এমিলি ডিকিনসন এর কবিতাগুচ্ছ ও ভূমিকার পরিবর্তে

মুজিব রাহমান

অনুবাদে_এমিলি_ডিকিনসন : এমিলি ডিকিনসন বলতেন, তাঁর কবিতাসমূহ পৃথিবীর কাছে তার চিঠি। তিনি রচনা করেছিলেন ঠিকই কিন্তু নিজে ডাকে পাঠাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। অলোকসামান্য ১৭৭৫ সংখ্যক কবিতা তিনি রচনা করেছিলেন। সযত্ন সংরক্ষণও করেছিলেন। তাঁর জীবদ্দশায় মাত্র ছয়-সাতটি কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল। সেসব নিয়ে তাঁর খেদ ছিলো, অভিমান ছিলো। কিন্তু প্রকাশনার ভেতর দিয়ে তাঁর মনোভাবনা সাহিত্যের বাজারে নিলামে ওঠাতে শতভাগ কুণ্ঠিত ছিলেন এই স্বভাব স্বতন্ত্র কবি।
তিনি বিশ্বাস করতেন –
Publication – is the Auction
Of the Mind of Man –

মাত্র পঞ্চান্ন বছর বেঁচে ছিলেন এই স্বভাব স্বতন্ত্র কবি। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ ছিল মৃত্যুর কারণ। এক চিঠিতে জীবনবাদী এই এই বিখ্যাত মার্কিন কবি লিখেছেন – ‘To live is so startling it leaves little time for anything else.’
কবি মনে করতেন, জীবনযাপনটা এতোটাই বিস্ময়কর যে অন্যকিছু করার আর সময় কোথায়।
প্রাত্যহিক জীবনযাপন, ভাবনা-চিন্তা ভাবা, এবং কল্পনায় বিভোর থাকাই ছিল তাঁর দিনভর কাজ। তিনি বিশ্বাস করতেন, অনুভবগুলো একপাশে সরিয়ে রাখলে চলবে না। অনুভবগুলো নিয়ে ভাবতে হবে। যা যা তিনি দেখতেন, যা যা কল্পনা করতেন এবং যেভাবে তিনি বোধ ও অনুভব করতেন সেসবকে ধরার জন্যই, সম্ভবত, তিনি কবিতা লিখতেন।
তার মনোজগতে মেঠোপথ ধরে তিনি তাঁর প্রিয় কুকুর কার্লোকে হাঁটাতেন, নিয়ে যেতেন, পরিদর্শন করাতে প্রতিবেশিদের নয়, সমুদ্রকে। তার মনে হতো সমুদ্র এক বহুতল প্রাসাদ। পালতোলা জাহাজ, রণতরী এসব একদম ওপর তলার। মৎস্যকন্যারা থাকে নিচতলায়। তারা ছুটে আসতো একদম নিচতলা – বেইসম্যান্ট তথা গৃহতল থেকে তাকে দেখার জন্য। সমুদ্র কীভাবে পায়ে পায়ে তাকে অনুসরণ করে শহর অবধি আসতো সেসব অনুভূতি নিয়ে এ এক অনবদ্য কবিতা।
১৮৬২ সাল তাঁর কবি জীবনের সুবর্ণ বছর। আজকে অনুবাদে তাঁর সে সময়ের একটা কবিতা উপস্থাপন করছি।
কবি বলেছেন, তাঁর কবিতা পৃথিবীর কাছে তাঁর চিঠি। জানিয়েছেন, পৃথিবী তাকে কখনো চিঠি লেখে নি। তিনি জানিয়েছেন, প্রকৃতি তাকে সহজ একটা বার্তা দিয়েছে সস্নেহ রাজসিকতায়। এবং কবি সে বার্তাটি অদৃশ্য হাতে অর্থাৎ তাঁর আগামী পাঠকদের কাছে রেখে যাচ্ছেন। কবি ভবিষ্যতের পাঠকদের বলেছেন, তিনি তাঁর কবিতায় নিসর্গের সমাচারই বিধৃত করেছেন। এবং কামনা করেছেন, প্রকৃতি প্রেমিক পাঠক প্রকৃতিকে ভালোবাসার খাতিরে তাকেও ভালোবাসবেন। এবং তাঁর কবিতা সদয় বিবেচনা ও ইতিবাচক অনুমোদন পাবে কবিতাজগতের সমঝদার পাঠকদের।

এটি_পৃথিবীর_প্রতি_আমার_চিঠি

এটি পৃথিবীর প্রতি আমার চিঠি
যে কখনো লিখেনি আমায়, –
প্রকৃতির বলা সহজ সমাচার,
সকরুণ মহিমায়।

আমি দেখতে পাই না এমন হাতে
সমাচার সমর্পিত তার;
তাকে ভালোবেসে করো,প্রিয়দেশবাসী
সদয় বিচার আমার।

সত্যি_কি_কখনো_ভোর_হবে_আর ?

সত্যি কি কখনো ভোর হবে আর?
দিন বলে আদৌ কি কোনো কিছু আছে ?
পাবো কি পাহাড়ের চূড়ো হতে দেখা তার
হতে যদি পারি সুউচ্চ তার মতো পাছে?

আছে কি শেকড় তার জলপদ্মের মতো ?
আছে কি পালক তার পাখির মতো ?
বিখ্যাত কোনো দেশ হতে এটি কি আনীত
যে দেশের নাম আমার আজও অশ্রুত?

আঃ পণ্ডিত তুমি! আঃ তুমি নাবিক!
বাঃ তুমি স্বর্গ হতে কোনো জ্ঞানীজন!
দয়া করে বলো আমি ক্ষুদ্র যাত্রিক
ভোর নামের জায়গাটির অবস্থান ঠিক!

বইয়ের_মতো_নেই_আর_কোন_রণতরী

বইয়ের মতো নেই আর কোন রণতরী
আমাদের নিয়ে যেতে দেশ থেকে দেশে,
নৃত্যপর একপৃষ্ঠা কবিতা এতো গতিময়
সব তেজি ঘোড়া হার মানে অবশেষে।
পাড়ি দিতে এই পথ হতদরিদ্রও পারে
মাশুলের পীড়ন ছাড়া
কতো সুমিত এইসব দ্রুতযান
মানবাত্মা বহন করছে যারা।

*’আশা সে এক পালকঅলা জিনিস’ লিখেছিলেন এমিলি ডিকিনসন। তিনি আশা নিয়ে লিখেছিলেন, যেমন লিখেছিলেন ফুল, পাখি, লোকজন, জীবন, এবং মৃত্যু – সাদামাটা জিনিস নিয়েও। কিন্তু তাঁর এমন প্রোজ্জ্বল কল্পনা শক্তি ছিল যে, মনে হতো তিনি সমস্ত জিনিসের ভেতর প্রবিষ্ট হতে পারতেন এবং তাদের দিকে তাকাতে পারতেন এক অভিনব দৃষ্টিতে।

আশা_সে_এক_পালকঅলা_জিনিস

আশা সে এক পালকঅলা জিনিস
আত্মার দাঁড়ে ঠাঁই
সুর ভাঁজে শব্দ ছাড়াই
থামাথামির গন্ধমাত্র নাই।

মধুরতম শোনায় প্রবল ঝঞ্ঝায়
এবং তীব্র যখন ঝড়
যা ভড়কে দেয় ছোট পাখিটিকে
যে রাখে অনেককেই উত্তেজনাকর।

আমি শুনেছি এ গান শীতলতম দেশে
এবং বিচিত্রতম সমুদ্রে সত্যি
তথাপি এটি চায়নি কখনো দুঃসময়েও
আমার কাছে খুদকুঁড়া একরত্তি।

সম্ভাব্যতায়_বাস_করি_আমি

সম্ভাব্যতায় বাস করি আমি
গদ্যের চেয়ে সুন্দরতর ঘর,
অগুনতি জানালা বেশুমার
অসংখ্য দরোজা উন্নততর।

সারিসারি কক্ষ, দেওদার যেন
দুর্ভেদ্য দৃষ্টিতে
শাশ্বত ছাদ হয়ে নেমে আসে
ঢালু-আকাশ সৃষ্টিতে।

দর্শনার্থীরা – সর্বোত্তম –
বৃত্তি হিসেবে – এই বর্গ
ছড়িয়ে বিশাল এই সরু হাত
জড়ো করি সুখস্বর্গ।

ভূমিকার_বিন্দুবিসর্গ :
*সমাজ এমিলি ডিকিনসনকে কিংকর্তব্যবিমুঢ় করে তুলতো। মানুষের ভীড়ে তিনি কখনো স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন না। কিন্তু তাঁর তীক্ষ্ণ অনুভূতিতে সমাজের ঊনতা, ন্যূনতা গভীরভাবে অনুভূত হতো। সমাজ সম্পর্কে তাঁর অনুভব ছিল মার্জিত, বাহুল্যবর্জিত ও সংবেদনশীল।
মূলত, তাঁর কবিতাই ছিল তাঁর অন্তরঙ্গ সখী, সজনী। এবং এই সজনীর কাছেই এই কবি অসঙ্কোচে ব্যক্ত করেছেন তাঁর গ্রীষ্ম-দুপুরের আনন্দ, বেঞ্জামিন নিউটনের সাহচর্য-সুখ, বন্ধুর মৃত্যুতে তীব্র বেদনাবোধ, রাত নেমে আসার হতাশা, একাকীত্বের ভয় – সকল কিছু।

১.
প্রভূত_পাগলামো_পরমার্থ_বোধ

প্রভূত পাগলামো পরমার্থ বোধ-
মর্মজ্ঞ চোখের কাছে –
অতি সংবেদ – বদ্ধ পাগলামো –
কয় অধিকাংশই পাছে।
সম্মতি দাও – তবেই সুবোধ তুমি
সকলেই জয়ী তাতে-
দ্বিধা করছো – তক্ষুনি বিপজ্জনক
শেকল পড়বে হাতে –

২.
গোলাপ_ঘরের_অতিকাছে_যেও_না

গোলাপ ঘরের অতিকাছে যেও না
মৃদুমন্দ বাতাসের উৎপাত
শিশিরের প্লাবন
তার দেয়ালগুলোকে ভড়কে দেয়;
প্রজাপতিটিকে বাঁধার চেষ্টা করো না,
পরমানন্দের গরাদ বেয়ে ওঠো না।
নিরাপত্তাহীনতার ভেতর থাকা
আনন্দের-ই নিশ্চয়তাজ্ঞাপক গুণমান।

কত_না_সুখী_এ_ক্ষুদে_পাথর

কতো না সুখী এ ক্ষুদে পাথর
একাকী গড়ায় পথের ওপর,
ভাবনাশূন্য রাত্রি-দিন
বড়ো প্রয়োজনেও শঙ্কাহীন –
একান্ত বাদামী তার পিরান
জঙ্গম জগত করে পরিধান।
সূর্যের মতো সে স্বরাট
যোগে ও বিভায় কী ভরাট,
পরম নির্দেশ মানে হেলায়
স্বভাবসুলভ সরলতায় –

*আমাদের জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি যাতনা ঘিরে আছে আমাদের অস্তিত্ব। কষ্ট সর্বজনীন। কষ্টের সময় কষ্টটাই ভবিতব্য বা নিয়তি হয়ে দাঁড়ায়। এই কবিতায় এমিলি ডিকিনসন মানবায়িত করেছেন কষ্টকে। অনিঃশেষ বেদনা নদী, অপরিমেয় কষ্টকে ঘিরে আছে শূন্যতা। এবং কষ্টকে পূর্ণায়ত করতেই যেন বারবার কষ্ট ঘুরে ফিরে আসে। রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠেও অন্তিম প্রহরে ফুটেছিল – ‘আমৃত্যুর দুঃখের তপস্যা এ জীবন -‘।

কষ্ট_শূন্যতার_এক_অনুপান

কষ্ট – শূন্যতার এক অনুপান –
মনে করতে পারে না শুরুটা
বা ছিল কি এমন সময়
যখন সে ছিল না পুরুটা।

তার কোন আগামী নেই – সে ছাড়া
অশেষ কষ্ট ধরে আছে বিগত দিন
আলোকিত বোধে নূতন সময়
নীল যাতনায় লীন।

শিল্পী হিসেবে মাকড়সা
মূল : এমিলি ডিকিনসন
অনুবাদ : মুজিব রাহমান

শিল্পী হিসেবে মাকড়সা
হয়নি কখনো নিযুক্ত
যদিও তার মেধামান
মুক্তভাবেই স্বীকৃত।

ঈশ্বরের এই দেশজুড়ে
সম্মার্জনী থরে থরে
প্রতিভার উপেক্ষিত পুত্র
তোমাকেই বরি হাত ধরে।

ঘাসের_বেশ_কমই_আছে_করবার

ঘাসের বেশ কমই আছে করবার
সরল সবুজ মাঠের ঘাস ধন্য
কেবল প্রজাপতির ভাবনা আর
মৌমাছিদের বিনোদনের জন্য।

এবং বাতাসের আনা মিষ্টি সুরে
দিনভর ঘাস লুটোপুটি খায়
এবং আঁচল বিছিয়ে ধরে রোদ
আর নুয়ে পড়ে সকলের পায়।

এবং মুক্তোর মতো শিশির পরায়
রাতভর ঘাস হয়ে ওঠে চমৎকার –
দেখার মতো মনোরম দৃশ্য এটি
তুলনায় ডিউক-পত্নী কোন ছার।

এবং এমনকি যখন মরে যায় ঘাস
কী এক স্বর্গীয় সৌরভ পায়,
সাদামাটা সুরভি লুপ্ত প্রায়
পাইনের তাবিজটাও চির নিদ্রায়।

তারপর থাকা দারুণ গোলাঘরে
এবং স্বপ্ন দেখা দূরের দিনের –
ঘাসের বেশ কমই আছে করবার
ইচ্ছে করে খড় হয়ে যাই শুকনো তৃণের।

#সার্জনকে_যত্নশীল_হতেই_হবে

সার্জনকে যত্নশীল হতেই হবে
শল্যছুরিকা যখনই নেয় হাতে!
তাদের সূক্ষ্ম কাটাকুটির নিচে
দুষ্কৃতী জাগে জীবন অভিঘাতে!

তারা বলে সময় উপশম করে

তারা বলে, “সময় উপশম করে,” –
সময় কখনো করেনি উপশম;
সত্যিকার যাতনা গেঁড়ে বসে,
যেমন মাংসপেশি, বয়সের যম।

সময় নেয় কষ্টের পরীক্ষা,
কিন্তু নয় কোনো প্রতিকার।
একটি নির্ণয়, আরেকটিও
ছিল না কোন ব্যাধিভার।

আমি কেউ না কে তুমি?

আমি কেউ না! কে তুমি?
তবে কি কেউ না তুমিও?
তাহলে আমরা একজোড় – বলো না এখন!
তুমি জেনো, তারা আমাদের দেবে নির্বাসন।

কেউকেটা হওয়া কী যে একঘেয়ে
কী যে বারোয়ারি, ব্যাঙের মতো
দিনমান শুধু তব নাম জপা
চারদিকে কাদাপাঁক-মোসাহেব শত।

আমার নদী বয়ে যায় তোমার দিকে
মূল : এমিলি ডিকিনসন
অনুবাদ : মুজিব রাহমান

আমার নদী বয়ে যায় তোমার দিকে
নীল সমুদ্র, স্বাগত জানাবে আমাকে?

উত্তরের অপেক্ষায় আমার নদী।
হে সমুদ্র, উদারভাবে দেখো যদি!

তোমাকে পৌঁছে দেব ছোটো নদী আমি
বিশেষ অঞ্চল হতে, স্বামী।

বলো, সাগর, ভেবে
আমাকে নেবে!

এমিলি ডিকিনসনের ধাঁধা কবিতা।

রুপোলি আভা সবখানে

রুপোলি আভা সবখানে
বালির বাঁধসহ
পথরেখা যাবে না মুছে
মাটি সুরক্ষাবহ।

যদি একটি হৃদয়ের ভাঙন ঠেকাতে পারি

যদি একটি হৃদয়ের ভাঙন ঠেকাতে পারি,
আমার বেঁচে থাকা বৃথা যাবে না;
যদি যাতনায়-জ্বলা জীবনে স্বস্তি দিতে পারি,
অথবা জুড়াতে পারি যাতনা
অথবা মূর্ছাগত লাল ছোটো পাখিখানা
পুনঃ নীড় অবধি পায় সমবেদনা,
আমার বেঁচে থাকা বৃথা যাবে না।

এমিলি ডিকিনসন (১৮৩০ – ১৮৮৬) ওয়াল্ট হুইটম্যান (১৮১৯ – ১৮৯২)-এর সমসাময়িক। একজন দাঁড়িয়ে আছেন আরেকজনের পুরোপুরি বিপ্রতীপে। জীবনচর্যায় হুইটম্যান অবারিত, অসংযত ও খোলামেলা। ভাবনা প্রকাশে হুইটম্যান দরাজ দিল, উচ্ছ্বসিত, বারোয়ারি। অন্যদিকে, এমিলি ভাবনা প্রকাশে সংকুচিত, সংক্ষেপিত, গুপ্ত এবং ব্যক্তিক। কবি হিসেবে পুরোপুরি বিকশিত হবার পথে একটি কৌশল হিসেবে বৃহত্তর সমাজ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়ার বিষয়টি তাঁর পছন্দের রূপায়ণ বলেই অনেক সমালোচক ও জীবনীকার মনে করছেন। জীবন এবং ভালোবাসায় অসম্ভব আশাবাদী এই কবি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের আরোপিত কড়াকড়ি উপেক্ষা করতেন নিজের ধরনে। লোকচক্ষুর অন্তরালবর্তী এই কবির প্রাতিস্বিক ভাবনা তাঁর পাঠককে নানান দিক থেকেই প্রথাবিরোধী করে তোলে। তাঁর যতি চিহ্নের প্রথাবিরুদ্ধ ব্যবহার পাঠককে বিশ্বাস-অবিশ্বাস, জন্ম-মৃত্যু, মরণশীলতা-অমরতা, প্রকৃতির নানান বিপরীত বিষয়সমূহ ভেবে দেখার এক ভিন্ন রকম সুযোগ এনে দেয়।

এমিলি ডিকিনসনের কবিতা ফোঁটা ফোঁটা করে ঝরানো জীবন আরক। এমিলির পরিশ্রুত জীবনের অন্যনাম কবিতা। সাকল্যে তাঁর আট বছরের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা জীবন। প্রচলিত ও জনপ্রিয় Pentameter বা দশ -মাত্রার বা পঞ্চ-স্বরাঘাতযুক্ত ইংরেজি ছন্দ পরিহার করে তিনি চতুর্মাত্রিক বা ত্রিমাত্রিক ও অনিয়মিত ছন্দে কবিতা লিখতে পছন্দ করতেন। তাঁর ব্যবহারজীবী বাবা যিনি পরবর্তীতে কংগ্রেসের সদস্য হয়েছিলেন তাঁর জন্য রান্নাবান্নার এবং গার্হস্থ্য যাবতীয় কাজ তিনি করতেন। ঘরবন্দী জীবনটা ছিল তাঁর স্বনির্বাচিত ও পরম পছন্দের জীবন। বাইবেল পড়েছিলেন, পড়েছিলেন শেইকসপিয়ার এবং গ্রিক ও রোমান পুরাণ। তাঁর জীবদ্দশায় সাহিত্যের জগৎ থেকে তিনি ছিলেন স্বেচ্ছা নির্বাসিত, নিঃসঙ্গ গ্রামীণ এক লাজুক নারী মাত্র। তাঁর কবিতার কুললক্ষণ ছিল শব্দগত কৃচ্ছ্রসাধন। শব্দ ব্যবহারে অত্যন্ত সাবধানী ছিলেন তিনি। একটি শব্দ কতোটা অর্থবহ ও অবিকল্প হতে পারে তাঁর কবিতার যারপরনাই খুঁতখুঁতে শব্দ বাছাই ও শব্দ নির্বাচন দেখলেই তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সতর্কভাবে শব্দবহুলতা পরিহার করেছেন। তাঁর কবিতায় অভিনবভাবে শব্দের বিকল্প হয়ে হয়ে ওঠে এসেছে কখনো চরণের মাঝখানে কোন একটি দুটি শব্দের আদ্যক্ষরের capitalization বা ইংরেজি বড় হাতের অক্ষর, অধিকাংশ ক্ষেত্রে যতিচিহ্নের অভাবিতপূর্ব বুদ্ধিবৃত্তিক যথেচ্ছ প্রয়োগ ও ড্যাশ-আকীর্ণ পঙক্তির অভূতপূর্ব ব্যবহার। এই প্রয়োগ-জনিত গোড়ার দিকের অসুবিধাসমূহ তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। কিন্তু তাঁর স্বাতন্ত্র্য তিনি বিসর্জন দেননি। অব্যাহতভাবে তাঁর দেরাজ ভরে ওঠেছিল কবিতার সোনালী শস্যে। কী করে তিনি যেন জানতেন মহাকাল তাঁকে ধারণ করবে অনন্য মহিমায়। ১৯৫৫ সালে যখন Thomas H. Johnson এই অনামা, অজানা ও অপ্রকাশিত কবির সংকলনটি প্রকাশ করেছিলেন তখন তা ছিল এক বিস্ময়ের মতো। কবিতার গতানুগতিক শিরোনাম প্রদানের প্রথাও তিনি আমলে নেন নি। যেন শিরোনাম কিছুই বলে না। কবিতার পুরো দেহটাই তৈরি করে কবিতার অর্থময়তা। তাঁর কবিতা মূলত সংখ্যায় চিহ্নিত। বহু-ব্যবহারজীর্ণ বিষয়টিও এমিলির ভাবনার স্পর্শে মৌলিকতার আলোয় উজ্জ্বল হয়ে ওঠেছে। পাথর কুঁদে যেমন ভাস্কর মূর্ত করে তোলেন চমৎকার ও জীবন্ত চোখমুখ, অবয়ব ঠিক তেমনি ভাষা ও ভাবনার ছেনি-বাটালি দিয়ে কুঁদে তিনি স্পষ্ট, উজ্জ্বল ও আকর্ষণীয় করে তোলেন তার বিচিত্র বিষয়ে নূতন নূতন জীবন ভাবনা, দৃষ্টিভঙ্গি ও বহুকৌণিক চিন্তন। মূলত, এই প্রথাবিরুদ্ধতা এবং নূতন পথ সৃষ্টির সক্ষমতা মার্কিন কবিতার সমৃদ্ধ ইতিহাসে এক অনন্য উচ্চতায় আসীন করেছে এমিলি ডিকিনসনকে। প্রকৃতি সংবেদী এই কবির মরমি চিন্তা ও অধ্যাত্ম ভাবনা স্বভাবগত স্বকীয়তায় সমুজ্জ্বল।
তাঁর প্রত্যেকটি কবিতায় তাঁর জীবনদর্শন ও মৃত্যু-ভাবনা ছড়িয়ে আছে।
তাঁর বন্ধু সুসান শেষ দিন পর্যন্ত পরম যত্নে, পরম ভালোবাসায় ডিকিনসনকে জড়িয়ে ছিলেন।

১.
আমরা শিখেছিলাম ভালোবাসা সমগ্র

আমরা শিখেছিলাম ভালোবাসা সমগ্র,
বর্ণমালা, শব্দাবলি,
একটি অধ্যায়, তারপর দাপুটে বই –
তারপর প্রত্যাদেশ হলো বন্ধ।

কিন্তু অজ্ঞতা পড়লো ধরা
পরস্পরের চোখে
শৈশবের চেয়ে অধিকতর স্বর্গীয়
এবং প্রত্যেকের কাছে শিশু প্রত্যেকে

এবং চললো চেষ্টা ব্যাখ্যা করার
দুজনের পক্ষেই যা বোঝা ভার।
হায়, ঐ প্রজ্ঞা এতোই উদারচেতা
এবং সত্য এতো বিচিত্র রূপ তার!

২.
মন্তব্য যে কেউ করতে পারে –
মন্তব্য নিজেই – এক প্রশান্ত বিষয়
ফিউজ যোগাতে পারে বিদ্যুৎস্ফুলিঙ্গের মুখে
বিদ্যমান থেকে – সুপ্ত দশায়।

আসুন বিভাজিত হই – দক্ষতাসহ
আসুন ব্যাখ্যা করি – সযত্ন –
কাঠকয়লাতেও বারুদ আছে –
আগুনে তা থাকার আগ হতেই।

৩.
বিবেচিত হতে ইচ্ছুক শব্দকে
কবি বললেন, তোমাকে নেবো কি?
বাকিদের সঙ্গে থির হয়ে বসো
আমার সুন্দরতর শব্দ পাওয়া অবধি –

ভাষাবিদ্যা আঁতিপাঁতি খুজলেন কবি
এবং ঘন্টা বাজাতে চাইলেন ঢংঢং
আপাত ঝুলিয়ে রাখা প্রার্থীর জন্য
অযাচিত কেউ এসে ঢুকে পড়লো ভেতরে –

স্বপ্নের ঐ অংশ
পূরণ করতে আবেদন করেছিল শব্দটি
মনোনয়ন পাবার আগেই
অভিজাত থেকে নিম্নবর্গের দেবদূতেরা আবির্ভূত।

এমিলি সম্পর্কে কবি টেড হিউজ –
She was devoted, she led the life of a recluse and she wore white, proper for a bride of the spirit, and she daily composed poems that read like devotions. But she was first of all true to herself and her wits. Whether from Church or Science, she would accept nothing by hearsay or on Authority, though she was tempted every way. She reserved herself in some final suspension of judgement. So her poems record not only her ecstatic devotion, but her sharp, sceptical independence, her doubt, and what repeatedly opens under her ecstasy – her despair

এমিলি পঞ্চক
১.

“স্বর্গ” কী –
কারা থাকে ওখানে –
তারা কি “কৃষক” –
তারা কি নিড়ানি দেয় –
তারা কি জানে যে এটি “অ্যামহার্স্ট” –
এবং আসছি আমিও –
স্বর্গে তারা কি “নূতন জুতো” পরে –
সবটা সময় কি ওখানে প্রীতিপ্রদ –
তারা কি আমাদের বকবে না আমরা ক্ষুধার্ত হলে –
অথবা বলবে না ঈশ্বরকে – আমরা কতটা ত্যাড়া –

তুমি কি নিশ্চিত সেখানেও আছে একজন
আকাশের – ঈশ্বরের মতোন –
সুতরাং আমি যদি চিরতরে ওখানে হারাই
অথবা সেবিকা যাকে বলে ঠিক “মারা যাওয়া” –
নগ্নপায়ে আমি জাফ্রং মণির ওপর দিয়ে হাঁটবো না
প্রায়শ্চিত্তে মুক্ত মানুষ – ঠাট্টা করবে না দেখে আমাকে –
স্বর্গ সম্ভবত এতোটা বিজন নয়
যেমনটা সচরাচর নিউ ইংল্যান্ড !
[What Is – “Paradise”]

২.
ভালোবাসাই সব সর্বত্র জুড়ে
ভালোবাসা নিয়েই আমরা সব অবগত
এইতো ঢের, পরিবাহিত পণ্য হওয়া উচিৎ
বাঁধা ছকে অনুপাতসম্মত।

[That Love is all there is]

৩.
হৃদয় চায় সুখানুভব – শুরুতে
তারপর – যাতনা হতে মার্জনা –
অতঃপর – ওই যৎসামান্য বেদনানাশক
যা উপশম করে মর্মবেদনা –

এবং তারপর – ঘুমুতে যাওয়া –
অতঃপর – যদি তেমন না থাকে দ্বিধা
বিচারকের পরম ইচ্ছায় মিলে যায়
মরণের বিশেষ সুবিধা –

[The Heart asks Pleasure – first]

৪.
রাসায়নিক প্রত্যয় এমন
কিছুই হবে না নাশ
সর্বনাশে সক্রিয়
আমার ভাঙ্গা বিশ্বাস

অণু কণার আকার ধরন
দেখতে যদি পারি
শেষ হয়ে যাওয়া প্রাণিকুল
কতো দ্রুত যেত ছাড়ি!

[ The Chemical conviction]

৫.
পৃথিবীতে কোন স্তব্ধতা নেই – এতোটা নিঃশব্দ
উচ্চারিত সব যা সহ্য করেছিল
যা প্রকৃতিকে নিরুৎসাহিত করবে
এবং বলবে বারবার হানা না দিতে বিশ্বে।

[ There is no Silence in the Earth – so silent]

মুজিব রাহমান : সহযোগী অধ্যাপক : ইংরেজি বিভাগ, চট্টগ্রাম কলেজ।

১টি মন্তব্য

  1. সুন্দর লেখা ও অনুবাদ। লেখক ও অনুবাদককে ধন্যবাদ। এমিলির ১৭৭৫টি কবিতার সবই বাংলা ভাষায় অনূদিত হওয়া দরকার। উল্লেখ্য আমিও ২০১৮ সালে অনুবাদ করেছিলাম ‘এমিলি ডিকিনসনের কবিতা’, যা চৈতন্য থেকে প্রকাশিত হয়েছিলো।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন