জন্মদিনে স্মরণ ও শ্রদ্ধার্ঘ্য : সাক্ষাৎকার
মুক্তিযুদ্ধ এদেশের মাটিকে স্বাধীন করেছে
মানুষকে নয়: বীরাঙ্গনা রমা চৌধুরী
চট্টগ্রাম বোয়ালখালী থানার পোপাদিয়া গ্রামে ১৯৪১ সালের ১৪ অক্টোবর জন্ম নেন সাহিত্যিক ও একাত্তরের বীরাঙ্গনা রমা চৌধুরী। মৃত্যুবরণ করেন ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮। বাবা শ্রী রোহিনী রঞ্জন চৌধুরী আর মা শ্রীমতি মোতিময়ী চৌধুরী। দুঃখে ভরা জীবন তাঁর। যেন দুঃখ দিয়ে গড়া। তাঁকে দুঃখীনী চৌধুরী বললেও খুব একটা অত্যুক্তি করা হবে না। নজরুলকে যেভাবে বলা হয় দুঃখু মিয়া। নজরুল প্রতিভা নিয়ে হয়ত জন্মাননি তিনি, তবে নজরুলের থেকে কম কিসে! ক্ষেত্রে আরো অধিক, গঞ্জনা-বঞ্চনা, দুঃখ-যন্ত্রণায়। একাত্তরে ধর্ষিতা শুধু নন, মুক্তিযুদ্ধের তাণ্ডবলীলা আর ভয়াবহতার রাজ স্বাক্ষী তিনি। তিনি একাত্তরের জননী, বীরাঙ্গনা। এছাড়াও তিনি একজন লেখিকা। রচনা করেছেন বিশটির মতো গ্রন্থ। লিখেন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ আর উপন্যাস। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাঁকে নিয়ে যেমন প্রকাশিত হয়েছে প্রায় শতাধিক প্রবন্ধ, নিবন্ধ, ফিচার আর সাক্ষাৎকার তেমনি নিয়মিত প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা প্রবন্ধ-নিবন্ধ আর গল্প-উপন্যাস। তাঁর সমগ্র জীবন নিয়ে একান্ত আলাপচারিতায় ওঠে এসেছে তাঁর জীবনের নানা অজানা দিক।
সাহিত্যিক ও বীরাঙ্গনা রমা চৌধুরী-র বিশেষ এই সাক্ষাৎকার নিয়েছেন গল্পকার আহমেদ মনসুর।
আহমেদ মনসুর: কেমন আছেন?
রমা চৌধুরী: শরীরটা ভালো না তেমন, তবে ভালো আছি।
আহমেদ মনসুর: শৈশবের স্মৃতিটুকু কি পুরোপুরি মুছে গেছে? নাকি কিছু কিছু স্মৃতি মনের কোণে মাঝে মাঝেই উঁকি দেয়?
রমা চৌধুরী: আমি ছিলাম বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। সে হিসেবে অত্যন্ত আনন্দঘন পরিবেশেই শুরু হয়েছিলো আমার শৈশব জীবন। বাবা-মায়ের খুবই আদরের কন্যা ছিলাম আমি। তবে গোলটা বাঁধে তখনই বাবা যখন অকস্মাৎ মারা যান। ১৯৪৫ সাল। আমার বয়স তখন মাত্র সাড়ে তিন বছর। তখনো আমি স্কুলে যাওয়া শুরু করিনি। বাবা একটা বই কিনি দিয়েছিলেন, মায়ের কাছে পড়তাম। খুব কম বয়সেই আমি লিখতে পড়তে শিখে গিয়েছিলাম। মা শিখিয়েছিলেন। তিনি যদিও উচ্চশিক্ষিতা ছিলেন না, পড়েছেন মাত্র পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। তবুও তিনি ভালো পড়াশুনা জানতেন। ঘরে বসে শুধু পড়তেন। নিজে নিজেই শিখেছিলেন সব। স্বশিক্ষিতা বলা যায়। আমি যখন নবম শ্রেণিতে পড়ি মা তখনো আমাকে অংক করাতেন। বাবা নারায়নগঞ্জে চাকরী করতেন। আমি বড় বড় হাতের অক্ষরে বাবার কাছে চিঠি লিখতাম তখন। বাবা পড়তেন আর নাকি হাসতেন। বন্ধুদের দেখাতেন সে চিঠি। তারা নাকি ও বয়সে আমার চিঠি লেখা দেখে বাবার কাছে খুব প্রশংসা করতেন আর আশীর্বাদ করতেন। একদিন খবর এলো বাবা আর নেই। মা কান্না করেছিলো খুব। আমি কিছু বুঝতে পারিনি। বাবার লাশ বাড়িতে আনেনি, সৎকার করা হয়েছে নারায়নগঞ্জেই। মা আমাকে বুঝতে দিত না। কষ্ট পাবো বলে। বলত বাবা বিদেশে গিয়েছে। ১২ বছর পর ফিরে আসবে। আমার বয়স যখন ৮/৯ বছর হলো, একটু বুঝতে শিখলাম, তখন একজন বলল, তোর বাবা মারা গেছে। আমি বিশ্বাস করিনি। মা-কে জিজ্ঞেস করলাম। মা লুকাতে চেষ্টা করেও পারেনি। সেদিন খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। মানসিকভাবে বিকারগ্রস্থ হয়ে পড়েছিলাম। আমার জীবনে ঘোর অন্ধকার নেমে আসে একেবারে শৈশব থেকেই।
আহমেদ মনসুর: আপনাদের সময় এ অঞ্চলের নারীরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জনে অনেকটাই পিছিয়ে ছিলো। আপনার পক্ষে সে সময়ে উচ্চ শিক্ষা অর্জন করা সম্ভব হয়েছিল কি করে? পরিবেশ পরিস্থিতি কি অনুকূলে ছিল নাকি সংগ্রাম করতে হয়েছিল বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের মতো ?
রমা চৌধুরী: পারিবারিক অস্বচ্ছলতা তো ছিলোই, সামাজিক প্রতিবন্ধকতাও কম ছিলো না। আমাদের সময়ে নারী শিক্ষার পথটা কুসুমাস্তীর্ণ ছিলো না, ছিলো কন্টকাকীর্ণ;। মা আর মামাদের ইচ্ছা, শিক্ষকদের আন্তরিক সহযোগিতা আর নিজের একাগ্র প্রচেষ্টায় অনেকটা অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রতিকুল অবস্থাতেই আমি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জন করি। আমার মাথা ভর্তি চুল ছিলো। চুলগুলো দড়ি দিয়ে সিলিং এর সাথে বেঁধে রেখে রাত জেগে পড়তাম। চুল এভাবে বেঁধে রাখতাম ঘুম এসে যাবে বলে। আমাদের সময়ে দিনে দু’টি করে পরীক্ষা হতো আর পরীক্ষা হতো টানা, প্রতিদিনই। তাই পড়তে হতো সারা রাত জেগেই। আমাদের স্কুল থেকে ১৯৫২ সালে আমরা মেট্রিক পরীক্ষা দিয়েছিলাম ৬৪ জন, কিন্তু পাশ করেছিলাম মাত্র ১৪ জন। এর মধ্যে ফাস্টক্লাস কেউ না পেলেও হাইয়ার সেকেন্ড ডিভিশন পেয়েছিলাম আমরা চার জন। এর মধ্যে আমি ছিলাম প্রথম। অংকের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ ছিলো আমার। খুব ভালো অংক করতে পারতাম। ক্লাসে অংক করাতাম। কিন্তু সেই অংক পরীক্ষাটাই আমার খারাপ হয়েছিলো। পরীক্ষার আগের রাতে ঘুম হয়নি বলে পরীক্ষার হলে অস্থির হয়ে পড়েছিলাম। নাহয় সব অংকগুলো আমার জানা ছিলো। সময় শেষ হয়ে গিয়েছিলো। আমার এক শিক্ষক এসে জোর করে খাতা নিয়ে নিয়েছিলো। সেদিন কি কান্নাটাই না আমি করেছিলাম।
আহমেদ মনসুর: আপনার একেবারে প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষা এই দীর্ঘ পরিক্রমার কিছুটা যদি বলতেন…
রমা চৌধুরী: প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিলো পোপাদিয়া গ্রামের ভট্টাচার্যদের স্কুল। স্কুলে যদিও আমি যেতাম না। পরীক্ষাগুলো শুধু দিয়ে আসতাম। এমনিতে পড়তাম মায়ের কাছে। খুব অল্প বয়সেই ভর্তি হয়েছিলাম কানুনগো পাড়া মুক্তকেশী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। পড়াশোনায় ভালো ছিলাম বলে দুটো প্রমোশন পেয়েছিলাম। বাবা বলতেন সরোজনী নাইড়– ১২ বছর বয়সে মেট্রিক পাশ করেছিলো, আমার মেয়েও ১২ বছর বয়সে মেট্রিক পাশ করবে। আমি যদিও এরও আগে অর্থাৎ সাড়ে ১১ বছর বয়সে ১৯৫২ সালে মেট্রিক পাশ করেছিলাম। এরপর আই.এ পাশ করেছিলাম ১৯৫৪ সালে কানুনগো পাড়া এসএটি কলেজ থেকে মানবিক বিভাগ নিয়ে। ১৯৫৯ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করি। এরপর ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী সম্পন্ন করি। চট্টগ্রামের দক্ষিণ ও সদরে আমিই প্রথম সবোর্চ্চ ডিগ্রীধারী নারী ছিলাম। এর আগে ১৯৬০ সালে রাউজানের অন্য একজন নারী এমএ ডিগ্রী অর্জন করেছিলেন। সবার সহযোগিতা ছিলো বলেই পেরেছিলাম। বাবা আমাকে ছোটবেলায় ব্যাগ কিনে দিয়েছিলেন, ছাতা কিনে দিয়েছিলেন, সাইকেল কিনে দিয়েছিলেন। আমরা বাড়ির মেয়েরা দল বেঁধে স্কুলে যেতাম। অন্যরা আমার চেয়ে বয়সে ছিলো বড়, আমি সবার ছোট। পড়াশোনাতেও ছিলাম ভালো তাই সবাই আমাকে সমাদর করতো খুব। আমরা স্কুলে যেতাম অনেকটা পথ পায়ে হেঁটে, ওরা আমাকে ধরে ধরে নিয়ে যেত, পারলে কোলে তুলে নেয় আর কি। মাথায় ছাতা ধরতো। ছোটবেলাতেই বাবাকে হারাই। আমার বড় কোন ভাই বা বোনও ছিলো না। সহযোগিতা পেয়েছি মামাদের আর ডিভাইন একটা পাওয়ার আছে, সেটার। আমি ভগবান, রাম-কৃষ্ণ বুঝি না। ঐ ডিভাইন পাওয়ারটাই আসল। অদৃশ্য এই শক্তিটাই জগতের সমস্ত কিছু নিয়ন্ত্রণ করে। আমি বিদেশ যেতে চাই না। দেশে থেকেই দেশটাকে স্বর্গে রূপান্তর করতে চাই। মাকে ছেড়ে যাওয়া যেমন উচিত না, বউকে ছেড়ে অন্য মেয়ের সাথে লটর ফটর করা যেমন ভালো না, দেশকে ছেড়ে পালানোও তেমনি ভালো না।
আহমেদ মনসুর: পড়াশোনা শেষ করে বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। কর্মজীবনে প্রথম পদার্পণ আর বর্ণাঢ্য এই কর্মজীবনের নানা দিক নিয়ে বলুন…
রমা চৌধুরী: আমি যখন চট্টগ্রাম কলেজে ডিগ্রী পড়ছিলাম তখন থেকেই শিক্ষকতা শুরু করি। শুরুতেই সহকারি শিক্ষিকা হিসেবে যোগদান করেছিলাম মুক্তকেশী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। এরপর প্রবর্তক স্কুলেও ছিলাম কিছুদিন। এরপর ১৯৬১ সালে যখন এমএ পাশ করি তখন কক্সবাজার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বারবার টেলিগ্রাম আসতে থাকে ঐ স্কুলে প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে যোগদার করবার জন্য। প্রথম দু’বার প্রত্যাখান করলেও তৃতীয়বার আর প্রত্যাখান করতে পারলাম না। ১৯৬২ সালে ঐ স্কুলে প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দিলাম। ওখানে ছিলাম প্রায় পাঁচ বছরের মতো। একটা বিষয় নিয়ে গন্ডগোল হওয়ায় ঐ স্কুল ছেড়ে চলে আসি ১৯৬৬ সালে। আমি যখন যোগ দিচ্ছিলাম তখন ঐ স্কুলটি সরকারি ছিলো না। পরে আমার হাতেই স্কুলটি সরকারি হয়েছিলো। কক্সবাজার সরকারি মহিলা স্কুল থেকে পদত্যাগ করে কিছুদিন বাড়িতে ছিলাম কর্মহীন অবস্থায়। এরপর ১৯৬৭ সালে কাট্টলী বাসন্তী মহিলা উচ্চ বিদ্যালয়ে দুয়েক মাস কাজ করি। এরপর যোগ দিই পটিয়া আবদুর রহমান মহিলা উচ্চ বিদ্যালয়ে। ওখানেও খুব বেশিদিন ছিলাম না। এরপর আবার কর্মহীন হয়ে পোপাদিয়ার বাড়িতে থাকা শুরু করি। এরপর শিক্ষকতা করার ইচ্ছা ত্যাগ করি। ঐ সময়ে জন্ম নেয় আমার দ্বিতীয় সন্তান টগর, ১৯৬৮ সালে। টগর জন্ম নেয়ার ১ মাস পরেই একটা বন্যা হয়েছিলো। আমার বাড়ি-ঘর সবকিছু পানিতে তলিয়ে যায়। ঐ সালটা ছিলো আমার জন্য খুবই কষ্টের। ১৯৬৮ সালের বন্যার কিছুদিন পরেই পুনরায় শিক্ষকতা শুরু করি। যোগ দিই হাওলা উচ্চ বিদ্যালয়ে। এরপর ১৯৭০ সালে হাওলা স্কুল ছেড়ে দিয়ে বিদগ্রাম স্কুলে যোগদান করি। তখন আমার তৃতীয় সন্তান জহরের বয়স ছিলো মাত্র তিন মাস। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি ঐ স্কুলে শিক্ষকতা করি। যুদ্ধ শেষে দীর্ঘদিন আর শিক্ষকতা করলাম না। ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত গ্রামে গৃহশিক্ষকতা করেছি। পরে ১৯৭৪ সালের ৬ নভেম্বর যোগ দিলাম ফটিকছড়ি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত ঐ স্কুলে ছিলাম। ১৯৭৮ সালেই একটা সমস্যার সম্মুখীন হয়ে স্থায়ীভাবে শিক্ষকতা পেশা থেকে অবসর গ্রহণ করি।
আহমেদ মনসুর: আপনি স্বেচ্ছায় শিক্ষকতা থেকে অবসর নিয়েছিলেন বলে শোনা যায়। এর নেপথ্যে যদিও একটা ঘটনা আছে। মূলত কি কারণে সেদিন আপনি শিক্ষকতা ছেড়েছিলেন?
রমা চৌধুরী: যুদ্ধের পর ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে তাদের সন্তানদের পড়িয়ে অর্থাৎ গৃহশিক্ষকতা করেই আমি জীবিকা নির্বাহ করেছি। ১৯৭৪ সালে যদিও ফটিকছড়ি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে যোগদান করি। কিন্তু সেখানে বেশিদিন শিক্ষকতা করতে পারিনি। স্কুল কমিটির সাথে আমার বনিবনা হচ্ছিল না। তারা স্কুল পরিচালনা বাবদ যা খরচ হতো এরচেয়ে বেশি টাকার বিল তৈরি করে আমাকে দিয়ে স্বাক্ষর করিয়ে নিতে চাইলে আমি সই করতে অস্বীকৃতি জানাই। তাই আমি হয়ে পড়েছিলাম তাদের চক্ষুশূলের কারণ। এরপর থেকেই তারা আমার বিরুদ্ধে লাগে। ষড়যন্ত্র শুরু করে। যুদ্ধে আহত হয়ে আমি তখন কানে একটু কম শুনতে পেতাম। তারা আমাকে কানের চিকিৎসার জন্য ভারতে পাঠিয়ে দিয়ে আমার অবর্তমানে আমার পারমিশান না নিয়েই স্কুলে একজন সহকারি প্রধান শিক্ষিকা নিয়োগ দেন। উদ্দেশ্য ছিলো আমাকে সরিয়ে তাকেই প্রধান শিক্ষক বানাবে। ২২ দিন পর আমি কোলকাতা থেকে ফিরে এসে এ অবস্থা দেখি। তা আমি মেনে নিতে পারলাম না। তাই আমি আর ঐ স্কুলে যাইনি। ১৯৭৮ সালের ঘটনা সেটা। যদিও আইনত আমি এখনো ঐ স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। আমার কাছে সব কাগজপত্রগুলি এখনো গচ্ছিত আছে। এরাও আমাকে বহিস্কার করেনি, আমিও পদত্যাগপত্র দিইনি। কাজেই আমি কাগজপত্রমূলে এখনো ফটিকছড়ি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা।
আহমেদ মনসুর: আপনার দাম্পত্য জীবন নিয়ে নানামুখী আলোচনা শোনা যায়। এ নিয়ে প্রকৃত সত্যটুকু আপনার মুখ থেকেই শুনতে চাই।
রমা চৌধুরী: আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যারয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করে চট্টগ্রাম ফিরে আসি তখন কক্সবাজার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে আমার কাছে বারবার টেলিগ্রাম আসতে থাকে ঐ স্কুলে প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দেওয়ার জন্য। প্রথম দু’বার প্রত্যাখ্যান করলেও তৃতীয়বার আর পারিনি। অগত্যা ১৯৬২ সালে আমি ঐ স্কুলে যোগ দিই। প্রধান শিক্ষিকা থাকা কালে আমাকে যে বাসাটায় থাকতে দেওয়া হলো ওটা নাকি একসময় স্যানিটারী ইন্সপেক্টরের বাসা ছিলো, তারও আগে নাকি ছিলো পশু চিকিৎসালয়। সেই বাসাটায় যখন জেলা বোর্ড থেকে আমাকে থাকতে দেওয়া হলো তখন তদানিন্তন ইন্সপেক্টর সাহেবকে সপরিবারে আশ্রয় নিতে হয় তাঁদের অফিস ঘরে। তাঁরই ডিপাটমেন্ট এ তখন কাজ করতেন নৃপেন চক্রবর্ত্তী। তিনি কাজ নিয়ে কক্সবাজারে যান আমি যাবার আরো এক বছর আগে, মানে ১৯৬১ সালে। তিনি থাকতেন আমার পাশের বাসায় খেয়ে না খেয়ে একা। তাঁর সাথে সৌজন্যমূলক কথাও হতো না কোন সময়। ১৯৬৫ সালের কোন একদিন। তারিখটা মনে নেই। ইন্সপেক্টর সাহেব তাঁর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ইনি শ্রী নৃপেন কুমার চক্রবর্ত্তীআমার ডিপাটমেন্ট এ কাজ করেন। চক্রবর্ত্তী সাহেব নাকি আমাকে চেনেন, আমি কিন্তু তাঁকে তখনো চিনতাম না। ইন্সপেক্টর সাহেব গ্রামের বাড়িতে যাবার কারণে তাঁর বাসায় থাকতে দিলেন নৃপেন বাবুকে। আর ঘরের চাবি দিয়ে গেলেন আমার হাতে। নৃপেন বাবু বের হলে চাবিটা আমাকে জমা দিয়ে যেতেন, ফিরে আসলে আবার চেয়ে নিতেন। এ সুবাদে তিনি মাঝেমাঝেই আমার বাসায় আসতেন যেতেন। মাঝেমধ্যে বসতেন, চা পান করতেন। একটু আধটু কথা হতো। ও অনেক কথা। পরে আমাদের বিয়ে হলো। যদিও রাষ্ট্রীয়, ধর্মীয় বা সামাজিকভাবে নয়, ঠাকুর দেবতাকে স্বাক্ষী রেখেই বিয়ে। তাঁর ঔরশ থেকে আমার গর্ভে তিনটি ছেলে সন্তান জন্ম নেয়। তাঁর বাড়ি ছিলো সীতাকুন্ডে। লোকটা এর আগেও একটা বিয়ে করেছিলো। আমি তা জেনেও তাকে বিয়ে না করে পারিনি। বিড়ালের মতো আমার সাথে লেগে ছিলো সবসময়। তবে তাঁকে কখনো স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে পারিনি। ১৯৭১ সালে তিনি আগের স্ত্রী আর সে ঘরের সন্তানদের নিয়ে ভারত চলে গিয়েছিলেন। আমি তখন তাঁর ঔরশের তিনটা ছোট ছোট বাচ্চা নিয়ে পোপাদিয়ার বাড়িতে। আমার খবর একটুও নিলো না। এদিকে যুদ্ধের সময় তো আমার উপর দিয়ে বয়ে গেলো অন্য এক মহাযুদ্ধ। যুদ্ধের পর আবারও আমার কাছে এসেছিলেন, আমি গ্রহণ করিনি। যুদ্ধের পরপরই দুই সন্তানকে হারিয়ে তৃতীয় সন্তান জহরকে নিয়ে কষ্টে শিষ্টে দিন কাটাচ্ছিলাম। তখন পত্রিকায় লিখতাম। দৈনিক সংবাদে লেখা পাঠাতাম, ছাপা হতো। ঐ পত্রিকায় তখন কাজ করতো দীলিপ দত্ত রায় নামের একজন লোক। তিনি আমার লেখা পড়ে খুশি হয়ে আমার সাথে যোগাযোগ করেন। পরিচয় হলো তাঁর সাথে। এক পর্যায়ে তিনি আমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেন আমার সম্পর্কে বিস্তারিত জেনেই। তিনি তখন আইন বিষয়ে পড়ে আইনজীবী হয়েছিলেন। বলেছিলেন আমাকে বিয়ে করে স্থায়ীভাবে চট্টগ্রামে চলে আসবেন। আর চট্টগ্রাম জজ কোর্টে আইন চর্চা করবেন। তাঁর বাড়ি ছিলো কিশোরগঞ্জে। পরে তাঁর সাথে ঐ অর্থে বিয়ে না হলেও ১৯৭৬ সালে আমার একটা সম্পর্কটা গড়ে উঠে। ঐ ঘরে আমার একটা ছেলে সন্তানের জন্ম হলো। দীপঙ্কর টুনু। এক পর্যায়ে দীলিপ বাবুও আমার সাথে প্রতারণা করে কিশোরগঞ্জে চলে যান। সেখানে জজ কোর্টে আইন চর্চা শুরু করেন। আরেকটা বিয়ে করে সেখানেই স্থায়ীভাবে থাকতে শুরু করেন। তারপর আমার সাথে আর কোন সম্পর্ক রাখেননি। আমি চেষ্টা করেও পারিনি। এরও অনেক বছর আগে, মানে ১৯৬০ সালে আমার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আমার কুমারীত্ব নষ্ট করেছিলো একজন, তার নাম আমি বলবো না। বিয়ে করার প্রলোভনে ভুলিয়ে সে আমার সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে শেষ পর্যন্ত অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করে সংসার পেতেছিলো। শুনেছি সে নাকি এখন অনেক নাম ধাম কুড়িয়েছে। সে-ই অনেক কাহিনী।
আহমেদ মনসুর: ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ কেড়ে নিয়েছে আপনার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদটি। এছাড়াও হারাতে হয়েছে আরো অনেক কিছু। আপনার জীবনে মুক্তিযুদ্ধের প্রভাবটা পড়েছিলো সবচেয়ে বেশি। একটু কি বলবেন মুক্তিযুদ্ধে আপনার সব হারানোর গল্পটি?
রমা চৌধুরী: মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমি তিনটা শিশু সন্তানের একজন সহায়হীন জননী। রূপে গুণে অনন্য ছিলাম বলে সবাই আমাকে নিয়ে চিন্তিত ছিলো। মা চিন্তা করতো সবচেয়ে বেশি। তখন আমি থাকতাম পোপাদিয়ার বাড়িতে। প্রতিদিনই শুনতাম নানারকম কাহিনী। আমিও ভীত সন্ত্রস্ত ছিলাম। প্রতিটা দিনই কাটতেছিলো সীমাহীন ভয় আর দুঃচিন্তায়। ১৯৭১ সালের ১৩ মে। যথারীতি বাংলার আকাশে সন্ধ্যা নামে, রাত ঘনিয়ে আসে। ঐ রাতেই হানাদারেরা স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তা নিয়ে হানা দেয় আমাদের গ্রামে। যে যার মতো দিগ্বিদিক ছুটছে একটুকু নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। আমাকেও পালাতে বলেছিলো মা। কিন্তু আমি শিশুপুত্র জহরকে কোলে নিয়ে ঘরে বসে ছিলাম। পালাইনি। আশা ছিলো শিশুপুত্র কোলে দেখে হয়ত ওরা আমার কোন ক্ষতি করবে না। কিন্তু আমার আশায় গুড়েবালি। আমার স্বর্গের দেবতুল্য শিশুদেরই সামনে ওরা আমাকে ধর্ষণ করলো। অনেক চেষ্টায় এক পর্যায়ে বাড়ির পিছনের পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। এরপরই দেখি পুরো বাড়িতে আগুন। দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন। বাড়িতে যা কিছু ছিলো লুণ্ঠন করে পাকিস্তানীরা আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলো। সম্ভ্রম হারিয়ে, যা কিছু সম্পদ ছিলো সব হারিয়ে, বাড়িঘরও হারিয়ে যত না কষ্ট পেয়েছিলাম সেদিন, তারচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছিলাম এতদিনে আমার যত লেখা- গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ এর সবগুলো পান্ডুলিপি চোখের সামনে পুড়তে দেখে। সেদিন এমন কিছুই আর অবশিষ্ট ছিলো না যা নিয়ে আমি বেঁচে থাকতে পারি। তাই আমি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নই, বিপক্ষে। কারণ মুক্তিযুদ্ধ আমাকে কিছুই দিতে পারেনি, শুধুই কেড়ে নিয়েছে।
আহমেদ মনসুর: আপনার দুই শিশু সন্তান সাগর আর টগর মুক্তিযুদ্ধের পরপরই রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। তারা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ না হলেও আপনি বলে থাকেন মুক্তিযুদ্ধের কারণে এরা মারা গেছে, সুতরাং এরাও শহীদ। মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের তালিকায় এদের নাম থাকা উচিত বলে কি আপনি মনে করেন?
রমা চৌধুরী: তালিকায় নাম থাকলো কি থাকলো না, কেউ স্বীকৃতি দিলো কি দিলো না তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমার দৃষ্টিতে ওরা শহীদ। হয়ত সরাসরি হানাদার কিংবা রাজাকারদের গুলিতে আমার সন্তানেরা মরেনি, কিন্তু সেই আঘাতেই তো মরেছে। যুদ্ধে আমি তখন সব হারিয়ে একেবারে নিঃস্ব, সহায়-সম্বলহীনা, অবলা। যুদ্ধের ধকলে আর প্রচন্ড ঠান্ডায় আমার বড় ছেলে সাগর অসুস্থ হয়ে পড়ে। সে তখন ‘জয় বাংলা, রাজাকার যা’ বলে বলেই চিৎকার করতো, মিছিলে গিয়ে স্লোগান দিতো। সে আমার কোন মানা শুনতো না। তাকে চিকিৎসা করানোর মতো দেশে তেমন অবস্থা ছিলো না। এমনকি আমার নিজেরও তেমন সংগতি ছিলো না। বলতে গেলে অনেকটা বিনা চিকিৎসাতেই আমার প্রথম সন্তান সাগর গত হয়ে গিয়েছিলো ২০ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে। এরপর আমার দ্বিতীয় ছেলেটিও অসুস্থ হয়ে পড়ে। সে বলতো আমি সাগরের মতো মিছিলে যাবো। তার আশাও পূর্ণ হলো। ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সেও মিছিলে চলে গেলো। মৃত্যুর মিছিলে।
আহমেদ মনসুর: মুক্তিযুদ্ধ শেষ হবার পর দেশ যখন স্বাধীন হলো তখনকার সময়গুলো আপনার কেমন ছিল?
রমা চৌধুরী: তা তো ভাষায় প্রকাশ করবার মতো নয়। আমি সম্ভ্রমহীনা, সমাজের চোখে অস্পৃর্শা ঘৃণিত। পরপর দু’টি সন্তানকে হারালাম। তখন আমার চাকরীও ছিলো না। বাড়িটাও ওরা পুড়িয়ে দিয়েছিলো। বেঁচে থাকা একমাত্র শিশুপুত্র জহর আর অসুস্থ মাকে নিয়ে সামান্য মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও পাইনি কোন খানে। খেয়ে না খেয়ে কি দুর্বিসহ জীবন তখন কাটিয়েছিলাম যুদ্ধের পর কয়েক বছর, তা মুখের ভাষায় প্রকাশ করবার মতো নয়। আমি অনেকগুলো বইতে লেখার চেষ্টা করেছি সেসব কথা। কিন্তু তা পূর্ণাঙ্গ নয়, খন্ডাংশ। সেসব দিনের চিত্রগুলো মানসপটে এখনো ভেসে উঠলে শিহরিত হয়ে পড়ি। অদৃষ্টের লীলায় আজো বেঁচে আছি। আসলে আজ অবধি বেঁচে থাকার কথা ছিলো না। কিভাবে যে সেই দিনগুলো অতিক্রম করে পুনরায় বেঁচে আসলাম, আবার ঘুরে দাঁড়ালাম সত্যিই তা অত্যন্ত আশ্চর্য জনক আর অবিশ্বাস্য।
আহমেদ মনসুর: ১৯৭৮ সালে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় আপনার তৃতীয় ছেলেটি মারা যায়। চাকরীও ছেড়েছিলেন সে বছরেই। সে থেকে আপনি পায়ে জুতা পড়া ছেড়ে দেন। এর আগেও একবার জুতা পড়া ছেড়েছিলেন। কিন্তু অসুস্থ হয়ে পড়ার কারণে পুনরায় জুতা পায়ে দিতেন। ১৯৭৮ সাল থেকে স্থায়ীভাবে ছেড়ে দিলেন। আপনি মূলত জুতা পায়ে দেয়া ছেড়েছিলেন কেন?
রমা চৌধুরী: মুক্তিযুদ্ধের কারণে দুই সন্তানকে হারিয়ে আমি উন্মাদ হয়ে পড়ি। ওদের দাহ করতে দিইনি, সমাধিস্থ করেছি। যে মাটির নিচে আমার দুই দু’টি সন্তান শুয়ে আছে, শুয়ে আছে লক্ষ লক্ষ শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সে মাটিতে আমি দম্ভের সাথে জুতা পায়ে চলি কি করে? তাই জুতা পায়ে দেয়া ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু এর পরপরই যখন অসুস্থ হয়ে পড়লাম তখন সবার চাপাচাপিতে একান্ত বাধ্য হয়েই পুনরায় জুতা পায়ে দেয়া শুরু করলাম। আবার ১৯৮৪ সালে মারা যান আমার মা। ১৯৯৮ সালে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় আমার আরেক পুত্র দীপঙ্কর টুনু। দিনটা ছিলো ১৬ ডিসেম্বর। ঐ থেকে ১৬ ডিসেম্বর আমার কাছে বিজয়ের নয়, শোকের। এরপর থেকেই আমি মূলত জুতা পায়ে দেয়া স্থায়ীভাবে ছেড়ে দিই। এই মাটিতে আমার বুক দিয়ে চলা উচিত। তা তো পারি না। তাই অন্তত জুতা ছাড়াই নগ্ন পায়ে চলি। যে মাটিতে আমার তিন সন্তান আর মা শুয়ে আছে, সে মাটিতে জুতা পায়ে চলি কি করে বলুন তো?
আহমেদ মনসুর: সড়ক দুর্ঘটনায় আপনার যে ছেলেটি মারা যায়, মানে টুনু, উনি তো লেখালেখির সাথে ছিলেন, কবিতা লিখতেন। টুনু ছিলেন আপনার দ্বিতীয় সংসারের সন্তান। আপনি কত সালে দ্বিতীয় সংসার শুরু করেন এবং কি কারণে সেই সংসারটি ভেঙে গিয়েছিল ?
রমা চৌধুরী: ১৯৭৬ সালে দীলিপ দত্ত রায়ের সাথে গন্ধর্ব মতে আমার বিয়ে হয়, ঐ অর্থে সামাজিকভাবে বা ধর্মীয়ভাবে নয়। তিনি তখন দৈনিক সংবাদ এর সার্কুলেশান ম্যানেজার ছিলেন। তিনি আবার ছিলেন আইনের ছাত্র। আমার গর্ভে একটি সন্তান দিয়ে, সে সন্তানকে স্বীকৃতি না দিয়ে আমাকে স্ত্রীর মর্যাদা না দিয়েই তিনি স্থায়ীভাবে কিশোরগঞ্জে চলে যান এবং ওখানে আরেকটা বিয়ে করে কিশোরগঞ্জে জজকোর্টে আইন চর্চা শুরু করেন। আমি অনেক চেষ্টা করেও তাঁকে ফেরাতে পারিনি। আমি প্রতারণার শিকার হয়েছিলাম।
আহমেদ মনসুর: প্রথম সংসারের তৃতীয় সন্তান মানে জহর, একমাত্র যে সন্তানটি এখনো বেঁচে আছে, তিনি এখন কি করেন ?
রমা চৌধুরী: তাঁর বয়স এখন পঁয়তাল্লিশের মতো। পোপাদিয়ার ঐ পোড়া বাড়িটাতেই থাকে। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। স্বাভাবিকভাবেই বিরাট একটা মানসিক একটা চাপ তো জগদ্দল পাথরের মতো তার মাথার উপরে আছেই। পিতৃপরিচয়হীনতায় ভুগতে ভুগতে আর সামাজিক বঞ্চনার দরুণ সে খুব একটা ভালো নেই। এখনো বিয়ে থা করাতে পারিনি।
আহমেদ মনসুর: শিশু কালেই পিতাকে হারিয়ে ছিলেন। আপনার আর কোন ভাই বোন ছিলো না। তাই পৈতৃক সম্পত্তিসমূহ আপনিই পেয়েছিলেন। যদিও পাকিস্তানী হানাদাররা বাড়িঘর সমস্তকিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল। কিছু পোড়া ভিটেমাটি ছিলো। যুদ্ধের পরেই আপনি সেখানে গড়ে তুললেন ‘দয়ার কুঠির’ নামের একটি অনাথাশ্রম। পরে অর্থাৎ টুনু মারা যাওয়ার পর ১৯৯৮ সালে এটির নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘দীপঙ্কর স্মৃতি অনাথালয়’। আপনি নিজেই যেখানে সর্বহারা সেখানে অনাথদের জন্য আশ্রম করার চিন্তা করলেন কেন ? এবং সেটির এখন কি অবস্থা ?
রমা চৌধুরী: এডভোকেট দীলিপ দত্ত রায়ের ঔরশজাত দীপঙ্কর টুনু যখন আমার গর্ভ থেকে জন্ম নেয় তখন আমি শিশুপুত্র টুনুকে নিয়ে তাঁর কাছে যাই স্বীকৃতি লাভের আশায়। তখন তিনি আমাকে এবং সন্তানটিকে স্বীকৃতি না দিয়ে বরং পরামর্শ দিলেন ছেলেটিকে যেন কোন একটা অনাথাশ্রমে দিয়ে দিই। আমি দিলাম না। বরং নিজের ঘরটাকেই অনাথাশ্রম বলে ঘোষণা দিলাম। আমার সন্তানের জন্মদাতা থেকেও নেই, সুতরাং আমার ঘরটা তো এমনিতেই অনাথালয়। ‘দয়ার কুঠির’ নাম দিয়ে সেটিকে অনাথাশ্রম হিসেবে পরিচালনা করতে শুরু করলাম। ১৯৯৮ সালে যখন সেই ছেলেটিও মারা গেল তখন নতুন করে সেই অনাথালয়ের নাম দিলাম ‘দীপঙ্কর স্মৃতি অনাথালয়’। সেখানে সব ধর্মে বর্ণের অনাথ শিশু আর বৃদ্ধদের রাখার ইচ্ছে। কিন্তু অর্থাভাবে সেটা পারছি না। এখন ওখানে অনাথদের থাকার জন্য ঘর নির্মাণ করেছি। সব ব্যবস্থা রেখেছি। কিন্তু বাইরের কোন অনাথকে থাকার ব্যবস্থা করতে পারিনি।
আহমেদ মনসুর: বিগত একচল্লিশ বছর ধরে আপনি লেখালেখি করছেন। এর মধ্যে প্রকাশ হয়েছে আপনার ১৮ টির মতো বই। অনেকে মনে করে আপনি সন্তান হারানোর বেদনা ভুলতে আর একাকীত্ব ঘোচাতে লেখ্যবৃত্তি গ্রহণ করেছেন। আবার অনেকের ধারণা জীবিকা নির্বসহের জন্যই লিখছেন আপনি। আসলে কোনটা সত্যি এবং লেখালেখির অনুপ্রেরণা কিভাবে পেলেন?
রমা চৌধুরী: সে অর্থে দু’টোই সত্য। যদিও আমি সন্তানদের হারানোর আগে থেকেই লিখছি। তবে প্রকাশিত হতো না। আমার কুষ্ঠিতে লেখা আছে আমি লেখ্যবৃত্তি গ্রহণ করেই নাকি জীবিকা নির্বাহ করবো। অনেকটা সে কথাকে বাস্তবায়ন করার জন্যই লিখছি। আর এছাড়া এই অবস্থায় আমার অন্য কিছু করারও সুযোগ নেই। বাঁচতে হলে অর্ঘের প্রয়োজন। আমি কারো গলগ্রহ হতে কখনো পছন্দ করতাম না, এখনো করি না। বই লিখে তা প্রকাশ করে, ঝোলা কাঁধে নিয়ে, খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে তা মানুষের কাছে বিক্রি করেই অর্থ উপার্জন করি আর তা দিয়ে আমি চলি। সব সময় চাইতাম স্বাবলম্বী হতে। স্বাবলম্বী অবস্থাতেই মরতে চাই। কারো কাছে যেন হাত পাততে না হয় সেজন্যই লিখি।
আহমেদ মনসুর: আপনার বই বাজারে পাওয়া যায় না। আপনি নিজেই বই ফেরি করেন। কারণ কি?
রমা চৌধুরী: এটা আমার উদ্ভাবিত নতুন পদ্ধতি। নিজের বই নিজে বিক্রি করা। তাতে হয় কি, পাঠকের সাথে সরাসরি সম্পর্ক রাখা যায়। তাদের অভিমত জানা যায়। এর পিছনে যদিও আরো অনেক কারণ আছে। আর তা হলো দোকানে আরো কতশত বই আছে। এগুলোর ভিড়ে আমারগুলো হারিয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে তখন কে কিনবে আমার বই? আর দোকানে দিলে দোকানদার কমিশন কেটে রাখবে, ক্রেতাকেও কমিশন দিতে হবে। ওসব বাদ দিলে আমার জন্য খুব কম পয়সাই থাকবে। আমি গায়ের দরে বই বিক্রি করি, কমিশন দিই না। মানুষের দোরগোড়াই বই পৌঁছিয়ে দিতে আমার পরিশ্রম হয় না? ওটা আমার পারিশ্রমিক।
আহমেদ মনসুর: অনেকের অভিযোগ, আপনার বইয়ের মূল্য অন্য বইয়ের তুলনায় একটু বেশি। এ ব্যাপারে কি বলবেন আপনি?
রমা চৌধুরী: একটু হয়ত বেশিই। তবে খুব একটা বেশি বলে মনে হয় না। ঐ অর্থ দিয়ে আমার অনাথালয় চলে। কাজেই বই ছাপানো বাবদ খরচটা বাদ দিয়ে কিছু টাকা তো পেতেই হয়। আমি তো আর কারো দান দক্ষিণা গ্রহণ করি না। আমার এমন কোন অভিভাবকও নেই যে আমার সাহায্যে এগিয়ে আসবে। কাজেই বই বিক্রির টাকাটার উপরেই আমাকে নির্ভর করতে হয়। তাই বইয়ের মূল্য একটু বেশিই রাখতে হয়। কিন্তু তারপরেও লোকে আমার বই কেনে। কেউ ফিরিয়ে দেয় না।
আহমেদ মনসুর: আপনার লেখায় সবচেয়ে বেশি কোন বিষয় উঠে এসেছে এবং এর মাধ্যমে আপনি সমাজকে কি বার্তা দিতে চান?
রমা চৌধুরী: আমি লিখি মূলত প্রবন্ধ। তবে গল্প, কবিতা, উপন্যাসও লিখেছি। অন্ধ সমাজ ব্যবস্থা আর অমানবিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সমাজ সচেতনমূলক বাস্তবধর্মী লেখাই মূলত আমি লিখে থাকি। কল্পনার আশ্রয় না নিয়ে বাস্তবতার নিরিখে প্রচলিত ঘটনা আর আমার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোকে পুঁজি করেই আমি লিখি। এর মাধ্যমে সমাজের কুসংস্কার, ভ্রান্ত ধারণা, সাম্প্রদায়িকতা, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ অর্থাৎ শ্রেণি বৈষম্য দূর করাই আমার লেখার উদ্দেশ্য। একটি বৈষম্যহীন, মানবিক পৃথিবী গড়ে তোলার বার্তা আমি সমাজের সকলকে আমার লেখার মাধ্যমে দিতে চাই।
আহমেদ মনসুর: বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক হরিশংকর জলদাস তাঁর ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ উপন্যাসটি আপনাকে উৎসর্গ করেছেন এবং উপন্যাসটির মূল ঘটনাটি আবর্তন হয়েছে আপনাকে কেন্দ্র করে। আপনি কি মনে করেন এতে আপনার জীবনের পূর্ণাঙ্গ চিত্রটি ফুটে উঠেছে?
রমা চৌধুরী: ঐ উপন্যাসে প্রতিমা চৌধুরী শীর্ষক যে চরিত্রটি ঔপন্যাসিক হরিশংকর জলদাস চিত্রায়িত করেছেন সেটাকে অনেকে আমার সাথে মিলাতে চান। অনেকটা অবশ্য বোঝাই যায় যে, লেখক ঐ চরিত্রটির মাধ্যমে আমাকেই ইঙ্গিত করেছেন। তবে বাস্তবিকপক্ষে ঐ চরিত্রের মাধ্যমে আমার জীবনের পূর্ণাঙ্গ চিত্রটি ফুটে উঠেনি। তবে লেখক যদি আমাকে নিয়ে আর একটু গবেষণা করতেন, তিনি যে মাপের লেখক, হয়ত তাঁর পক্ষে আমাকে তাঁর লেখায় পূর্ণাঙ্গভাবে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হতো বলে আমার বিশ্বাস।
আহমেদ মনসুর: বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা আপনাকে গণভবনে ডেকে নিয়ে একান্তে সময় দিয়েছিলেন। তিনি আপনাকে কিছু দিতে চাইলে তা আপনি বিনয়ের সাথে প্রত্যাখান করেন। এর পরেই কবি ও সাংবাদিক কামরুল হাসান বাদল আপনাকে ‘শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বোকা’ আখ্যা দিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেন। পুরো ব্যাপারটি নিয়ে যদি আপনি কিছু বলতেন…
রমা চৌধুরী: মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা আমাকে গণভবনে একান্ত সাক্ষাত দিয়েছেন। এতে আমি গর্বিত, এবং আগের চেয়ে নিজেকে আরো বেশি শক্তিশালী আর সাহসী মনে করতে পারি। তাঁকে সেদিন আমি বলেছি, আমি আপনার বড়বোন, আমাকে দিদি বলে ডাকবেন। শেখ রেহানা আপনার ছোটবোন আর আমি বড়বোন। আপনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ডেকেছেন বলে নয়, আপনি জাতির জনকের কন্যা তাই আমি আপনার ডাকে সাড়া দিয়েছি। আমি বীরাঙ্গনা, ৩২ নং আমার ঠিকানা আর বঙ্গবন্ধু আমার পিতা। প্রধানমন্ত্রী আমাকে অর্থ সহায়তা দিতে চেয়েছিলেন আমি নিইনি। কারণ আমি কারো দান দক্ষিণা গ্রহণ করি না। আমি সেদিন তাঁকে আমার লেখা তিনটি বই উপহার হিসেবে দিয়েছিলাম। এরপরই কবি ও সাংবাদিক কামরুল হাসান বাদল আমাকে নিয়ে একটি লেখা লিখেছিলেন। আমি পড়েছি। বাদল আমার ছোট ভাইয়ের মতো। আমি তাঁর জন্য দোয়া করি। তিনি আমাকে বুঝেছেন বলেই তাঁর পক্ষে আমাকে নিয়ে ওরকম একটি লেখা সম্ভব হয়েছে।
আহমেদ মনসুর: আপনাকে নিয়ে এই পর্যন্ত বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় নানা প্রবন্ধ, নিবন্ধ, ফিচার আর সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। এসবের কোন কোনখানে তথ্য বিভ্রাট হয়েছে বা বিভ্রন্তিমূলক তথ্য প্রকাশিত হয়েছে বলে আমার ধারণা। এ ব্যাপারে আপনি কি মনে করেন? এবং কেন এরকমটি হয়েছে বলে আপনার ধারণা?
রমা চৌধুরী: আমার সম্পর্কে ভালো মতো না জেনেই আর আমার সাথে কথা না বলেই তারা আমাকে নিয়ে লিখেছে, তাই ওরকমটি হয়েছে। তবে তা কোনভাবেই ঠিক নয়। কারো সম্পর্কে মনগড়া যাচ্ছেতাই লিখলে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য প্রকাশিত হবেই। এজন্য বলি আমাকে নিয়ে লিখতে গেলেই অবশ্যই আমার লেখা বইগুলো পড়া উচিত এবং আমি যেহেতু এখনো বেঁচে আছি আমার সাথে কথা বলেই লেখা উচিত। তাহলে তথ্যবিভ্রাট আর ঘটবে না।
আহমেদ মনসুর: এ পর্যন্ত আপনার পূর্ণাঙ্গ জীবন নিয়ে কোন গ্রন্থ রচিত হয়নি। ‘একাত্তরের জননী’সহ আপনার অন্যান্য গ্রন্থে যদিও আপনার জীবনের খণ্ড খণ্ড অংশ আলোচিত হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ আত্মজীবনী রচনার ক্ষেত্রে আপনার কোন চিন্তা ধারা আছে কি না?
রমা চৌধুরী: আত্মজীবনী লেখা আমি শুরু করেছিলাম। যা একাত্তরের ১৩ মে পুড়ে যায়। এরপর আর ওভাবে লেখা হয়নি। তবে ‘একাত্তরের জননী’ গ্রন্থটা অনেকটা আত্মজীবনীর মতই। দশখণ্ড যদি প্রকাশ করতে পারি তাহলে আমার পূর্ণাঙ্গ জীবনী হয়ত পাঠকের সামনে তুলে ধরতে পারবো।
আহমেদ মনসুর: একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের মাটি স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু মানুষ স্বাধীন হয়নি। আপনি কোন এক সময় এরকম একটি মন্তব্য করেছিলেন। কেন আপনার এরকমটি মনে হল?
রমা চৌধুরী:
মুক্তিযুদ্ধের মূল যে চেতনা বা আদর্শ তা এখনো পরিপূর্ণ ভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। কোন দলই তা চায় না। অর্থাৎ নৈতিক উন্নতি কিছুটা হলেও অর্থাৎ নৈতিকভাবে শ্রেণিবৈষম্য বরং আগের চেয়ে বেড়েছে। মানুষের যে সাংবিধানিক অধিকার তা পরিপূর্ণ রূপে বাস্তবায়িত হয়নি। এক কথায় মানুষ তার অধিকার পায়নি। আর এজন্যই আমি সবসময় বলে থাকি মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে এ অঞ্চলের মাটি স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু মানুষ স্বাধীন হয়নি।
আহমেদ মনসুর: মুক্তিযুদ্ধে আপনার ত্যাগ তো সর্বোচ্চ। আপনি এর যথাযত মূল্যায়ন পেয়েছেন কি?
রমা চৌধুরী: একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাকে এত বেশি ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে এর মূল্যায়ন করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। কেউ কি আমার হারানো সম্ভ্রম ফিরিয়ে দিতে পারবে? পারবে কি আমার দেবতুল্য শিশু সন্তানদের ফিরিয়ে দিতে? (কান্না) পারবে না। এজন্যই আমি এর মূল্যায়ন কারো কাছেই কোনদিন চাইনি।
আহমেদ মনসুর: এই প্রজন্মের যারা একাত্তর সম্পর্ক জানতে চায়, বায়ান্ন নিয়ে আগ্রহী এবং লেখালেখিতেও আসতে চায়, তাদের প্রতি আপনার পরামর্শ কি থাকবে?
রমা চৌধুরী: লেখক হওয়া সহজ নয়। এর জন্য প্রয়োজন কঠিন সাধনা আর ত্যাগ। বৈষয়িক চিন্তা থেকে আত্মকেন্দ্রিক হলে হবে না। ভাবতে হবে অন্যদের কথা, হতে হবে মানবিক। অর্থনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠা পাবার লোভে মোহগ্রস্থ হয়ে পড়লে লেখক হওয়া যাবে না। লেখকের জীবন বড়ই করুণ হয়। নিজেকে পুড়িয়ে পুড়িয়ে লেখক শুধুই দিয়ে যাবেন, কিন্তু তার বদলে পাবে না কিছুই। রবীন্দ্রনাথের মতো জমিদারও লিখতে গিয়ে জমিদারি হারিয়েছেন। মাইকেল মধুসূধন বড় ধনী ঘরের সন্তান হয়েও মৃত্যুকালে অর্থাভাবে এক প্রকার বিনা-চিকিৎসাতেই দাতব্য চিকিৎসালয়ে মরেছিলো। জীবনানন্দ দাশের মতো কবিকেও অর্থকষ্ট আর নানাবিধ জরায় অতিষ্ঠ হয়ে আত্মহত্যা করতে হয়েছিলো। নজরুলের কথা না হয় বাদই দিলাম। সকলেরই তা জানা। সুতরাং এ পথে আসতে চাইলে লোভ-লালসা-মোহ ত্যাগ করেই তবে আসতে হবে। আর বেশি বেশি করে বই পড়তে হবে। অগ্রজদের লেখা না পড়ে কেউ কোনদিন ভালো লিখিয়ে হতে পারবে না। অবশ্যই জানার জগতটাকে প্রসারিত করতে হবে, জ্ঞানভান্ডারকে করতে হবে সমৃদ্ধ। জেনে, শুনে, বুঝে সত্যিটাকেই লিখতে হবে। যাতে লোকে পড়ে উপকৃত হতে পারে, সমৃদ্ধ হতে পারে, অভিজ্ঞতা পেতে পারে। ৭১, ৫২ সম্পর্কে জানতে হলে ঐ বিষয়ে ব্যাপক পড়াশুনা করতে হবে। তাহলে সত্যিকারের দেশপ্রেমিক হওয়া যাবে। দেশপ্রেমিক হওয়া গেলেই ভালো লেখক হওয়া যাবে।
আহমেদ মনসুর: আপনার পুরো জীবনের এই দীর্ঘ সময়ে বিড়ালের সাথে একটা সম্পর্ক আছে। বিড়াল পুষতে ভালবাসেন। অনেকে আপনাকে বিড়ালের মা আখ্যা দিয়ে থাকেন। আবার অনেকে মনে করেন সন্তান হারানোর বেদনা ভুলে থাকতেই আপনি বিড়াল পুষেন। বলতে গেলে বিড়াল নিয়েই তো আপনার সংসার। এ নিয়ে আপনি কি বলবেন?
রমা চৌধুরী: আমি বিড়াল পুষি। বিড়াল বড্ড পছন্দ করি। বলতে গেলে বিড়ালের সাথেই আমার সংসার। সেই ছোটবেলা থেকেই বিড়ালের প্রতি একটা দুর্বলতা অনুভব করতাম। সেই থেকে সারাটা জীবন যখন যেখানে থেকেছি তখন থেকেই আমার সাথে বিড়াল ছিলো। একাত্তরের ১৩ মে আমাকে এত কিছু হারাতে হতো না যদি শিশু সন্তানদের আর বিড়ালের মায়া ত্যাগ করে গ্রামের অন্য মেয়েদের মতো নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতাম। আমি পারিনি। বিড়াল আমার ভালো লাগে কেন বলতে পারবো না। আমার প্রথম সন্তান সাগর জন্মেছিলো সিলেটে, একটি ক্লিনিকে। ওখান থেকে যখন ফিরে আসছিলাম তখন একজন নার্স সাথে করে নিয়ে এসেছিলাম, শান্তি ভট্টাচার্য ফেরার পথে ওর কোলে ছিলো আমার ছেলে সাগর আর আমার কোলে ছিলো বিড়াল। আমি আমার ছেলেদের মতোই বিড়ালদের জানি। আমি মাছ খায় না অথচ মাছ কিনতে হয় বিড়ালের জন্য। বই বিক্রির পয়সা দিয়েই তা হয়। এখন যে বিড়ালগুলো আমার সাথে আছে, ওরা আমার ভাষা বুঝে। আমার সাথে ঘুমায়। টয়লেটে গিয়ে পায়খানা প্রশ্রাব করে। আমি ওঠতে বললে ওঠে বসতে বললে বসে। ওরা আমার সব সময়ের সঙ্গী। সন্তান হারানোর বেদনা কিছুটা হলেও ভুলিয়ে রেখেছে বিড়ালগুলো বৈকি। তবে সন্তানের মা হওয়ার আগে থেকেই আমি বিড়াল পালি।
আহমেদ মনসুর: বর্তমানে আপনার দেখাশুনা কে করেন?
রমা চৌধুরী: আলাউদ্দিন খোকন। আমার সন্তানতুল্য ছোটভাই। গত ২১ বছর ধরে আমার সাথে আছে। সেও আমার মতো অসহায়, ভাগ্য বিড়ম্বিত। সৎ মায়ের অত্যাচারে আজ থেকে ২৩-২৪ বছর আগে বরিশালের বাপের বাড়ি ছেড়ে চট্টগ্রাম চলে আসে। জামালখানের একটা প্রেসে কাজ করতো। আমি সেখানে যাই বই ছাপানোর কাজে। তখনই এর সাথে পরিচয় হয়। তার কষ্টের কথা শুনে আমার বাসায় খাবার খেতে ডাকতাম। আস্তে আস্তে আমার দুঃখগাঁথার কাহিনীও ওর জানা হয়ে গেল। আমারও কেউ নেই ওরও কেউ নেই। সেই থেকে সে আমার সাথে থাকে। আমি বই লিখি, ও তা প্রকাশ করে। আবার একসাথে হেঁটে হেঁটে ওগুলো বিক্রি করি। ২০০৫ সালে আমি যখন গুরতর অসুস্থ হয়ে পড়ি, ও রাত দিন মৃত্যু যমের সাথে সংগ্রাম করে আমাকে নতুন জন্মদান করে। সে হিসেবে ও আমার নতুন জীবন দানকারী। আমরা যখন বই বিক্রি করতে বের হই, ও তখন আমার বইয়ের থলেটা বহন করে আর আমার মাথায় ছাতা ধরে। আমার চিকিৎসা, ঔষধ পথ্য, খাবার দাবার সবকিছুর দেখভাল ওই করে। বড়ই নির্মোহ মানুষ সে। পুরো জীবনটা আমার পিছনে নষ্ট করলো। নিজের কথা ভাবলো না একটুও। আমি ওর জন্য তেমন কিছুই করতে পারলাম না। তবে আমি তার মঙ্গল কামনা করি।
আহমেদ মনসুর: আমরা জানি আপনি স্বপ্ন দেখতে ভালবাসেন। স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে আছেন। আপনার এমন কয়েকটি স্বপ্ন হলো সমস্ত যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি দেখে যাওয়া। লোকনাথ ব্রক্ষ্মচারীর মতো ১৬০ বছর বাঁচতে চান আপনি। ‘দীপঙ্কর স্মৃতি অনাথালয়’ নামে দেশের প্রতিটি জেলায় একটি করে অনাথাশ্রম প্রতিষ্ঠা করতে চান। সেখানে সব ধর্ম বর্ণের বয়স্ক আর শিশুরা থাকবে। আর লিখতে চান আরো হাজার খানেক বই। এর বাইরেও কি আপনার আর কোন স্বপ্ন আছে? এবং এসব স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা কি আদৌ সম্ভব বলে মনে করেন?
রমা চৌধুরী: মানুষ স্বপ্ন নিয়ে বাঁচে। আমিও স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি। এর বাইরেও আমার আরো অনেক স্বপ্ন আছে। আমি চাই এদেশের প্রত্যেকটা মানুষ খেয়ে পরে সম্মান নিয়ে বাচুঁক। এর জন্য প্রয়োজন উদ্যোগী হওয়া। মানুষ তো খালি পড়াশুনা শেষ করে চাকরীর পিছনে ছুটে। একটা পিয়নের চাকরীতেও জমা পরে হাজার হাজার দরখাস্ত। এর মধ্যে আবার অনেকগুলো এমএ পাশ করা লোকের দরখাস্ত। আমার তো তাদের ধরে ধরে পিটাতে ইচ্ছা করে। মানুষের তো কিছু জমি থাকে। জমি না থাকলেও ভিটে বাড়ি তো থাকে। ওখানে ওরা ফলের চারা বুনতে পারে। ঐ গাছে ফল ধরে না, বলুন? ওখান থেকে তো চলতে পারে। আমি বলছি স্বনির্ভর হওয়ার কথা। সীম গাছও তো বুনতে পারে। সীম চাষে কোন কষ্ট আছে, বলুন? কষ্ট নেই। সীমের চাষ করেও এদেশের মানুষ স্বচ্ছন্দে চলে যেতে পারে। আমি করে দেখাবো। আপনি বলেছেন, আমার এসব স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা সম্ভব কিনা। অবশ্যই সম্ভব। আগ্রহ, একাগ্রতা আর প্রচেষ্টা থাকলে। মানুষ নিয়তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলেও পরিবর্তন তো করতে পারে।
আহমেদ মনসুর: আপনি হিন্দু ধর্মের অনুসারী হলেও মৃত্যুর পর শবদেহ দাহ করার সংস্কারটি মানেন না কেন?
রমা চৌধুরী: আমি হিন্দু ধর্মে বিশ্বাস করি, পুনজন্মেও বিশ্বাসী। তবে মৃত্যুর পর মৃতদেহ দাহ করার সংস্কারটি মানতে পারি না। এত সুন্দর দেহখানা কেন শুধু পুড়িয়ে অঙ্গার করতে হবে? তাই মাটির দেহ মাটিতে সমাধিস্থ করাতেই আমার মত। আমার পরিবারের কাউকে দাহ করা হয়নি। বাবাকে শুধু দাহ করা হয়েছিলো নারায়নগঞ্জে। আমি খুব ছোট ছিলাম তখন। কিছু বুঝার বয়স হয়নি। নাহয় তাও দিতাম না। আমার তিন সন্তানের মৃতদেহ এবং আমার মায়ের মৃতদেহ সমাধি দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেশী হিন্দুরা যদিও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিলো। হিন্দু ধর্মের সংস্কার অমান্যকারিনী আখ্যা দিয়েছিলো আমাকে। কোন প্রতিবন্ধকতা আমাকে একাজ থেকে নিভৃত করতে পারেনি। আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল আর দৃঢ় ছিলাম। কাজেই পিছু হটানোর চেষ্টা করেও ওরা ব্যর্থ হয়েছিলো। মৃত্যুর পর আমার দেহটাও মাটিতে সমাধিস্থ করতে বলে যাচ্ছি। যেন পোড়ানো না হয় কিছুতেই। আমি এ সংস্কার মানি না।
আহমেদ মনসুর: লিখতে পারেন আগের মতো? এখন কি নিয়ে লিখছেন?
রমা চৌধুরী: দিব্যি লিখতে পারি। লিখতে আমার কোন অসুবিধে হয় না। তবে জীবিকা নির্বাহের তাগিদে প্রতিদিনই বই নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হয়। সারাদিন হেঁটে হেঁটে পথচলার কারণে অবশ্রান্ত হয়ে পড়ি। শক্তি কুলোয় না। তবে সময় পেলেই বসে বসে লিখি। লেখার বিষয় তো আমার কাছে অনেক। সারা জীবন লিখেও শেষ করার নয়। ইচ্ছে আছে আরও এক হাজার বই লেখার। এখন একটা কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ হওয়ার পথে। বইটার নাম এখনো ঠিক করা হয়নি। ‘একাত্তরের জননী’ গ্রন্থটা দশ খন্ড হবে। প্রথম খন্ড প্রকাশিত হলেও বাকি আছে আরো নয় খন্ড। ওসবের কাজ করছি। দ্বিতীয় খন্ড খুব শীঘ্রই প্রকাশ করবো।
আহমেদ মনসুর: এবার একটি ভিন্ন রকমের প্রশ্ন! জীবনে কখনো কি প্রেমে পড়েছিলেন? আপনার পুরো জীবনটা তো দুঃখ দিয়ে গড়া। এমন কোন আনন্দের মূহুর্ত কি আছে, যা আজো মাঝে মাঝে মনে পড়লে খুব হাসি পায়?
রমা চৌধুরী: আমি পড়িনি, আমার প্রেমে পড়েছে অনেকেই। তবে আমার বয়স যখন ১২ বছর, তখন একজনের প্রেমে পড়েছিলাম। যদিও সেটাকে সে-অর্থে প্রেম বলা যাবে না, ভালো লাগা ছিলো। বয়সটা তো ছিলো আবেগের, তাই না? উনার নাম আমার এখনো মনে আছে, প্রবাস। এখন বেঁচে আছে কিনা জানি না। সেই অনেক বছর আগেকার কথা। পুরো জীবনটা দুঃখে দুঃখে কাটলেও আনন্দের মূহুর্ত যে একেবারে নেই তাও নয়। এরকম অনেকগুলো ঘটনার কথা বলতে পারি যা আমার সাথে ঘটেছে, আমাকে আনন্দ দিয়েছে। তবে সবচেয়ে উল্লেখ করার মতো ছিলো আমার সন্তান জন্মদানের মুহুর্তগুলো। প্রতিটা সন্তানের জন্মই ছিলো আমার কাছে সবচেয়ে আনন্দের ক্ষণ। তবে সে আনন্দ টেকেনি। নিয়তির করুণ ঝাপটায় সে আনন্দ আমার স্থায়ী হয়নি। তবে আমি এখনো আনন্দ পাই, এখনো হাসি, যখন দেখি দুঃখী এদেশটার সন্তানেরা ভাল কিছু করে দেশ মাতৃকার জন্য, কিছু অর্জন করে। যখন দেখি অন্যরা খুশিতে আছে, আনন্দে আছে, তখন খুবই খুশি হই, পুলক অনুভব করি, আনন্দ পাই।
আহমেদ মনসুর: বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মডেল বলা হয়। আর বিভিন্ন সূচকেও এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। তথ্য প্রযুক্তি খাতে এদেশ এখন দারুণ উৎকর্ষ সাধন করেছে। এ নিয়ে আপনি কেমন মন্তব্য করবেন?
রমা চৌধুরী: বাংলাদেশকে পরিপূর্ণ ভাবে অসাম্প্রদায়িক দেশ বলি কি করে? একাত্তরের চেতনায় যদিও সেটা ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পরেও তো আমরা এ অঞ্চলে ধর্মীয় সংঘাত দেখেছি। বিচ্ছিন্নভাবে এখনো হচ্ছে। পুরোপুরি অসম্প্রদায়িক চেতনায় বাংলাদেশকে গড়ে তোলা যায়নি। মুসলিমরা বলছে আমরা সেরা, হিন্দুরা বলছে আমরা। পূর্ণাঙ্গ সাম্য প্রতিষ্ঠা এখনো সম্ভব হয়নি। আরো কাজ বাকি। কেউ কেউ বড় হচ্ছে বটে, অধিকাংশই অবেহেলিত, পদদলিত। অর্থনৈতিক সাম্যও এখনো প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। পুঁজিপতিদের আধিপত্য চারিদিকে। আমি বেঁচে আছি কি জন্যে? আমি এদেশের সব মানুষকে সমান সুযোগ পেয়ে, খেয়ে, পরে, বেঁচে থাকবে, এটা দেখে যেতে চাই। আমার সংগ্রাম তাই এখনো চলছে, চলবে।
আহমেদ মনসুর: আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সময় দেওয়ার জন্য।
রমা চৌধুরী: আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ আর আশীর্বাদ।
বেশ লম্বা সাক্ষাৎকার। বেশ হয়েছে