চিন্তা
বাংলা ভাষায় ইসলামের অভিব্যক্তি: বয়ান, ইরফান ও বুরহান
মনোয়ার শামসী সাখাওয়াত
পুবাকাশ
কৃষিভিত্তিক সমাজে ক্ষমতারিক্ত বাঙালি মুসলমান ইরান, তুরান কিংবা হিন্দুস্তানের মত ধ্রুপদী শিক্ষা ও জ্ঞান চর্চার স্বাক্ষর রাখতে পারে নি। তাই সোনারগাঁও এবং গৌড়ে সীমাবদ্ধ দারসবাড়িগুলিতে কুরআন, হাদিস, ফিকহ ও কালামের চর্চা হয়তো কিছুটা হয়েছে; কিন্তু শিরাজ, ইসফাহান, দিল্লী বা লক্ষ্ণৌর মত হিকমার চর্চা হয়নি। এ কারণে মোল্লা সদরা শিরাজীর (১৫৭২-১৬৪০) মধ্য দিয়ে সাফাভি ইরান ও মুঘল হিন্দুস্তানে যে হিকমাতুল মুতা’আলীয়ার চর্চা হয়েছিল তা বাংলার আশরাফ মুসলমানদেরও ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে গিয়েছিল।
১.
বাংলা ভাষায় ইসলামের লিখিত অভিব্যক্তি খুব বেশি হয়নি। ইসলাম প্রচারক বড় বড় অলি আউলিয়া, দায়ী, উলামা, পীর, মুরশিদ তাদের কার্যক্রম মূলত মৌখিক ভাবে করেছেন। যতটুকু প্রচারকালের লেখালেখি পুঁথি আকারে পাওয়া গেছে তা আখ্যান বা কাব্য আঙ্গিকের। যুক্তিতর্ক বিন্যাস সেখানে প্রান্তিক। বর্ণনামূলক আখ্যান, ছন্দমিলসমৃদ্ধ কাব্যিক বিন্যাস ও অন্তরলোকের মায়াময় উদ্ভাসন—অর্থাৎ বয়ান ও ইরফান হল সেখানে প্রধান প্রকাশ প্রকরণ। প্রামাণ্য ও যৌক্তিক ভাষার গ্রন্থনা ও পরাজ্ঞান বা বুরহানি হিকমা সেখানে খুব কমই দৃশ্যমান।
কৃষিভিত্তিক সমাজে ক্ষমতারিক্ত বাঙালি মুসলমান ইরান, তুরান কিংবা হিন্দুস্তানের মত ধ্রুপদী শিক্ষা ও জ্ঞান চর্চার স্বাক্ষর রাখতে পারে নি। তাই সোনারগাঁও এবং গৌড়ে সীমাবদ্ধ দারসবাড়িগুলিতে কুরআন, হাদিস, ফিকহ ও কালামের চর্চা হয়তো কিছুটা হয়েছে; কিন্তু শিরাজ, ইসফাহান, দিল্লী বা লক্ষ্ণৌর মত হিকমার চর্চা হয়নি। এ কারণে মোল্লা সদরা শিরাজীর (১৫৭২-১৬৪০) মধ্য দিয়ে সাফাভি ইরান ও মুঘল হিন্দুস্তানে যে হিকমাতুল মুতা’আলীয়ার চর্চা হয়েছিল তা বাংলার আশরাফ মুসলমানদেরও ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে গিয়েছিল।
অবশ্য বাংলার সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় নদীয়ায় চৈতন্যদেবের ভাবান্দোলনের যে সূত্রপাত হয়েছিল তা বৈষ্ণব, বাউল, ফকির ইত্যাদি শাখা-প্রশাখায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে তার নিজ নিজ অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছে। এটা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের লিখিত ও মৌখিক দুই রূপেই হয়েছে। তবে এই ভাবান্দোলন সমাজের কুলীন ও আশরাফ মহলে স্বীকৃতি পায়নি। ফলে চৈতন্য থেকে লালন অব্দি এই ভাবান্দোলন সনাতন ও ইসলাম ধর্মের স্বীকৃত কাঠামোর বাইরে স্থান পেয়েছে।
বাংলা ভাষায় ইসলামের বয়ান, ইরফান ও বুরহান প্রাক-উপনিবেশিক যুগে ঐতিহাসিক কারণে বিকশিত হতে পারেনি। কিন্তু উপনিবেশিক যুগের শেষের দিক থেকে মীর মশাররফ হোসেন, কায়কোবাদ, মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, বেগম রোকেয়া, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, আবুল মনসুর আহমদ, গোলাম মোস্তফা, কাজী নজরুল ইসলাম, কাজী আবদুল ওদুদ, মওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী, আবুল হাশিম, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, আবদুল হক, মওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম, ফররুখ আহমদ, আহমদ শরীফ, শামসুর রাহমান, এবনে গোলাম সামাদ, আল মাহমুদ, আহমদ ছফা, হুমায়ুন আজাদ, ফরহাদ মজহার, সলিমুল্লাহ খান, তসলিমা নাসরীন প্রমুখ বিভিন্নভাবে ইসলামের পক্ষে বা বিপক্ষে বাংলা ভাষায় চর্চা করেছেন।
২.
উনিশ শতক থেকে উপনিবেশিক কলকাতায় বাঙালির যে নবজাগরণ হয়েছে তার চূড়ান্ত উৎকর্ষ পুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি বাংলার ভাবান্দোলনের উত্তরাধিকার ফকির লালন শাহকে তার অনুপ্রেরণার একটি সূত্র হিশেবে গ্রহণ করেছিলেন। এর মাধ্যমে বাঙালি স্বারস্বত সমাজের একধরনের স্বীকৃতি ফকির লালন শাহের মিলেছে বলা যায়। যদিও নাগরিক আধুনিক সমাজ তখন থেকে এখনো বাংলার ভাবান্দোলনকে একটি লোকায়ত ও নিম্নবর্গের বিষয় বলেই মনে করে। আর বাঙালি মুসলিম আশরাফ বিশেষ করে আখবারি-হানাফি-ফিকহী সমাজ তো একে তার মাজহাবি কাঠামোর মধ্যে জায়গা দেয় না।
বাংলা ভাষায় ইসলামের বয়ান, ইরফান ও বুরহান প্রাক-উপনিবেশিক যুগে ঐতিহাসিক কারণে বিকশিত হতে পারেনি। কিন্তু উপনিবেশিক যুগের শেষের দিক থেকে মীর মশাররফ হোসেন, কায়কোবাদ, মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, বেগম রোকেয়া, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, আবুল মনসুর আহমদ, গোলাম মোস্তফা, কাজী নজরুল ইসলাম, কাজী আবদুল ওদুদ, মওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী, আবুল হাশিম, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, আবদুল হক, মওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম, ফররুখ আহমদ, আহমদ শরীফ, শামসুর রাহমান, এবনে গোলাম সামাদ, আল মাহমুদ, আহমদ ছফা, হুমায়ুন আজাদ, ফরহাদ মজহার, সলিমুল্লাহ খান, তসলিমা নাসরীন প্রমুখ বিভিন্নভাবে ইসলামের পক্ষে বা বিপক্ষে বাংলা ভাষায় চর্চা করেছেন।
৩.
প্রাক-উপনিবেশিক, উপনিবেশিক ও উত্তর-উপনিবেশিক কালে বাংলা ভাষায় ইসলামের অভিব্যক্তির একটা সংক্ষিপ্ত পরিচিতি আমরা পেয়েছি। এই তিন কালের চর্চাকে যদি তানকীদ বা পর্যালোচনা করি তাহলে দেখব যে বাংলা ভাষায় ইসলামের অভিব্যক্তির যে তিন প্রকাশভঙ্গী রয়েছে যথা বয়ান, ইরফান ও বুরহান—এসব এই তিন যুগের কোনো যুগেই একাধারে একসঙ্গে কিংবা পাশাপাশি আলাদাভাবে আকাঙ্খিত মানে ও স্তরে চর্চিত হয় নি।
যেমন নদীয়া থেকে ছেউড়িয়াতে চৈতন্য থেকে লালন পর্যন্ত যে চেতনাময় অদ্বৈত অস্তিত্বকেন্দ্রিক উদ্ভাসন, আস্বাদন, উপলব্ধি ও যাপনের চর্চা তা প্রধানত গানের মাধ্যমে মৌখিক অভিব্যক্তি পেয়েছিল। সমাজের ব্রাত্যজনের এই ভাব বিপ্লব অনেক পরে লিখিত আকার পেয়েছে। এরা অবশ্য মৌখিক রূপকেই ইতিমধ্যে মহিমা দিয়ে ফেলেছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে অনেক ভাবচর্চাই মৌখিকভাবে শুরু হলেও তা একপর্যায়ে লিখিত রূপে না এলে সমাজে এর প্রচার ও প্রসার করা কঠিন হয়ে যায়। আরবে কুরআন প্রথমে মৌখিক রূপেই এসেছিল; কিন্তু যখন ইসলাম আরব থেকে প্রতিবেশী বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল তখন এর একটা লিখিত রূপ দেয়া প্রয়োজন হয়ে পড়ল।
এছাড়া নদীয়া-ছেউড়িয়া ভাবকৃষ্টি বেশি প্রকাশিত হয়েছে বয়ান ও ইরফান আকারে। বুরহানী উপস্থাপনা তুলনামূলকভাবে কম হয়েছে। অলিখিত রূপকল্প ও গানের আকারে প্রকাশিত হতে গেলে যে সীমাবদ্ধতা চলে আসে তাতে বুরহানী বা গদ্যরূপে যুক্তিতর্কের বিন্যাস করাটা কঠিন হয়ে যায়। শাস্ত্রবিরোধী হবার ফলে এটা হওয়াটাই স্বাভাবিক। সমাজের শিক্ষিত ও শাসক গোষ্ঠীসহ সকল স্তরের মানুষের কাছে পৌঁছাতে হলে যে কোন ভাবকৃষ্টিকে একদিকে যেমন লিখিত বর্ণনা ও মায়াবী উদ্ভাসন নিশ্চিত করতে হয়, তেমনি অন্যদিকে মানুষের আকল বা বুদ্ধির কাছেও গ্রহণযোগ্য হতে হয়।
আর এই নদীয়া-ছেউড়িয়া ভাবকৃষ্টির সবচাইতে বড় সমস্যা যেটা হয়েছে সেটা হল এটা বৈদিক শাস্ত্র ও সমাজনীতি বিরোধী হলেও এর ভাব-ধারণার উৎস স্থানীয় দ্বৈত-অদ্বৈত কাঠামোর মধ্যেই নিহিত। এটি সেসময়ে আগত ইসলামের সূফি ধারার সঙ্গে একধরনের মোকাবিলা করেছে বটে। ইসলামের সামাজিক সাম্য দ্বারা প্রভাবিত হয়ে জাত-পাত-লিঙ্গ-শ্রেণি ইত্যাদি অমান্য করেছে; একত্ববাদ দ্বারাও প্রভাবিত হয়েছে। কিন্তু পৌরাণিক ভাষা, ব্যক্তিত্ব, চরিত্রকে নিজেদের মত করে ব্যাখ্যা করে চর্চা করা অব্যাহত রেখেছে; সর্বোপরি ব্যক্তিক স্রষ্টার ভজনা না করে জীবন্ত মানুষের শরীর ও দেহকেই স্রষ্টা রূপে ভজনা করেছে। যা ইসলামের শারিয়ী কিংবা মা’আরেফি কোনো ভাষ্যেই গ্রহণযোগ্য হয় নি। এসব কারণে বাংলার গাঙ্গেয় এই ভাব বিপ্লব অনেক সম্ভাবনা জাগিয়েও বৃহত্তর সনাতন ও মুসলিম সমাজে প্রান্তিক হয়েই থেকে গেছে। এটা বাংলা ভাষায় ইসলামের অভিব্যক্তি নয়। এই দাবী এরা নিজেরাও করে না; আর অন্যেরাও এটিকে বাংলা ভাষায় সমন্বয়ী কৃষ্টি বা সিনক্রেটিজমের একটি স্থানীয় উদ্যোগ হিশেবেই গ্রহণ করে থাকে।
এই নদীয়া-ছেউড়িয়া ভাবকৃষ্টির সবচাইতে বড় সমস্যা যেটা হয়েছে সেটা হল এটা বৈদিক শাস্ত্র ও সমাজনীতি বিরোধী হলেও এর ভাব-ধারণার উৎস স্থানীয় দ্বৈত-অদ্বৈত কাঠামোর মধ্যেই নিহিত। এটি সেসময়ে আগত ইসলামের সূফি ধারার সঙ্গে একধরনের মোকাবিলা করেছে বটে। ইসলামের সামাজিক সাম্য দ্বারা প্রভাবিত হয়ে জাত-পাত-লিঙ্গ-শ্রেণি ইত্যাদি অমান্য করেছে; একত্ববাদ দ্বারাও প্রভাবিত হয়েছে। কিন্তু পৌরাণিক ভাষা, ব্যক্তিত্ব, চরিত্রকে নিজেদের মত করে ব্যাখ্যা করে চর্চা করা অব্যাহত রেখেছে; সর্বোপরি ব্যক্তিক স্রষ্টার ভজনা না করে জীবন্ত মানুষের শরীর ও দেহকেই স্রষ্টা রূপে ভজনা করেছে। যা ইসলামের শারিয়ী কিংবা মা’আরেফি কোনো ভাষ্যেই গ্রহণযোগ্য হয় নি।
৪.
উপনিবেশিক ও উত্তর-উপনিবেশিক যুগে বাংলা ভাষায় ইসলামের অভিব্যক্তি হয়েছে ভিন্নভাবে। এবারে মৌখিক ও লিখিত উভয় প্রকাশরূপেই তা পরিবেশিত হয়েছে। মৌখিক রূপকল্প হিশেবে বিরাট একটা ভূমিকা রেখেছে ওয়াজ মাহফিলের তাহজীব, আদাব এবং তমদ্দুন। আর লিখিত আকারে বিভিন্ন রকমের কিতাব প্রকাশিত হয়ে আসছে। এইসবের প্রকাশভঙ্গীতে কী বয়ান, ইরফান ও বুরহানের উপস্থিতি সমানুপাতিক না অসমানুপাতিক?
উপনিবেশিক ও উত্তর-উপনিবেশিক কালে যারা বাংলা ভাষায় ইসলামের অভিব্যক্তি বিভিন্নভাবে করেছেন তারা কি বয়ান, ইরফান এবং বুরহান সমানুপাতিকভাবে নিশ্চিত করতে পেরেছেন? এখানে বয়ান হল আখবারি বা উলুম আল নাকলিয়া যা প্রতিষ্ঠিত কিতাব, সাহিত্য ও ইতিহাসের বর্ণনামূলক ও প্রায়শঃ পুনরুৎপাদনমূলক ভাষিক উপস্থাপনা। ইরফান হল চর্চাকারীদের নিজস্ব চৈতন্যে অখন্ড ও অদ্বৈত অস্তিত্বের আস্বাদন ও উপলব্ধিময় আলোকোজ্বল উদ্ভাসন ও উন্মীলন। আর বয়ান হল উলুম আল আকলিয়া যা বুদ্ধির বিচারের মাধ্যমে উলুম আল নাকলিয়ার বর্ণনা ও ইরফান লব্ধ প্রজ্ঞার প্রামাণিক যুক্তিবিন্যাস ও প্রতিপাদন করে।
মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, মওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী, মওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম থেকে শায়খ ড. খন্দকার আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর পর্যন্ত বাংলা ভাষায় যারা ইসলামের অভিব্যক্তি বিভিন্নভাবে করেছেন তাদের রচনাবলী এই তিন প্রকাশ প্রকরণের আলোকে তানকীদ বা ক্রিটিকালি পাঠ করা প্রয়োজন। তাহলে আমরা বুঝতে পারব যে তারা কে কোন কোন বৈশিষ্ট্য ও প্রকাশ প্রকরণে বেশি বা কম জোর দিয়েছেন।
আবার আবুল হাশিম, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ থেকে ফরহাদ মজহার প্রমুখ পর্যন্ত সাধারণ বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকারীরা এই পর্যালোচনায় কেমন ভাবে উঠে আসবেন সেটাও একটা ইন্টারেস্টিং অবলোকন হবে।
উপনিবেশিক ও উত্তর-উপনিবেশিক কালে যারা বাংলা ভাষায় ইসলামের অভিব্যক্তি বিভিন্নভাবে করেছেন তারা কি বয়ান, ইরফান এবং বুরহান সমানুপাতিকভাবে নিশ্চিত করতে পেরেছেন? এখানে বয়ান হল আখবারি বা উলুম আল নাকলিয়া যা প্রতিষ্ঠিত কিতাব, সাহিত্য ও ইতিহাসের বর্ণনামূলক ও প্রায়শঃ পুনরুৎপাদনমূলক ভাষিক উপস্থাপনা। ইরফান হল চর্চাকারীদের নিজস্ব চৈতন্যে অখন্ড ও অদ্বৈত অস্তিত্বের আস্বাদন ও উপলব্ধিময় আলোকোজ্বল উদ্ভাসন ও উন্মীলন। আর বয়ান হল উলুম আল আকলিয়া যা বুদ্ধির বিচারের মাধ্যমে উলুম আল নাকলিয়ার বর্ণনা ও ইরফান লব্ধ প্রজ্ঞার প্রামাণিক যুক্তিবিন্যাস ও প্রতিপাদন করে।
এই পর্যালোচনাগুলি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এসব থেকে উঠে আসবে যে কেন বাংলা ভাষায় ইসলামের অভিব্যক্তি অনতি দূরবর্তী হিন্দুস্তান বা উত্তর ভারতের বিভিন্ন ভাষায় কৃত অভিব্যক্তিগুলির সমকক্ষ হয়ে উঠতে পারেনি। যেমন সেখানে শায়খ আহমদ সিরহিন্দী থেকে শাহ ওয়ালী উল্লাহ, ফজলে হক খায়রাবাদী হয়ে আশরাফ আলী থানভী, হোসাইন আহমদ মাদানী, মুহাম্মদ ইকবাল, আজাদ সুবহানী প্রমুখেরা ইন্দো-পারসিক ভাষা পরিমন্ডলে ফারসি ও উর্দু ভাষায় ইসলামের উৎকৃষ্ট অভিব্যক্তি করেছেন। কিন্তু বাংলা অঞ্চলে সমতুল্য কাজ ঐসব ভাষাতেও হয়নি। বাংলা ভাষাতে তো নয়ই। এর কারণ আমাদেরকে বুঝতে হবে এবং এর প্রতিবিধান আমাদেরকে করতে হবে।
৫.
কুরআনের “প্রথানুগ” ব্যাখ্যা হল “তাফসির”। আর “তাবিল” হল কুরআনের ভাষ্যমূলক “উন্মোচন” যা এর ভাষার উপরে প্রলিপ্ত থাকা “পর্দা”র মোচন করে। এই ভাষ্য উন্মোচন কখনো টেক্সট বা পাঠের ভাষাগত-সাহিত্যিক ও দার্শনিক স্তরে নজর দেয়; আবার কখনো ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক স্তরে দৃষ্টিপাত করে। দুঃখজনকভাবে বাংলা ভাষায় ইসলামের অভিব্যক্তিতে এই তাবিল যথেষ্ট বিকশিত হয়নি। মোহাম্মদ আরকুনের ভাষায় যদি বলি তাহলে বলতে হয় যে তাবিল এখনো ইসলামের তুরাসে “চিন্তিত” ও “চিন্ত্যনীয়”-এর সীমার বাইরেই সাধারণত বিরাজ করছে। তাবিলের নতুন একটি কক্ষপথ শুরু করতে হবে যেখানে “পর্দা”র আবরণ অপসারণ করে সত্যকে উন্মোচিত করতে হবে। ঐতিহাসিকতা কিংবা স্থানকালপাত্রের সাপেক্ষে “আয়াতে”র অর্থ উদ্ধার করে প্রতীকসমৃদ্ধ বিশ্বজগতের ভাষ্য রচনা করতে হবে। আর এটি করতে হবে বয়ান, ইরফান এবং বুরহানের যৌথ প্রয়োগে। সেইসঙ্গে তুরাসের তানকীদ বা উত্তরাধিকারের পর্যালোচনা করে তাজদীদ বা নবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
৬.
বাংলা ভাষায় ইসলামের অভিব্যক্তির তানকীদ বা পর্যালোচনা করতে গিয়ে এই অভিব্যক্তি উপমহাদেশের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে কিভাবে হয়ে আসছে তার একটু তত্ত্বতালাশ ও সুলুকসন্ধান করতে হচ্ছে।
আঠারো শতকে দুটি স্বতন্ত্র বুদ্ধিবৃত্তিক ও আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য সংহত হয়ে উঠেছিল। মুঘল আমলের উত্তুঙ্গ পর্যায়ে এই দুই ধারার বীজ রোপিত হয়েছিল। প্রথমটি দিল্লী এবং এর আশেপাশে বিকশিত হয়েছিল। এটাতে শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দিসের (মৃ. ১৬৪১) হাদিস পাঠের প্রতি গুরুত্ব দেয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল শায়খ আহমদ সিরহিন্দীর (মৃ. ১৬২৪) নকশবন্দীয়া-মুজাদ্দেদীয়া তরিকা অনুযায়ী ওয়াহাদাতুশ শুহুদের প্রতি মনোযোগ। সতের শতকের শেষার্ধে এই ধারাটি শক্তিশালী হয়েছিল বিশেষ করে সম্রাট আওরঙ্গজেবের সমর্থনে এবং দিল্লীস্থ মাদরাসার মওলানা আবদুর রহীমের (মৃ. ১৭১৮) কর্মকান্ডের সূত্রে। তার পুত্র শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলবি (মৃ. ১৭৬২) আঠারো শতকে এই ধারার তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক চর্চার প্রধান ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন। অন্যদিকে নকশবন্দীয়া-মুজাদ্দেদীয়া তরিকার সুফি মাজহার জান-ই-জানান (মৃ. ১৭৮১) এই ধারাটিকে আঠারো শতকে বিশেষ সাফল্যের সাথে রক্ষা করেছিলেন।
দ্বিতীয় ধারাটি ছিল প্রধানত মীর ফতেহউল্লাহ শিরাজী (মৃ. ১৫৮৯) কর্তৃক ইরান থেকে নিয়ে আসা বুরহানি বা বুদ্ধিযুক্তিবাদী জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্য। এতে ইবনে আরাবীর ওয়াহাদাতুল উজুদের উপরে জোর দেয়া হয়েছিল। এই ধারাটি সুফি চিন্তা ও চর্চায় তেরো শতক থেকে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে আসছিল। সম্রাট শাহজাহান যে স্থানকে “হিন্দুস্তানের শিরাজ” বলেছিলেন সেই অযোধ্যার মাদরাসাগুলিতে এই ধারার চর্চা লক্ষ্যণীয়ভাবে প্রচলিত ছিল। এই অঞ্চলের চিশতী সিলসিলাও এই ধারার অনুশীলনে লিপ্ত ছিল। মোল্লা নিজামউদ্দীন (মৃ. ১৭৪৮) প্রণীত দারসে নিজামিয়া নামক শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে এই ধারাটির একটি বিদ্যাজাগতিক রূপের উন্নয়ন করে একে আরো সংহত করা হয়েছিল আঠারো শতকে। এই কাজটি সম্পন্ন হয়েছিল লখনৌর ফিরিঙ্গি মহল পরিবারের হাত ধরে। আর এর আধ্যাত্মিক রূপের চর্চায় সংহতি দিয়েছিলেন কাদিরিয়া তরিকার সুফিবৃন্দ।
উপমহাদেশের মুসলিম বিদ্যাজগত, বুদ্ধিবৃত্তি এবং হৃদয়বৃত্তির বলয়গুলিতে এই দুটি ধারার মধ্যে একটি সম্পর্ক মূলত বিরোধীতার। কখনো কখনো এই দুটি ধারা পাশাপাশি অবস্থান করে বিকশিত হলেও এর একটির উন্নতি আরেকটির অবনতির কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। যেমন মুঘল আমলে বিশেষ করে সম্রাট আকবরের শাসনকালে যখন উপমহাদেশের মুসলিমেরা অনেক সংহত এবং শক্তিমান ছিল তখন তাদের এই উচ্চকিত অবস্থান তাদেরকে উদার ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হবার সুযোগ করে দিয়েছিল। তারা নিজেদেরকে বিপদগ্রস্ত অথবা অস্তিত্ব ঝুঁকির মুখোমুখি না পাওয়াতে তাদের মধ্যে উদারতা ও অন্যকে গ্রহণ করার একটা ইতিবাচক প্রবণতা দেখা গিয়েছিল। এই রাজনৈতিক-সামাজিক পরিবেশে বিদ্যাজগত, বুদ্ধিবৃত্তি ও হৃদয়বৃত্তির চর্চায় বেশি উন্মুক্ত হবার সুযোগ এসেছিল। এই প্রেক্ষিতেই কুরআন, হাদিস, তাফসির, ফিকহ ইত্যাদি মানকুলাত বিষয়াবলীর পাশাপাশি কালাম, মানতেক, হিকমা ইত্যাদি মা’কুলাত বিষয়াবলীর চর্চা প্রাতিষ্ঠনিকভাবে হতে পেরেছিল।
কিন্তু আঠারো শতকের মাঝামাঝি থেকে যখন মুঘল সাম্রাজ্য অবক্ষয় ও পতনের দিকে নেমে গেছে তখন থেকে এর সামরিক, রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক বিপর্যয়ের মুখে বিদ্যাজগত, বুদ্ধিবৃত্তি ও হৃদয়বৃত্তিও ক্রমশ: আত্মরক্ষামূলক ও অন্তর্মুখী হয়ে অন্য/অপরভীতিতে ভুগেছে। ফলে তারা মনে করেছে তাদের মৌলিক টেক্সট ও চর্চাগুলিতে কেবল তাদের মনোযোগ দেয়া উচিত। আর এসবের ক্ষেত্রে যত শুদ্ধবাদী, আক্ষরিক ও আদিরূপের অনুসারী হওয়া যাবে ততই তাদের মঙ্গল হবে বলে তারা মনে করেছে। এক্ষেত্রে একদিকে হিন্দুস্তানের বিপুল অমুসলিম জনগোষ্ঠীকে তারা যেমন হুমকী মনে করেছে তেমনি ইউরোপ থেকে আগত বেনিয়ারূপী উপনিবেশিকদের সামগ্রিক অনুপ্রবেশেও তারা অস্থির ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল। এই প্রেক্ষাপটেই দেখতে হবে লখনৌর ফিরিঙ্গি মহলের অবক্ষয় ও পতন এবং এর পরবর্তীকালে প্রতিস্থাপনকারী কলকাতা আলীয়া মাদরাসা, দারুল উলুম দেওবন্দ ও আলীগড় কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্থান ও বিস্তার।
বাংলা ভাষায় ইসলামের অভিব্যক্তিতে দারুল উলুম দেওবন্দের প্রভাব ব্যাপক। এর কারণ হল এই মাসলাক আশরাফ ও আতরাফ বিভাজন অতিক্রম করতে পেরেছে। ফারসি ও উর্দু ভাষায় পারদর্শী উত্তর ভারতীয় উলামার সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে বাংলাভাষী একটি উলামা বর্গ এখানে তৈরি হয়েছে।
৭.
বাংলা ভাষায় ইসলামের অভিব্যক্তিতে দারুল উলুম দেওবন্দের প্রভাব ব্যাপক। এর কারণ হল এই মাসলাক আশরাফ ও আতরাফ বিভাজন অতিক্রম করতে পেরেছে। ফারসি ও উর্দু ভাষায় পারদর্শী উত্তর ভারতীয় উলামার সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে বাংলাভাষী একটি উলামা বর্গ এখানে তৈরি হয়েছে।
অন্যদিকে বাংলা ভাষায় ইসলামের অভিব্যক্তিতে ফিরিঙ্গি মহল্লী উলামার প্রভাব নজরে পড়ে না। ফার্সি ও উর্দু ভাষা কেন্দ্রিক এই উত্তর ভারতীয় অযোধ্যার (আউধী) আশরাফ তাহজিব ও আদাব বাংলার প্রধানত আতরাফ থেকে উত্থিত বাংলাভাষী উলামা বর্গে প্রভাব বিস্তার করেনি। সেইসঙ্গে মানকুলাতের চাইতে মা’কুলাতের প্রতি তাওয়াজ্জু এদেশের অপরিণত বুদ্ধিবৃত্তিক ও হৃদয়বৃত্তিক আবহে বেশি চ্যালেঞ্জিং হবারই কথা। আর সেইসাথে শাহ ওয়ালী উল্লাহী সংস্কারের প্রভাবে হাদিস ও ফিকহ ভিত্তিক নেসাব ও দারস এখানে অধিকতর “সহী” বিবেচিত হয়েছে।
এর ফলে বাংলা ভাষায় ইসলামের অভিব্যক্তিতে আপনি ফিরিঙ্গি মহলকে খুঁজে পাবেন না। দেওবন্দের একাধিপত্যে তা চাপা পড়ে গেছে। এর ফলাফল কি হয়েছে তার তানকীদ বা পর্যালোচনা এই ধারাবাহিক নিবন্ধের অন্যতম লক্ষ্য।
মীর ফতেহউল্লাহ শিরাজীর মূল অবদান হল শিক্ষার সংস্কার এবং শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের একটি সিলসিলা তৈরি করে যাওয়া; যা বিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত হিন্দুস্তানের মাদরাসা শিক্ষায় উল্লেখযোগ্য প্রভাব বিস্তার করেছে। এই শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের ধারাবাহিকতায় অনেক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব বিভিন্নভাবে অবদান রেখেছেন।
৮.
উপমহাদেশের শিক্ষাক্রমে বৈপ্লবিক পরিবর্তন: দাবিস্তানে শিরাজ থেকে দাবিস্তানে ফিরিঙ্গী মহলের দাস্তান
ষোলো শতক থেকে হিন্দুস্তানে হিকমা বা ফালসাফার প্রতি আগ্রহ তৈরিতে পারস্যের শিরাজ বিদ্যাঘর (দাবিস্তানে শিরাজ/স্কুল অফ শিরাজ) বড় ভূমিকা রেখেছিল। এটা যে কেবল এই বিদ্যাঘরের প্রভাবেই হয়েছিল তা নয়, এই বিদ্যাঘরে শিক্ষিত কয়েকজন বিশিষ্ট পারসিক হেকিম হিন্দুস্তানে অভিবাসন করে এসে বসবাস করে এই প্রক্রিয়ায় সরাসরি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এদের মাধ্যমে হিন্দুস্তানে বুদ্ধিবৃত্তিক বিদ্যাশৃঙ্খলাগুলিতে, বিশেষ করে হিকমাতে বেশ আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল। এভাবে সাফাভি হেকিমবৃন্দ যেমন সদরউদ্দীন শিরাজী তথা মোল্লা সদরার (মৃ. ১৬৪০) রচনাবলী হিন্দুস্তানে গৃহীত হবার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল। শিরাজ বিদ্যাঘরের শিক্ষার প্রচারের মধ্য দিয়ে হিন্দুস্তানে শুধু হিকমা ও কালামের চর্চাই হয়নি, চিকিৎসাবিজ্ঞান, প্রাকৃতিক ও গাণিতিক বিজ্ঞানেরও প্রসার ঘটেছিল।
শিরাজ বিদ্যাঘরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব শাহ তাহির ইবনে রাযীউদ্দীন (মৃ ১৫৪৯), যার শিক্ষক ছিলেন শামসুদ্দীন খাফরি (মৃ. ১৫৫০), তিনি পারস্য থেকে হিন্দুস্তানে চলে আসেন এবং হিন্দুস্তানে বিশেষ করে দাক্ষিণাত্যে ইসলামের বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
শাহ তাহির সূচিত হিকমা চর্চার এই প্রক্রিয়াটিকে আরো পুষ্ট করেছিলেন শিরাজ বিদ্যাঘরেরই আরেকজন ব্যক্তিত্ব। তিনি হলেন মীর ফতেহউল্লাহ শিরাজী (মৃ. ১৫৮৯)। যিনি হিন্দুস্তানে হিকমা ও বিজ্ঞানের প্রচার ও প্রসারে অনেক বড় ভূমিকা রেখেছিলেন। সম্রাট আকবর তার দরবারে ফতেহউল্লাহকে সাদরে বরণ করে নিতে চেয়েছিলেন। এতে সাড়া দিয়ে এই প্রখ্যাত হেকিম ১৫৮৩ সালে আকবরের দরবারে যোগ দেন। তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের অন্যতম প্রধান বুদ্ধিবৃত্তিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিশেবে পরিগণিত হন। তিনি রাজস্ব আদায়, কৃষি, বিভিন্ন যন্ত্রের আবিস্কার, একটি নতুন বর্ষপঞ্জি প্রণয়ন এবং সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা সংস্কারে নির্ধারক ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ চিকিৎসাবিদও ছিলেন। অর্থাৎ তিনি ছিলেন একজন চৌকস, সব্যসাচী ও বহুমুখী ব্যক্তিত্ব বা পলিম্যাথ।
মীর বা শাহ ফতেহউল্লাহ শিরাজীর সবচাইতে স্থায়ী অবদানসমূহের একটি হল সম্রাট আকবরের নির্দেশে তার করা বিভিন্ন শিক্ষা সংস্কার। তিনি সাইয়্যেদ শরিফ জুরজানি (মৃ. ১৪১৩) এবং জালালউদ্দীন দাওয়ানী (মৃ. ১৫০২) কৃত হিকমাতী কালামের প্রচলন করেছিলেন; এছাড়া তিনি গিয়াসউদ্দীন মনসুর দাশতাকী (মৃ. ১৫৪২) ও অন্যান্যদের হিকমাতী রচনাবলী মাদরাসায় প্রচলিত নেসাবে যুক্ত করেছিলেন। তার সময় থেকে বিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত যতদিন দেওবন্দী মাদরাসার ব্যাপক প্রসার ও বিস্তার হয়নি ততদিন এই পাঠ্যক্রম হিন্দুস্তানের মাদরাসাগুলিতে কমবেশি অনুসৃত হয়েছে। অন্যদিকে আরব দেশগুলির সুন্নী মাদরাসাসমূহে চৌদ্দ শতক থেকেই বুদ্ধিবৃত্তিক বিদ্যাশৃঙ্খলাগুলি বিশেষ করে হিকমার পাঠ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
মীর ফতেহউল্লাহ শিরাজী অনেকগুলি গ্রন্থ লিখেছিলেন; কিন্তু এর বেশ কয়েকটি হারিয়ে গেছে। যেমন তিনি কুরআনের একটি তাফসির লিখেছিলেন যেটি হারিয়ে গেছে। তার রচনাবলীতে রয়েছে ফারসি ভাষায় অনূদিত ইবনে সিনার (মৃ. ১০৩৭) ‘আল কানুন ফি’ল ত্বিব’ (দ্য ক্যানোন অফ মেডিসিন); কিন্তু এটি একই নামের অন্য কেউ লিখে থাকতে পারে বলে মনে করা হয়; এছাড়া তিনি নাসিরউদ্দীন আল তুসী (মৃ. ১২৭৪), সাদ’উদ্দীন তাফতাজানী (মৃ. ১৩৮৯) ও জালালউদ্দীন দাওয়ানী (মৃ. ১৫০২) রচিত বিভিন্ন দুর্বোধ্য হিকমা ও হিকমাতী কালাম বিষয়ক গ্রন্থাবলীর উপরে ভাষ্য ও মন্তব্য লিখেছিলেন।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, মীর ফতেহউল্লাহ শিরাজীর মূল অবদান হল শিক্ষার সংস্কার এবং শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের একটি সিলসিলা তৈরি করে যাওয়া; যা বিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত হিন্দুস্তানের মাদরাসা শিক্ষায় উল্লেখযোগ্য প্রভাব বিস্তার করেছে। এই শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের ধারাবাহিকতায় অনেক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব বিভিন্নভাবে অবদান রেখেছেন। এই নিবন্ধের সংক্ষিপ্ত পরিসরের কথা বিবেচনা করে সবার নাম উল্লেখ করা সম্ভব না হলেও একজনের নাম এখানে উল্লেখ করতেই হয়। তিনি হলেন সতেরো শতকের হিন্দুস্তানের অন্যতম খ্যাতিমান বিদ্বান মোল্লা কুতুবউদ্দীন।
এই মোল্লা কুতুবউদ্দীন ১৬৯২ সালে নৃশংসভাবে নিহত হলে সম্রাট আওরঙ্গজেব তার পরিবারের জন্য লখনৌ শহরের একটি মহলের ব্যবস্থা করে দেন; এই মহলটিতে ইউরোপীয় বণিকেরা থাকতো বলে এটি ফিরিঙ্গী মহল নামে পরিচিতি পায়। এই ফিরিঙ্গী মহলে ১৬৯৫ সালের দিকে মোল্লা কুতুবউদ্দীন পরিবারের উত্তরাধিকারীরা তাদের আবাস গড়ে তোলেন। এই আবাসই তাদের বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্র হিশেবে পরিগণিত হয়েছে। এখানেই হিন্দুস্তানের হিকমা চর্চার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রটি স্থাপিত হয়েছিল। মুঘল শাসক ও ধনী ব্যক্তিদের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতায় মোল্লা কুতুবউদ্দীনের তৃতীয় পুত্র মোল্লা নিজামউদ্দীন ফিরিঙ্গী মহল্লীর (মৃ. ১৭৪৮) নেতৃত্বে এটি পরিচালিত হয়েছিল। তিনি মা’কুলাত বিষয়াবলীর পাঠে গুরুত্ব দিয়ে মানকুলাত বিষয়াবলীর সঙ্গে একটি ভারসাম্য এনেছিলেন। তার এই অভিনব শিক্ষাক্রম দারসে নিজামীয়া নামে পরিচিতি পেয়েছে। এই নেসাবের ভিত্তিতে তৈরি মাদরাসা-ই-নিজামীয়ার পরম্পরা আঠারো ও উনিশ শতকে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল। যা বিশ শতকে সাতচল্লিশের দেশভাগ হয়ে ষাটের দশক পর্যন্ত হিন্দুস্তানের মাদরাসা শিক্ষায় কিছুটা হলেও প্রভাব রেখেছে। এরপর থেকে উপমহাদেশে দেওবন্দী নেসাব ও মাদরাসার ব্যাপক প্রসার ও বিস্তার ফিরিঙ্গী মহলের প্রভাব স্তিমিত করে দিয়েছে।
৯.
রাজনৈতিক ক্ষমতা হারাবার ফলে ইসলামের অভিব্যক্তি খন্ডিত, আংশিক ও সংকীর্ণ হয়েছে
এই নিবন্ধের গত পর্বে আমরা দেখেছি যে মুঘল আমলে যখন মুসলমানেরা রাজনৈতিক ক্ষমতায় আসীন ছিল তখন মুঘল সম্রাট ও অন্যান্য নওয়াব ও আশরাফ বর্গ কিভাবে একটি উন্নত শিক্ষা ও জ্ঞান কাঠামো তৈরি করেছিলেন। এই কাঠামোর শক্তি ও দুর্বলতা আছে বেশ কয়েকটি।
🔴
আসুন আমরা সেগুলি একটি তুলনামূলক নিক্তিতে বিবেচনা করি, যেমন:
(১) এটি ছিল একাধারে প্রত্যাদেশ, হৃদয়বৃত্তি এবং বুদ্ধিবৃত্তির ভিত্তিতে গঠিত। ফলে এখানে মানকুলাত ও মা’কুলাত উভয় ধরনের বিষয়ের চর্চা হত।
⭕
(২) এটিতে ছিল আরবি ও ফারসি এই দুটি ধ্রুপদী ভাষার যৌথ চর্চা। ফলে আরব ও পারসিক সভ্যতা ও সংস্কৃতির সম্মিলিত সমৃদ্ধির সঙ্গে পরিচিত হবার একটা সুবর্ণ সুযোগ এখানে ছিল।
⭕
(৩) একদিকে ছিল আরব বেদূইন কৃষ্টির আবহে ইসলামের সাম্যভিত্তিক ভ্রাতৃত্ব, গোষ্ঠীচেতনা ও সমস্তরের নেতৃত্বের অধীনে দিগ্বিজয়ের ঐতিহ্য। অন্যদিকে ছিল দু হাজার বছরের পারসিক সাম্রাজ্যের সম্রাট ও সামন্তদের নেতৃত্বে অভিজাত ও ধ্রুপদী কৃষ্টি, সাহিত্য, ভাবচর্চা, দ্বৈত ও অদ্বৈত মহাচৈতন্যে বিধৃত আলোকময় বিচিত্র ধর্মচর্চা ও নান্দনিকতা। যা ইরান ও তুরানের ভূগোল অতিক্রম করে হিন্দুস্তানেও প্রসারিত হয়েছিল।
⭕
(৪) বাংলার বাংলাভাষী কৃষিজীবী মুসলমানেরা অবশ্য মুঘল আশরাফ বর্গের এই উপরতলার শিক্ষা, জ্ঞান ও সংস্কৃতির সক্রিয় অনুশীলক ও অংশীদার হতে পারে নি। বাংলার সুলতানেরা বাংলা ভাষার চর্চায় উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন একথা সত্য। কিন্তু তার ফলে বাংলাভাষী মুসলমানেরা বাংলা ভাষায় যা সৃষ্টি করেছে তা প্রান্তিক থেকে গেছে। তারা একদিকে মুঘল পৃষ্ঠপোষকতায় ফারসি ও উর্দু ভাষা ও অন্যদিকে বর্ণহিন্দুর সংস্কৃতপ্রভাবিত বাংলা ভাষার আধিপত্যের শিকার হয়েছে।
⭕
(৫) কাজেই স্বাধীন ও সার্বভৌম মুঘল রাজসভার অনুপ্রেরণায় গড়ে ওঠা ফিরিঙ্গী মহল বিদ্যাঘরের উৎকৃষ্ট বিদ্যাশিক্ষা ও জ্ঞান-প্রজ্ঞা কাঠামো থেকে বাংলাভাষী মুসলমান উপকৃত হতে পারেনি। এসব তাদের কাছে পৌঁছায়নি।
⭕
(৬) ফিরিঙ্গী মহল বিদ্যাঘরের শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিল মুঘল প্রশাসনে স্বাধীন ও উদ্ভাবনী চিন্তার মাধ্যমে কার্যকর সিদ্ধান্ত ও মীমাংসায় উপনীত হতে পারে এমন ব্যক্তি তৈরি করা। কিন্তু এই শিক্ষা ও জ্ঞান-প্রজ্ঞা থেকে বঞ্চিত হয়ে বাংলাভাষী মুসলমানেরা এখনো যোগ্য ও উপযুক্ত শাসক ও প্রশাসক বর্গ গঠন করতে পারেনি।
⭕
(৭) পক্ষান্তরে উপনিবেশিক শাসনের আবহে মুঘল ব্যবস্থার অবক্ষয় ও পতনের প্রেক্ষাপটে বাংলায় যে দুই ধরনের মাদরাসা এবং পাশ্চাত্য শিক্ষা ও জ্ঞান কাঠামো গড়ে উঠেছে তা বাংলাভাষী মুসলমানদেরকে এখনো সংকীর্ণ, খন্ডিত ও আংশিক বিশ্ববীক্ষায় সীমাবদ্ধ করে রেখেছে।
⭕
(৮) আলীয়া মাদরাসার নেসাব মানকুলাত ও মা’কুলাত উভয় বিষয়েই দুর্বল শিক্ষাক্রম অনুসরণ করছে; অন্যদিকে ফিরিঙ্গী মহলের দারসে নিজামীর জায়গায় যে দেওবন্দী নেসাব ব্যাপকভাবে প্রচলিত ও প্রসারিত হয়েছে তাতে মানকুলাত আপেক্ষিকভাবে মা’কুলাতের চাইতে প্রবল।
⭕
(৯) তবে মুঘল শাসনের আশরাফ আতরাফ বিভাজন অতিক্রম করে দেওবন্দ আন্দোলন বিপুল নিম্নবিত্ত বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীকে তাদের শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় নিয়ে আসতে পেরেছে। এই শিক্ষাক্রম এক অর্থে সমাজের আনুষ্ঠানিক শিক্ষাবঞ্চিত বর্গকে থাকা-খাওয়া সহ একটি শিক্ষাজীবনের সুযোগ দিয়ে এদের প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার মোচন করছে। কাজেই এখানে শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য মুঘল আমলের ফিরিঙ্গী মহলী শিক্ষা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।
⭕
(১০) এখন সমাজের অভিজাত, উচ্চবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত বর্গ পাশ্চাত্য শিক্ষায় গঠিত হচ্ছে; সঙ্গে ইসলামের অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা তারা হয়তো অল্পস্বল্প নিচ্ছে। আর ইসলামের আনুষ্ঠানিক শিক্ষার আওতায় সমাজের নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত বর্গই বেশি আসছে।
⭕
(১১) দেওবন্দী মাদরাসা শিক্ষার সংস্কারে এর নিজস্ব কর্তৃপক্ষ উৎসুক নয়; কারণ তারা মনে করে যেহেতু তাদের শিক্ষার উদ্দেশ্য কেবলমাত্র কুরআন, হাদিস ও ফিকহ “বিশেষজ্ঞ” তৈরি করা এবং যেহেতু তারা ক্রাঊড ফান্ডিং-এর মাধ্যমে এর অর্থায়ন করছে, তাই এখানে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই।
⭕
(১২) অন্যদিকে রাষ্ট্রও এদেরকে খুব একটা ঘাটাতে চায় না। কারণ একদিকে এরা রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালনে যে ঘাটতি ও ব্যর্থতা—তা একভাবে জোড়াতালি দিয়ে পূরণ করছে। অন্যদিকে বিপুল নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তকে যদি এই শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে কার্যত রাষ্ট্র কাঠামোর বাইরে রাখা যায়, তাহলে অন্তত এদের দ্বারা বিদ্রোহ বা বিপ্লবের সম্ভাবনা অনেক কমে যায়। আবার একান্তই যদি এসবের দুঃসাহস এরা দেখায়, তাহলে এদেরকে দমন করাও সহজ থাকে।
🔴
বাংলা ভাষায় ইসলামের অভিব্যক্তিতে স্থানকালপাত্র বিবেচনায় ইসলামের শিক্ষা, জ্ঞান-প্রজ্ঞা কাঠামো কেমন হবে ও এর ভিত্তিতে কি হবে এর বিশ্ববীক্ষা—তা তো আসলে বিভিন্ন ফিরকার আঙ্গিকেই ভাষ্যকৃত ও উপস্থাপিত হয়। কিন্তু প্রায় সবার দাবী এমন যে তার দাবীটিই সবচাইতে “সহী” এবং কাজে কাজেই মান্য।
মনোয়ার শামসী সাখাওয়াত : শিক্ষা বিষয়ক গবেষক, মরমী কবি ও সমাজ চিন্তক।