নজরুল: যাপনে ও প্রেরণার ।। আলমগীর মোহাম্মদ

নজরুল আমার কাছে এক দুঃখ ও আক্ষেপের নাম। নজরুল আমার কাছে এক অনুপ্রেরণার নাম। কতটুকু উদ্যমী এবং সৃজনপ্রেমিক হলে শত দুঃখ, বাঁধা ডিঙিয়ে এত এত দূর পথ পাড়ি দেয়া যায়?

নজরুল পেরেছিলেন দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত হয়ে, দারিদ্র্যের মাঝে বাস করে ধনী মনের অধিকারী হতে। মনে, মননে, সৃজনে বড় এই কবি হেরে গিয়েছিলেন ঘাতক ব্যাধির কাছে। নজরুল পত্রাবলি পড়তে গিয়ে নজরুলের দুঃখজাগানিয়া মনের প্রেমে মুগ্ধ হয়ে রাত জেগে অনুবাদ করেছিলাম তাঁর নির্বাচিত পত্রাবলি। একজন সাহিত্যিককে তাঁর গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ পড়ে যতটুকু না চেনা যায় তাঁর চেয়ে বেশি চেনা যায় তাঁর পত্র পড়ে।

বোদলেয়ার, ঠাকুর , ডিএইচ লরেন্স, কীটস, ছফা ও রোকেয়ার চিঠিগুলোর চেয়েও সাহিত্যমানের দিক থেকে এগিয়ে আজন্ম দুঃখী মিয়ার চিঠিগুলো। নজরুলকে পড়তে, বুঝতে নজরুল পত্রাবলি পড়া অত্যাবশ্যক বলে মনে করি।

আগামী ২৯শে অগাস্ট কবির চুয়াল্লিশতম মৃত্যুবার্ষিক। কবির আত্মা শান্তিতে থাকুক।

নজরুলকে জানতে তাঁর জীবন ও সাহিত্য সম্পর্কে কয়েকটি বিষয়ে আলাপ করা যাক।

নজরুল জীবনের নানা প্রসঙ্গ:

১.
অসাধারণ প্রতিভাবান ও প্রাণোচ্ছল নজরুল একজন সীমাবদ্ধতাপূর্ণ রক্তমাংসের মানুষ ছিলেন। নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা, প্রতিবাদের ভাষা ও উদ্দামতা বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছিল।

স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে দেশে নিয়ে আসেন। কবি ও তাঁর পরিবারকে নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়।চিকিৎসার ভার-ও নেন। কিন্তু কবিকে সুস্থ করে তোলা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ১৯৭৬সালের ২৯শে অগাস্ট কবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর কবির ইচ্ছে অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়। কবি তাঁর অন্তিম ইচ্ছে ব্যক্ত করেছিলেন এভাবে,

মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই।
যেন গোরে থেকেও মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই।।

আমার গোরের পাশ দিয়ে ভাই নামাজীরা যাবে,
পবিত্র সেই পায়ের ধ্বনি এ বান্দা শুনতে পাবে।
গোর – আজাব থেকে এ গুনাহগার পাইবে রেহাই।।

কত পরহেজগার খোদার ভক্ত নবীজীর উম্মত
ঐ মসজিদে করে রে ভাই, কোরান তেলাওয়াত।
সেই কোরান শুনে যেন আমি পরান জুড়াই।।

কত দরবেশ ফকির রে ভাই, মসজিদের আঙ্গিনাতে
আল্লার নাম জিকির করে লুকিয়ে গভীর রাতে,
আমি তাদের সাথে কেঁদে কেঁদে
(আল্লার নাম জপতে চাই) ।।

তাঁকে জাতীয় কবি বলা হলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে কোন স্বীকৃতি আজো দেয়া হয়নি।

২.

পরিবার-নিরপেক্ষ, স্বগঠিত,স্বাবলম্বী, স্বাধীন ও স্বধন্য একজন মানুষ নজরুল। অবশ্যই তাঁর মধ্যে খ্যাতিমান হবার ইচ্ছে ছিল প্রবল। বিয়ের নিমন্ত্রণ পত্রে নিজের পিতাকে ‘আয়মাদার’ হিসেবে উল্লেখ করে গৌরবান্বিত করতে চেয়েছিলেন। নিজের নাম নাজিরুল ইসলাম থেকে কাজী নজরুল ইসলামে রূপান্তরিত করেন। তাঁকে তাঁর চাচা ডাকতেন ‘ব্যঙাচি’। নজরুলের আরেকটি ডাক নাম ছিল ‘তারাখেপা’। অবশ্যই এই নামের পিছনে ইতিহাস আছে।

৩.
শৈশব থেকে নজরুল ছিলেন ভাবপ্রবণ, স্পর্শকাতর এবং অভিমানী। কবির অভিমানের পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর কবিতায়-

“যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে,
অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে-
বুঝবে সেদিন বুঝবে!
ছবি আমার বুকে বেঁধে
পাগল হ’লে কেঁদে কেঁদে
ফিরবে মর” কানন গিরি,
সাগর আকাশ বাতাস চিরি’
যেদিন আমায় খুঁজবে-
বুঝবে সেদিন বুঝবে! ”

আপনজনের প্রতি তাঁর উদাসীনতা চোখে পড়ার মতো ছিল। অল্প বয়সে বাবা মারা যান। মায়ের বিয়ে হয় অন্যত্র। বলা হয়ে থাকে এ বিয়ে নজরুলকে পীড়া দেয় মারাত্মক। পিতার পরিবার থেকে স্নেহের তৃষ্ণা না মেটায়, পরবর্তীতে পরিবারের বাইরে পরিচতজনদের সাথে স্নেহের বন্ধন গড়ে তোলার জন্য আকুল হয়ে পড়েন। বাঁধনহারা উপন্যাসে কবির আবেগী ব্যক্তিত্বের স্বরূপ প্রকাশিত হয়েছে।

৪.

যুদ্ধে যাবার সময় নজরুল তাঁর প্রেমিকার একটি চুলের কাঁটা সঙ্গে করে নিয়ে গেছিলেন। করাচীতে আড়াই বছর থেকেছিলেন নজরুল। সে সময় কাঁটাটা যত্ন করে রেখেছিলেন। অবশ্যই যুদ্ধ ফেরত কবি তাঁর সেই প্রেমিকার সাথে আর দেখা করেছিলেন কিনা জানা যায় না। ‘ ব্যথার দান’ – গ্রন্থটি সেই প্রেমিকাকে উৎসর্গ করেছিলেন ‘মানসী আমার’ ব’লে।

৫.

নজরুল অন্য সাহিত্যিকদের তুলনায় আর্থিক ও পারিবারিকভাবে পিছিয়ে ছিলেন। কিন্তু তাঁর মন বড়ো ছিল। রবীন্দ্রনাথকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন। ত্রিশালে স্কুলের পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে রবি ঠাকুরের কবিতা আবৃত্তি করেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার কোনো অবধি ছিল না তাঁর, যাকে তিনি ‘কবিগুরু ‘, ‘বিশ্বকবি’ ও ‘কবিসম্রাট’ বলতে অভ্যস্ত ছিলেন এবং ‘সঞ্চিতা ‘ কাব্য সংকলনটি তাঁকে উৎসর্গ করেন।

রবীন্দ্রনাথকে এত সম্মান করতেন, কিন্তু সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে তাঁর বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নিতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করেননি নজরুল। রবীন্দ্রনাথকে উদ্দ্যেশ্য করে লিখেন ‘বড়র পিরীতি বালির বাঁধ’ প্রবন্ধটি। উপলক্ষটা ছিল কবিতায় ‘খুন’ শব্দ ব্যবহারে রবীন্দ্রনাথের আপত্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জ্ঞাপনের।

৬.

‘বড়র পিরীতি বালির বাঁধ’- প্রবন্ধের শেষের দিকে এসে নজরুল শরৎচন্দ্রকেও ছাড় দেননি। নজরুল শুনেছেন শরৎচন্দ্র নাকি একটি কুকুরের মঠ তৈরি করবেন বলেছিলেন, যেটি কুকুরদের আশ্রয়স্থল হবে। ‘তিনি (শরৎচন্দ্র) নাকি জানতে পেরেছেন ঐ সময় কুকুর পূর্বজন্মে সাহিত্যিক ছিল,পরে কুকুর হয়েছে।’

নজরুলের মর্মস্পর্শী মন্তব্য:

সত্যিই আমরা সাহিত্যিকরা কুকুরের জাত। কুকুরের মত আমরা না খেয়ে এবং কামড়াকামড়ি করে মরি।

৭.

১৩৩০সালের ১১ই ফাল্গুন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের মেদিনীপুর শাখার অধিবেশনে যোগদান করেছিলেন নজরুল। ওখানকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কবিকে সম্মানিত করেছিলেন বিভিন্ন উপহার দিয়ে।

স্থানীয় মহিলা কলেজে একটি সভার আয়োজন করা হয়েছিল কবির সম্মানে। সেখানে নজরুল দারুণ পারফর্ম করেছিলেন। মুগ্ধ হয়ে এক হিন্দু তরুণী তার গলার হার খুলে উপহার দিয়েছিলেন নজরুলকে। সমাজপতিরা এতে ক্ষেপে যান। তরুণীটিকে লাঞ্চিত করেছিলেন গোঁড়া সমাজপতিরা।

লোকের কথার জ্বালা থেকে বাঁচার জন্য আত্মহত্যা করেছিলেন সেই মেয়েটি।

৮.
কবির দ্বিতীয় পুত্র বুলবুল। তাকে নিয়ে কবি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেতেন। এতটুকুন বাচ্চা কবি হারমোনিয়ামে যখনই কোন সুর বাজাতেন বুলবুল শুনে তা কোন সুর বলে দিতে পারতো। এই শিশুটিকে পেয়ে নজরুল কিছুটা শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু বিধি বাম। কবি আর কবি পত্নীকে শোকের সাগরে ডুবিয়ে একদিন বেহেস্তের ফুল বেহেস্তেই চলে গেল। কবি শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন। নজরুল লিখেন,

বুলবুলি নীরব নার্গিস বনে
ঝরা বন গোলাপের বিলাপ শুনে ।।

শিরাজের নওরোজে ফাল্গুন মাসে
যেন তার প্রিয়ার সমাধির পাশে
তরুন ইরান কবি কাঁদে নিরজনে ।।

উদাসীন আকাশ থির হয়ে আছে
জল ভরা মেঘ লয়ে বুকের মাঝে ।

সাকীর শারাবের পিয়ালার পরে
সকরুন অশ্রুর বেলফুল ঝরে
চেয়ে আছে ভাঙ্গা চাঁদ মলিন আননে ।।

বাচ্চার চিকিৎসা করতে গিয়ে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন কবি। শোক ভুলতে ডিএম লাইব্রেরিতে বসে প্রতিদিন কিছু কিছু লিখতেন এবং লাইব্রেরীর কর্মকর্তার কাছ থেকে অল্পস্বল্প টাকা নিতেন।

৯.
যুদ্ধফেরত নজরুল তাঁর বন্ধু শৈলজানন্দের মেসে উঠেছিলেন। মেসের বাবুর্চি নজরুলের মুসলমান পরিচয় জানতে পেরে তাঁর বাসন ধুতে অস্বীকার করেন। পরদিন সকালে নজরুল মুজাফফর আহমদের বাসায় উঠেন।

১৯২৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নজরুলকে বড়োই ব্যথিত করেছিল। এতে তিনি বিচলিত বোধ করলেও হতাশ হননি। লিখেছিলেন ‘কাণ্ডারি হুশিয়ার’ কবিতাটি, যা শুধু নজরুলের পক্ষেই সম্ভব।

‘ হিন্দু না ওরা মুসলিম এই জিজ্ঞাসা কোন জন?
কাণ্ডারি, বল ডুবিছে মানুষ সন্তান………’

সাম্প্রদায়িক এ দাঙ্গা নিয়ে নজরুল বিদ্রুপ ও কম করেননি। বন্ধু শৈলজানন্দকে লেখা চিঠিতে তিনি জানাচ্ছেন,

‘ আমি এবার কলকাতা গিয়েছিলাম। আল্লা….
আর ভগবানের…… মারামারির দরুন তোমার কাছে যেতে পারিনি।

১০.
বাংলা- সাহিত্যে বারাঙ্গনাদের নিয়ে মন-কাড়া তেমন কিছুই রচিত হয়নি। তবে এক্ষেত্রে নজরুলের ‘বারাঙ্গনা’ কবিতাটা অনন্য। নজরুল প্রশ্ন রাখেন সামাজিক আদালতে,

‘কার পাপে কোটি দুধের বাচ্চা আঁতুড়ে জন্মে মরে?’

বারাঙ্গনা কবিতার শেষ দুই লাইনে কবি লিখেন-

অসতী মাতার পুত্র সে যদি জারজ-পুত্র হয়,
অসৎ পিতার সন্তান ও তবে জারজ সুনিশ্চয়! ‘

সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশকে নজরুল ‘লালমুখো বাঁদর ‘ বলে আখ্যায়িত করেন, যারা আবার সিংহ সেজে বসে আছে।

পাকিস্তান নামক কলংকিত রাষ্ট্রকে নজরুল ‘ফাঁকিস্থান’ বলেছিলেন।

সাহিত্যের অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তাঁর ‘নজরুলকে কি নামে চিনব’- প্রবন্ধে লিখেছেন-

‘এমন একটি সমাজ নজরুল চেয়েছিলেন যেখানে মানুষের জীবন হবে সুন্দর ও স্বাভাবিক। তিনি ভাঙতে চেয়েছেন, নৈরাজ্য সৃষ্টির জন্য নয়, নতুন করে গড়বার জন্যই, যেকথা তিনি বারবার বলেছিলেন। সুন্দরের সাধক ছিলেন বলেই অসুন্দরের বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই।লড়াইটা মুক্তির।’

নজরুল তাঁর গানে বলেছেন,’ আমারে দেব না ভুলিতে’।

আমরা তাঁকে ভুলি নাই। নজরুলের কর্ম তাঁকে ভুলতে দেয় না আমাদের।

আলমগীর মোহাম্মদ: শিক্ষক, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন