হঠাৎ , মায়াকোভস্কি-র জন্য!

পাহাড়ী ভট্টাচার্য

“Art must not be concentrated in dead shrines called museums. It must be spread everywhere -on streets, in the trams, factories, workshops and in the workers’ homes”.-ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কি

১৯৩০-র ১৪ই এপ্রিল কবি-র এপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে কিছুদুর যেতে না যেতেই যুগপৎ গুলির শব্দ ও মর্মষ্পর্শী আর্তচিৎকার স্তম্বিত করে দেয় ভেরোনিকা পোলনষ্কায়া-কে। ফিরে গিয়ে ভেরোনিকা দেখেন মেঝেয় পড়ে আছে তাঁর প্রিয়তম-র নিথর দেহ, আর, বুক চিরে বেরিয়ে গেছে বুলেট। মায়াকোভস্কি মৃত! মৃতদেহের পাশে পড়ে আছে একটি সুইসাইড-নোট। তাতে লেখা, আমার আত্মহনন সম্পর্কহীন । এ মৃত্যুর দায় একান্তই আমার, আত্মহনন ছাড়া, আমার, অন্য বিকল্প ছিল না! সুইসাইড-নোটটির সাথে একটি অসমাপ্ত কবিতাও মেলে। কবিতার দু’লাইন ছিল এমন :

The incident disolved..
The love-boat smashed up..

মস্কোয়, ১৭ এপ্রিল ১৯৩০-এ অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় উপস্হিত হয়েছিল দেড় লাখ মানুষ। লেনিন, স্ট্যালিনের পর এটি আকারে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাসে ৩য় বৃহৎ এক অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া! মায়াকোভস্কির মৃত্যুতে, উত্তেজনার পারদ চড়তে থাকে যখন এই মৃত্যু তদন্তের দায়িত্ব-প্রাপ্ত কর্মকর্তাও ১০ দিনের মাথায় রহস্যজনকভাবে মৃত্যুবরণ করেন! সোভিয়েত রাষ্ট্র, সে সময়, মায়াকোভস্কির মৃত্যুর কারণকে ব্যক্তিগত ও প্রণয়-ঘটিত বললেও বস্তুুত সেসব খুব একটা গ্রহনযোগ্যতা পায়নি। পরে, তদন্তে দেখা যায়, তাঁর পিস্তলের সাথে দেহে বিদ্ধ বুলেটের কোন মিল নেই! আরো বিষ্ময়কর হল, প্রতিবেশীরা শুনেছিল দুটি গুলির শব্দ! জীবৎকালের মতই প্রবল আকর্ষনীয়, রহস্যাবৃত ও অমিমাংসিত হয়ে থাকল মায়াকোভস্কির এই আত্মহনন অথবা পরিকল্পিত হত্যাটি-প্রায় শতবর্ষ পর, অদ্যাবধি!

স্টকহোম-নিবাসী গবেষক ও সাহিত্য-সমালোচক বেঙ্ট জেঙফেল্ডট-কে মনে করা হয় মায়াকোভস্কি-বিষয়ে এক জন অথরিটি। “মায়াকোভস্কি:এ বায়োগ্রাফি”- শিরোনামে ৬০০ পৃষ্টার বেশী বড় কলেবরের একটি বই লিখেছেন বেঙ্ট, যেখানে মায়াকোভস্কিকে আমরা পাই বিস্তৃত, ভিন্ন অবয়বে। লক্ষ্যনীয়, মায়াকোভস্কির প্রেয়সী-সংখ্যা ছিল একাধিক। সমসাময়িক লেখিকা, অনুবাদক, অভিনেত্রী, মডেল এমনকি সাবেক ছাত্রীও তাঁর জীবনে প্রণয়িনী-বেশে এসেছে, নানা কালপর্বে। তাঁর সৃজনশীলতার মত, প্রণয়কাহিনীও কম চমকপ্রদ নয়। এ তালিকায় এলশা ট্রিওলেট, লিলি ব্রিক, লিলিয়া লেভিনেস্কায়া, তাতিয়ানা ইয়াকোডলেভা, লিলি জোনস, নাতালিয়া গ্রুকশেঙ্কো-র নাম সবিশেষ উল্লেখ্য। এদের মধ্যে, দীর্ঘতম সময়জুড়ে, প্রায় ১৫ বছরের, ধারাবাহিক সম্পর্কটি ছিল লিলি ব্রিক-এর সাথে কেবল। স্মর্তব্য, মায়াকোভস্কি লিলি ব্রিক-কে ৪১৬টি পত্র লেখেন যেগুলো বেঙ্ট তাঁর বইতে, অনুবাদে যুক্ত করেছেন। এ মায়াকোভস্কি-প্রেয়সীদের সিংহভাগ-ই পরস্ত্রী অথবা বাগদত্তা! ভেরোনিকা পোলনাস্কায়া ছিলেন সর্বশেষ। বেঙ্ট-কে দেয়া দীর্ঘ সাক্ষাতকারে লিলি ব্রিক জানিয়েছেন, অতৃপ্ত ও অস্হিরচিত্ত মায়াকোভস্কি প্রায়শ অাত্মহননের কথা বলতেন। মনে হত, আত্মহনন-ষ্পৃহাটি কবির একধরনের অসুখ! দুরারোগ্যে এ ব্যাধিই জীবনের ইতি ঘটায় কবির। বেঙ্ট-এর অনুসিদ্ধান্ত, প্রেম, শিল্প ও সমাজ বিপ্লব-সবকিছুই বুঝি মায়াকোভস্কি-র কাছে ছিল জীবন-জুয়া! কবিতায়, মায়াকোভস্কি, যাপিত জীবনেরই সম্যক উপলব্ধির প্রকাশ ঘটান এভাবে:

Our plannet
is poorly equiped
for delight
one must snatch
gladness
for the days that are
In this life
It is not difficult to die
To make life
is more difficult by far.

রুশ সাহিত্যকে বিশ্ব পরিসরে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া দস্তয়ভোস্কি, তলস্তয়, গোর্কি, তুর্গিনেভ, গোগোল, চেখভ, পস্তেরনাক, সোলঝানিৎসিন-দের তুমুল পাঠক-প্রিয়তার ভিড়েও হারিয়ে যাননি তিনি। বরং, চর্চায়, পাঠে ও জনপ্রিয়তায় ক্রমাগত অধিকতর আকর্ষনেরই অন্যন্য কেন্দ্রবিন্দু হয়েছেন মায়াকোভস্কি।

মায়াকোভস্কি ছিলেন দৃশ্যত প্রথাবিরুদ্ধ, এক কেতাদুরস্ত সুপুরুষ, যাপনে প্রচন্ড বোহেমিয়ান, প্রবল অনুভূতিপ্রবণ, অফুরন্ত জীবনী-সত্ত্বা সস্পন্ন, দর্শনে মার্কস ও হেগেলীয় ভাবধারায় আস্হাশীল, সাহিত্য ও শিল্পে ফিউচারিজমের পক্ষে উচ্চবাক, সোশ্যালিষ্ট রিয়ালিজম-এর সমান্তরালে নিউ রিয়ালিজম ধারা তৈরীতে ক্রিয়াশীল ও বৈপরীত্যকে ধারণে সুনিপুণ। ৩৬ বছরের অায়ূষ্কালে তিনি প্রবলভাবে প্রভাবিত করেন তাঁর স্বদেশ, সম-সময় ও উত্তরকালকে।

রূশ কবি, নাট্যকার, অভিনেতা, চিন্তক, সমাজ-বিশ্লেষক, বক্তা-বিশ শতকের বহুল আলোচিত এক চরিত্র ভ্লাদিমির ভ্লাদিমিরোভিচ মায়াকোভস্কি। জন্ম ১৯শে জুলাই ১৮৯৩ রাশিয়ার জর্জিয়ায়। নিন্ম-মধ্যবিত্ত পরিবারে তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা। প্রথমে জর্জিয়ায়, পরে, বাবার অকাল মৃত্যুর পর মা ও বোনদের সাথে মস্কোয় আগমন। অল্প বয়সেই, সেই সময়ের সোভিয়েত ইউনিয়নের জারতন্ত্রের বিরূদ্ধে বিক্ষোভে যুক্ত হওয়া, জারের বিরোধীতায় রাস্তায় লড়াই, দলীয় লিফলেট ছড়ানো, গোপনে ও প্রকাশ্যে জনগনকে সংগঠিতকরণ, পিস্তল পকেটে ঘুরে বেড়ানো, জেল-বন্ধী বলশেভিক বিপ্লবীদের মুক্ত করতে অভিযান পরিচালনার ঝুঁকি নেয়ার মধ্য দিয়েই ঘটে একপ্রকারের রাজনীতিতে হাতেখড়ি। দীর্ঘসময় রাজনৈতিক তৎপরতায় যুক্ত থেকে এক পর্যায়ে সাহিত্যে চুড়ান্ত মনোনিবেশ। এই সবকিছুর নেপথ্যে মায়াকোভস্কির সংবেদনশীল স্বদেশ-চেতনা ও গণমানুষের চুড়ান্ত মুক্তি-ই ছিল মুখ্যত উদ্দিষ্ট। ১৯২০-এ আত্ম-জৈবনিক রচনা ” I, Myself”-এ মায়াকোভোস্কি-র অকপট স্বীকারোক্তি “Revolution and poetry got entangled in my head and became one.”

তারুণ্যে, রেডিক্যাল ধারার রুশ সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক লেবার পার্টি-র সাথে সম্পৃক্ততা, ৩ দফায় জেল-জীবন, জেলে বসেই ১৯০৯-এ প্রথম কবিতা লেখা, বলশেভিক বিপ্লবে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত হওয়া, লেনিনের সানিধ্য ও সংশ্রব, ট্রটস্কিপন্হীদের কারো কারো সাথেও যোগসূত্র, রুশ রাষ্ট্রে বিপ্লবকে অমোঘ এবং সাম্যবাদকে জনগনের মুক্তির অ-বিকল্প কার্যকারণ বিবেচনা, বিপ্লবোত্তর, নতুন রাশিয়াকে নিয়ে হতাশা, আশ্চর্যজনকভাবে রূশ কম্যুনিষ্ট পার্টিতে যোগ না দেয়া, লেনিনের সাথে আপাত প্রচ্ছন্ন দুরত্ব ও সম্পর্কসূত্রের ক্রমাবনতি, রুশ স্টেট টেলিগ্রাফ এজেন্সির হয়ে নানা প্রপাগন্ডায় অংশগ্রহন, পলিটিক্যাল এ্যক্টিভিজম ছেড়ে, পরিশেষে, সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ, ফিউচারিস্ট-ধারার বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতার সাথে সম্পর্ক, নব্য আমলাতন্ত্র ও সোভিয়েত রাষ্ট্র-কাঠামোকে কটাক্ষ করে কবিতা, নাটক রচনা ও মঙ্চায়ন, নানা একাডেমিক বক্তৃতায়, সংলাপে-আলোচনায় এবং চলচিত্র নির্মানে যুক্ততা, স্টেজ পারফর্মেন্স, নবধারার সাহিত্য সাময়িকী “লেফ” সম্পাদনা, প্রথম মহাযুদ্ধে মাঠের সাংবাদিকতা, নানা পত্র-পত্রিকা, সাময়িকীর জন্য ফরমায়েশি লেখা, ইউরোপ ও ল্যাটিন আমেরিকা পরিভ্রমন, স্টালিনের রাশিয়ায় নিজেকে নিয়ে অস্বস্তিবোধ -ইত্যাদিতে মূলত মায়াকোভস্কি-র জীবনকে অবর্তিত হতে দেখি আমরা।

মায়াকোভস্কি-র উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে “ওড টু দ্য রেভলিউশন”, “লেফট মার্চ”, “এ স্লেপ ইন দ্য ফেস অব পাবলিক টেষ্ট”, “এ ক্লাউড ইন ট্রাউজারস”, “ব্যকবোন ফ্লুট”, “দ্য ওয়ার এন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড”, “সিম্পল এজ মুয়িং”, “দ্য বেডবাগ”, “দ্য বাথ-হাউজ”, “প্যারিস সাইকলস”, “মিষ্ট্রি ব্যুফে” অন্যতম। “সিলেকটেড ওয়ার্কস” ছাড়াও প্রাগুক্ত আত্মজীবনী “আই, মাইসেলফ্” তো রয়েছেই। পদ্য, নাটক, স্মৃতিকথা, ফিচার, ভ্রমন-বৃত্তান্ত প্রায় সবই লিখেছেন তিনি।

রুশ সমাজ ও জীবন, ১ম বিশ্বযূদ্ধকালের পূর্বাপর, রুশ রাজনীতির ছন্দপতনে ব্যক্তি-মানসের দ্বন্ধ, নানামাত্রিক অনুভব-প্রতিক্রিয়া কখনো হাস্যরসাত্বক, কখনো প্রতিকী, কখনো বা নিরেট রেটোরিকে প্রতিবিম্বিত মায়াকোভস্কির কবিতায়, গদ্যে। সৃজনশীলতার ওপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ বা ব্যক্তির চিন্তা ও স্বাধীনতার ওপর কর্তৃত্ববাদী হস্তক্ষেপের বিরূদ্ধে উচ্চকন্ঠ, প্রলেতারীয় ও আপাময় গণমানুষের স্বার্থের প্রতি দায়বদ্ধতা, গতানুগতিকতা, ঐতিহ্যাশ্রয়ীতা, পিউরিটানিজমের বিরূদ্ধবাদিতা মায়কোভস্কিকে দিয়েছে সন্দেহাতিত অনন্যতা। তাঁর প্রশ্নবিদ্ধ অকাল পরিসমাপ্তি যেন বড় বেশী বেমানান, গভীর বেদনার, শোকস্তব্ধতার ; তাঁর একটি পদ্যাংশের মতই:

“If you like
I’ll be furious flesh elemental,
or- changing to tones that the
sunset arouses- if you like-
I’ll be extraordinary gentle,
not a man but – a cloud in trousers.”

পাহাড়ী ভট্টাচার্য :কবি ও প্রাবন্ধিক।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন