মুক্তমত
মুসলিম হৃদয়বৃত্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিতে তুরাস, তানকীদ ও তাজদীদ: ঐতিহ্য, পর্যালোচনা এবং আধুনিকতা
মনোয়ার শামসী সাখাওয়াত
পুবাকাশ
পর্ব-১
প্রথমত: একটি নতুন জ্ঞানকান্ডের উদ্ভাবনের লক্ষ্যে মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা (যাদের দুজনের নাম উপরে উল্লেখ করা হয়েছে) জ্ঞানতত্ত্ব ও পদ্ধতিতত্ত্বের কথা তুলেছেন। তারা ইসলাম ও মুসলিম সমাজগুলি পাঠে পশ্চিমা ইতিহাসবিদ্যা ও ভাষাবিদ্যার পদ্ধতিগুলির পর্যালোচনা করেছেন। এভাবে তারা এসবের মধ্যে ইউরোকেন্দ্রিক বিশ্ববীক্ষা, প্রাচ্যবাদ, মোটা দাগের সাধারণীকরণ, রাজনৈতিক, মতাদর্শিক ও উপনিবেশিক লক্ষ্য পূরণে জ্ঞানের ব্যবহার এবং ইসলামের মৌলিকতা ও বিশিষ্টতা উপেক্ষা করে এর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মধ্যে বহিরাগত প্রভাব খোঁজার প্রবণতা উন্মোচন করেছেন।
১.
উনিশ শতকের শেষ থেকে মুসলিম বুদ্ধিজীবিরা মুসলিম সমাজগুলিকে কিভাবে আবার ক্ষমতায়িত করা যায় সেই বিষয়ে বিভিন্ন প্রস্তাব ও ধারণা দিয়ে যাচ্ছেন। এসব তারা করেছেন পশ্চিমা সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে তাদের লড়াইয়ের অংশ হিশেবে। এর ফলে ইসলামের ধর্মতাত্ত্বিক, রাজনৈতিক এবং আইনী তুরাস বা ঐতিহ্যের সঙ্গে নিরন্তর সংলাপের একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তারা বিভিন্ন ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রকল্প গ্রহণ করেছেন। ঐতিহ্যের প্রশ্ন এবং আধুনিক সমাজে এর তুল্যমূল্য নিয়ে মুসলিম বিদ্বান, ধর্মতাত্ত্বিক এবং বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে তুমুল তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। এই তর্ক-বিতর্ক পুরো বিশ শতক ধরেই হয়েছে। এই প্রশ্ন ও সমস্যাগুলি এখনো ধারালো বাক-বিতন্ডা এবং আলোচনা চলমান রেখেছে। উপনিবেশিক এবং উত্তর-উপনিবেশিক কালের আধুনিকতার চ্যালেঞ্জগুলির মোকাবিলা করতে গিয়ে কিছু বুদ্ধিজীবী ঐতিহ্যকে উপেক্ষা বা এমনকি পরিত্যাগ এবং আধুনিকীকরণের পশ্চিমা মডেল অনুসরণের পরামর্শ দিয়েছেন। তাদের কাছে ইসলামের ঐতিহ্য একটি বাতিল হয়ে যাওয়া বোঝা যা ফেলে দেয়া প্রয়োজন।
অন্যেরা সিদ্ধান্ত নিলেন যে সংকটের মূল কারণ হল মুসলিমেরা নবী মুহাম্মদ সা.-এর কালে চর্চিত “শুদ্ধ ইসলাম” থেকে বিচ্যুত হয়েছে। সুতরাং, তারা ভাবলেন যে এই সংকটের সমাধানের জন্য “সালফে সালেহীন”দের দৃষ্টান্তের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে হবে। “কুরআন ও সুন্নাহতে ফিরে যাওয়া”র স্লোগান দিলে সালাফদের অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি ঘটবে।
উল্লেখিত এই দুটি পন্থার বাইরে আরেকটি বিকল্প হল সংস্কারবাদী পন্থা। এই পন্থাটি ঐতিহ্যকে পুরোপুরি পরিত্যাগের সবরকম আহ্বানকে উপনিবেশবাদের ধ্বংসাত্মক প্রভাবের অংশ হিশেবে বিবেচনা করে। এই পন্থার যারা আহ্বায়ক তারা মনে করেন যে মুসলিমেরা যেসব উৎস থেকে শত শত বছর যাবত জ্ঞান আহরণ করেছেন সেসব যদি পরিত্যাগ করা হয় তাহলে তা মুসলিম বিশ্বে বুদ্ধিবৃত্তিক সংকটের আরো অবনতি ছাড়া অন্যকিছু ঘটাবে না।
একই সময়ে এই পন্থাটি সালাফদের অনুসরণের যে প্রস্তাবনা সেটিরও বড় সমালোচক। এই পন্থা মনে করে সালাফদের অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি মুসলিম সমাজগুলিতে সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যাগুলির সমাধান করতে পারবে না।
সংস্কারবাদী পন্থার সমর্থকেরা ইসলামের পদ্ধতিসমূহ এবং নীতিমালা ব্যবহার করে ইসলামের ধর্মীয়, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ধারণাগুলির নবায়ন, পুনর্গঠন এবং সংস্কার করার চেষ্টা করেছেন। তারা ইসলামের জ্ঞানকান্ডের একটি সম্পূর্ণ পুনর্গঠনের প্রস্তাব করেছেন। তারা ইসলামের বিষয়গুলির অন্তর্ভুক্ত প্রথাগত জ্ঞানতাত্ত্বিক ও পদ্ধতিতাত্ত্বিক ব্যবস্থার প্রতিস্থাপন করে একটি নতুন জ্ঞানবৃত্তের উদ্ভাবন ও বিকাশ করেছেন।
জ্ঞানের নতুন রূপ এবং চিন্তার নতুন কাঠামো অনুসন্ধান করে মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা সেক্যুলারিস্ট এবং সালাফিস্ট উভয়ের সঙ্গে জোরালো তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হয়েছেন।
সংস্কারবাদীদের কাছে—ঐতিহ্য বিষয়ে কি করা যেতে পারে, সমাজে এর কি ভূমিকা থাকতে পারে এবং মুসলিম জাতিরাষ্ট্র ও বিশ্বায়নের প্রেক্ষাপটে এর বোঝাপড়া ও ভাষ্যনির্মাণ কিভাবে হতে পারে—এসব কেবল শুদ্ধ বুদ্ধিবৃত্তিক প্রশ্ন নয়। উদাহরণস্বরূপ সমকালীন মুসলিম বুদ্ধিবৃত্তির অন্যতম দুজন ব্যক্তিত্ব, যারা নিজ নিজ জ্ঞানকান্ডের উদ্ভাবন করেছেন, যেমন মরক্কোর মুহাম্মদ আবিদ আল জাবরী (১৯৩৫-২০১০) এবং মিশরের হাসান হানাফি (১৯৩৫-২০২১) বলেছেন যে জ্ঞান নিরপেক্ষ ও নিষ্পাপ কোনো বিষয় নয়। তাদের মতে পশ্চিমা উপনিবেশবাদ প্রাক-আধুনিক মুসলিম সমাজের প্রতিষ্ঠানগুলিই শুধু ধ্বংস করেনি; তারা প্রাক-আধুনিক এই সমাজের জ্ঞান আহরণ ও সঞ্চালনের বিভিন্ন রূপও ধ্বংস করেছে। সুতরাং, ইসলামের যেসমস্ত সামাজিক, রাজনৈতিক ও আইনী ব্যবস্থা ও ধারণাসমূহ এখনো সাধারণ মুসলিমেরা গ্রহণ করে ও বুঝতে পারে সেগুলিকে সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করলে তা মুসলিম সমাজগুলিতে পশ্চিমা সাংস্কৃতিক আধিপত্যকেই কেবল জোরদার করবে। এছাড়া এইসব চিন্তাবিদেরা সূক্ষভাবে এই প্রশ্ন তোলেন যে তারা কি শুধু মুসলিম ঐতিহ্যের উপরে ভিত্তি করেই তাদের নিজ নিজ জ্ঞানকান্ডের বিকাশ করবেন, নাকি পশ্চিমা জ্ঞানকান্ডে স্বীকৃত নিয়ম ও রূপ থেকেও তাদের অনুপ্রেরণা আহরণ করবেন।
প্রথমত: একটি নতুন জ্ঞানকান্ডের উদ্ভাবনের লক্ষ্যে মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা (যাদের দুজনের নাম উপরে উল্লেখ করা হয়েছে) জ্ঞানতত্ত্ব ও পদ্ধতিতত্ত্বের কথা তুলেছেন। তারা ইসলাম ও মুসলিম সমাজগুলি পাঠে পশ্চিমা ইতিহাসবিদ্যা ও ভাষাবিদ্যার পদ্ধতিগুলির পর্যালোচনা করেছেন। এভাবে তারা এসবের মধ্যে ইউরোকেন্দ্রিক বিশ্ববীক্ষা, প্রাচ্যবাদ, মোটা দাগের সাধারণীকরণ, রাজনৈতিক, মতাদর্শিক ও উপনিবেশিক লক্ষ্য পূরণে জ্ঞানের ব্যবহার এবং ইসলামের মৌলিকতা ও বিশিষ্টতা উপেক্ষা করে এর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মধ্যে বহিরাগত প্রভাব খোঁজার প্রবণতা উন্মোচন করেছেন। এভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক মুক্তি এমন একটি স্তরে পৌঁছায় যে আল জাবরী সাধারণত: প্রাচ্যবাদীদের বরাত দেয়া পুরোপুরি বন্ধ করে দেন। তিনি প্রাথমিক উৎস থেকে সরাসরি আহরণ করাকে প্রাধিকার দিতে পছন্দ করতেন। তিনি পশ্চিমা বিদ্যাজগতে উৎপাদিত প্রাচ্যবাদের প্রতি বরাত দেয়ার প্রথাকে একধরনের সাংস্কৃতিক আধিপত্য বলে বিবেচনা করতেন। এই প্রথা মুসলিম বুদ্ধিজীবীকে তার নিজস্ব ঐতিহ্যের সঙ্গে পর্যালোচনামূলক সংলাপে লিপ্ত হতে অনেকটাই বাধা দেয় বলে তিনি মনে করতেন।
২.
আবিদ আল জাবরীর (১৯৩৫-২০১০) শ্রেষ্ঠ রচনা হল চার খন্ডে প্রকাশিত ‘দ্য ক্রিটিক অফ এরাব রিজন” বা ‘আরব যুক্তির পর্যালোচনা’ (‘নাকদ আল আকল আল আরাবি’, ১৯৮৪, প্রথম খন্ড)। এই বইতে তিনি ইসলামের প্রধান বিদ্যাশৃঙ্খলাসমূহের জ্ঞানতত্ত্ব এবং প্রাক-আধুনিক মুসলিম ইতিহাসে জ্ঞান ও ক্ষমতার সম্পর্ক পর্যালোচনা করেছেন। তার এই পর্যালোচনামূলক বুদ্ধিবৃত্তিক প্রকল্পের মর্মে রয়েছে এই ধারণা যে আরব দেশগুলি ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির উপনিবেশ হবার আগে মুসলিম বিশ্বে নির্দিষ্ট জ্ঞানতাত্ত্বিক ব্যবস্থার (আল নিজাম আল মা’রিফি) চর্চা ছিল।
আরব-ইসলামীয় বিশ্বের এই বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তিসূত্রগুলি ছিল—জ্ঞানের একটি কাঠামো, সুনির্দিষ্ট কিছু আদর্শ, শাখা-প্রশাখার একটি বিন্যাস, ধারণা ও নীতিমালার সমাহার। এই জ্ঞানতাত্ত্বিক কাঠামোর মধ্যে বিকশিত হয়েছিল আল জাবরীর ভাষায় “আরব আকল” (আল আকল আল আরাবি)। আরব-ইসলামীয় সংস্কৃতির (মূলত লিখিত) একটি ব্যাপক বিশ্লেষণ আল জাবরীকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত করে যে, তিন প্রকারের জ্ঞানতাত্ত্বিক বিন্যাস আরব আকল বা যুক্তির স্বরূপ নির্ধারণ করেছে। আরব আকল অথবা আরব-মুসলিমদের চিন্তা ও ধারণা করার এই পন্থাগুলি হল: বয়ান—ইসলামীয় ধ্রুপদী জ্ঞানশৃঙ্খলাসমূহ যেমন কুরআনের ভাষ্যবিদ্যা (হার্মেনিউটিকস), আইনবিদ্যা, হাদিসশাস্ত্র ইত্যাদিতে অনুসৃত পদ্ধতিবিদ্যা; ইরফান—গুপ্ত অধ্যাত্মরহস্য জ্ঞান, নব-প্লেটোবাদ এবং সূফি ধারণাসমূহ; এবং বুরহান—“শক্ত গাঁথুনিসম্পন্ন তর্কবিন্যাস”, যুক্তিবাদী চিন্তার প্রণালীসমূহ, আন্দালুসিয়া ও মাগরেবের ফালসাফা ও ফিকহ ভিত্তিক ঐতিহ্যের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা।
আল জাবরী মনে করতেন যে একটি নতুন নাহদা বা বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক পুনর্জীবন অর্জন করতে হলে বুরহানের উপরে ভিত্তি করে বয়ান ও ইরফানের জ্ঞানতাত্ত্বিক বিন্যাসগুলির পুনর্গঠন করা উচিত। তাহলে পুরনো জ্ঞানের প্রণালীসমূহের সঙ্গে একটি জ্ঞানতাত্ত্বিক ছেদ (কাতিয়া আল মা’রিফিয়া) অর্জন করা সম্ভব হবে। বুরহানের উপরে ভিত্তি করে ইসলামীয় আধুনিকতা (হাদাসা) ও সমকালীন ইসলামীয় চিন্তাকে গড়ে তোলা উচিত বলে তিনি মনে করতেন। এই বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থান এবং তার প্রকল্পে ইবনে রুশদের ঐতিহ্যের কেন্দ্রীয় ভূমিকা থাকার কারণে আল জাবরীকে তার সমসাময়িক কয়েকজন “সর্বশেষ আভেরোয়িস্ট” (সর্বশেষ ইবনে রুশদপন্থী) বলে মনে করতেন।
আল জাবরীর বিখ্যাত মিশরীয় সহযাত্রী ছিলেন হাসান হানাফি (১৯৩৫-২০২১)। তিনি কয়েক খন্ডে প্রকাশিত তার বিপুল বুদ্ধিবৃত্তিক ‘তুরাস ও তাজদীদ’ প্রকল্পে ইসলামের বিদ্যাশৃঙ্খলাসমূহের জন্য একটি নতুন জ্ঞানবিপ্লব পেশ করেছেন। তিনি মনে করতেন যে আরব-মুসলিম বিশ্ব একটি গভীর সংকটে নিমজ্জিত। তাদেরকে অনেক সামরিক পরাজয়ের গ্লানি বহন করতে হচ্ছে, এবং তারা রাজনৈতিক কর্তা হিশেবে নয় রাজনৈতিক বিধেয় হিশেবে টিকে আছে। ঐতিহ্য ও আধুনিকতার ভাষ্যরচনায় একটি নতুন পালাবদল একটি নতুন জ্ঞানঅধ্যায়ের সূচনা করবে যা স্বকীয়তা ও নবসৃষ্টির সুষমিত সংশ্লেষ করবে। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যাবলীর চাইতে কোনো অংশেই কম নয়।
প্রথমে, হাসান হানাফি ইসলামের সুন্নি ধর্মতত্ত্বের পদ্ধতি ও ধারণাগুলির পুনর্গঠন করলেন। তারপর তিনি ইসলামের উসুল আল ফিকহ, হাদীসবিদ্যা, কুরআনের ভাষ্যবিদ্যা, ফালসাফা ও তাসাউফ ইত্যাদির জন্য নতুন পদ্ধতিতত্ত্ব পেশ করলেন। ইসলামের বিদ্যাশৃঙ্খলাগুলিতে সাধিত এই নতুন জ্ঞানীয় পরিবর্তন সমকালীন মুসলিমদের সমস্যাবলী ও আধুনিকতার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছে। প্রাক-আধুনিক অনুগত ধর্মতত্ত্ব পরিবর্তিত হয়ে এমন একটি বিন্যাস সেখানে উদ্ভাবিত হয়েছে যা মুক্তি, মর্যাদা, বিচার, উন্নয়ন, প্রগতি, উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ইত্যাদিকে উচ্চকিত করে তুলেছে।
৩.
উপমহাদেশে জন্ম নেয়া প্রখ্যাত মুসলিম বুদ্ধিজীবী ফজলুর রহমান (১৯১৯-১৯৮৮) এই তুরাস, তানকীদ ও তাজদীদ ধারার সূচনা করেছিলেন। এই পাকিস্তানী-আমেরিকান স্কলার কুরআনের প্রকৃতি ও প্রত্যাদেশের বোঝাপড়াকে একটি মানবীয় (Humanistic) এবং প্রেক্ষিতবাদী (Contextualist) দৃষ্টিতে দেখেছিলেন। তার এই দৃষ্টিভঙ্গী গড়ে উঠেছিল মধ্যযুগের মুসলিম দার্শনিকদের উপস্থাপিত প্রত্যাদেশ বিষয়ক তত্ত্বের প্রভাবে। বিশেষ করে আল ফারাবি এবং ইবনে সিনার প্রভাবের কথা উল্লেখ করতে হয়। এদের প্রভাবে তিনি কুরআন পাঠের লক্ষ্যে দুটি ভাষ্যবিদ্যাগত (Hermeneutic) কৌশল প্রস্তাব করেছিলেন তার ‘মেজর থিমস অফ দ্য কুরআন’ (১৯৮০) গ্রন্থে। পরে ‘ইসলাম এন্ড মডার্নিটি’ (১৯৮২) গ্রন্থে তিনি তার প্রস্তাবনাগুলির আরো বিস্তার করেছেন।
এই দুই কৌশলের প্রথমটি ছিল এই যে, ওয়াহি নাজিলের সুনির্দিষ্ট কালে বিদ্যমান সামাজিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উপাদানগুলি কুরআনের ভাষ্য রচনা প্রক্রিয়ায় নির্ধারক ভূমিকা রাখে। অর্থাৎ ওয়াহির ঐতিহাসিকতার (Historicity) বিচার। আর দ্বিতীয় কৌশলের নির্দেশনাটি ছিল এমন যে, কুরআনে বিধৃত বার্তাটি মুহাম্মদ সা.-এর ব্যক্তিত্ব ও একটি নৈতিক ব্যবস্থা তৈরি করার জন্য তার আকাঙ্খার সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। এর অর্থ হল কুরআনের মৌলিক বাণী প্রণয়নে মুহাম্মদ সা.-এর একটা ভূমিকা আছে। আর এই বাণী হল মূলত নীতি-নৈতিকতা (Ethical-moral) সংশ্লিষ্ট; সাধারণত যেভাবে দেখানো হয় সেভাবে আইন-কানুনী, অক্ষরবাদী ও প্রথাগত (Legalist-literalist-traditionalist) নয়।
ফজলুর রহমানের ভাষ্যবিদ্যার সঙ্গে কুরআনের বিধি-বিধানের পরিবর্তনীয়তা ও অপরিবর্তনীয়তার প্রশ্নটি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। কুরআনের আইন-প্রণয়নকে ঠিকমত বুঝতে হলে তা সেই সময়ের ইতিহাসের প্রেক্ষিতেই বুঝতে হবে। আইন প্রণয়নের পেছনকার কারণটি কি ছিল এবং কুরআনের বার্তা কোন কোন সুনির্দিষ্ট নৈতিক লক্ষ্যসমূহ অর্জনের দিকে ধাবিত হচ্ছিল সেইসবকে বিবেচনায় নিতে হবে।
৪.
ইউরোপীয় উপনিবেশিক কালের শেষ লগ্নে উসমানী খিলাফতের পতনের সময়ে আবুল আ’লা মওদূদী তার ইসলামচিন্তা গঠন করেছিলেন। ইসলামের চূড়ান্ত বিক্ষমতায়ন ও বিরাজনীতিকরণ তিনি নিজের চোখে দেখেছিলেন। এটা তাকে এত বিচলিত ও প্রভাবিত করেছিল যে তিনি তার ইসলামভাষ্যে এর প্রতিক্রিয়ায় ইসলামের একটি অখন্ডিত ও সামগ্রিক রূপ দিতে চেয়েছিলেন। এর ফলশ্রুতিতে তার ইসলামভাষ্য রাজনীতিকে সবচাইতে গুরুত্ব দিয়েছে। এক্ষেত্রে তিনি তখন প্রবলভাবে প্রতিষ্ঠিত বিরাজনীতিকৃত ইসলামের প্রবক্তা ঐতিহ্যবাদী উলামাদের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন। মওদূদী কৃত বিরাজনীতিকৃত ইসলামের এই তানকীদ ছিল বিশ শতকের প্রথম মহাযুদ্ধ ও উসমানী খিলাফতের অবসান উত্তর কালে একটি বৈপ্লবিক চিন্তা, নিঃসন্দেহে।
কিন্তু তিনি শুধু ইসলামের অখন্ডিত ও সামগ্রিক রূপ দিয়েই ক্ষান্ত হননি; তিনি এটি করতে গিয়ে যে ইক্বামতে দ্বীনের তত্ত্ব প্রস্তাব করলেন সেখানে তিনি আধুনিক রাষ্ট্রবাদকে নিয়ে এলেন। ফলে তার চিন্তায় ইক্বামতে দ্বীন আর ইক্বামতে দৌলা একাকার হয়ে গেল। এখানে চিন্তক হিশেবে তার প্রথম বিচ্যুতি। এর ফলে দ্বীনের চেয়ে দৌলা বেশি প্রাধান্য পেয়ে গেল।
তার ইসলামভাষ্যের দ্বিতীয় সমস্যা হল সেখানে আত্মজ্ঞান চর্চার সুযোগ নেই। এখানে বোঝা যায় তিনি সমকালীন সালাফি-ওহাবি-ওয়ালীউল্লাহী কিতাবী ও প্রতিবেদনমূলক (Scriptural and Narrative) এবং উপমাভিত্তিক (Analogical) পদ্ধতিতে বিধিবিধান প্রণয়নের আক্ষরিক ও পরম্পরাসর্বস্ব প্রকরণ থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন নি। হাদিস ও ফিকহ পাঠের এইসব জায়গায় তিনি তার তানকীদকে নির্লিপ্ত এবং নিঃশব্দ রেখেছেন। এখানে তিনি দারুণভাবে ইবনে তাইমিয়া দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। এটাকে তার তাইমিয়ান মোমেন্ট বলা যায়।
অন্যদিকে তার ইসলামভাষ্যে ইবনে আরাবী, শিহাবউদ্দীন সুহরাওয়ার্দী ও মোল্লা সদরা প্রমুখ দ্বারা যে ইরফানী, ইশরাকী ও হিকমাতী ভাববিপ্লব ঘটে গেছে তার কোনো উপস্থিতি নেই। এই ভাববিপ্লবে অনেক বিচ্যুতি ও বিকৃতি এসেছিল একথা ঠিক, কিন্তু মুহাম্মদ ইকবাল যেমনিভাবে সেসবের সংস্কার করে তার নতুন ব্যাখ্যা দিয়ে সক্রিয় ও সকর্মক খুদী তত্ত্বের উদ্ভাবন করেছিলেন এবং এই সমস্যাগুলির একপ্রকার নিষ্পত্তি করেছিলেন, মওদূদী তেমন কোনো চেষ্টাই করেন নি। ফলে মানুষের আত্মজিজ্ঞাসা ও আত্মজ্ঞানের পরিসরে মওদূদীর ইসলামভাষ্য যারপরনাই নীরব এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন। মানুষের আত্মসত্তা ও কর্তাসত্তার প্রশ্নে তিনি ইসফাহান স্কুল ও ফিরিঙ্গী মহলী দারসে নিজামী পরবর্তী মহাচৈতন্য ও অস্তিত্ব ভিত্তিক অর্থাৎ উজুদী কোনো বীক্ষার প্রতি আগ্রহ দেখাবার প্রয়োজন বোধ করেন নি। এখানেও মওদূদী দারুণভাবে খন্ডিত, আংশিক ও সংকীর্ণ। এর ফলে আজ তার সূচিত ইক্বামতে দ্বীনের আন্দোলন রুহানীয়াতের চর্চার দিক থেকে অনেক পিছিয়ে পড়েছে।
৫.
বিশ শতকের তিরিশ দশকের শেষের দিক থেকে উপমহাদেশের রাজনীতি রাষ্ট্র প্রশ্নকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতে থাকে। মুসলিম লীগ একটি স্বতন্ত্র মুসলিম আবাসভূমি হিশেবে একটি নতুন রাষ্ট্রের কথা বলছিল। আর কংগ্রেস এই মুসলিম আবাসভূমি হতে দিতে চায়নি; তারা বরঞ্চ এর পরিবর্তে অখন্ড ও একীভূত ভারত হিশেবে একটি সেক্যুলার রাষ্ট্র চেয়েছিল। আর কমিউনিস্টেরা চেয়েছিল একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ‘রাষ্ট্র’ যেখানে রাজনীতির প্রধান ভাষা হয়ে উঠেছে এমন একটি প্রেক্ষিতে আবুল আ’লা মওদূদী (১৯০৩-১৯৭৯) তার শরিয়া রাষ্ট্রের প্রস্তাব উত্থাপন করলেন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি মুসলিম লীগকে অনৈসলামী মনে করেছিলেন। তিনি লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যে রাষ্ট্রের চরিত্র প্রশ্নে কোনো পার্থক্য দেখতে পাননি। কারণ এই দুটি সংগঠন সেক্যুলার রাষ্ট্রের কথাই বলতো। এই কারণে তিনি ১৯৪১ সালে ‘জামায়াতে ইসলামী’ গঠন করেছিলেন এবং এর লক্ষ্য ঠিক করেছিলেন ‘হুকুমাতে ইলাহিয়া’—‘দিব্য সরকার’ কিংবা ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ (তরজুমান, মে ১৯৪১: ১১)
মওদূদী অবাক হলেন যে তার এই ‘হুকুমাতে ইলাহিয়া’ সম্পর্কে খুব বেশি কেউ উৎসাহী হচ্ছিলেন না। উলামাদের দল হিশেবে ‘জমিয়তুল উলামায়ে হিন্দ’ একটি সেক্যুলার ও অখন্ড ভারত রাষ্ট্রে বিশ্বাস করতো এবং উপমহাদেশে ইসলামের জন্য আলাদা কোনো রাষ্ট্রের প্রয়োজন আছে বলে মনে করতো না। মওদূদী বুঝতে পারলেন যে মুসলিমেরা তাকে সমর্থন দেবে যদি তিনি কুরআনের মাধ্যমে প্রমাণ করতে পারেন যে কেন ইসলামের জন্যে রাষ্ট্র এতো কেন্দ্রীয় একটি বিষয়। তিনি লিখেছিলেন: “কুরআনের আয়াতসমূহ দিয়ে প্রমাণ করা ছাড়া….জনসাধারণ আমার প্রত্যেকটি ব্যাখ্যাকে আমার ব্যক্তিগত বলে মনে করছিলো, এবং আমার বিরোধীদের কাছে আমার অভিমত এতে অন্তত গ্রহণযোগ্য হবে না’ (তরজুমান, মে ১৯৪১: ২১৬)। রাষ্ট্রের একটি মৌলিক ও নতুন ধর্মতত্ত্ব ছাড়া মানুষকে তিনি তার লক্ষ্য বোঝাতে পারছিলেন না।
মওদূদী আধুনিক রাষ্ট্রের ক্ষমতা সম্পর্কে খুব ভালো করেই জানতেন। কংগ্রেস পরিচালিত প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রীরা যেভাবে মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন বিধিবিধান চালু করছিলো তার প্রেক্ষিতেই তিনি তার চিন্তায় রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ভূমিকা তুলে ধরেছিলেন। ১৯৩৮ সালের মার্চ মাসে প্রকাশিত ‘তরজুমান’ সাময়িকীতে তিনি রাষ্ট্র সম্পর্কে তার বিশদ বয়ান প্রথমবারের মত হাজির করেছিলেন: “উনিশ শতকের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মনীষীরা যেভাবে রাষ্ট্র সম্পর্কে ধারণা রচনা করেছিলেন তা আজ দারুণভাবে পুরনো হয়ে গেছে….সেইদিন পুরনো হয়ে গেছে যখন রাষ্ট্র অর্থনীতি, শিক্ষা, শিল্প অথবা সমাজ বিষয়ক পরিকল্পনা পেশ করলে জনগণ সেসবকে দাদী-নানীর আদর বলে হাসাহাসি করতো। পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে গেছে। এখন রাষ্ট্রের ক্ষেত্র ধর্মের মত প্রায় সর্বব্যাপী হয়ে গেছে।“ (তরজুমান, মার্চ ১৯৩৮: ৫)
মওদূদী একটি ধর্মীয় পরিভাষা প্রয়োগ করে মন্তব্য করলেন যে: “একজন ব্যক্তির প্রথম এবং শেষ আনুগত্য তার রাষ্ট্রের প্রতি, এবং এক্ষেত্রে কোনোরকমের ব্যত্যয় ঘটলে তা অবিশ্বাস বা কুফরের চাইতে কোনো অংশে কম নয়” (তরজুমান, মার্চ ১৯৩৮: ৬)। আধুনিক রাষ্ট্রের খুব হস্তক্ষেপমূলক ভূমিকা এবং মুসলিমদের দৈনন্দিন জীবন রূপায়ণে এর ব্যাপক প্রভাবের কথা মাথায় রেখে তিনি ইসলাম ও রাষ্ট্রকে সমান বলে মনে করেছিলেন। এই কারণেই, ১৯৪১ সালে, তিনি ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমের উদ্দেশ্যে ‘জামায়াতে ইসলামী’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
৬.
আগেই বলেছি যে, অধিকাংশ উলামা মওদূদীর অভিমতকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এর প্রধান কারণ ছিল এই যে, তিনি কোনো মাদরাসা থেকে সনদ প্রাপ্ত ছিলেন না। এর ফলে মওদূদী কুরআন থেকে জামায়াতের লক্ষ্যকে বৈধতা দেবার একটা তাগিদ ও প্রয়োজন বোধ করতেন।
মওদূদীর লেখা যে বইটি তার রাজনৈতিক ধর্মতত্ত্বের চাবি-গ্রন্থ হিশেবে গণ্য হয়েছে সেটি হল ‘কুরআন কি চার বুনিয়াদী ইস্তেলাহে’ (১৯৭৯ [১৯৪১])। এটি একটি পুস্তিকা হিশেবে পরে প্রকাশিত হলেও, তিনি এই দীর্ঘ প্রবন্ধের প্রথম কিস্তিটি লিখেছিলেন ‘তরজুমান’ সাময়িকীর মে ১৯৪১ সংখ্যায়; যেখানে ‘জামায়াতে ইসলামী’র গঠনতন্ত্রও প্রকাশিত হয়েছিল। তার লেখা এই প্রবন্ধে মওদূদী যুক্তিবিস্তার করে দেখান যে, কুরআনের ‘প্রামাণিক উদ্দেশ্য’ যদি বুঝতে হয় তাহলে কুরআনের চারটি শব্দের ‘প্রকৃত ও সম্পূর্ণ’ অর্থ অনুধাবন করা খুব গুরুত্বপূর্ণ (কুরআন কি চার বুনিয়াদী ইস্তেলাহে’, ১৯৭৯ [১৯৪১]: ৭)। শব্দ চারটি হল: ইলাহ, রব, ইবাদত এবং দ্বীন। উলামারা কি এই শব্দগুলির ‘প্রকৃত ও সম্পূর্ণ’ অর্থ জানতেন না? মওদূদী দাবী করলেন যে, তারা তা জানতেন না, কারণ কুরআন নাজিল হবার পরে সালাফদের কয়েকটি প্রজন্মের পরে এসবের প্রকৃত অর্থ সম্পর্কে জ্ঞান ও চর্চা হারিয়ে গেছে।
কুরআনের চারটি শব্দের মধ্যে মওদূদী ‘ইলাহ’ শব্দটিকে সবচাইতে গুরুত্বপুর্ণ মনে করতেন। কারণ, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ”—এই কালিমা উচ্চারণের মধ্য দিয়ে একজন মুসলিম হিশেবে গণ্য হন। কালিমাতে উচ্চারিত সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ শব্দটি হচ্ছে ‘আল্লাহ’ যা সবরকম ইলাহকে অস্বীকার করে উচ্চারণ করা হয়। একজন যদি এর প্রকৃত অর্থ না বুঝতে পারে তাহলে তার ইমানের এই শাহাদা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে। মওদূদী ‘পরাবিদ্যাগত’ ও ‘পার্থিব রাজনৈতিক’ জীবনকে দুটি আলাদা মন্ডল হিশেবে চিহ্নিত করলেও, এই দুয়ের সমন্বয়ে একটি অখন্ড ও পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থাকে তার মূল অনুমান হিশেবে গ্রহণ করেছিলেন। একজন মুসলিম হতে হলে একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করতে হবে। এই ইবাদত শুধু পরাবিদ্যাগত মন্ডলের বিষয় নয়, এটি রাজনৈতিক মন্ডলেরও বিষয়; কারণ আল্লাহ এই দুই মন্ডলেরই মালিক। এরই অনুসিদ্ধান্ত হিশেবে মওদূদী দাবী করলেন যে, আল্লাহ রাজনৈতিক মন্ডলেরও ‘শাসক, একনায়ক ও বিধায়ক’ (কুরআন কি চার বুনিয়াদী ইস্তেলাহে, ১৯৭৯ [১৯৪১]: ২৮)। ফলে কেউ যদি একটি দেশের শাসক হিশেবে নিজেকে দাবী করে, তাহলে তার এই দাবী পরাবিদ্যা জগতের ইলাহ হিশেবে দাবী করারও শামিল হবে। কাজেই, মওদূদী ঘোষণা করলেন যে, যে বা যারা আল্লাহর আইনকে অগ্রাহ্য করে—এমন কারো সঙ্গে রাজনৈতিক ক্ষমতা শেয়ার করা মানে হল আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো ইলাহকে ইবাদত করা, যা শিরক করার শামিল (কুরআন কি চার বুনিয়াদী ইস্তেলাহে’, ১৯৭৯ [১৯৪১]: ২৯)।
আল্লাহ শব্দের সহার্থক ‘রব’ শব্দের অর্থ সম্পর্কে বিশদ ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মওদূদী লেখেন যে, এই শব্দটি ‘সার্বভৌমত্ব বা সুলতানি’ শব্দের সমার্থক (কুরআন কি চার বুনিয়াদী ইস্তেলাহে, ১৯৭৯ [১৯৪১]: ৭৯)। তিনি যেহেতু এখানে সার্বভৌমত্বকে রাজনৈতিক পরিভাষায় ব্যাখ্যা করেছেন, তাই তিনি যুক্তি দিলেন যে আল্লাহও একজন ‘রাজনৈতিক রব’ (কুরআন কি চার বুনিয়াদী ইস্তেলাহে, ১৯৭৯ [১৯৪১]: ৭৩)। সুতরাং, কুরআনের আরেকটি শব্দ ‘তাগুত’ মানে কেবল শয়তান বা মূর্তি নয়। এর অর্থ হল আল্লাহর সার্বভৌমত্বের উপরে প্রতিষ্ঠিত নয় এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা। মওদূদী তাগুতের অর্থ আক্ষরিকভাবে কেবল মূর্তি মনে করার জন্য উলামাদের সমালোচনা করেছিলেন। তার কাছে আল্লাহকে ইবাদত ও তাগুতকে প্রতিরোধ করতে কুরআনের যে নির্দেশ রয়েছে—তার অর্থ হল একটি শরিয়া রাষ্ট্র কায়েম করা এবং অনৈসলামী রাজনৈতিক পরিসরকে প্রত্যাখ্যান করা।
আল্লাহকে ‘ইবাদত’ করার অর্থ তার রাজনৈতিক কর্তৃত্বেরও ইবাদত করা। মওদূদী বিলাপ করে লিখেছিলেন যে, মুসলিমেরা ইবাদতের অর্থকে কেবল পরাবিদ্যাগত মন্ডলে আল্লাহর ইবাদতের মধ্যে সংকুচিত করে ফেলেছে; এবং তাদের রাজনৈতিক মন্ডল থেকে আল্লাহর ইবাদতকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দিয়েছে (কুরআন কি চার বুনিয়াদী ইস্তেলাহে, ১৯৭৯ [১৯৪১]: ৮১-৯৮)। অন্যত্র তিনি নামাজের মত ধর্মাচারকে সামরিক প্রশিক্ষণের সমার্থক হিশেবে দেখিয়েছেন এবং এসব ধর্মাচারকে ইসলামী রাষ্ট্রের লক্ষ্য অর্জনের উপায় হিশেবে বিবেচনা করেছেন। তিনি লিখেছেন যে: “নামাজ, রোজা…আসলে…নিশ্চিতভাবে সেই উদ্দেশ্যে [ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমে] পরিচালিত প্রশিক্ষণ” (খুতবাত, ১৯৬৮ [১৯৪০]: ৩১৫)।
মওদূদী ‘দ্বীন’ বা ধর্ম শব্দের ভাষ্যও একইভাবে করেছেন। “[দ্বীন শব্দের অর্থ] একালের রাষ্ট্র শব্দের সমার্থক হয়ে দাড়িয়েছে” (কুরআন কি চার বুনিয়াদী ইস্তেলাহে, ১৯৭৯ [১৯৪১]: ১০৮)। অন্য আরেকটি লেখায় তিনি লিখেছেন যে: “বাস্তবত: দ্বীন শব্দটির অর্থ বর্তমান কালে ‘রাষ্ট্র’ শব্দটির যে অর্থ দাড়িয়েছে তার প্রায় সমার্থক হয়ে গেছে। রাষ্ট্র মানে হল জনগণ দ্বারা একটি উচ্চস্তরের কর্তৃপক্ষকে স্বীকার ও মান্য করা। আর এটিই হল দ্বীন বা ধর্মের সুনির্দিষ্ট অর্থ” (তরজুমান, ফেব্রুয়ারী-মার্চ ১৯৪১: ১৩)। তার চিন্তায় যেহেতু রাষ্ট্র ছিল কেন্দ্রীয় বিষয়, তাই মওদূদী যুক্তিপ্রয়োগ করে প্রস্তাব করলেন যে, “সকল নবী-রাসুলদের দাওয়াতের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল আল্লাহর রাজত্ব কায়েম করা” (তাজদীদ-ও-এহিয়ায়ে দ্বীন, তরজুমানুল কুরআন ১৭, ১৯৪০: ২৮১)। তিনি নবী ইউসুফ আ.-এর দাওয়াতকে মুসোলিনির ‘একনায়কত্বে’র সঙ্গে তুলনা করেছিলেন (তাফহিমাত, ২য় খন্ড, ১৯৯৯ [১৯৩৯]: ১২২)। ইউসুফ আ. যখন মিশরের অমুসলিম রাজার সার্বভৌমত্বের অধীনে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন, তখন এই উদাহরণ দিয়ে দেখানো হয় যে, মুসলিমেরা অমুসলিম রাজনৈতিক পরিসরেও অংশ নিতে পারে। মওদূদী এই অভিমতের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে যুক্তিবিন্যাস করে দেখান যে, ইউসুফ আ. শুধুমাত্র অর্থমন্ত্রী হতে চান নি, বরঞ্চ তিনি সেই রাজত্বের একনায়ক হতে চেয়েছিলেন।
মওদূদীর আরো অনেক তত্ত্বায়নে আধুনিক রাজনীতির প্রতিধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়: যেমন, ইসলামকে একটি আন্দোলন এবং মুসলিমদেরকে একটি দল হিশেবে দেখিয়ে তিনি দুটি ধারণা তৈরি করেছেন। ‘শুদ্ধ’ ইসলামকে উদ্ধার করার লক্ষ্যে তিনি এধরনের উদ্ভাবনাগুলি প্রবর্তন করেছিলেন। পরিস্কারভাবে বলতে গেলে, তার এই শুদ্ধ ইসলামের (আসলি ইসলাম) আহবান ছিল ঐতিহ্যের জায়গায় নব আবিস্কার। মওদূদী কর্তৃক কুরআনের শব্দসমূহের এহেন অভিনব পাঠ সকল ধরনের উলামাকে বিস্মিত ও অভিভূত করেছিল। এদের মধ্যে ছিলেন তার প্রাক্তন সহযোগী এবং দেওবন্দী ধর্মতাত্ত্বিক মোহাম্মদ মনযুর নোমানী (মৃ. ১৯৯৭)। নোমানী মওদূদীর বিরুদ্ধে কুরআনের ‘রাজনৈতিক ভাষ্য’ রচনার অভিযোগ তোলেন এবং বলেন যে, এতে করে মওদূদী কুরআনের অন্যান্য শব্দাবলী সঠিকভাবে বুঝতে পেরেছেন কিনা সে ব্যাপারেও সন্দেহ জাগার যথেষ্ট অবকাশ তৈরি হয়েছে। তিনি মনে করতেন যে, ‘কুরআন কি চার বুনিয়াদী ইস্তেলাহে’ বইটি “ফিতনার দরজা” খুলেছে, “নাস্তিকদের জন্য বৈধতা”র সুযোগ করে দিয়েছে, এবং “ইসলামের একেবারে বুনিয়াদ”কে নাড়িয়ে দিয়েছে। মওদূদী এর কি জবাব দিয়েছিলেন সেটা বেশ তাৎপর্যময়। যখন নোমানী মওদূদীকে জিজ্ঞাসা করলেন যে, তার আগে কি কেউ এসব শব্দের প্রকৃত অর্থ বুঝতে পারেনি, তখন মওদূদী খুব ইন্টারেস্টিংলি বললেন যে, কেবলমাত্র ইবনে তাইমিয়া (মৃ. ১৩২৮) অনেকটা বুঝেছিলেন, কিন্তু এমনকি তিনিও পুরোপুরি সঠিকভাবে এসবের অর্থ বুঝতে পারেন নি (মোহাম্মদ মনযুর নোমানী, মওলানা মওদূদী কে সাথ মেরি রেফাক্বাত কি সারগুজাশত…, ১৯৯৮: ৯৪, ৮৪, ৮৮, ৯০)।
৭.
ব্রিটিশ উপনিবেশিক ভারত রাষ্ট্রটি ছিল সর্বব্যাপী ক্ষমতাশালী। যা বিশ শতকে তর্কসাপেক্ষে ইসলামতন্ত্রের সবচাইতে প্রভাবশালী মতাদর্শিক ভাষ্যকার আবুল আ’লা মওদূদীর রাজনৈতিক ধর্মতত্ত্ব গঠনে নির্ধারক ভূমিকা রেখেছিল। ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমে মওদূদীর আহবান ছিল সুস্পষ্টভাবে একটি আধুনিক বাসনা; কারণ উপনিবেশিক ভারতের নির্বাচনমুখী রাজনীতির পরিসরেই এর উৎপত্তি হয়েছিল। ইসলামের অনন্য ধর্মতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের কারণে ইসলামী রাষ্ট্রের ধারণা ইসলামের মধ্যেই নিহিত ছিল—তা কিন্তু নয়। মওদূদী ইসলামী রাষ্ট্রের ধারণাটি আসলে নতুন করে তৈরি করেছিলেন। আধুনিক রাষ্ট্র অসাধারণ ক্ষমতা ও ব্যাপক সঞ্চারণশক্তির মাধ্যমে জনসাধারণের দৈনন্দিন চর্চাসহ সামষ্টিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিপুল প্রভাব বিস্তার করতে পারে—মওদূদী এই কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাশালী আধুনিক রাষ্ট্রের জায়গায় শক্তিশালী ইসলামী রাষ্ট্রের ধারণাটি তৈরি করেছিলেন।
বিভিন্ন প্রদেশগুলিতে মন্ত্রীসভা গঠনের লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্র ভারতীয় রাজনীতির প্রধান পরিভাষায় পরিণত হয়েছিল। এটি কংগ্রেসের ক্ষেত্রে যেমন কেন্দ্রীয় ছিল, ঠিক তেমনি লীগ এবং বিভিন্ন বাম ধারাগুলির ক্ষেত্রেও একইভাবে কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে উঠেছিল। দক্ষিণ এশীয় ইতিহাসের একটি সংকটকালে যখন রাষ্ট্র পরিভাষাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্লোগান হয়ে উঠেছিল, ঠিক তখনই মওদূদী তার ইসলামী রাষ্ট্রের ধারণাটি উপস্থাপন করেছিলেন। এটা সহজেই বোঝা যায় যে, সে সময়ের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি এক্ষেত্রে একটি প্রধান ভূমিকা রেখেছিল।
কাজেই যারা বলেন যে, ইসলাম প্রথম থেকেই একটি রাষ্ট্র ছিল—তাদের যুক্তিবিন্যাস ভ্রমাত্মক ও অনৈতিহাসিক। তালাল আসাদ লিখেছেন যে, উনিশ শতকে সামাজিক বিজ্ঞানের পরিভাষায় যে অর্থে রাষ্ট্র ধারণাটি প্রচলিত ছিল, ঠিক সেই অর্থে সপ্তম শতক অথবা পরবর্তীকালে আরব উপদ্বীপে কোনো রাষ্ট্রের ধারণা ছিল না (1997: Europe against Islam, Islam in Europe, The Muslim World LXXXVII, 183-95)। ইসলাম শুরু থেকেই রাষ্ট্র ছিল—এই তর্ক করা মানে হল একটি সুনির্দিষ্ট আধুনিক পরিভাষাকে একটি প্রাক-আধুনিক সামাজিক গঠনের উপরে চাপিয়ে দেয়া। বিদ্যাজগতের বিভিন্ন শৃঙ্খলাতে ব্যাপকভাবে প্রচলিত এই অধিপতি অনুমানটিও একইভাবে বিভান্তিকর যে, ইসলামের কথিত ‘ধর্মতাত্ত্বিক’ চরিত্রের কারণেই এখানে ধর্ম ও রাজনীতির মিশ্রণ ঘটাটা অনিবার্য। কিন্তু ভারতে মুসলিম শাসনের বাস্তব ইতিহাসে এর সমর্থন পাওয়া যায় না। মুঘল সাম্রাজ্য আসলে ছিল একটি ‘ধর্মমুখী সেক্যুলার রাষ্ট্র’ (‘religion-oriented secular state’), কিন্তু কোনোক্রমেই ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ কিংবা উলামা শাসিত ধর্মতান্ত্রিক (Theocratic) রাষ্ট্রও নয়। ধর্ম ও রাষ্ট্রের এমনি পার্থক্য বজায় রাখার দীর্ঘ প্রেক্ষাপটে মওদূদী রাষ্ট্র ও ইসলামের সংমিশ্রণের তর্কটি তুলেছিলেন। তিনি এই তর্কটি তুলেছিলেন, কারণ তিনি দেখতে পেয়েছিলেন যে, উপনিবেশিক রাষ্ট্র একটি সর্বদর্শী ও সর্বশক্তিমান (Panoptic and Omnipotent) প্রতিষ্ঠান আকারে উত্থিত হয়ে জনসাধারণের জীবনযাত্রার প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করছিল।
রাষ্ট্র ও ইসলামের গতিষ্মান সম্পর্ক নিয়ে প্রচলিত ধারণাগুলির পর্যালোচনামূলক পুনর্চিন্তা করতে হবে। ইসলাম ও রাজনীতির সম্পর্ক প্রসঙ্গে কেবলমাত্র কিতাবী হরফি পাঠ নয় বরং সংশ্লিষ্ট সমাজ ও ইতিহাসের আনুভূমিক ও বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। মওদূদীর ‘কুরআন কি চার বুনিয়াদী ইস্তেলাহে’ শীর্ষক চাবি-গ্রন্থে যেভাবে রূপায়িত হয়েছে, তার আলোকে বলা যায় যে, তার রাজনৈতিক ধর্মতত্ত্বের কেন্দ্রে ছিল কেবল ধর্মগ্রন্থের পাঠ নয়, বরঞ্চ সেখানে ছিল, আরো গুরুত্ব সহকারে, আধুনিক উপনিবেশিক রাষ্ট্র কাঠামোর সেই বৃহত্তর মর্মভূমি যা জনসাধারণের সামাজিক-রাজনৈতিক জীবনে অসাধারণভাবে প্রভাব ফেলে। মওদূদীর ইসলামতন্ত্র ও তার ইসলামী রাষ্ট্র ধারণার আবিস্কারকে বোঝা মানে হল আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের জটিল মর্মভূমি উন্মোচিত ও উন্মুক্ত করা। দক্ষিণ এশিয়ার উপমহাদেশীয় প্রেক্ষাপটে মওদূদী তার রাজনৈতিক সক্রিয়তা ও লেখালেখির মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্রের ধারণা আবিস্কার করতে গিয়ে কিভাবে শুধু কিতাবী হরফে নিজের দৃষ্টি নিবদ্ধ না করে তার সমকালীন উপনিবেশিক ইতিহাস, সমাজ ও রাষ্ট্রকে নৃতাত্ত্বিক ও সমাজবিদ্যার বিভিন্ন আঙ্গিকে পুনর্পাঠ ও পুনর্চিন্তা করেছিলেন—তা যেমন একদিকে শিক্ষণীয় তেমনি অন্যদিকে পর্যালোচনাযোগ্য, নিঃসন্দেহে।
৮.
মার্কস ও মওদূদী: একটি প্রতিতুলনা:
আবুল আ’লা মওদূদী (১৯০৩-১৯৭৯) বিশ শতকে, খুব সম্ভবত, ইসলামের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক চিন্তক ছিলেন। দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশ, আরব বিশ্ব এবং পাশ্চাত্যে মুসলিম অধিবাসীদের মধ্যে তার ইসলামভাষ্যের ব্যাপক প্রভাবের কথা বিবেচনায় নিয়ে একথা বলা যেতে পারে। একথা ঠিক যে, তার ইসলামের রাজনৈতিক ভাষ্য প্রায় সব রকমের মুসলিম সমাজেই ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে। কেউ কেউ এমনও বলেছেন যে, রাজনৈতিক ইসলামের ক্ষেত্রে মওদূদী তা-ই হয়েছেন যা কমিউনিজমের ক্ষেত্রে কার্ল মার্কস হয়েছিলেন (Nadeem F. Paracha, Abul A’la Maududi: An Existentialist History, Dawn, January 1, 2015)। এই তুলনা রাজনৈতিক ইসলাম বিষয়টিতে তার গুরুত্ব ও প্রভাবের চারিত্র যথার্থভাবে বোঝার জন্য জরুরী।
মওদূদী বুঝতে পেরেছিলেন যে, ইসলামের শ্রেয়ত্বকে যদি ধরে রাখতে হয়, তাহলে একে আর শুধুমাত্র একটি আধ্যাত্মিক বিশ্বাস আকারে উপস্থাপন করলে যথেষ্ট ফল পাওয়া যাবে না। বিগত কয়েক শতকে পাশ্চাত্যে যেসব সামাজিক-রাজনৈতিক ভাবধারার উত্থান হয়েছে, সেগুলি বিবেচনায় নিতে হবে। তিনি নিজে তার কাঁধে এসব নতুন ধ্যান-ধারণা পাঠের দায়িত্ব তুলে নিয়েছিলেন। এই ধ্যান-ধারণাগুলি উপমহাদেশের মুসলিম সামাজিক-রাজনৈতিক জ্ঞানবৃত্তে ধীরে ধীরে তাদের পথ খুঁজে নিচ্ছিল। আর এসব সম্পর্কে ঐতিহ্যবাদী উলামারা ছিলেন যারপরনাই বেখবর এবং বেখেয়াল; যা মওদূদীকে বিচলিত ও উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল। তিনি উলামাদের এই মনোভাবকে রীতিমত অপছন্দ করতেন এবং এসবের চর্চায় নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন। একজন লেখক লিখেছেন যে, তিনি যখন একদিন মওদূদীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন, তখন তিনি দেখতে পেয়েছিলেন যে, মওদূদী একগাদা ইংরেজী বইয়ের মধ্যে বসে আছেন। আর এসব বইয়ের অধিকাংশই ছিল কমিউনিস্ট ঘরানার (এই উক্তিটি করেছেন মাহিরুল কাদরী, দেখুন 1996: Seyyed Vali Reza Nasr, Mawdudi and the Making of Islamic Revivalism, p. 33)।
এ থেকে বোঝা যায় যে, কেন মওদূদীর করা ইসলামের রাজনৈতিক ভাষ্যে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের এত সাদৃশ্য রয়েছে। তিনি দৃশ্যত কমিউনিজমকে অপছন্দ করতেন, কিন্তু কমিউনিস্ট অনেক ধ্যান-ধারণা তার উপরে পরোক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল। আর এই প্রভাব তার কৃত ইসলামের রাজনৈতিক ব্যাখ্যার বিভিন্ন স্থানে রেখাপাত করেছে। এরই প্রভাবে তিনি তার ইসলামী রাজনৈতিক দলটি গঠন করেছিলেন এবং ভবিষ্যত ইউটোপিয়ান ইসলামী সমাজের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন।
সমগ্রবাদী (Totalitarian) দুটি প্রকরণ হল সমাজতন্ত্র এবং ফ্যাসিবাদ; এই দুই প্রকরণেই মানবগোষ্ঠীর একটি নির্বাচিত অংশকে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার অধিকারসম্মত উত্তরাধিকারী গণ্য করা হয়। সমাজতন্ত্রের বলশেভিক আঙ্গিকে এই অধিকার দেয়া হয়েছিল কথিত ‘প্রগতিশীল’ অথবা ‘অগ্রবর্তী’ (Vanguard) দলকে অর্থাৎ বলশেভিক পার্টিকে। আর ফ্যাসিবাদের ক্ষেত্রে একটি উচ্চমন্য জাতি কিংবা বর্ণ এই ‘স্বাভাবিক’ অধিকারের দাবীদার হয়েছিল। এই দুই সমগ্রবাদী কল্পরাষ্ট্র বা টোটালিটারিয়ান ইউটোপিয়ার সঙ্গে মিল রেখে মওদূদী তার নিজের ইসলামি রাজনৈতিক দলটিকে ইসলামি বিপ্লবের ‘অগ্রবর্তী’ দল হিশেবে দেখতেন। তিনি দাবী করতেন যে, ইউরোপের সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রবণতাগুলির প্রতি তিনি বিতৃষ্ণ ছিলেন; অথচ ইউরোপের একটি উদ্ভাবনার প্রতি ছিল তার অনেক ঋণ, আর সেটি হল: সমগ্রবাদ (Totalitarianism)।
কিন্তু, একথা আবার মনে রাখা দরকার যে, মওদূদীর বিপ্লব বা ইনকিলাব মানে কোনো সশস্ত্র বিদ্রোহ অথবা সশস্ত্রতার কোনোরকম প্রকরণই নয়। তিনি, বরঞ্চ, এমন একটি স্বচ্ছন্দ সামাজিক-সাংস্কৃতিক রূপান্তরে বিশ্বাসী ছিলেন যা একপর্যায়ে একটি আদর্শিক সমাজে উত্তীর্ণ হবে। এদিক থেকে তার সঙ্গে ইরানের আয়াতুল্লাহ খোমেনী এবং মিশরের সাইয়েদ কুতুবের বেশ কিছুটা ভিন্নতা ছিল। যদিও ঐ দুজনই মওদূদীর রচনা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন বলে মনে করা হয়।
মওদূদীর এই পদ্ধতির সঙ্গে মার্কসের সমাজতন্ত্রে উপনীত হবার বিবর্তনমূলক পদ্ধতির বেশ খানিকটা মিল দেখতে পাওয়া যায়। মার্কস যেভাবে ঐতিহাসিক নির্ধারণবাদ (Determinism) সূত্রের উপরে নির্ভর করে ভবিষ্যত প্রস্তাব করেছিলেন (যা বাস্তবে সেভাবে এখনো ঘটেনি) যে, পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার সম্যক পরিণতিই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে পুষ্ট করে তুলবে, অনেকটা সেভাবে মওদূদী অনুমান করেছিলেন যে, আধুনিক জাহেলিয়াতের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ উপায়ে লড়াই করে ইসলামি দল ও আন্দোলন একটি মৌলিক সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক রূপান্তর ঘটিয়ে ইসলামি ইউটোপিয়া হিশেবে ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম করবে। ফলে, এটা সত্য যে, বিগত কয়েক দশকের জিহাদী চরমপন্থা মওদূদীর চাইতে সাইয়েদ কুতুব কিংবা তার অনুসারীদের (যেমন আইমান আল জাওয়াহারী প্রমুখ) দ্বারা বেশি প্রভাবিত হয়েছে; তা সত্ত্বেও মওদূদীই এখনো মুখ্য মতাদর্শিক ভাষ্যকার হিশেবে রয়েছেন, যিনি খুব সঙ্গতিপূর্ণ উপায়ে ইসলামের রাজনৈতিক চিন্তাকে উপস্থাপন করেছেন।
৯.
মওদূদীর ইসলামভাষ্যের পর্যালোচনা: উপমহাদেশে ইসলামতন্ত্র থেকে উত্তর-ইসলামতন্ত্রের অভ্যূত্থান:
আবুল আ’লা মওদূদী (১৯০৩-১৯৭৯) পাশ্চাত্য দর্শন এবং রাষ্ট্রচিন্তা গভীরভাবে পাঠ করেছিলেন। এই বিষয়ে তিনি বিশ শতকের তিরিশের দশকে বেশ কয়েকটি নিবন্ধ লিখেছিলেন; যা ১৯৩৯ সালে ‘তানকীহাত’ নামে সংকলিত হয়ে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। এই নিবন্ধগুলি পড়লে বোঝা যায় যে, তিনি পাশ্চাত্য চিন্তার প্রতি কোনোরকম বিদ্বেষ বা বিপক্ষপাত হেতু সেসব খুব একটা বিকৃতভাবে পাঠ করেন নি; বরঞ্চ সেসব তিনি অবিকল যেভাবে পেয়েছেন সেভাবেই অধ্যয়ন ও অনুধাবন করেছিলেন। তিনি খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্বের কয়েকটি প্রবণতা সম্পর্কে আলোচনা করে ইউরোপীয় রেনেসাঁ ও এনলাইটেনমেন্ট থেকে যে দর্শনের উৎপত্তি হয়েছিল সেদিকে মনোনিবেশ করেছিলেন। তার রচনায় তিনি পাশ্চাত্যের অনেক চিন্তকদের উপরে আলোচনা করেছেন, যেমন বেকন, দেকার্ত, হিউম, লক, বার্কলে, কান্ট এবং আরো অনেকে। এই কারণে এতে অবাক হবার কিছু নেই যে, মওদূদী তরুণ মুসলিমদের একটা বড় অংশ, যারা আধুনিক শিক্ষাসূত্রে এইসব ধ্যান-ধারণার সঙ্গে কমবেশি পরিচিত ছিল, তাদেরকে আকর্ষণ করতে দারুণভাবে সফল হয়েছিলেন।
মওদূদীর রচনাবলীর দিকে খেয়াল করলে এটা পরিস্কার হয়ে যায় যে, তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে একটি সংঘাত দেখতে পেয়েছিলেন। এই দুই সভ্যতা যে পরস্পরের কাছাকাছি আসতে পারবে না—এ ব্যাপারে তার কোনো সন্দেহ ছিল বলে মনে হয় না। কিন্তু মজার ব্যাপার হল—তিনি এই দুই সভ্যতার দ্বন্দ্ব-সংঘাত উপস্থাপন করতে গিয়ে যে পশ্চিমা সভ্যতার তীব্র সমালোচনা করেছিলেন—সেই সভ্যতা থেকে কিছু কিছু পরিভাষা এবং ধ্যান-ধারণার সাহায্য নিয়েই তিনি তা করেছিলেন।
তিনি যখন ১৯৪১ সালে ‘জামায়াতে ইসলামী’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তখন প্রথমদিকে প্রথাগত উলামাদের বেশ কয়েকজন এই দলে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু এদের মধ্যে কেউ কেউ তার অতিরাজনীতিকৃত ইসলামভাষ্যের প্রতি ভিন্নমতের কারণে পরবর্তীকালে দল ছেড়ে চলে গিয়েছেন। একজন প্রখ্যাত দেওবন্দী আলেম মনযুর নোমানী (মৃ. ১৯৯৭) মনে করতেন যে মওদূদী ইসলামকে অনেকটা রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের একটা বিষয়ে নামিয়ে এনেছেন। এতে করে ইসলামের আধ্যাত্মিক ও নাজাতী অনুষঙ্গগুলির গুরুত্ব অনেক কমে গিয়েছে। মওদূদী ইসলাম ধর্মকে যেন একটি ‘ইজম’ বানিয়ে ফেলেছেন যার সঙ্গে ‘ন্যাশনালিজম’, ‘ফ্যাসিজম’ অথবা ‘কমিউনিজম’-এর মিল রয়েছে। (মনযুর নোমানীর এই অভিমতের জন্য দেখুন, 1996: Seyyed Vali Reza Nasr, Mawdudi and the Making of Islamic Revivalism, p. 114)। আরেকজন প্রসিদ্ধ আলেম আবুল হাসান আলী নদভী (মৃ. ১৯৯৯) অভিমত প্রকাশ করেছিলেন যে: “ধর্মতন্ত্র বা থিওক্র্যাসিতে কুরআনের ওহির মূল লক্ষ্য আধ্যাত্মিকতা আর বজায় থাকে না” (আবুল হাসান আলী নদভীর এই উক্তির জন্য দেখুন, 1996: Seyyed Vali Reza Nasr, Mawdudi and the Making of Islamic Revivalism, p. 62)।
মওদূদীর ইসলামভাষ্যের সবচাইতে উল্লেখযোগ্য খন্ডন যারা করেছেন তারা একসময় তার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং অনুসারী ছিলেন। দুজন বিদ্বান এক্ষেত্রে সবার উপরে স্থান পেতে পারে: এদের একজন হলেন হিন্দুস্তানের ওয়াহিদউদ্দীন খান (১৯২৫-২০২১) এবং আরেকজন হলেন পাকিস্তানের জাভেদ আহমদ ঘামিদী (জন্ম ১৯৫১)।
মওদূদীর আন্দোলন ওয়াহিদউদ্দীন খানকে অনুপ্রাণিত করেছিল এবং তিনি ১৯৪৮ সালে ‘জামায়াতে ইসলামী হিন্দ’-এ যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি অল্পকাল পরেই মওদূদীর ইসলাম বয়ানের মধ্যে বিস্তর রাজনৈতিক ভাষ্য চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, মওদূদী যেহেতু পশ্চিমা সমগ্রবাদ (Totalitarianism) ব্যাপকভাবে পাঠ করেছেন, সেহেতু অনেক বহিরাগত প্রভাব তার ইসলাম বোঝাপড়ার মধ্যে ঢুকে পড়েছে। এই প্রেক্ষিতে ওয়াহিদউদ্দীন ইসলামের রাজনৈতিক ভাষ্যকার মওদূদী এবং আরো বেশ কয়েকজন উর্ধ্বতন সহযোগীদের সঙ্গে চিঠি ও অন্যান্য উপায়ে প্রায় দুই বছর যোগাযোগ করতে লাগলেন। কিন্তু ওয়াহিদউদ্দীন এদের কারো কাছ থেকেই যথেষ্ট সন্তোষজনক কোনো জবাব পাননি বলে মনে করেছিলেন। কাজেই, প্রায় ১৫ বছর দলে থাকবার পরে ১৯৬২ সালে তিনি দলত্যাগ করেন। এই অসন্তোষ নিয়ে তিনি এরপরে ১৯৬৩ সালে উর্দু ভাষায় একটি বই লেখেন; যার নাম ছিল ‘তা’বির কি গলতি’ (বাংলা ও ইংরেজীতে যার অর্থ দাঁড়ায় যথাক্রমে ‘ভাষ্যের ভুল’ বা ‘The Error of Interpretation’)। অপেক্ষাকৃত বিস্তারিত এই বইটির একটি উর্দু সারাংশ প্রকাশিত হয়েছে ১৯৮৫ সালে ‘দ্বীন কি সিয়াসী তা’বির’ (‘দ্বীনের রাজনৈতিক ভাষ্য’) নামে। এর একটি ইংরেজী অনুবাদ বেরিয়েছে ‘The Political Interpretation of Islam’ নামে ২০১৫ সালে।
এই বইতে ওয়াহিদউদ্দীন খান বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছেন যে, কিভাবে মওদূদীর রাজনীতি-কেন্দ্রিক বিশ্ববীক্ষা তার ইসলামভাষ্যে ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে। কার্ল মার্কসের (১৮১৮-১৮৮৩) করা কমিউনিজমের অর্থনীতিবাদী ভাষ্যের সঙ্গে তুলনা করে ওয়াহিদউদ্দীন খান লিখেছেন যে, মওদূদী “ইসলামকে এমনভাবে দেখিয়েছেন যে মনে হয় যেন ইসলামের প্রত্যেকটি দিকের রয়েছে একটি করে রাজনৈতিক রূপ। ফলে মওদূদীর মতাদর্শকে দ্বীন অথবা ইসলাম ধর্মের রাজনৈতিক ভাষ্য বলা যেতে পারে” (2015 [1963]: Maulana Wahiduddin Khan, The Political Interpretation of Islam, p. 10)। তাহলে দেখা যাচ্ছে মার্কস যেমন কমিউনিজমের একটি অর্থনীতিবাদী ভাষ্য রচনা করেছিলেন, ঠিক তার সঙ্গে তুলনীয়ভাবে মওদূদী ইসলামের একটি রাজনীতিবাদী ভাষ্য তৈরি করেছিলেন।
মার্কসের করা ইতিহাসের বস্তুবাদী ভাষ্যে মানব ইতিহাস ও কৃষ্টির বোঝাপড়াতে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে শ্রেণি সংগ্রামের। যারা মার্কসিস্ট নন এমন অনেকেই হয়তো এটা মেনে নেবেন যে, সামাজিক সংগ্রাম ও সংঘাতমুখী স্বার্থ যে কোনো মানব সমাজকে বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আবার এদের অনেকেই হয়তো মার্কসের মতো এতটা সহজে মানতে চাইবেন না যে, আইন-কানুন, ধর্ম, দর্শন অথবা কৃষ্টিসহ অন্যান্য উপাদানের ইতিহাসে কোনো স্বতন্ত্র ভূমিকা নেই; ইতিহাস যেন কেবলই শুধু উৎপাদন সম্পর্কের ইতিহাস। ওয়াহিদউদ্দীন খান মনে করতেন যে, মওদূদী, পাশ্চাত্যের কয়েকটি পূর্বোল্লিখিত সেক্যুলার মতাদর্শ দ্বারা অলক্ষ্যে এতটাই প্রভাবিত হয়েছিলেন যে, তিনি ইসলাম ধর্মের ভাষ্য রচনা করতে গিয়ে মার্কসের মত ইসলামের একটি বিশেষ দিকের উপরে বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন। রাজনীতি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষঙ্গ এতে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু তাই বলে এটি সবকিছুকে ছাপিয়ে তার ইসলামভাষ্যকে রাঙিয়ে দিলে তা আর ভারসাম্যপূর্ণ থাকে না। তার বইয়ে ওয়াহিদউদ্দীন অনেক দৃষ্টান্ত দিয়ে দেখিয়েছেন যে মওদূদী অনেক ক্ষেত্রে ইসলামের প্রতিষ্ঠিত বোঝাপড়া থেকে শুধু বিচ্যুতই হননি, তিনি বরঞ্চ দ্বীনকে শেষমেশ একটি রাজনৈতিক প্রপঞ্চে রুপান্তর করে ফেলেছেন।
১০.
মওদূদীর যুক্তি ও ওয়াহিদউদ্দীনের প্রতিযুক্তি: উপমহাদেশে ইসলামতন্ত্র থেকে উত্তর-ইসলামতন্ত্রের অভ্যূত্থান:
ওয়াহিদউদ্দীন খান (১৯২৫-২০২১) ১৯৬৩ সালে উর্দু ভাষায় ‘তা’বির কি গলতি’ নামক বইটি লেখেন। এই বইতে তিনি মওদূদীর ইসলামভাষ্য সম্পর্কে তার অনুধাবন, পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন উপস্থাপন করেন। ‘জামায়াতে ইসলামী হিন্দ’-এ দীর্ঘ ১৫ বছর অবস্থান করে তিনি যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন তার সাপেক্ষে তিনি মওদূদীর যুক্তিতর্কের একপেশে রাজনীতিকতা চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। বিষয়টি তাকে ভাবিয়ে তুলেছিল। তিনি তার পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন নিয়ে মওদূদীসহ আরো অন্যান্য উর্ধ্বতন নেতৃবৃন্দের সঙ্গে পত্রযোগাযোগ ছাড়াও বিভিন্নভাবে যোগাযোগ করেছিলেন। কিন্তু কোনো সন্তোষজনক জবাব না পেয়ে তিনি ১৯৬১ সালে দলত্যাগ করে চলে যান। এর দুই বছর পরে ১৯৬৩ সালে তিনি তার পর্যালোচনা লিখিতভাবে বই আকারে প্রকাশ করেন। উর্দু ভাষায় লেখা মূল এই বইটির একটি সারসংক্ষেপ ‘দ্বীন কি সিয়াসী তা’বির’ (দ্বীনের রাজনৈতিক ভাষ্য) নামে ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। যার একটি ইংরেজী অনুবাদও প্রকাশিত হয়েছে ২০১৫ সালে ‘The Political Interpretation of Islam’ নামে। ওয়াহিদউদ্দীন খান নিজেই সহজবোধ্য ভাষায় এই ইংরেজী অনুবাদটি করেছেন।
সর্বমোট ৭২ পৃষ্ঠার এই বইটিতে রয়েছে ৬টি অধ্যায়। প্রথম ৪টি অধ্যায়ে মওদূদীর ইসলামভাষ্যের বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক যুক্তিতর্ক ও প্রস্তাবনা নিয়ে ওয়াহিদউদ্দীন খান তার মূল খন্ডনমূলক প্রতিযুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেছেন। ৫ম অধ্যায়ে তিনি মওদূদীর ইসলামভাষ্যের একরৈখিক রাজনৈতিকতা কি কি নেতিবাচক ফলাফল বয়ে এনেছে তা সম্পর্কে একটি সার্বিক বক্তব্য দিয়েছেন। আর শেষ ৬ষ্ঠ অধ্যায়ে তিনি তার এই পুরো অভিজ্ঞতাটির একটা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা হাজির করেছেন এবং আবেগী ভাষায় এর নিষ্পত্তির ভার অনাগত ইতিহাসের উপরেই অর্পণ করেছেন।
নির্মোহ ও নিরাসক্ত দৃষ্টিতে তানকীদ বা পর্যালোচনার ঐতিহ্য এই উপমহাদেশে অত্যন্ত বিরল বলা যায়। একদিকে পীর-মুরিদ গদগদ ভক্তি আর অন্যদিকে আকাবিরদের তাকলীদের ঐতিহ্য এখানে মূলধারা হয়ে গেছে। এই তানকীদ বা পর্যালোচনাহীন সংস্কৃতিতে মওদূদীর ইসলামভাষ্য সম্পর্কে ওয়াহিদউদ্দীন খানের খন্ডনমূলক প্রতিতর্ক একটি ব্যতিক্রমী বুদ্ধিবৃত্তিক যোজনা। ষাটের দশকে যখন মওদূদীর মতাদর্শ অপেক্ষাকৃত নতুন এবং উপমহাদেশ ও মুসলিম বিশ্বের অন্যত্র প্রচারিত ও প্রসারিত হচ্ছিল, ঠিক সেই সময়েই ওয়াহিদউদ্দীন খান যে এর দুর্বলতাকে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন—এতে তার তীক্ষ্ণ মেধা ও বিচার শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়।
ওয়াহিদউদ্দীন খান পরবর্তীকালে স্বাধীন হিন্দুস্তানের মুসলিমদের সংখ্যালঘিষ্ঠ বাস্তবতার সাপেক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়সহ সবরকমের অমুসলিমদের সঙ্গে শান্তি, অহিংসা ও সহাবস্থানের যে আদর্শ ও চর্চার কথা বলে গেছেন—সে সম্পর্কেও অনেকে অনেক সমালোচনা করেছেন এবং করবেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এতে করে তার দ্বারা মওদূদীর ইসলামভাষ্যের সমস্যা চিহ্নিতকরণের কৃতিত্ব কোনোভাবে বাতিল হয়ে যায় না। চিন্তার ইতিহাসকে যারা প্রাপ্তবয়স্কের মত কেবল চিন্তার উৎকর্ষ বা অপকর্ষ দিয়ে মূল্যায়ন ও বিচার করবেন—তারা একথা স্বীকার করতে কুণ্ঠিত হবেন না। আর যারা দলীয় মোহ, মতাদর্শিক একরৈখিকতা এবং নেতৃত্বের কারিশমার মন্ত্রমুগ্ধতায় তাদের বিচারবুদ্ধিকে শিকেয় তুলে রেখে চলতে চান—তারা খুব বেশিদিন তাদের এই অন্ধ অনুচর্চা চালিয়ে যেতে পারবেন না। সাফল্য তো আসবেই না, বরং স্থবির অহমিকাপূর্ণ স্থিতাবস্থায় আটকে থাকবে তারা।
১১.
মওদূদীর যুক্তি ও ওয়াহিদউদ্দীনের প্রতিযুক্তি: উপমহাদেশে ইসলামতন্ত্র থেকে উত্তর-ইসলামতন্ত্রের অভ্যূত্থান:
ওয়াহিদউদ্দীন খান তার উর্দু বই ‘তা’বির কি গলতি’ (১৯৬৩)-র ইংরেজী সারাংশ ‘The Political Interpretation of Islam’ গ্রন্থের ৩য় অধ্যায় ‘Maulana Maududi’s Writings’-এর ৩০ পৃষ্ঠা থেকে প্রাসঙ্গিক অনুচ্ছেদের বাংলা অনুবাদ পেশ করছি। এখানে বেশ কয়েকটি পর্বে প্রথমে মওদূদীর কিছু চুম্বক যুক্তিতর্ক উদ্ধৃত হবে; তার পরে সেসব বক্তব্য সম্পর্কে ওয়াহিদউদ্দীনের খন্ডনমূলক প্রতিযুক্তি উপস্থাপিত হবে। পাঠকদেরকে ধৈর্য ধরে পড়ে যেতে অনুরোধ করছি। এই পর্বগুলি পড়া শেষে এই দুজন মেধাবী ও ধারালো চিন্তকের চিন্তাপ্রণালী সম্পর্কে বেশ খানিকটা জানতে পারবেন আশা করি:
“মওলানা মওদূদী তার ‘তেহরিকে ইসলামী কি আখলাকী বুনিয়াদে’ (ইসলামী আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি) গ্রন্থে প্রস্তাব করেন যে, “আমাদের সংগ্রামের চূড়ান্ত লক্ষ্য হল রাজনৈতিক নেতৃত্বে পরিবর্তন নিয়ে আসা”। তিনি এর ব্যাখ্যা করলেন এভাবে যে, “এর অর্থ হল: আমরা এই দুনিয়াতে যে শেষ লক্ষ্য অর্জন করতে চাই, তা হল আল্লাহহীন ও অনৈতিক শাসনের অবসান এবং ধার্মিক নেতৃত্বের উপরে গঠিত একটি ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা। আমরা এই ব্যবস্থাকে এই দুনিয়া এবং আখিরাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের একটি পন্থা বলে গণ্য করি।“ তিনি লিখেছেন যে, “এটা হল তাই যাকে আমরা আমাদের লক্ষ্য বানিয়েছি.” তিনি এই বাস্তব তথ্যটি বলতে গিয়ে ব্যথিত হয়েছিলেন যে, অনেক মুসলিম ‘দ্বীনের তাৎপর্য বিষয়ক এই সমস্যার গুরুত্ব’ সম্যক উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হচ্ছে। তিনি প্রস্তাব করেছিলেন যে, মানবিক বিষয়াবলীতে অগ্রগতি ও অবক্ষয়ের ‘শেষ ভিত্তি’ কি সেটা কে রাজনৈতিক ক্ষমতা ধারণ করে আছে—সেই প্রশ্নের উত্তরের উপরে নির্ভর করে। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, এমন ক্ষমতা ছাড়া দ্বীনের মৌলিক উদ্দেশ্য অর্জন করা অসম্ভব। এবং, সুতরাং, এই কারণে, তিনি অভিমত দিয়েছিলেন যে, ‘ধার্মিক নেতৃত্ব’ (ইমামাতে সালেহ) ও ‘দিব্য ব্যবস্থা’ (নিজামে হক) প্রতিষ্ঠা সর্বোচ্চ গুরুত্ব বহন করে। তিনি প্রস্তাব করলেন যে, “যদি এই বিষয়ে কোনো রকমের অবজ্ঞা করা হয়, তাহলে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য একজনের কাছে আর কোনো কিছু অবশিষ্ট থাকবে না।“ তিনি আরো বলেন যে, “ধার্মিক নেতৃত্ব এবং দিব্য ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা এবং বজায় রাখা হল দ্বীনের সতিকারের উদ্দেশ্য।“ তিনি লিখলেন যে, “ইসলাম অনুযায়ী ধার্মিক নেতৃত্বের প্রতিষ্ঠা কেন্দ্রীয় ও মৌলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ”; এর সঙ্গে আরো যোগ করলেন যে, “আমার মত অনুযায়ী এটাই হল আল্লাহর কিতাবের দাবী। এটাই নবীদের চর্চা (সুন্নাহ)। এবং আমি এই বিষয়ে আমার মতের পরিবর্তন করতে পারবো না, যদিনা কেউ আমার কাছে আল্লাহর কিতাব এবং নবী স.-এর সুন্নাহ থেকে প্রমাণ করে যে, দ্বীনের দাবী এমন নয়।“
একইভাবে ‘জামায়াতে ইসলামী’র গঠনতন্ত্র ঘোষণা করছে যে: “’জামায়াতে ইসলামী’র উদ্দেশ্য ও এর সকল প্রচেষ্টার লক্ষ্য হল এই দুনিয়াতে দিব্য সরকারের প্রতিষ্ঠা এবং আখিরাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা।“
১২.
মওদূদীর যুক্তি ও ওয়াহিদউদ্দীনের প্রতিযুক্তি: উপমহাদেশে ইসলামতন্ত্র থেকে উত্তর-ইসলামতন্ত্রের অভ্যূত্থান:
দ্বীন ইসলামের বোঝাপড়া:
“মওলানা মওদূদী যেভাবে দ্বীনের ভাষ্য রচনা করেছেন তার রাজনৈতিক চরিত্র পরবর্তী অনুচ্ছেদ থেকে স্পষ্ট বোঝা যাবে। এই অনুচ্ছেদটি নেয়া হয়েছে তার ‘মুসলমান আওর মওজুদা সিয়াসি কাশমাকাশ’ (‘মুসলিম ও সমকালীন রাজনৈতিক সংগ্রাম’) গ্রন্থ থেকে:
দ্বীন শব্দটির অর্থ বর্তমান কালে ‘রাষ্ট্র’ শব্দটির প্রায় সমার্থক হয়েছে। জনসাধারণ কর্তৃক কোনো এক উর্ধ্বতন ক্ষমতাকে মেনে নেওয়া ও তার প্রতি অনুগত থাকা—এটাই হল ‘রাষ্ট্র’। এবং সত্যিকারের দ্বীন (দ্বীনে হক) হল মানুষ কর্তৃক অন্য মানুষের প্রতি দাসত্ব ও আনুগত্য এবং নিজস্ব অহংবোধ ও সকল সৃষ্ট সত্তার প্রতি একই মনোভাব পরিত্যাগ করা, এবং সবচাইতে উর্ধ্বতন ক্ষমতাকে স্বীকার করা এবং তার সেবক হওয়া ও আনুগত্য করা।
মওলানা মওদূদী লিখলেন যে, নবী একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থা ‘তার প্রেরকের কাছ থেকে নিয়ে এসেছিলেন’ যেখানে জনসাধারণের স্বাধীন কর্তৃত্বের কোনোরকম পরিসর ছিল না এবং কিছু মানুষ অন্যদের উপরে শাসন করবে তারও অনুমোদন ছিল না। বরঞ্চ, তিনি যোগ করলেন যে, ‘শাসক-পদ এবং সবচাইতে উর্ধ্বতন ক্ষমতা সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর’।
নবুয়াত:
দ্বীনের রাজনৈতিক ভাষ্য আল্লাহ কর্তৃক এই দুনিয়াতে নবীদের প্রেরণকে একটি বিশেষ রাজনৈতিক আলোকে উপস্থাপন করে। কাজেই, তার ‘তাজদীদ-ও-ইহইয়ায়ে দ্বীন (‘দ্বীনের নবায়ন ও পুনর্জীবন’) গ্রন্থে নবীদের আগমনের উদ্দেশ্য আলোচনা করে মওলানা মওদূদী লেখেন:
নবীদের (যাদের উপরে শান্তি বর্ষিত হোক) এই দুনিয়াতে আগমনের সর্বোচ্চ উদ্দেশ্য হল দিব্য সরকার এবং আল্লাহর কাছ থেকে যে জীবন ব্যবস্থা তারা নিয়ে এসেছেন তা প্রতিষ্ঠা করা।
তারা যেসকল মানুষেরা অজ্ঞতা অনুসরণ করত (আহলে জাহিলিয়া) তাদেরকে তাদের অজ্ঞ বিশ্বাসের প্রতি অনুগত থাকার অধিকার দিতে রাজী ছিলেন এবং যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের কর্মকান্ডের প্রভাব কেবল তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতো ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের এই অজ্ঞতার পথ অনুসরণের সুযোগ দিতেন।
কিন্তু তারা তাদেরকে সেই অধিকার দিতে রাজী ছিলেন না—এবং, খুব স্বাভাবিকভাবেই, তারা তাদেরকে এই অধিকার দিতে পারতেন না—যে ক্ষমতার দন্ডটি তাদের হাতে থাকবে এবং তারা মানব বিষয়াবলী নিজেরাই তাদের অজ্ঞতা (জাহিলিয়াত) ভিত্তিক আইন-কানুন দিয়ে চালাবে। এই কারণে সকল নবীরা একটি রাজনৈতিক বিপ্লবের (সিয়াসি ইনকিলাব) জন্য প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। কয়েকজনের ক্ষেত্রে তাদের প্রচেষ্টা শুধু মাঠ প্রস্তুতি পর্যন্ত ছিল—উদাহরণস্বরূপ, নবী ইব্রাহীম (আ.)। কয়েকজন বাস্তব চর্চায় বিপ্লবী আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন, কিন্তু তাদের কাজ দিব্য সরকার গঠনের আগেই শেষ হয়েছিল, যেমন ঈসা মসীহ (আ.)। এবং কয়েকজন এই আন্দোলনকে সাফল্যের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন—যেমন নবী মুসা (আ.) এবং নবী মুহাম্মাদ (স.)।
নবীদের সম্পর্কে এই অভিমত সঠিক নয়—যে যখন তারা ক্ষমতা লাভ করেছিলেন, তখনও তারা জনসাধারণকে তাদের ভুল পথে চলার অনুমোদন অব্যাহত রেখেছিলেন।“
(চলবে)
মনোয়ার শামসী সাখাওয়াত : মরমী কবি, সমাজ চিন্তক, শিক্ষা বিষয়ক গবেষক।