মাঈন উদ্দিন জাহেদ

রবীন্দ্র চেতনায় মৃত্যু বোধ অরুণ আলোকেই উদয় হয় । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনের ঊষালগ্নেই তাই মৃত্যুকে অমৃতের স্বরূপ বলে চিহ্নিত করেছিলেন ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলীতে ‘মরণ’ কবিতায়।
মরণ রে, তুঁহু মম শ্যামসমান।
মেঘবরণ তুঝ, মেঘজটাজূট,
রক্তকমলকর, রক্ত-অধরপুট,
তাপবিমোচন করুণ কোর তব
    মৃত্যু-অমৃত করে দান॥
        আকুল রাধা-রিঝ অতি জরজর,
        ঝরই নয়নদউ অনুখন ঝরঝর-
        তুঁহু মম মাধব, তুঁহু মম দোসর,
            তুঁহু মম তাপ ঘুচাও।
            মরণ, তু আও রে আও।
ভুজপাশে তব লহ সম্বোধয়ি,
আঁখিপাত মঝু দেহ তু রোধয়ি,
কোর-উপর তুঝ রোদয়ি রোদয়ি,
    নীদ ভরব সব দেহ।
        তুঁহু নহি বিসরবি, তুঁহু নহি ছোড়বি,
        রাধাহৃদয় তু কবহুঁ ন তোড়বি
        হিয়-হিয় রাখবি অনুদিন অনুখন-
            অতুলন তোঁহার লেহ।
গগন সঘন অব, তিমিরমগন ভব,
তড়িতচকিত অতি, ঘোর মেঘরব,
শালতালতরু সভয়-তবধ সব-
    পন্থ বিজন অতি ঘোর।
        একলি যাওব তুঝ অভিসারে,
        তুঁহুঁ মম প্রিয়তম, কি ফল বিচারে-
        ভয়বাধা সব অভয় মুরতি ধরি,
            পন্থ দেখায়ব মোর।
ভানু ভণে – ‘অয়ি রাধা, ছিয়ে ছিয়ে
    চঞ্চল চিত্ত তোহারি।
জীবনবল্লভ মরণ-অধিক সো,
    অব তুঁহু দেখ বিচারি।’
[রাগ: ভৈরবী-কীর্তন,তাল: মুক্তছন্দ-কাহারবা,রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ১২৮৮,রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ১৮৮১]

এছাড়া,‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে’ 
(পূজা-২৪৮)-
গান থেকে সহজে অনুমান করা যায় রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুচিন্তায় এক ধরনের সুন্দরম বোধ ছিলো। রবীন্দ্রনাথ চিন্তার নানা স্তরে মানবকল্যাণের বিচিত্র দিক উন্মোচিত। সুদীর্ঘ সাহিত্যিক জীবনে রবীন্দ্রনাথ অনেক ঘাত-প্রতিঘাতে যাপন করতেছেন। অল্প বয়সে মায়ের মৃত্যু এবং পরবর্তীতে বাল্যপ্রেয়সী কাদম্বরী দেবী, সন্তান ও স্ত্রীর অকাল মৃত্যু এর মধ্যে অন্যতম। মৃত্যুর বেদনার্ত ঘটনা জীবনকে উলোট-পালট করে দেয়, সেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এন্তার স্বজন হারিয়েও নিজেকে স্থির রেখেছিলেন। সাহিত্যের নানা আংগিকে কবির ‘মৃত্যু-দর্শন’ নানা অনুষঙ্গে উন্মোচন থেকে উপলব্ধ হয়, তার অন্তঃস্থলে প্রচুর ভাংচুর যাচ্ছিলো। তিনি বেদনার্ত ঘটনাগুলোকে আত্মস্থ করে এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করুন না কেন, ক্ষরণ ছিলো অবিরত। নিজের জন্মদিনের আড়ম্বর নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় লিখেন- ‘খ্যাতির কলবরমুখর প্রাঙ্গণে আমার জন্মদিনের যে আসন পাতা রয়েছে, সেখানে স্থান নিতে আমার মন যায় না। আজ আমার প্রয়োজন স্তব্ধতায় শান্তিতে।’
কবি গুরু আবার যখন নৈবেদ্য কাব্যগ্রন্থে ‘মৃত্যু’ কবিতায় বলেন-
‘মৃত্যু অজ্ঞাত মোর
আজি তার তরে
ক্ষণে ক্ষণে শিহরিয়া কাঁপিতেছি ডরে
এত ভালোবাসি
বলে হয়েছে প্রত্যয়
মৃত্যুরে আমি ভালো
বাসিব নিশ্চয়’

‘মৃত্যু’ এমনই নির্মমতা অস্বীকারের সুযোগ নেই। মৃত্যু পরবর্তী জীবন নিয়ে নানা বিশ্বাস আছে। মৃত্যু পরবর্তী জীবন ইহযাপনে যেহেতু অনুমান করা যায় না,উঁকি দিয়ে কিংবা যন্ত্র দিয়ে ঠাহর করা যায় না, তাই এ বিষয়ট নিয়ে নানা কথা-চিন্তন উঠে আসে। মানুষ ভয় পায় মৃত্যুকে, মৃত্যুকে এড়াতে পালিয়ে বেড়ায়। তবুও মৃত্যু মানুষের পিছু ছাড়ে না। মৃত্যুকে এড়ানো কোনো জীবকেই সম্ভব নয়, এটাই চিরন্তন সত্য।

রবীন্দ্রনাথ ভাবনায় মৃত্যু তাই বার বার এসেছে।
মৃত্যুর কয়েক বছর পূর্ব থেকে মৃত্যু সম্বন্ধে বহু কবিতা লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ- সেগুলি কেবল প্রশ্ন নয়, মানুষের চির-নিরুত্তর কিছু প্রশ্নের উত্তরও তার মধ্যে রয়েছে।’ একবার কঠিন রোগ থেকে মুক্তি লাভের পর একটি চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ‘মৃত্যুর ভিতর দিয়ে ফিরে আসা সকলের ভাগ্যে ঘটে না। যদি ঘটে, তবে অন্তত তখনকার মত অহমিকা শিথিল হয়ে আসে কতখানি স্থায়ী হয় বলতে পারিনে। প্রিয়জনের মৃত্যুর পর বৈরাগ্য আসে নিজের মৃত্যুর সময় দেখি যে সব জিনিস অত্যুক্তি করেছে। মৃত্যুর ব্যথা দেখে তাকে যেন অশ্রদ্ধা না করি।’

মৃত্যু বেদনা মানুষকে একটু হলেও পৃথিবীর প্রতি অনাসক্ত করে তোলে- এমন নির্মম সত্য ফুটে উঠেছে কবির উপলব্ধিতে। মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতর হওয়া উচিত নয় বলে তিনি উপদেশ দিয়েছেন, যদিও তা আমরা সাধারণের পক্ষে অসম্ভব। হয়তে মহামানবের পক্ষে এমন সাধ্য। রবীন্দ্রমানসে এ চিন্তাকে মূলত মৃত্যুচেতনায় তার সৌন্দর্য অবলোকনের নান্দনিক প্রয়াস হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

রবীন্দ্রনাথের অধিকাংশ কবিতা এবং গানে পরমাত্মায় নিবিষ্ট হওয়ার গভীর আকুতি স্পষ্ট । পরমের সান্নিধ্য লাভের মধ্য দিয়েই কবি যে পরম সুখের সন্ধান করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার গানে বিশ্বতানকে জীবন গানে মেলাবার চেষ্টা করেছেন। তিনি রচনা করেছেন অজস্র দুঃখের গান যা শুনে মানুষের মন অনন্তর পানে ধেয়ে যায়। এই অনাবিল অনন্তের ধারা মৃত্যু পরবর্তী অবস্থায় পর্যবসিত। তিনি যখন বলেন-
‘জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণা ধারায় এসো।
সকল মাধুরী লুকায়ে যায়, গীতসুধারসে এসো॥
কর্ম যখন প্রবল-আকার গরজি উঠিয়া ঢাকে চারি ধার
হৃদয়প্রান্তে, হে জীবন নাথ, শান্ত চরণে এসো॥

জীবনকে ফ্রেমে আটকে রাখা যায় না, এই পরম সত্যকে বার বার উপলব্ধি করেছেন রবীন্দ্রনাথ। তার মৃত্যুদর্শন কালক্রমে হয়ে উঠেছে নান্দনিক এক জীবনদর্শন।
কবিগুরু যখন লিখেন, ‘জীবনেরে কে রাখিতে পারে, আকাশের প্রতি তারা ডাকিছে তাহারে।’
তা উপলব্ধিতে অনন্যতা ছুঁয়ে দিয়ে যায়।

কবি তাঁর প্রত্যয়গুলো ব্যক্ত করেছেন বিভিন্ন আঙ্গিকে। জীবন উপলব্ধিতে এ সব কবি জীবন দিয়ে বুঝেছেন। তাই তিনি মৃত্যু সম্পর্কে সানাই-এর ‘ক্ষণিক’ কবিতায় লিখেছেন-
‘এ চিকন তব লাবণ্য যবে দেখি
মনে মনে ভাবি একি
ক্ষণিকের পরে অসীমের বরদান
আড়ালে আবার ফিরে নেয় তারে
দিন হলে অবসান।’

‘রবীন্দ্র প্রতিভায় পাশ্চাত্যের রবার্ট ব্রাউনিং-এর মৃত্যুর শিল্পময় দার্শনিক উপস্থাপনা আমরা দেখতে পাই। স্যামুয়েল টেলর কোলরিজ এবং লর্ড বাইরনের জীবনমুখীন বাস্তবতাও যেমন আছে, তেমন তরুণ কবি জন কীটসের অনিঃশেষ সৌন্দর্যচেতনা, উইলিয়ম ওয়ার্ডসোয়ার্থের পরিশুদ্ধ প্রকৃতির প্রতি অনাবিল আস্থা ও প্রেম এবং পার্সি বিশি শেলীর অতীন্দ্রিয় সত্তার গূঢ় রহস্যময়তা মিলেমিশে এক স্পর্শকাতর অনুভূতিতে অপূর্ব সমন্বিত হয়েছে।

মৃত্যু সম্পর্কে রবির উপলব্ধিরও পরিবর্তন ঘটছে। তাঁর গীতিমাল্য কবিতায় ইন্দ্রিয় জগত ও ইন্দ্রিয়াতীত জগতের জিজ্ঞাসা ও প্রসঙ্গ এসেছে।
কবির জিজ্ঞাসা-
‘ওগো পথিক, দিনের শেষে
যাত্রা তোমার কোন্ সে দেশে,
এ পথ গেছে কোন খানে?’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মৃত্যুকে জীবনের অপর দিক হিসেবে দেখেছেন। ইন্দ্রিয়াতীত বিভিন্ন জিজ্ঞাসার আলোকেও তা স্পষ্ট। মৃত্যুকে কবি অনন্ত জীবনের পথে পরমাত্মীয়ের মতো নতুন নতুন পথের প্রদর্শক হিসেবে উপলব্ধি করেছেন। কখনো মহাকালের মহামিলনদূত হিসেবে দেখেছেন। তা কবির চাক্ষুষ বাস্তবতা অতিক্রম করে, বিশেষকে ছাড়িয়ে হয়ে উঠেছে নির্বিশেষ। আবার পরক্ষণেই নির্বিশেষ থেকে বিশেষের স্তরে নেমে এসেছে ব্যক্তিসত্তা হয়ে, ঠিক যেনো প্রণয়িনী রাধিকার শ্যামরূপী অমৃতের উৎস হয়ে। জীবন ও বিশ্বপ্রকৃতি সম্পর্কে নিজস্ব উপলব্ধির নিরবচ্ছিন্ন উৎসারণ থেকেও তার মৃত্যুচিন্তার সুন্দর্যানুভূতি স্পষ্ট।

রবীন্দ্রনাথ এ জীবন এবং বিশ্বদৃষ্টিতে উপনিষদের প্রভাব স্পষ্ট। গভীর ভাবে এর তাত্ত্বিক দর্শন পরিপূর্ণভাবে করে জীবনে কাব্যে উপলব্ধি করেছেন। অনন্যসাধারণ শিল্পময়তায়, অতীন্দ্রিয় সত্তার প্রগাঢ় রহস্যময়তায় চিত্রিত করেছেন নানা উপলব্ধিগুলো। মৃত্যুচিন্তার ভেতর থেকেও মৃত্যুর নান্দনিক রূপ উন্মোচন করেছেন তিনি।

একে একে প্রিয়জনদের মৃত্যু শোক রবীন্দ্রনাথের জীবনকে করেছে স্থিতধী। কবি জীবনস্মৃতিতে লিখেছেন ‘মৃত্যু শোক’ পর্যায়ে- ‘জগৎকে সম্পূর্ণ করিয়া এবং সুন্দর করিয়া দেখিবার জন্য যে দূরত্ব প্রয়োজন, মৃত্যু দূরত্ব ঘটাইয়া দিয়াছিল। আমি নির্লিপ্ত হইয়া দাঁড়াইয়া মরণের বৃহৎ পটভূমিকার ওপর সংসারের ছবিটি দেখিলাম এবং জানিলাম, তাহা বড়ো মনোহর।”

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু-দর্শনের দৃষ্টিবিন্দুতে হচ্ছে একটি বোধ; তা হলো- মৃত্যু তার শোক ও দুঃখের মাধ্যমে জীবনের- সত্যের, মুক্তির ও শক্তির- ত্রয়ীরূপকেই ফুটিয়ে তোলে। তাই সুখের মতো দুঃখকেও স্বাগত জানাও, স্বাগত জানাতে হবে জীবনের মতো মৃত্যুকেও। এই উপলব্ধির মাঝে মৃত্যুর নান্দনিক অনুভব আছে। রবীন্দ্রনাথ যাপনে অতলস্পর্শী হৃদয়মুখরতার গাম্ভীর্য এনেছেন মহিমান্বিত নন্দন চেতায়। আবার সেই নান্দনিকতাই তিনি বস্তুত একা হয়েছেন, উষ্ণতায় মেলে ধরেছেন জীবনের সহস্র রস রঙ নানা আঙ্গিকে। তাই রবীন্দ্রনাথের ‘মৃত্যু-দর্শন’ অনন্যতায় গুরুত্বপূর্ণ।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ছিন্নপত্রে লিখেছেন- ‘ইচ্ছে করে জীবনের প্রত্যেক সূর্যোদয়কে সজ্ঞানভারে অভিবাদন করি এবং প্রত্যেক সূর্যাস্তকে পরিচিত বন্ধুর মতো বিদায় দিই।’
রবীন্দ্রনাথের কাছে জীবনবিমুখতা স্বার্থমগ্নতারই অন্য এক রূপ। তিনি অন্য এক জায়গায় লিখেন- ‘মৃত্যু সে ধরে মৃত্যুর রূপ, দুঃখ হয় হে দুঃখের কূপ, তোমা হতে যবে হইয়ে বিমুখ আপনার পানে চাই’, অথবা, ‘তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যত দূরে আমি ধাই- কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু, কোথা বিচ্ছেদ নাই’।

‘ রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধিতে মৃত্যু কখনো প্রণয়ী, বাউল, কখনো বা বালিকা বধূর বর বেশে, সখা সেজে বন্ধুরূপে, অন্ধকারের ধ্যাননিমগ্ন ভাষার মতো অবগুণ্ঠনের আবরণ পরে, অরুণবহ্নির রুদ্র সাজে, জীবন রথের সারথি হয়ে, ললিত লোভন মোহন রূপে বা জ্যোতির্ময়ের পরশমণি হয়ে ধরা দিয়েছে। মৃত্যুর সৌন্দর্য আস্বাদন করে তিনি সেই পরম উপলব্ধির অমিয়ধারা ছড়িয়ে দিয়েছেন তাঁর কবিতা ও গানে, তাঁর সাহিত্য নানা শাখায়।

মৃত্যু অপর নাম বিদায় কে তাই বরণ করে নিতেই হবে, এ সত্য জেনেও কবি ভালোবাসাকে হৃদয়ে ধারণ করে লিখেছেন-
‘এ বিশ্বেরে ভালোবাসিয়াছি।
এ ভালবাসাই সত্য এ জন্মের দান।
বিদায় নেবার কালে
এ সত্য অম্লান হয়ে মৃত্যুরে করিবে অস্বীকার।’

কবির তাই একান্ত উপলব্ধি – ‘জীবনকে সত্য বলে জানতে গেলে মৃত্যুর মধ্য দিয়েই তার পরিচয় পেতে হবে। যে মানুষ ভয় পেয়ে মৃত্যুকে এড়িয়ে জীবনকে আঁকড়ে রয়েছে, জীবনের পরে তার যথার্থ শ্রদ্ধা নেই বলে জীবনকে সে পায়নি। যে লোক নিজে এগিয়ে গিয়ে মৃত্যুকে বন্দি করতে ছুটেছে, সে দেখতে পায়, যাকে সে ধরেছে সে মৃত্যুই নয়, সে জীবন’, (ফাল্গুনী, ১৩২২)।

মাঈন উদ্দিন জাহেদ: কবি ও প্রাবন্ধিক। সম্পাদক: পুবাকাশ।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন