জাবীদ মাইন্উদ্দীন ’র 

একগুচ্ছ কবিতা

পুবাকাশ

 

এক.   তিনি আসবেন

বাকিংহামে শূণ্যতার বিরহ বিষাদ সুর।

ত্রৈমাসিক অবকাশে যাবেন

রাণীমাতা মহামতি ভিক্টোরিয়া,

অকস্মাৎ প্রাসাদের কর্মযজ্ঞে এসেছে

শিশিরের তীব্র তুমুল গতি

কোন্ বিশেষ তারকা ছুঁয়ে দিয়ে যাবে আজম্ম অস্পৃশ্য রাণীর

হিরম্ময় মুকুট শিখর,

দুদিনেরও কম সময়ে আনা হবে উৎপাদিত সর্বশেষ পরিবহন ব্র্যান্ড,

কোন্ প্রহরে পরিহিত হবেন কোন্ বিশেষ পোশাকে,

মাতার বুনো টেবিলে পরিবেশিত হবে রসনার কোন্ বিশেষ উপাদেয় খাবার

ইত্যাকার সকল কিছুই

সুনসান নির্ধারিত হয়ে যাবে ভ্রমণের বেশ দিনকাল আগেই

পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশেরও বেশী মহান অধিপতির শৈত্যভ্রমণে

রাজকীয় প্রটোকল বলে কথা

শীতের শুরু এলে এখানেও শুরু হয় মিথ্যের অপ্রতিরোধ্য দূরন্ত কর্মশালা,

উড়ুক্কু রমণীর সঙ্গে অনুশোচনার মধুচন্দ্রিমা রাত,

কখনো কখনো পরিচয় আড়াল করে দেয়া

দুষ্কৃতি কোনো শিক্ষকও ঢুঁ মেরে যায় প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে

ঝিঁ ঝিঁ পোকাদের কান ঝালাপালা করা অভিনব এক মৌনতায়

বস্তুতঃ, সকল প্রটোকলেই নিহিত থাকে
অপার সুষমায় সুসজ্জিত
অপূর্ব মিথ্যে সৌন্দর্যের প্রলেপ
ঠিক তেমনি তাঁর বিরক্তিকর আগমনেও
আমি সাজিয়ে রেখেছি
মিথ্যের যাবতীয় কদম ফুলের ডালা
শীতই যখন এলো, দুর্দমনীয় পদাঘাতে
ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে তিনিও এসে পড়বেন
ভিক্ষাগ্রস্থ পরিবার পরিজন নিয়ে
তিনি আসবেন,
দস্যুর মুখোশ পরে আচ্ছাদিত শিক্ষকের মতোই তিনি আসবেন,
প্যালেস্টাইনের মৃত্যুপথযাত্রী নারী শিশুদের ভারাক্রান্ত ক্রন্দনধ্বনি নিয়ে আসবেন,
অনুরোধের ক্রোড়পত্রে
পেশাগত সীল ছাপ্পর মেরে
মাথামুন্ডুহীন কবিতার মতোই তিনি আসবেন
বাকিংহাম প্রাসাদের ভ্রমণের প্রাক প্রস্ত্তুতির মতো
তাঁর ভ্রমণে কেউই একচুল বিচলিত না,
তাঁর নির্ধারিত না আসার জন্যে,
তাঁর বুভুক্ষু চোখ আর মুখে না চাওয়ার জন্যে
শিক্ষাপ্রতিষ্টানে ঘোষিত হয়েছে দুর্যোগের অনাকাংখিত ছুটির নোটিশ জারী
তিনি আসবেন, তবুও তিনি আসবেন;
রাজপ্রাসাদের জ্যোতির্ময় পোশাকে
কর্দমাক্ত বিদঘুটে  শরীর ঢেকে তিনি আসবেন
নাফের স্নিগ্ধ মোহনা, বিশাল সমুদ্র তটে
শিক্ষাকে বিপদগ্রস্থ করার জন্যে,
কবিতাকে আরও একটিবার কলংকিত করার জন্যে,
তিনি আসবেন
নপুংসক কবিতাবালক তিনি,
বেশরম হারকিউলিস দৈত্যের মতো
পথে পথে ভিক্ষার বেসাতি বসিয়ে
সারল্যপীড়িত অভাগা এই সীমান্ত শহরে
অবশেষে তিনি আসবেন…..
দুই.   দ্বিতীয় জন্মের গান
দীর্ঘ গ্রীষ্ম শেষে এক পশলা বৃষ্টি,
কিম্বা চৈত্রের খা খা রোদ্দুর পরে
একটি প্রশান্ত গোধূলি,
হিমহিম কনকনে ভোরে
আবশ্যিক স্নানের এক কাপ উষ্ণ ধোঁয়ার চা
হৃদয়ে আকাংখার উত্তাপ ছিলো,
ছিলো অদম্য বিদ্রোহ শিখা,বৈশাখী ঝড়,
তোমার সটান বুকের চিতায় আমার শীতল দেহ,
যন্ত্রণার নহর স্নানে অভিসিঞ্চন হলো
প্রলম্বিত বিষাদ বাসর
আহা,এমোন স্নিগ্ধ একটি ভোরের জন্যে,
তুষের আগুন নেভা সুশোভিত একটি সকাল,অশ্রুসজল মুদিত দুখানি চোখের জন্যে
কতোই না বেদনার অশেষ প্রহর ছিলো
পরমত্রাতা বিশ্ববিধাতা, স্ফটিক অন্তর্যামী
তোমার কোমল কোলেই কি ছিলো
অবিনাশী আরাধ্য সুখের ছোঁয়া,
আকাশ ফুঁড়ে আসা বিধৌত সুখের আলো,
সমুদ্রের অন্তর্গত আলোড়ন,
প্রমুগ্ধ চকিত বিহবল,
আমাকে ফিরিয়ে নেই যেনো
আলোকমন্ডিত মায়েরই জরায়ু মুখে
আজ আমি পুনর্বার দেখে নেবো
পৃথিবীর প্রথম সূর্যরেখা…..
তিন.  হালদা
কাব্যদেয়াই ভ্রান্তি ছিলো
কড়া এবং ক্রান্তি ছিলো
সম্পাদকের নিক্তি কাঁটায়
নিষ্পেষিত হলেম ছাটাই
কী পাঠালাম কি ছাপালো
ফেরীওয়ালার ঘি মাপালো
এমন কাটা কেটে দিলেন
যেনো মরিচ বাটা দিলেন
কবির চিন্তা মুছে দেয়া
রশি কাঁচি সূঁচে দেয়া
লিখতে লিখতে হলেম বুড়া
শিরোণামও শূণ্যে ছুঁড়া!
কথা তো হয় কলকলিয়ে
নামটি শুধু জ্বলজ্বলিয়ে
খুব অবিচার করা হলো
মূল্য দেয়া চড়া হলো
ক্রোড়পত্রের শেষ সীমানায়
আমার লিখার নাই সীমা নাই
একটু হলেই কাটা যেতো
ইস্ যদি পা চাটা যেতো
চাটা চাটির লং মিছিলে
প্রশ্ন করি কে কি ছিলে
তাই তো পথ মাড়াই না তো
তেলের শিশি বাড়াই না তো
চান্দিতে আর তেল দিও না
বিনা দোষে জেল দিও না
উচিৎ সবই পড়ে দেখা
উচিৎ না সব গড়ে দেখা
তওবা লিখা আর দেবো না
পাঁঠা হয়ে ঘাড় দেবো না
বানর হয়ে ঝুলবো গাছে
আমার কি সময় আছে
ছাপার হরফ নাম দেখিবার
জনসভায় বাম দেখিবার
কেউ আমাকে কাইন্ড করেছে
হালদা নদী মাইন্ড করেছে
হালদা আমায় ক্ষমা করো
মান অভিমান জমা করো
বুলবুলিরা ধান খেয়েছে
মহাজনে রান খেয়েছে
রক্তে আমার ক্ষরণ আছে
হাজার ডালা বরণ আছে
হালদা আমায় সঙ্গে রেখো
তোমার সর্ব্ব অঙ্গে রেখো
চার.   দেখা হলো না
আমি যখোন টগবগে দূরন্ত এক তরুণ,
আইনের কিয়ৎকালীন মেধাবী ছাত্র,
মধ্যবিত্ত পিতার মাসিক টাকায় আমার দিন চলতো না
বঙ্গবন্ধু হলের আশ্রিত আধখানা সীটে
টইটম্বুর মধ্যরাতে ক্ষুধার্ত কুকুরের মতো
কতো স্বপ্নই না দেখতাম এই আমি
সকাল হবে, সূর্যোদয়ে কিরণছটার মতো
আমারও জীবনে আসবে লাবণ্যপ্রভার ছায়া,
দুটাকার প্রাতঃরাশ শেষে হন্তদন্ত ছুটে যেতাম
বর্ণালী টি এস সি মোড়
রঙের মোহ কেটে এলে বিস্ময়ে দেখতাম
ডোরাকাটা জোড়াভ্রুণ, টসটসে ওষ্ঠদ্বয়,
টোকা দেয়া গাল,
জিন্স প্যাগাসাস ক্যাডসে মোড়া
এই আমার প্রতি নেই কারুরই কোনো ন্যুনতম ভ্রুক্ষেপ
পাঁচটাকার রুমালে ঘাড় মুছতে মুছতে একাকী
নিজেই হেঁটে যেতাম লালবর্ণ এ্যানেক্স ভবন,
আদ্যোপান্ত খেয়ালী পরিভ্রমণে আড়চোখে দেখতাম
খ্যাতিমান কিছু কিছু মুখ,
করিডোরে জ্ঞানী অতি জ্ঞানীদের সদর্প হেঁটে যাওয়া
বৈষম্যের বিরাটকায় চোখ ধাঁধানো দেয়াল
এখানেও প্রেম ছিলো, প্রেম আছে তাদের জন্যেই,
যাদের জন্যে প্রেম চিরকাল অপেক্ষায় থাকে তীর্থের কাকের মতো
বিমর্ষ দীর্ঘশ্বাসে আমি পুনরায় ছুটে যেতাম মধুর ক্যান্টিন
শাহজাদার কাছে ভর্ত্তির গচ্ছিত অর্থের আশায়
যে অর্থ শ্বাশ্বত উড়াল দিয়েছে
ধূসর ধূ ধূ আকাশে,
অতঃপর কোনো না কোনো উপায়ে হয়ে যেতো
একটি সিঙ্গারা প্লেটহীন এককাপ উষ্ণ ধোঁয়ার চা
ইতোমধ্যেই অভাব বুঝে ফেলা দুএকজন সতীর্থ
আমাকে ছেড়ে যাবার আগেই
আমি ছেড়ে যেতাম তাদের অভাবী সান্নিধ্য
উদাত্ত ঘুরে ফিরে দেখতাম সুউচ্চ সূর্যসেন মহসীন,
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তাম কলা অনুষদের দেশখ্যাত কীর্তিমান বরেণ্য জ্ঞানীদের নাম,
এখানে সেখানে যেখানেই চোখে পড়ে যেতো রাজপথ কাঁপানো সময়ের সূর্য সন্তানগুলো
অনেকটা গায়ে পড়ে পড়েই বলতাম অর্থহীন এই সেই কথা,
বিদায়ে প্রলম্বিত দীর্ঘ সেলাম অভিবাদন,
ভাবতাম
এঁদেরই বিমল হাত বেয়ে
পুনঃশ্চ প্রগাঢ় হবে ম্রিয়মাণ রক্তলাল পতাকা,
আমূল বদলে যাবে কন্ঠ ধরে আসা আমার দুঃখিনী স্বদেশভূমি
আমি গ্রামের ছেলে
একদিন সহসাই ঢাকা ছেড়ে আসি
মাতৃক্রোড়ে নিজেরই গ্রাম্য শহর,
রাজপথের সূর্য সারথী,
রক্তমাংসের মুষ্টিবদ্ধ সেইসব মানুষগুলো,
পর্বতসম জ্ঞানী আর গুণীদের আর দেখা হলো না
স্বকীয় সচকিত চোখে,
প্রযুক্তির আশাতীত উৎকর্ষে এখনও প্রতিদিন
দেখে যাই আচ্ছাদিত সেইসব প্রোজ্জ্বল প্রাণের ছায়া,
অথচ দেখা হলো না লাল নীল স্বপ্নের নবারুণ উদ্দীপ্ত সেই পতাকা,
পতাকার বিশুদ্ধ রঙ্, আকাংখিত পরমাত্মার সবুজ সুললিত অভ্যূদয়
পাঁচ. স্যার
হঠাৎ করেই কান্না জুড়েন তিনি
পাখা মেলে শূণ্যে উড়েন তিনি
সেখানটাতে গিয়ে দেখেন
রঙীন পানি পিয়ে দেখেন
ভালোই ছিলেন নিম্মদেশে
হাউমাউ হাউ কান্নায়
অভিনেত্রী ব্যস্ত এখন
ছালন বাতি রান্নায়
অভিনয়ের কি আর আছে
স্যারের বোধয় শিয়ার আছে
অভিনেত্রী অবাক দেখেন
স্যারের ফিলিংস মাত্রা
প্রিমিয়ার শো এক নিমেষেই
রুপান্তরের যাত্রা
স্যার কেঁদেছেন চুল বেঁধেছেন
জায়েদ খানের দুল বেঁধেছেন
অবশেষে খাঁ খাঁ বুকে
নেত্রী যখন ঝাপটায়
স্যার ভুলে যান কাপড় চোপড়
বেল্ট বটমের মাপটাই

জাবীদ মাইন্উদ্দীন: কবি ও অধ্যাপক ।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন