমধ্যে বানিয়ে ফেলেছে এগারোটি মাচাংঘর। বাঁশের খুটির উপর বেতির চাটাই, বৃষ্টি বাদলা থেকে রক্ষা পেতে তজ্জার (বাঁশের ফালি) ছাউনি। প্রত্যেক বিছানার উপর নতুন মশারী, পাশে খড়ের বেনা(আগুন ও ধোঁয়ার আধার) আর জলভর্তি কত্তি (মাইট্যা বদনা)। দশ বারো হাত দূরে দূরে বানানো এই নির্জন আবাস চাটগাঁ ফেরত সুখময়দের কাছে দ্রষ্টব্য হয়ে উঠতে সময় নেয়নি। শিল্পাঞ্চলের মেসবাড়ির আট বাই দশফুটের গুমোট কোঠার বিপরীতে মাটি, গাছ, লতা-জংলার মিঠে গন্ধ তাদের মগজে নেশা ধরাবে। বৈশাখের দখিনা হাওয়া প্রশান্তি জাগাবে মনে। আর পোঁক-জোনাকীর মিহি তীক্ষ্ণ চিৎকার শুনতে শুনতে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যাবে তারা; এমনি স্বপ্ন দোলে সুখময়ের চোখে।

বাঘাইছড়ির তরুন ইউএনও অমিয় বাবুর উদ্যোগে আপ্লুত। করিৎকর্মা ইউএনও মাঝবয়সী ওসিকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে চারপাশটা দেখে আর বিষ্ময়ে তোতলায় । “কী ভাবে করলেন এসব! এভাবে যে করতে হয়; কী করে তা বুঝলেন!”
নিরুত্তর হেডম্যানের চোখে চোখ রেখে জানতে চায়-
“আমরাতো নির্দেশনা দেইনি, তাহলে কার প্রেরণায় এতো নিরাপদ একটা জায়গা রেডি হলো!”

চাকমা সামাজিক আইনে সেই আদ্যিকাল থেকেই মহামারীকালে গ্রামবন্ধের যে রীতি প্রতিষ্ঠিত তা উপজেলা নির্বাহী অফিসার জানবে কোত্থ্যেকে? অমিয় খীসা মিটিমিটি হেসে বলে,
“বাপ দাদার কাল থেকে এসব মেনে চলেছি বলেইতো এখনো বিলুপ্ত হইনি স্যার”।

ছোটবেলায় বাপ চাচাদের সাথে রিজার্ভে বাঁশ বেত যোগাড়ের কাট্টনে যেতো অমিয়। তখন একটা বর্গি (কোমরতাঁতে বোনা মোটা কাপড়) চাপিয়ে রাত কাটিয়ে দিতো ছড়ার বালুতীরে। নির্জন পাহাড়ে রাত কাটানোর সেই সুখানুভূতি কী ভোলা যায়! একালের চাকমাদের কাছে কাট্টনের আনন্দ তো রূপকথার গল্প। করোনার কারণে আইসোলেশানে থাকা চাকমা ছেলেরা যেন এই সুযোগে কাট্টনের ডাক শুনতে পায়, জংগলে থাকার সুখ পায় সেটাই তার পরম চাওয়া। সেজন্যই তো এই আয়োজন। লোকালয় থেকে দূরে, সংক্রমনের ছোঁয়া থেকে বাইরে, নিভৃতে নিসঙ্গ অবস্থান। মুখে তৃপ্তির হাসি লেপ্টে অমিয় খীসা বলেন,- “দুই সপ্তাহের আগে কেউ বাড়িঘরে ফেরার চেষ্টা করো না। তোমাদের খাওয়া দাওয়ার চিন্তা আদাম্যাদের(গ্রামবাসীর) উপর রইলো।”

কিন্তু নির্জন আবাস আর নিস্তরঙ্গ থাকলো কই? মারিশ্যা, বাঘাইছড়ি, বটতলী থেকে দলবল নিয়ে আড্ডাবাজরা এখন ভীড় জমায় অমিয় খীসার বাগানে। গরম ভাতের সাথে শুটকী মেশানো মরিচ গুদিয়ে (ভর্তা), নাপ্পি দিয়ে বেগুন তরকারি আর আমিলা (টক) ঝোল মেখে সুস্বাদু প্রাতরাশ সেরেই শুরু হয় তাস খেলার উল্লাস। খেলাকে আকর্ষনীয় ও মনযোগী করার লক্ষে যুক্ত করা হয়েছে ছোট অঙ্কের টাকা। ফলে নির্দোষ আনন্দের তাসখেলা বিশুদ্ধ জুয়ায় রূপ নিতে খুব একটা সময় নেয়নি। চিৎকার, চেঁচামেচি, তর্ক, খিস্তি, হাসিঠাট্টায় সরগরম হয়ে ওঠে আইসোলেশানে থাকার নিভৃত কেন্দ্র। বিকেল থেকে শুরু হয় পানপিয়াসীদের নানা আয়োজন। খাজির (মদপানের সাথে খাদ্যঅনুসঙ্গ) আয়োজনে শশা-মারফার সালাদ, শাক-সব্জি সেদ্ধ, মাছ ভাজা, সেক্যা, গুদিয়ে, করবো রান্নায় ব্যস্ত হয়ে ওঠে সবাই। অমিয় খীসা হতাশ চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেন। কিন্তু চাকমা তারুণ্যের উল্লাসিত উচ্ছ্বাসের সামনে তার সুবচন চাপা পড়ে যায়।

করোনার শুরু থেকেই বলাবলি হচ্ছিলো- এলকোহল করোনার মহাশত্রু। সেনিটাইজারের বদলে ক’ফোটা দোচোয়ানী হাতে মেখে নিলেই কোভিট জীবানুর দফারফা। বিঝুকে সামনে রেখে ঘরে ঘরে মদের যোগাড় হয়েছিলো অঢেল। বিঝুতো এবার হলো না। সুখময় যুক্তি দিয়ে বুঝালো,-
“দোচোয়ানীর সদ্বব্যবহার যদি হাতকে করোনামুক্ত করে তবে তাজিমের সাথে পান করলে গলা, পাকস্থলী রোগমুক্ত হতে বাধ্য। সাথে কানা বৈদ্যের নুনপড়া দুআঙুলের চিমটিতে করে জিহ্বায় ফেললে করোনা বাপ বাপ করে পালাবে।”
লবনপড়া কী আজকের মহৌষধ! সেতো বহুযুগ ধরে ধন্বন্তরীর মর্যাদায় আসীন।

তুলাবানের নিভৃত নিবাস এখন আর শান্ত, সমাহিত, স্তব্ধ নিরাময়কেন্দ্র নয়। এটি এখন মদ্য পানের প্রাকৃতিক বার, জুয়া খেলার খোলামেলা ক্লাব, নৃত্য-গীতের আনন্দধাম।
পালের গোদা সুখময় চাকমা পাড়া থেকে সাউন্ডবক্স আনিয়ে উচ্চস্বরে গান বাজানোর আয়োজন করেছে। রাত পোহাতেই পিকনিক আনন্দে মতোয়ারা অমিয় খীসার বাগান। করোনার করাল গ্রাসের কথা ভুলে গিয়ে কচু পাতায় মশলা মাখা ব্যাঙাচি পুড়িয়ে মদ খাওয়ার আয়োজনে ব্যস্থ সুখময়। অমিয় খীসা তাদের আচরণে ত্যাক্ত বিরক্ত। তার বলতে ইচ্ছে হয়- “অমগদ চাউম্মাঅল এধইক্কাই মুরিবো,” (বোকা চাকমারা এভাবেই মরবে) কিন্তু রাগটা মুখে প্রকাশ না করে অনুযোগ জানায়-

সবাইর ভালোর জন্যই এই আয়োজন করেছিলাম। কিন্তু তোমরা বাড়াবাড়ির শেষ করেছো। এমন করলে আমিও কঠিন হতে বাধ্য হবো।
কী গরিবি তুই? হেডম্যানের দিকে আঙুল উঁচিয়ে সুখময় বলে- “আমি মদ খেবং, তাস খেলা খেবং, গান শুনিবং। তোমার অসুবিধা কী? তুমি চুপ গরি থাক।”
“মুই পুলিশ ডাকিম্। পুলিশ তোমারে লাঠির বারি ন দিলে আক্কল ন অব!”
“অয়! অয়! আজু। ডাক পুলিশ। মোগদা বাঙাল পুলিশ মর চেদরবাল চিরিবো।”
“এই চাউম্মাউনর মাতা এক্কিবারে গেইয়্যে। বোধ বুদ্ধি নাশ অইয়্যে। চেদরবাল চিরিবো?”

অমিয় খীসার চোখে মুখে নৈরাশ্যের ছায়া-
কিভাবে গোপনকেশ উৎপাটন করা হবে? মঙ্গোলয়েডদের তো কেশ গজায় না। যেখানে কেশই নাই সেখানে তা ছেঁড়া হবে কী করে!

আজাদ বুলবুল : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন