অন্তর্দৃষ্টি ও মানবতার কবি লুইস গ্লিক ।। মুজিব রাহমান।। পুবাকাশ

১.বাগান

বাগান তোমাকে সমীহ করে।
তোমার খাতিরে সে নিজেই মেখে নিয়েছে সবুজ রঞ্জক,
গোলাপের লাল উন্মত্ততা,
যাতে তুমি তোমার প্রিয়জনকে নিয়ে তার কাছে আসো।

এবং উইলোগাছ
দেখো কীভাবে বানিয়ে নিয়েছে এতো এতো
নিস্তব্ধতার সবুজ তাঁবু। তথাপি
এখনো তোমার একটা কিছু চাই,
তোমার শরীর এতো কমনীয়, এতো চনমনে
এই প্রস্তর প্রাণীদের মাঝে।

স্বীকার করে নাও তাদের মতো হওয়াটা যাচ্ছেতাই,
ক্ষতির বাইরে।
(মূল: লুইস গ্লিক।। অনুবাদ: মুজিব রাহমান)

২.তুষার ফোঁটা

তুমি কি জানো আমি কী ছিলাম, কীভাবে ছিলাম বেঁচে?
হতাশা কী তুমি জানো, অতঃপর
শীতের অর্থও থাকা উচিত তোমার কাছে।

আমি বাঁচার প্রত্যাশা করিনি,
ধরিত্রী চেপে রাখতে চেয়েছিলো আমাকে,
আমি পুনর্বার জেগে ওঠার আশা করিনি
স্যাঁতস্যাঁতে মাটির অনুভবে আমার শরীর
পুনশ্চ সাড়া দিতে সমর্থ হলো
অনেক পরে স্মরণে এলো
ঠিক কীভাবে আবার মাটি ফুঁড়ে বেরুতে হবে
প্রথম বসন্তের ঠাণ্ডা আলোয় –

ভয়ার্ত, হ্যাঁ, কিন্তু আবারও তোমাদের মাঝে
কান্নায় আনন্দের ঝুঁকি নিয়ে –

নূতন বিশ্বের কনকনে বাতাসে।
(মূল: লুইস গ্লিক। অনুবাদ: মুজিব রাহমান)

সত্তর এবং আশির দশকের অ্যামেরিকান কবিদের বিশেষ করে ১৯৭৫ পরবর্তী অ্যামেরিকান কবিদের তালিকায় যেকজন বিখ্যাত কবি রয়েছেন তাদের মধ্যে লুইস গ্লিক (১৯৪৩) অন্যতম।

The Norton Anthology of American Literature- এর দ্বিতীয় সংস্করণের দ্বিতীয় ভলিউমের সূচীপত্রে একেবারে শেষের সংযোজনটির শিরোনাম:
After 1975: Some poems from a younger generation – এ শিরোনামাধীন কবিদের মাঝে চতুর্থ জন বিখ্যাত কবি Robert Pinsky এবং পঞ্চম জন এবারের নোবেল লরিয়েট লুইস গ্লিক।
এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে তাঁর The Garden কাব্যগ্রন্থের পাঁচটি কবিতা। এখানে Garden শিরোনামের দ্বিতীয় কবিতাটির অনুবাদ উপস্থাপিত হলো।

৭৭ বছর বয়স্ক লুইস গ্লিক বিগত ২৭ বছরে প্রথম অ্যামেরিকান নারী কবি যিনি ১৯৯৩ সনে টনি মরিসনের নোবেল সাহিত্য পুরষ্কার লাভের পর এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার অর্জনকারী ১১৭তম লেখক।
বারোটি কাব্য সংকলনে ধরা আছে তাঁর অসামান্য সব কাব্যকৃতি। ১৯৬৮ সালে তাঁর প্রথম কাব্য Firstborn বা ‘অগ্রজ’ প্রকাশিত হবার পরেই তিনি সমসাময়িক আমেরিকান সাহিত্যে উল্লেখ্যোগ্য কবি হিসেবে প্রশংসিত হয়েছিলেন।

তাঁর কাব্যকৃতি বৃত্তান্তে নোবেল কমিটি উল্লেখ করেছে –
‘তাঁর অভ্রান্ত কাব্যকন্ঠ ও কবিতার নিরাভরণ সৌন্দর্য ব্যক্তিক অস্তিত্বকে বৈশ্বিক করে তোলে।’

তার কবিতার শাব্দিক সারল্য অসতর্ক পাঠককে সহজেই প্রতারিত করতে পারে। অত্যন্ত সহজভাবে গভীর কথাটি উচ্চারণে তাঁর পারঙ্গমতা প্রবাদপ্রতিম। তাঁর কাছে –
Nothing is final.
Certainty is an illusion
কোন কিছুই যে চূড়ান্ত নয়, কোন কথাই যে শেষ কথা নয় এবং নিশ্চয়তা যে এক কুহকের নাম তা কবি খুব স্পষ্ট করেই বলেছেন।

তাঁর উচ্চারণ :

“all human beings are divided/ into those who wish to move forward/ and those who wish to go back”

বিশ্বাসের তত্ত্বগুলো গ্রহণের বিষয়ে গ্লিকের ঋজুতা, অনৌৎসুক্য ও অসম্মতিজ্ঞাপক মনোভঙ্গির জন্যে
তাকে তুলনা করা হয় অসামান্য নারী কবি এমিলি ডিকিনসনের সঙ্গে।

ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি অধ্যাপক কবি লুইস গ্লিক একজন প্রকৃত কবি। তাঁর কবিতা একাধারে নিরাভরণ, দুরূহ এবং অত্যন্ত জীবন্ত।

১৯৯৩ সালে তাঁর পাঠক-সমালোচক নন্দিত কাব্যগ্রন্থ The Wild Iris (১৯৯২) এর জন্যে তিনি অর্জন করেছিলেন পুলিৎজার পুরস্কার। ২০১৪ সালে তিনি অর্জন করেন ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড।

Averno তাঁর শ্রেষ্ঠ কাব্যকৃতির একটি। Averno শব্দটি নেপলসের পশ্চিমে অবস্থিত জ্বালামুখ বা গহ্বরটিকে বুঝায় যেটিকে প্রাচীন রোমানরা পুরাণের প্রেতলোক বা যমপুরীতে প্রবেশ-গহ্বর হিসেবে বিবেচনা করতেন।
তাঁর কবিতার কেন্দ্রে শৈশব, পারিবারিক জীবন, বাবা-মা, ভাই-বোন এবং নিকটজনদের সাম্পর্কিক নিবিড়তা নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। অন্যদিকে, গ্রিক এবং রোমান পুরাণও তাঁর কবিতায় এক প্রাতিস্বিক ভিন্ন মাত্রায় পুনরুত্থিত হয়েছে।

স্পষ্ট করে বলার চেষ্টা তাঁর কবিতার কুললক্ষণ।

১৯৯৬ সালে প্রেসিডেন্ট ওবামার কাছ থেকে ন্যাশনাল হিউম্যানিটিজ মেডেল লাভ করেছিলেন গ্লিক। ২০০৩ সালে তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন অ্যামেরিকার পোয়েট লরিয়েট।

কবির দৃষ্টিতে তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত সৃষ্টি ” Faithful and Virtuous Night” (২০১৪) কাব্যগ্রন্থটি। ” বিশ্বস্ত এবং পূণ্যময় রজনী”-ই প্রথমে পাঠকের হাতে নেয়া উচিত এমনটিই বলেছেন এই নোবেল বিজয়ী জগতনন্দিত কবি, গ্লিক।

জীবন, পুনরুজ্জীবন, উপকথা আর মিথের ধ্রুপদী প্রয়োগ তাঁর কবিতাকে কালজয়ী কবিতার ধারায় প্রবহমান রেখেছে। তাঁর Oneiric বা স্বপ্নবিষয়ক কবিতা, হারানোর গভীর বোধে উন্মথিত কবিতা, ডিডো, পার্সেফোনে এবং ইউরিডিসের মিথ-নিষিক্ত বেদনাসিক্ত কবিতাবলী বিশ্বকবিতায় নূতনভাবে উপস্থাপিত।
জগৎ- জীবনের প্রতি শৈশবে যে দৃষ্টিতে আমরা তাকাই তার মাহাত্ম্য কবির বিবেচনায় অনতিক্রম্য।
তাঁর কবিতায় তিনি লিখেছেন:
We look at the world once, in childhood.
The rest is memory.

তৎক্ষণিক মন্তব্যে নির্জনতা পিয়াসী এই কবি এতো বড়ো পুরস্কার প্রাপ্তিকে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় বড়ো এক বিঘ্নসৃষ্টিকারী বলেই অভিমত ব্যক্ত করেছেন। কারণ, তখনো তাঁর ভাষায়, কিঁচকিঁচ করে টেলিফোন বেজেই যাচ্ছিলো।

১৯৪৩ সালের ২২ এপ্রিল নিউ ইয়র্কে জন্মগ্রহণ করেন এই খ্যাতকীর্তি নোবেল বিজয়ী কবি লুইস গ্লিক।

মুজিব রাহমান: সহযোগী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, চট্টগ্রাম কলেজ।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন