প্রয়াণতিথিতে স্মরণ
জীবন ও চেতনায় কবি নজরুল ইসলাম
মুজিব রাহমান
পুবাকাশ
আবহমান বাংলা কবিতার পাঠককে যদি জিজ্ঞেস করা হয় – এমন একটি কবিতার নাম বলুন যে কবিতা পাঠে আকাশ-পাতাল সব কিছুকে স্পর্শ করা যায়।
এক কথায় তার উত্তর তো একটাই:
‘বিদ্রোহী’।
‘Old order changeth yielding place to new’
নূতনের বিজয় কেতন উড়ানোর আনন্দ-উল্লাসই তো সমগ্র নজরুল-কাব্যের সারাৎসার।
কাজী নজরুল ইসলাম কবিতা ও সঙ্গীতের বরপুত্র। তাঁর উচ্চারণ, আচরণ ও জীবনযাপন একাত্ম। অকপট নগ্ন সত্য মধ্যাহ্ন সূর্যের প্রাখর্যে দেদীপ্যমান তাঁর কবিতার পঙ্কতিতে পঙ্কতিতে।
আপন বেগে পাগলপারা নদীর ছুটে চলায় যে গতিময়তা – যে মত্ততা, নজরুলের গতিতীব্র জীবন চাঞ্চল্যেও তা ভীষণভাবে মূর্ত, একান্ত স্বরূপে পরিস্ফুট।
নজরলের কবিতায় তা বাঙ্ময় হয়ে আছে:
আপনার বেগে আপনি ছুটেছি জন্ম-শিখর হতে
বিরামবিহীন রাত্রি ও দিন পথ হতে আন্ পথে।
……..
কোন্ গ্রহ হতে ছিঁড়ি!
উল্কার মত ছুটেছি বাহিয়া সৌর-লোকের সিঁড়ি!
( পথচারী – কাব্য: চক্রবাক)
উপর্যুক্ত কবিতায় একটি নদীর স্বগতোক্তির মধ্য দিয়ে যে-ছুটে চলার কথা আছে, সেই সমুদ্রতৃষ্ণাই নজরুলকে সাধারণ কবিদের কাতার থেকে নিয়ে গেছে অন্য জায়গায় – কল্প ও বাস্তবের উপলব্ধ পরিসরে। ব্যক্তি ও পরিপার্শ্বকে স্পর্শ করেছেন নজরুল; কিন্তু তাঁর কবিতা ও গানে নজরুল এক অন্য লোকে উত্তীর্ণ হয়েছেন। এই সমুত্তরণেই নজরুল হয়ে উঠেছেন নজরুল। আপন স্বভাবে স্বয়ম্ভর কবিসত্তা।
নজরুলের প্রয়াণতিথিতে তাঁর স্মৃতি ও হিরণ্ময় কৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও পরম ভালোবাসা নিবেদন করছি।
দেশ-কাল-সমাজ-রাজনীতি-চেতন কবি নজরুল।
পূর্বতন প্রেম-প্রকৃতি-মরমিয়তার বাইরে এসে নজরুল ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে দ্বিতীয় প্রকৃতির ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন তাঁর কবিতায়। অগ্নিবীণার ‘বিদ্রোহী’তে দেখি তার পরম প্রবল স্ফুরণ।
আবহমান বাংলা কবিতার পাঠককে যদি জিজ্ঞেস করা হয় – এমন একটি কবিতার নাম বলুন যে কবিতা পাঠে আকাশ-পাতাল সব কিছুকে স্পর্শ করা যায়।
এক কথায় তার উত্তর তো একটাই:
‘বিদ্রোহী’।
‘Old order changeth yielding place to new’
নূতনের বিজয় কেতন উড়ানোর আনন্দ-উল্লাসই তো সমগ্র নজরুল-কাব্যের সারাৎসার।
নূতনের তরে ব্রত পুরাতন-সংহার,
ছাড়ি তাই হুঙ্কার বার বার বার।
( নির্ভীক: রাধাকান্ত গোস্বামী)
জীবনবাদী নজরুলের কাছে শিল্প ছিল জীবনের জন্য।
নির্জিত, পরাভূত মানুষের পক্ষে নজরুলের অবস্থান ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট। নজরুলের কাছে তাঁর জীবনের শুরু থেকে সারা অবধি মূলমন্ত্র ছিলো – Art is for life. Art is for life.
Art is empathy.
জীবনের জন্য শিল্প এবং সমানুভূতিই শিল্প।
তাঁর উচ্চারণ :
‘বন্ধু, বিলাস সৃষ্টি এই
আমার কবিতা আমার গান
অন্ধেরে আলো দিত যদি
অপঘাতে তার যেত না প্রাণ!’
কবি বলেছেন, শিল্প সাহিত্য দিয়ে কী হবে, যদি তা মানুষের কাজে না-লাগে।
সে-জন্যেই যে-কবি জীবনভর শিল্পসাধনা করেছেন, ক্ষোভ ও ক্রোধের চরমে উঠে তিনিই বলে উঠেছেন,
‘আগুন লাগুক রসলোকে’।
মানুষের প্রতি কত গভীর ভালোবাসা থাকলে এই উচ্চারণ সম্ভব!
এবং সৃষ্টিশীল জীবনের শেষ দিকের কাব্যিক উচ্চারণে এক পুষ্পিত জাগরণের কথা আছে। মানুষ ও ঐশ্বরিকতা একাকার হয়ে আছে:
‘প্রিয়া-রূপ ধরে এতদিনে এলে আমার কবিতা তুমি,
আঁখির পলকে মরুভূমি যেন হয়ে গেল বনভূমি!’
‘আমি’ এবং ‘তুমি’ শব্দ দুটি এখন আর ‘পুরুষ’ ও ‘নারী’র প্রতিরূপ নয়, মানুষ ও ঐশ্বরিকতার প্রতিভূ।
সর্বোপরি, বাংলা সাহিত্যের উন্নত-শির এক অনন্য আলোকস্তম্ভের নাম নজরুল। তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশের শতবর্ষ ২০২২। শতবর্ষ প্রাচীন একটি কবিতা কতোটা প্রভাব, ঐশ্বর্য আর সময়জয়ী তা আজকের দিনে দাঁড়িয়ে বাংলাভাষী কোনো শিক্ষিতজনকে আর নতুন করে বলতে হয় না। কবির এ-এক বিশাল কৃতিত্ব, বিপুল অর্জন।
যে কবিতায় কবির মাথা হিমাদ্রিশিখরের উপরে উঠে যায়, মহাবিশ্বের মহাকাশ অতিক্রম করে যায়, ছাড়িয়ে যায় চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারা সে-কবিতা ‘বিদ্রোহী’। ব্যক্তির উচ্চতার আকাঙ্ক্ষায় যে কবিতার শুরু আর সমষ্টির ভাবনা-বেদনায় যে কবিতার শেষ সে-কবিতার শিরোনাম ‘বিদ্রোহী’।
প্রকৃত অর্থে, যে-শক্তি সব অতিক্রম করে যায় সে-হচ্ছে কবির চৈতন্য। চৈতন্যই সেই পরমতা যা অবলীলায় অতিক্রম করে বস্তুসত্যকে। চৈতন্যবলেই যে-কবি শারীরিকভাবে বেঁচে ছিলেন মাত্র ৫৬-বছর, তিনি অনায়াস উচ্চারণ করতে পারেন:
‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে।’
অস্তিত্বের এই প্রবলতা, চেতনার এই পরমতা একজন নিঃসংশয়তাবাদী কবিই অর্জন করেন।
তাঁর লেখক জীবনের আয়ুষ্কাল কমবেশি পঁচিশ বছর। জীবনের নানা উত্থান-পতন,দারিদ্র্যের নির্মম কশাঘাত, স্বকালের লাঞ্ছনা-গঞ্জনা-তিরস্কার সত্ত্বেও তাঁর সৃষ্টিসম্ভারের প্রাচুর্য ও পর্যাপ্তি অপরিমেয়।
২০০৪ সালে বিশ্বব্যাপী জরিপ চালিয়ে বিবিসি সর্বশ্রেষ্ঠ ‘কুড়িজন’ বাঙালির যে তালিকা তৈরি করেছে, সেই কুড়িতে, সেই ‘বিশে’ কাজী নজরুল ইসলামের স্থান তৃতীয়। বাংলাদেশের ‘জাতীয় কবি’ তিনি। বিশিষ্ট কবি, নজরুল-সুহৃদ ও গবেষক আবদুল কাদির নজরুলকে ‘জাতীয় মহাকবি’ বলে গৌরববোধ করেছেন। বিশিষ্ট কেউ কেউ আবার নজরুলকে উড়িয়ে দেবার চেষ্টাও করেছেন। নজরুল নজরুলই। যুগন্ধর কবি, যুগের মহাকবি, নজরুলকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে তাঁর সুকৃতি, তাঁর কাব্যকৃতি, তাঁর অলোকসামান্য অসংখ্য সঙ্গীত। তাঁর গল্প, তাঁর অনালোচিত উপন্যাসসমূহ।
নজরুল যখন প্রতিবাদে জ্বলে উঠেছেন, তখন তিনি শ্রেষ্ঠ প্রতিবাদী, তিনি যখন প্রখর প্রেমে বিনত হয়েছেন, তখন তিনি প্রবুদ্ধ প্রেমিক, তিনি যখন শিল্পী, তখন তিনি নির্মম জীবনের নির্মোহ ভাষ্যকার।
সামাজিক ক্রোধ, রাজনৈতিক রোষ, অর্থনৈতিক বিভাজন নজরুলকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল। তাঁর জীবন ও রচনায় তা উজ্জ্বল হয়ে আছে।
১৯২২ সালে ১২টি কবিতা নিয়ে নজরুলের অগ্নিবীণা প্রকাশিত হয়েছিল। কাল বোশেখির ঝড়ের গতিতে নতুনের কেতন উড়িয়ে জয়ধ্বনিতে চারদিক সচকিত করে বাংলা কবিতায় তাঁর অনন্য অভিষেক ঘটে। কাব্যটিতে ছিল অনেকগুলো সমর-কবিতা।
‘ব্যথার দান’-এর গল্পগুচ্ছেও যুদ্ধের একটি প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল। এর আগে বাংলা সাহিত্যে এমন গল্প ছিলো না।
‘যুগবাণী’ প্রবন্ধগ্রন্থেও এমন এক তেজ ও জোশ ঝলকে উঠেছিল যা বাংলা সাহিত্যে ছিল অভিনব।
ঝড়ের মতো তাঁর এ-আবির্ভাব সাংবাদিকতা ও সাহিত্যের মধ্যবর্তী ক্ষীণ দেয়ালটি এক লহমায় ভেঙেচুরে দিয়েছিল। কবিতাটি প্রকাশের দিন থেকেই, ১৯২২ সাল থেকেই কবি ‘বিদ্রোহী কবি’ অভিধায় চিহ্নিত হয়ে গিয়েছিলেন।
১৯২৮ সালে প্রকাশিত হয়েছিল কবির প্রথম গীতিগ্রন্থ ‘বুলবুল’। ১৯২৬ সাল থেকে কবি শুরু করেছিলেন গজলগান লেখা। বাংলায় গজল তাঁর হাতেই প্রাণ পেয়েছিল। এবং মুহূর্তে তাঁর এ-সকল গজল জয় করে নিয়েছিল জনচিত্ত।
নির্দ্বিধভাবেই বলা যায়, নজরুলের সকল লেখা যুগ-মানসকে বিশ্বস্তভাবে প্রতিফলিত করেছে। আর নজরুল রচনার এ-দিকটিকে দৃষ্টিতে রেখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মন্তব্য করেছেন:
‘যুগের মনকে যা প্রতিফলিত করে, তা শুধু কাব্য নয়, মহাকাব্য।’
নজরুল থেমে যেতে যেতে শেষ কথা উচ্চারণ করলেন:
‘বিদায়, হে মোর বাতায়ন-পাশে নিশীথ জাগার সাথী!
ওগো বন্ধুরা, পাণ্ডুর হয়ে এল বিদায়ের রাতি!
আজ হতে হল বন্ধ আমার জানালার ঝিলিমিলি,
আজ হতে হল বন্ধ মোদের আলাপন নিরিবিলি।
…..
তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু, আর আমি জাগিব না।
কোলাহল করি সারা দিনমান কারো ধ্যান ভাঙিব না।
– নিশ্চল নিশ্চুপ
আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধবিধূর ধূপ।’
বিভাজিত আবহে বিচলিত নজরুল পাঠ নয়।
অখণ্ড ও অবিভাজিত নজরুলই বাঙালির নজরুল, বিশ্বমানব নজরুল।
তাঁর দেশাত্মবোধক গানে যে মন্ত্র উদ্ভাসিত তার চেয়ে অধিক সত্য আর কী হতে পারে!
‘জাতের চেয়ে মানুষ সত্য, অধিক সত্য প্রাণের টান
প্রাণ ঘরে সব এক সমান।’
মুজিব রাহমান : কবি ও প্রাবন্ধিক। সহযোগী অধ্যাপক ,ইংরেজি বিভাগ, চট্টগ্রাম কলেজ।