আবদুল কাইয়ুম মাসুদ
সৌভাগ্য আমার! শ্বশুর বাড়িতে উপহার পাঠাতে পেরেছি। আস্ত একটি খাসি। বিবাহিত হিসেবে প্রথম কুরবান। বিয়ে হয়েছে বটে অনুষ্ঠান এখনো হয়নি। বউ বাপের বাড়িতে ঈদ করছে। নতুন বউ যেখানে উপহার উপঢৌকন সেখানেই যাবে; অপজিট পক্ষ থেকে, বউয়ের সৌজন্যে। এটিই প্রচলিত সামাজিক রীতি।
এসব রীতি সম্পর্কে আমার জ্ঞানের পরিধি খুবই সীমিত। আশেপাশে বিজ্ঞ অনেক মুরব্বী থাকেন। সময়মতো তারা এসব জানিয়ে দেন, শিখিয়ে দেন। আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। সেই সময় আমার এক মাসের বেতন দিয়ে দিতে হয়েছে; এ উপহার কেনার জন্য। ২০০৬ সাল। একজন বেসরকারি কলেজ শিক্ষকের বেতন এরকমই ছিলো। একটি খাসির দামের সমান।
এটি না পেলে যে আমার শ্বশুর খুব নাখোশ হতেন তা কিন্তু নয়। তবে পাওয়ার পর যে খুশী হয়েছেন, এতেও কোনো সন্দেহ নেই। উনাকে আমি আগে থেকেই চিনতাম। এসব সামাজিক রীতি হয়তো উনারও পছন্দ না। কিন্তু উনি, আমি বা আমরা যে সমাজে বাস করছি সেখানে দীর্ঘকাল থেকে এমন রেওয়াজ চলে আসছে। আশপাশের কেউ এ বিষয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। তা হয়তো বিব্রতকর ঠেকতো। এমন আশংকা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না।
আমার এ সুবিধাও ছিলো যে, আমি সেখানে ছিলাম না। আমার বাড়িতেই ঈদ করেছি। এ উপহার পৌঁছানোর পর কে কি মন্তব্য করেছে তা আমি শুনতে পাইনি। সেখানে থাকলেও অন্দর মহলের কটু মন্তব্য হয়তো আমার কানে পৌঁছাতো না। পরে সেখানে বেড়াতে গেলেও এমন কিছু আমার কানে আসেনি। সব মিলিয়ে উপহার দিয়ে আমি খুশী থাকতে পেরেছি।
সমস্যাও অনেক, এক্ষেত্রে, তবে তা অন্য জায়গায়। ধরুন, কারিণ নামের ছেলেটি এ বছর বিয়ে করেছে। নতুন বউয়ের প্রথম ঈদ। তার শ্বশুর খাসী পাঠিয়েছে; বেশ নাদুসনুদুস। কারিণ, তার পরিবার বা আশপাশের সবাই এমন ঈদ উপহার পেয়ে বেজায় খুশী।
পাশের বাড়ির ছলিমের শ্বশুর বাড়ি থেকেও একটি খাসী পাঠিয়েছে। ছলিমের চাচী এসে কারিণের মায়ের সাথে কথায় কথায় এ খবর দিলো। তিনি আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলেন ছলিমের শ্বশুরের পাঠানো খাসিটি অনেক সুন্দর, অনেক বড়। এও বললেন যে, দামও বেশি। এসব আলোচনা কারিণের বউ শুনছে আর মন খারাপ করছে। এদিকে শ্বাশুড়িরও মন খারাপ হতে লাগলো। আকারে ইঙ্গিতে বউকেও খোঁচা দিতে লাগলো। তিক্ততা শুরু এখানেই। খুব স্বাভাবিকভাবে এ খবর কারিণসহ পরিবারের সবার কানে পৌঁছাবে। কানাঘুষা হবে। পারিবারিক কলহের বীজ বুনন সম্পন্ন হলো।
নতুন বউ। প্রথম ঈদ। শ্বশুর বাড়িতে উৎসবমূখর পরিবেশে পালন করবে। তার এতোদিনের লালিত সে স্বপ্ন আস্তে আস্তে ক্ষয়ে যেতে থাকে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা বিষাদময় হয়ে ওঠে। কোন কারণে কণেপক্ষ পশু দিতে অপারগ পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়। এমন কি ছাড়াছাড়িও হয়ে যায়।
আদুরে কন্যার মূখ উজ্জ্বল করার নিমিত্তে মধ্যবিত্ত বাবা যে তার সামর্থের সর্বোচ্চটুকু ব্যয় করেছে এটি্ মেয়ে বুঝে। তাই নানা জনের নানান কথা কানে এলেও মূখবুজে সয়ে যাওয়া ছাড়া তার আর কিই বা করার আছে?
উপহার উল্লেখ করেই আমি শুরু করেছি। উপহার দেয়া নেয়া ভদ্রতার মধ্যে পড়ে। কেউ যদি উপহার দেয় তা হাসি মূখে গ্রহন করাও শিষ্টাচারের আওতায় পড়ে। সেটা অনেক মূল্যবান কোন দ্রব্য-সামগ্রী হোক বা একটি ক্ষুদ্র ক্যান্ডি হোক।
সম্পর্ক সুদৃঢ় করার লক্ষ্যেই উপহার আদান প্রদান করা হয়। তা না হয়ে এখন দেখছি তা সম্পর্ক ভাঙ্গন বা সম্পর্ক খারাপ হওয়ার কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে। এখন আরেকটি প্রশ্ন এসে যায়, ঈদের আগে শ্বশুর বাড়ির পশু প্রদান কি উপহারের মধ্যে পড়ে?
আসলে তাই, এটি এখন আর উপহারের পর্যায়ে নেই, এটি রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে সবাই এটি চায়। এ রেওয়াজ থেকেই নানা সামাজিক ব্যাধি জম্ম লাভ করছে। এখান থেকে আমাদেরকে বেরিয়ে আসতে হবে। সমাজকে পরিশুদ্ধ করতে হবে। এখনই তার উপযুক্ত সময়।
করোনা পরিস্থিতিতে আমরা অনেক কিছু অনুধাবন করতে শিখেছি। শেখার সে তালিকায় এটিও যুক্ত করে নিতে হবে। এটি একজন বা একপক্ষ অনুধাবণ করলে বা বুঝলে হবে না। পরিবারের সকল সদস্য বা সমাজের প্রতিটি নাগরিককে এটি নিয়ে ভাবতে হবে, ভূমিকা রাখতে হবে। তাহলে এ ব্যাধি দূর করা সম্ভব।
কুরবানি ধর্মীয় বিষয়। ধর্মীয় বিধান অনুসারে শ্বশুর বাড়ি থেকে পশু নেয়ার কোন বাধ্যবাধকতা নেই। ধর্ম (হাদিস) কি বলছে দেখুন, বারা ইবনে আযিব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘যে ঈদের সালাতের পর কুরবানির পশু যবেহ করল তার কুরবানী পরিপূর্ণ হলো ও সে মুসলিমদের আদর্শ সঠিকভাবে পালন করল।’ (বুখারী, মুসলিম)
পশু কুরবানি করা ওয়াজিব। এ সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সামর্থ থাকা সত্ত্বেও কুরবানি করে না সে যে্নো আমাদের ঈদগাহের ধারেকাছে না আসে।’ (মুসনাদ আহমাদ, হাকেম, ইবনে মাজাহ, )
এখান থেকে আমরা বুঝতে পারলাম, শুধু সামর্থবানরাই ঈদের নামাজ শেষে পশু কুরবানি দেবেন। অথচ মেয়ের বাপের সামর্থ থাক বা না থাক, ধার করে হলেও পশু পাঠাতে হয়। আমাদের মধ্যবিত্ত শ্রেণি তার যে সামর্থ নেই সেটা সহজে প্রকাশ করতে চায় না। এর বাস্তব অনেক কারণও আছে। তারওপর মেয়ের বাড়ির এমন আচরণ খুবই দুঃখজনক। এটি অমানবিক।
করোনার প্রাদুর্ভাবে এবার বিয়ে কম হয়েছে। তারপরও যারা এমন আছেন, আপনারা মেয়ে পক্ষের গার্ডিয়ানদের সুন্দর করে বলে দিন, করোনার এ পরিস্থিতিতে কোনো পশু যেনো না পাঠায়। এমনিতেইতো ঈদের পর উনারা মেয়েকে দেখতে যাবেন। মেয়ের জন্য মাংস নিয়ে যাবেন। আত্মীয়ের বাসা-বাড়িতে মাংশ দেয়া-নেয়ার রেওয়াজ আছে, এ ঈদে। এটি অনেক সুন্দর নিয়ম। সবার সাথে দেখা সাক্ষাৎ হয়। ঈদ-আনন্দ ভাগাভাগি হয়।
ছেলেপক্ষ যদি আশ্বস্ত করে তাহলে মেয়েপক্ষ জোর পাবে। পশু দেয়া নেয়ার এ অপসংস্ক্রৃতি দূর হবে।
আবদুল কাইয়ুম মাসুদ :প্রভাষক,আইসিটি,এজে চৌধুরী কলেজ। চট্টগ্রাম।