১৫ আগস্ট ২০২০ জাতীয় শোক দিবসের বিশেষ আয়োজন
পদাবলী ।। পুবাকাশ
তিনি মানে বাংলাদেশ ।। আবু মুসা চৌধুরী
বুকে তার সমস্ত আকাশ
তাবৎ পাখিদের গান
এই জনপদ, আরণ্য, বিল, মাঠ, হাওর
এবং মাটির সমুদয় লাবণ্য-মায়া
বঙ্গোপসাগরের উত্তাল ঊর্মী, এই
ভাটির দেশের সমস্ত সুষমা
মার খাওয়া মানুষের আর্তি-হাহাকার
তার বক্ষ পাঞ্জরে।
তিনি তর্জনী নির্দেশ করলে
ঝড় বয়ে যায় দিক্-দিগন্তরে
তিনি ডাক দিলে মৃত্যুর সাথে আলিঙ্গন
তিনি মানে মুক্তির খসড়া
তিনি মানে স্বাধীনতা
তিনি মানে বাংলাদেশ
ঝরাপাতার ঋণ ।। মুজতাহিদ ফারুকী
যেসব কবিতা গান এখনও লিখিনি
তারই মধ্যে অচিহ্ণিত আদি অন্তহীন
আছে যে না বলা বাণী অধরা কাহিনী
লুকানো শোণিতপাত বিষণ্ন মলিন।
দেখে নিও বন্ধুজন সখী সুহাসিনী,
বাঁচার আয়ুধ মায়া মুহূর্ত রঙিন
এঁকেছি নীরব হাসি ভুবন-মোহিনী
মেঘ ভাঙা রোদ আর জোছনা অচিন।
শুনিও অলস দিনে শান্ত অবসরে,
যখন হয়েছে শেষ সব বিকিকিনি
হয়নি এখনও গাওয়া যে পুতঃ রাগিণী
ঘুম ঘুম নিঝ্ঝুম ভরা দ্বিপ্রহরে।
ঝরে পড়বার আগে ক্লান্ত ঝরাপাতা
রেখে গেছে অলিখিত অতিক্ষুদ্র ঋণ
নিগূঢ় নিসর্গ গীতি স্নিগ্ধ অমলিন
নির্ঝরের বাঁকে বাঁকে স্বপ্ন জয়গাঁথা।
এসো এ বাংলায় ।। আরিফ চৌধুরী
একদিন ফুলের স্পর্শের মতো ফুটেছিলে এ বাংলায়
তোমার চেতনার অহংকারে
এ দেশ পেয়েছিলো গৌরবের মানচিত্র
লাল সবুজের পতাকা
অনাবিল মুক্তি ও স্বাধীনতা,
আমরা শোণিতে পেয়েছি অদম্য সাহস
দীপ্তিময় আলোর ছায়া
বজ্রকন্ঠের দৃপ্ত বাণীর উচ্চারণে
জেগেছিলো মানুষ বিস্তীর্ণ এই জনপদে,
আবার আসো যদি এ বাংলায়
তোমার কন্ঠে উচ্চারিত হবে
নতুন দিনের ডাক
আবার জাগবে জানি এ বাংলায়
আবহমান কালের নতুন সূর্য,
আমাদের মৌলিক চেতনায় প্রবাহিত হবে নতুন সময়ের স্রোত
সৌন্দর্যের পূর্ণিমার মতো ফুটবে জীবনের আলো,
সকল সংশয় কেটে সভ্যতার নতুন দিনের পথচলায় কেটে যাবে নতুন ভোর,
আবহমানকালের নতুন নীলিমা পেরিয়ে উত্তরাধিকারের রক্তের ঋণে
সকল স্বত্বায়
আসবে নতুন এক অনুভবের চেতনা।
আবার হবে জয় জীবনের
তোমার ব্যাকুল আহবানে,
অনন্ত বিশ্বাসে , জীবনের স্নিগ্ধতার আলোয়
মানুষ স্বপ্নের যাপিত জীবনে
খুঁজে নেবে নতুন পথ এ বাংলায়।
এসো এ বাংলায় জনস্রোতের সেই আহবানে
প্রাণের উচ্ছাসে মানুষের
সকল আনন্দ বেদনায়।
জলঘূর্ণি ।। নাসির মাহমুদ
“কতো কী যে কথা
উল্কার মতো তীব্রতায় ছুটে এসে
বুদবুদের মতো কোথায় যে মিলে যায়
জানি না-
বোবার মতো নির্বাক ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকি
শব্দের আর কোনো রেশ কিংবা
ধ্বনি-প্রতিধ্বনি খুঁজে পাই না।
হায় জীবন! হায় বিরুদ্ধ বাতাসের কাল!
বুকের বাঁ-পাশের ঘড়ি কি স্তব্ধ হয়ে গেছে
কণ্ঠনালী হারিয়েছে স্বরতন্ত্রী ভেদ করে বেরিয়ে আসার শক্তি?
ফুসফুসও নড়েনা বুঝি-কী নিদারুন পাথরচাপা হৃদয়।
তবু, যমুনার অদৃশ্য স্রোতের মতো বয়ে যায়
পিছুটানহীন বধির সময়।”
বঙ্গবন্ধু:অনিবার্য ইশতেহার ।। মহিবুর রহিম
একটি স্বপ্ন দেখেছিলাম আমি আর্য ও অনার্যের
অনিবার্য বিরোধ উপেক্ষা করে
সেই প্রাকৃত জীবনের উষালগ্নে
চিরক্ষুধিতসত্তার গণগণে আগুনের উত্তাপে
পর্বত প্রমাণ নিষেধাজ্ঞার সময়ে
দশদিক আমাকে নিরুৎসাহের গল্প শুনিয়েছিল
সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি খোড়ল থেকে
দুর্যোগের কলাপাতার মতো
না না কম্পন ভেসে এলো
আমি এক দ্রাবিড় যুবকের মতো মাটিতে উপুড় হয়ে
অচ্যুত সেই স্বপ্নকে পুতে রাখলাম।
কেউ জানে না কীভাবে শত শতাব্দীর বৃক্ষ হয়ে
পাখি হয়ে, নদী হয়ে এবং চ‚ড়ান্ত অর্থে মানুষ হয়ে
স্বপ্নের সেই চারাগাছ ঢেকে দিলো
আমাদের ভ‚গোলের সবুজ দ্রাঘিমা।
কালের নৃশংসতায় ধ্বংস হলো কাল
একটি বদ্বীপের দলিত তরঙ্গ
ভেসে চলেছে বেহুলার ভাসানে
সহজ সাধনার ভগ্নস্তুপে
অনিবার্য আকাক্সক্ষার মাটির চত্ত¡রে
ঝিম ধরে আছে একটি ফলিত সম্ভাবনার গান
যেন এক অনিবার্য ইশতেহার
হাজার বছর পেরিয়ে আমাদের কণ্ঠে জেগে উঠল
একটি উদাত্ত আহ্বান
‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।
১৫ আগস্ট ।। মাঈন উদ্দিন জাহেদ
ব্যাক্তি আমাকে ছোঁয় না, ছোঁয় না ইতিহাসের খেরোপাতা,
আমিতো অনন্তের মৌমাছি শব্দভুগ চারুভাষী-
চিরকাল অনেতিহাসের হালখাতা, ছুঁতেছি তোমার চিবুক।
ইজেলে এঁটে, ফ্রেমে তুলির আঁচড় হয়ে বোধের বাড়ি-
তুমিও তাড়াতাড়ি ঘোমটা আঁটো আমার আড়াআড়ি;
জীবন-বারান্দায় আর হয় না দেখা তোমার আমার।
বৈষ্যবুদ্ধিরা হাটে, হাটে-বাটে-ঘাটে-মাঠে পকেটে,
এমন দো দিল, বেচইন মন তাবৎ এই বঙ্গ-সমাজে ?
তোমার আমার এ গাথার মুখচ্ছবি হয় না আঁকা মৃত্তিকায় ;
বিরহ কাহিনীগাথার শেষ সংলাপও হয় নাতো শেষ;
আগস্ট মানে অনিশেষ দুঃখ- করুণ এই বাংলাদেশ ।
প্যারোল ।। নাসির উদ্দিন আহমদ
মাঝে মাঝে জেল থেকে
প্যারোলে মুক্তি পায় নদী
তখন মাঠ ঘাট থেকে জলের স্বাগত মিছিল
ছড়িয়ে পড়ে সবুজে গোয়ালে নীমের তলায় খড়ের গাঁদায়
আমাদের দু:খেরা বুক পানিতে সাঁতরায়
কলকল শ্লোগান ওঠে
—জেলের তালা ভেঙেছি
জল-যমুনা এনেছি
আমার তো মিছিলেই ভয়
আমার তো প্যারোলেই ভয়
প্যারোলের মেয়াদ ফুরুলেই নদী
আবার ঢুকে যায় গরাদে শিকে
শুকনো বালু-রুটি আর কাঁকড় মিশানো ইরি চালের ভাত
চেয়ে থাকে নদীর চোখে
কঠিন শেকলে আটকে থাকে প্রাণ
নদীরা এখন প্যারোলে এসেই
সখীদের সাথে যৌবনের কথা কয়
মার্চ পাস্ট করে পাড়াময়
মূক বধির ল্যাংড়া থাকে বাকীটা সময়!
অব্যক্ত পদাবলি ।। পাহাড়ী ভট্টাচার্য
মধুর প্রতীক্ষার আড়ালেও থাকে অদৃশ্য যাতনা কত
প্রত্যাশার অগোচরে স্বপ্নভঙ্গের অনিবার্য বেদনার মত
অনন্ত অসীমের দিকে যেতে যেতে চিরকাল যত রক্তপাত
মানুষী মোহ-প্রেম-অভিমান-দ্রোহ আর সংঘাত;পৃথিবীতে
ঘটে গেছে নিয়ত নির্দ্বিধায়, মানুষ তার সবটুকু জানে।
সন্ন্যাসীরও থাকে গৃহকাল,গৃহীর যেমন পরবাস;সময়কে
থামাতে চেয়েছে সে দুর্বিনীত স্পর্ধায় চিরকাল।জাগতিক
মায়া ছাড়েনি পিছু তার,চেয়েছে যে মুক্ত আকাশ,সন্ন্যাস!
তবু,পার্থিব মোহে আবিষ্ট মানুষ অপার্থিবেই খোঁজে পথ;
যাপিত এক জীবনের ধারাপাত,শত মানে।
বঙ্গবন্ধুর প্রতি ।। নাজমুন নাহার
আপনি এতোটা ক্ষমা না করলেও পারতেন
যেমন ধরুন ক্ষমা করে না সাপ তার শিকারকে
কেমন হা করে গিলে খায় –
অথচ আপনি সিংহের মতোন হেলেদুলে
নির্লিপ্ত চোখে তাদের ক্ষমা করে দেন –
তারা মুখে বিষ নিয়ে ফোঁস ফোঁস করছিলো
সুযোগ পেতেই পেখম ছড়িয়ে ফনা মেলে –
একুশ বছর এদেশের মানুষের রন্ধ্রে রন্ধ্রে
ঢুকিয়ে দিলো পরাধীনতার মন্ত্র
তাই আপনি পৃথিবী থেকে প্রয়াণ হলে
আপনার উত্তরসূরিদের সাথে আমরাও কাঁদতে কাঁদতে
হাজির হলাম হে মহান সূর্য সৈনিক –
দোযখ হা দোযখ – উপচে পড়ছিলো মদের গিলাফ
রসালো মিথ্যার মহুয়ার বন
অথচ পালাচ্ছিলো পাখির দল
ঘোমটা দিয়ে নেচেছে কসবী
আমরা উঁকি ঝুঁকি দিয়ে দেখি
ভাংগা পা নিয়ে বসে আছেন আচার্য
অতএব হে মহান ছুড়ি-কাঁচি দিয়ে কেটে দিয়েছি
পুঁজ ভরা দগদগে ঘা –
এখনো মার্চ পাস্ট করে চলছি
অস্ত্র জমা দিয়েছি ট্রেনিং তো জমা দেই নাই’
স্বপ্নজোনাক ।। সাবিনা পারভীন লীনা
দীর্ঘ নীরবতার আদ্রতা চুইয়ে
কিছু মেঘ জমেছে এপারে
বৃক্ষের শরীর ভুলেছে ঢেউ
জলের ক্যানভাসে বিমূর্ত ছায়া
নয়নতারায় ঝরা পাতার কায়া।
ঘুঘুর ডাকে রাধাচূড়া উঠে কেঁপে
বাসর লতার পর্দা সরিয়ে
আঁধারে বার্তা আনে স্বপ্নজোনাক
ওপারে তখন আসর সাজে
মেঘের রাগে তানপুরা বাজে।
সে আমার নদী ।। সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব
কি এমন পূর্ণিমা ছিলো সে রাতে
দুধেল জোসনায় চুঁয়ে পড়ছিলো প্রাণের আকুতি
জানালার পাশ ঘেঁষে পাতার দুলুনি
ডেকে যায় মাখনের নরম গলায়
আঁচড়ানো চিরুনীর মত সুড়সুড়িতে
কি কথা বলতে চায় আহ্লাদী রাত?
ডাংগুলির মত তীব্র গতিতে
বুকের গভীরে লুকিয়ে থাকা শব্দগুলি
ছুটে আসে ধাবমান এই জংলি অশ্বের দিকে
থতমত – অপ্রস্তুত প্রাণের ভূগোল
উদ্বেল, অপার শিহরণে
ঝকমকে চাঁদ উঠে মুখের আকাশে
আহা! সে যদি জানতো, তার এক ইশারাতে
সূর্যের আলোয় একটি ভূখণ্ড গোসল সেরে নেয়
একটি মানচিত্র শুদ্ধ হয় চুম্বনের লীলায়
কান পেতে আছি অরণ্যের হরিণের মত
ঘোরলাগা শব্দের টংকারে কখন
হৃদয়ের উত্তাল জোয়ারে শুরু হবে স্বপ্নের ভ্রমণ।
সে আমার নদী
আমি তার বুকে সাম্পান নিরবধি।