পুরনো ফোনসেট কেনাবেচায় আসামি হওয়ার ঝুঁকি।। আবদুল কাইয়ুম মাসুদ।। পুবাকাশ

ফোনসেট পুরনো হলে কেনাবেচায় ঝুঁকি থাকে
দুপুরে খেয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছিলাম। এমন সময় এক নিকট আত্মীয়ের ফোন। ওপাশ থেকে বললেন, … ভাই একটু সমস্যা হয়েছে। আমি থানায়। আপনি একটু আসেন। থানার কথা শুনলে আমাদের মতো দেশে যে কারো উদ্বেগ উৎকন্ঠা বেড়ে যায়। আমারও তাই হয়েছে। বের হলাম, মসজিদে আসরের নামাজ পড়ে দ্রুত থানায় পৌঁছানো লক্ষ্য। নামাজ পড়েছি ঠিকই, বের হয়ে দেখি আমার সেন্ডেল নেই। চুরি হয়ে গেছে। তাড়াহুড়ো করলে যা হয়। অগত্যা বাসায় ফিরে আসতে হলো।

থানায় পৌঁছানোর পর দেখলাম আমার সে আত্মীয় একজন পুলিশ ইন্সপেক্টরের সামনে বসে আছেন। ইন্সপেক্টরের সাথে পরিচয় পর্ব সেরে জানতে চাইলাম বিষয়টা কি? তিনি যা বললেন তা নিম্নরূপ-
সে (আমার আত্মীয়) চোরাই মোবাইল কেনাবেচা চক্রের সদস্য। ছিনতাইকারীরা ছিনতাই করে নিয়ে আসে আর সে তা বিক্রি করে। পাশে বসে থাকা এক ভদ্রলোক ও ভদ্র মহিলাকে দেখিয়ে বললো উনাদের কাছ থেকে এরকম ছিনতাইকৃত একটি মোবাইল সেট আমরা উদ্ধার করেছি। যেটি সে (আত্মীয়) উনাদের কাছে বিক্রি করেছে। এখন তাকে কোর্টে চালান দেবো, তার বিরুদ্ধে দুটি মামলা হবে।

আমার আত্মীয় অনলাইন ফ্লাটফর্ম থেকে কিনেছে। কেনার কনভারসেশন দেখিয়ে বললো, দেখেন আমি অনলাইনে কিনেছি, তারপর উনাদের কাছে বিক্রি করেছি। পুলিশ ইন্সপেক্টরের পালটা যুক্তি, আপনি কিনে থাকলে আপনার কাছে বক্স, এক্সেসরিস সব থাকবে, সেগুলো কোথায়? ছিনতাই করা মোবাইলে এসব থাকে না। ছিনতাইকারী শুধু মোবাইল নিয়ে যায়। এ জায়গায় আমার আত্মীয় খুব অসহায়। কারণ তার কাছে এসব কিছুই নেই। সে কেনার সময় বিক্রেতা নাকি বলেছিলো যে, এটি তার বাবা বিদেশ থেকে এনেছে। আমার আত্মীয় তা বিশ্বাস করেছে।
এর মাঝে আরও কয়েকজন ইন্সপেক্টরের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে। তার মধ্যে একজন চবিয়ান আমার ফ্যাকাল্টিরই পেয়ে গেলাম। সে বললো, ভাইয়া সে (আমার আত্মীয়) যাদের কাছে বিক্রি করেছে তারা টাকার জন্য এসে বসে আছে। তাদের টাকাটা দেয়ার ব্যবস্থা করে দেন। তাহলে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আমরা বুঝতেছি এরা পরিস্থিতির শিকার। সে যার থেকে কিনেছে তাকে যদি আমাদের হাতে সোফর্দ করে দিতে পারে আমরা ওর থেকে টাকাটা উদ্ধার করে উনাকে (আমার আত্মীয়কে) ফেরৎ দেবো। আমরাও তাই করলাম।
টাকা দিয়ে এ যাত্রায় নিস্তার পেয়েছি বটে, বিকেল থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত আত্মীয়-স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী যারা জেনেছে তাদের যে মানসিক চাপ ছিলো তা বলে বুঝানো কষ্টসাধ্য ব্যাপার।
কিছুদিন পর আমার আত্মীয় আরেকটি মোবাইল ক্রয়ের কথা বলে ঢেকে এনে এ মোবাইলটি যার কাছ থেকে কিনেছিলো তাকে পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার হাতে তুলে দিতে সক্ষম হয়েছে। সে লোকও কি পরিস্থিতির শিকার না ছিনতাইকারী তা আমি জানি না। তবে এক মোবাইল কেনাবেচায় ৩ পরিবার বিব্রত হওয়ার কাহীনি দৃশ্যমান হয়েছে; যা অনাকাঙ্ক্ষিত। তারপরও ধাপে ধাপে মূল অপরাধী সনাক্ত হবে, এটি কিন্তু কাঙ্ক্ষিত।
কেউ হয়তো ভাবতে পারেন, কিনে বিক্রি করে দিয়েছিতো ঝামেলা শেষ, তাহলে বুঝতে হবে প্রযুক্তি সম্পর্কে আপনার ধারণা পরিষ্কার নয়। ছিনতাইকৃত বা অন্য কোনো অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট মোবাইলের ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল ইকুইপমেন্ট আইডেনটিটি (আইএমইআই) এর মাধ্যমে এ ফোন সেটটি এ মুহূর্তে কে ব্যবহার করছে তা সণাক্ত করা সম্ভব হয়। অপরাধ সংঘটনের পর কোনো ব্যক্তি তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটির ব্যবহার বন্ধ কিংবা ভেঙে ফেললেও প্রযুক্তির মাধ্যমে সেটির আইএমইআই সনাক্ত করা যায়। আর এই আইএমইআই নম্বর সনাক্ত হলেই মোবাইল ব্যবহারকারীর পরিচয় জানা সময়ের ব্যাপার মাত্র।

অপরাধী শনাক্তকরণ ও সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যপী পুলিশ এখন অনেক বেশি প্রযুক্তিনির্ভর। কোথাও কোনো অপরাধ ঘটামাত্রই শুরু হয় ওই এলাকায় ব্যবহৃত মুঠোফোনের ওপর নজরদারি। সেই মুঠোফোন মালিকদের থেকে বাছাই করা সন্দেহভাজনদের পরিচয় সম্পর্কে তথ্য নিয়ে শুরু হয় তদন্ত। কেউ হত্যার শিকার হলে তাঁর সেলফোন নম্বর চলে যায় পুলিশের কবজায়।
সাধারণ মানুষ এসকল প্রযুক্তিগত তথ্য সম্পর্কে না জানলেও অপরাধীরা কিন্তু ঠিকই সব খবর রাখে। তাই তারা অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট মোবাইল ফেলে দেয় বা ধ্বংশ করে ফেলে। শুধু তাই নয় আন্তর্জাতিক অপরাধীরা তদন্তে ব্যবহৃত পুলিশের প্রযুক্তি ফাঁকি দেয়ার চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছে। নিচে এরকম একটি ঘটনার উল্লেখ করছি।

জেল থেকে পালিয়ে গিয়ে এভাবে একবার প্রায় ৬ মাস আত্মগোপনে থাকতে সক্ষম হয়েছে মেক্সিকোর কুখ্যাত মাদক সম্রাট এল চ্যাপো। তার ছিল কয়েকশো কোটি ডলারের মাদক ব্যবসা। মাদক ব্যবসার জন্য তার যে বিস্তৃত নেটওয়ার্ক, সেটি তাকে পালিয়ে থাকতে সাহায্য করেছিলো। এল চ্যাপো তখন কেবল একটি এনক্রিপ্টেড ফোন দিয়ে যোগাযোগ রক্ষা করতো। সেসময় এই মোবাইল ফোন হ্যাক করা অসম্ভব বলেই মনে করা হতো। মেক্সিকোর কর্তৃপক্ষ নাকি তখন খুবই অত্যাধুনিক গুপ্তচর প্রযুক্তি কিনেছিল এল চ্যাপোকে ধরার জন্য।
এল চ্যাপোর ঘনিষ্ঠ মহলের লোকজনের ফোনে তারা এই স্পাইওয়্যার ঢুকিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলো। এর মাধ্যমে তারা এল চ্যাপোর গোপন আস্তানার সন্ধান পেয়ে যায়।
এভাবে এল চ্যাপোকে ধরার পর এই স্পাইওয়্যার যে কতটা কার্যকর, তার প্রমাণ পাওয়া গেলো। সন্ত্রাসবাদী এবং সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে এধরণের স্পাইওয়্যার এক মূল্যবান অস্ত্র হিসেবে পরিগণিত হলো।
নিরাপত্তা সংস্থাগুলো এ ধরণের স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে এনক্রিপ্টেড ফোন এবং অ্যাপসে ঢোকার মাধ্যমে হয়তো অনেক চরমপন্থীকে ধরতে পেরেছে, অনেক মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে।
অপরাধ দমনে প্রযুক্তিই হবে বড় অস্ত্র, এটি সময়ের ব্যাপার মাত্র। অপরাধ করে কেউই আর বাঁচার সুযোগ নেই। প্রযুক্তির জালে সে ধরা পড়বেই।

আবদুল কাইয়ুম মাসুদ : প্রভাষক, আইসিটি, কর্ণফুলী এ জে চৌধুরী কলেজ, চট্টগ্রাম।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন