ভি এস ন্যয়পল: তাঁর পৃথিবী
পাহাড়ী ভট্টাচার্য
“The world is what it is, men who are nothing, who allow themselves to become nothing, have no place in it”.
– V S Naipaul.
২০১৮-র ১১ আগষ্ট ৮৫ বছর বয়সে লন্ডনে স্যার বিদ্যাধর সূর্যপ্রসাদ ন্যয়পল মৃত্যুবরণ করেন ৩য় স্ত্রী পাকিস্তানি বংশোদ্ধুত সাংবাদিক নাদিরা আলভি, সানডে মেল-পত্রিকার সম্পাদক বন্ধু গর্ডি গ্রেইগ সহ অনেকটা প্রিয়জন পরিবেষ্টিত অবস্থায়, ইংরেজ কবি লর্ড টেনিসনের ” ক্রসিং দ্য বার” কবিতাটি শুনতে শুনতে!
ন্যয়পলের মৃত্যু, স্বভাবতই, শোকাকূল ও হতবিহব্বল করে সালমান রুশদি সহ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা তাঁর
অসংখ্য বন্ধুজন ও ভক্তকুলকে। রুশদি লেখেন, আমৃত্যু সাহিত্য, রাজনীতি, শিল্প-সংশ্লিষ্ট নানান বিষয়ে আমাদের পারষ্পরিক মতদ্বৈততা সত্ত্বেও ন্যয়পল আমার একান্তই নিকটজন, বয়োজ্যোষ্ট, ভ্রাতৃপ্রতিম। এই মৃত্যু বেদনার, তাঁর অনুপস্থিতিতে, প্রকৃতই আমি স্বজন-হারা!
পৃথিবীর নানা দেশে, নানা প্রান্তে নিরন্তর পরিভ্রমণ, কখনোবা সাময়িক বসবাস, সমকাল ও ইতিহাসের নিরিখে সে সব দেশ, সমাজ ও মানুষের জীবন-ধারা, বিশ্বাস, সংষ্কৃতি ও বৈচিত্রময়তাকে উপনিবেশ ও উত্তর-উপনিবেশকালের আলোয়, বৈশ্বিক আর্থ-সামাজিক পরিবর্তিত বাস্তবতায়, নিতান্তই স্যাটায়ারিস্টিক ও কমিক এপ্রোচে, অনবদ্য ক্ষুরধার গদ্যে, স্বকীয় সৃজন-দক্ষতায় সাহিত্যে তুলে আনবার কৃতিত্ব স্যার ভি এস ন্যয়পলকে দিয়েছে খ্যাতি, পুরষ্কার, সম্মাননা, খেতাব বিশেষত নাইটহুড, স্যার উপাধি-ইত্যাদি!
“ইন এ ফ্রি স্টেট”, “এ হাউস ফর মি: বিশ্বাস”, “মিগুয়েল স্ট্রিট” ” দ্য সাফরেজ অব এলভিরা”, “এন এরিয়া অব ডার্কনেস” “এ ফ্ল্যাগ অন দ্য অাইল্যান্ড” ” গেরিলাস” ” দ্য এনিগমা অব এরাইভ্যাল” ” দ্য মিডল প্যাসেজ” সহ কালজয়ী অসংখ্য রচনা তাঁর। ৫০ বছরের নিরলস লেখালেখিতে গ্রন্হ সংখ্যা প্রায় ৩০টি। রয়েছে নানান ইস্যুতে অসংখ্য মেমোয়ার্স, ক্রনিকলস, ট্রাভেলগ, সাক্ষাতকার, বক্তৃতা ও মতামত । সাহিত্যে, ১৯৭১ সালে বুকার এবং ২০০১ সালে নোবেলজয়ী এ লেখক।
ভারতীয় বংশোদ্ধূত স্যার ভি এস ন্যয়পলের জন্ম ১৯৩২ সালের ১৭ আগষ্ট ব্রিটিশ কলোনি টোব্যাগো ও ত্রিনিদাদ দ্বীপের চাকুয়ানাসে। ন্যায়পলের পূর্বপুরুষেরা এখানকার আখক্ষেতে কাজ করতে জন্মভিটা ও আরেক ব্রিটিশ উপনিবেশ ভারত থেকে এসেছিলেন মূলত অভিবাসী শ্রমিক হয়েই। ন্যায়পলের বাবা, সম্ভবত দ্বিতীয় প্রজন্মের শ্রীপ্রসাদ ন্যায়পল, ত্রিনিদাদের তৎকালীন ভারতীয়দের মধ্যে ছিলেন উচ্চশিক্ষিত ও অগ্রসর একজন , যিনি সাংবাদিকতা ও সাহিত্যকর্মকে পেশা হিসেবে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। পিতার সাহিত্যপ্রীতি ও মনন-ধারা ন্যয়পলের জীবনকে সবিশেষ প্রভাবিত করেছে।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা-বৃত্তি নিয়ে ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে ভি এস ন্যয়পল ‘৫০-এর দশকের শুরুতে অক্সফোর্ডে পড়তে যান। এখানেই তাঁর সাক্ষাত ঘটে প্রেমিকা, ১ম স্ত্রী ও অকৃত্রিম বন্ধু, আমৃত্যু শুভানুধ্যায়ী, তাঁর সকল রচনার প্রথম পাঠিকা, কখনো অনুলেখক, সমালোচক, প্যাট্রিসিয়া এ্যান হেইল-এর সাথে। ১৯৫৩-য় দু’জন অক্সফোর্ড হতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। স্মতর্ব্য, প্যাট্রিসিয়া ন্যয়পলকে নানাভাবে সাহিত্যে মনোনিবেশে পৃষ্টপোষকতা ও প্রেরনা দিয়ে গেছেন। এমনকি তাঁর আর্থিক দায়ভার নিয়ে, নিজ পরিবারের অমতে তাঁকে বিয়েও করেছেন। ১৯৯৬ সালে প্যাট্রিসিয়া মারা যান। ‘৭২ সালে সস্ত্রীক আর্জেন্টিনা সফরের সময় মাগার্রিট ম্যারি গুডিং নামের এক এঙ্গলো-আর্জেন্টাইন বিবাহিতা নারীর সাথে পরিচয় ও সস্পর্ক গড়ে ওঠে ন্যয়পলের। ধারনা করা হয় ইনি ন্যায়পলের ২য় স্ত্রী। এমনকি, প্যাট্রিসিয়ার গোচরে ও ন্যয়পলের জীবদশায় ২৪ বছর এ সম্পর্ক টিকে ছিল!
মোটাদাগে, ভাগ্যবিড়ম্বিত ন্যয়পলকে কখনো বিবিসি-র রেডিও-তে ক্যারিবীয় ব্রডকাষ্টারের চাকুরী, কখনো পত্রিকায় মামুলি সংবাদদাতা, ফরমায়েশি কলাম ও ভ্রমন বৃত্তান্ত লেখকের কাজ, কখনো অন্যদের বই ও লেখাজোকা অনুবাদ ও সম্পাদনার কাজ করে অনেকটা অনিশ্চয়তায় ও আর্থিক দৈন্যে কাটাতে হয়েছে শুরুতে। জীবনের নানান টানাপোড়েনে নাকাল, হতাশ ও কিছুটা অস্থিরচিত্ত ন্যায়পলের একপর্যায়ে তৎকালীন ব্রিটিশ রাজনীতিক হিউ ফ্রেজারের স্ত্রী এন্তোনিয়ার সুবাদে লন্ডনের খ্যাতনামা শিল্পী-সাহিত্যিক ও অভিজাত মহলের সাথে পরিচয় ও ঘনিষ্টতা বাড়ে । এ যোগসূত্রে, ক্রমে ভাগ্য সুপ্রসন্ন হতে থাকে তাঁর।
জোসেফ কনরাড-প্রভাবিত ন্যয়পল একাধারে ত্রিনিদাদ-ট্যোবাগো, পোর্ট অব স্পেন, বার্বাডোজ, মারিশাস, স্পেন, আফ্রিকার কঙ্গো, উগান্ডা, মোজাম্বিক, গায়ানা, সুরিনাম, মৌরিতানিয়া, জ্যামেইকা, ল্যাটিন আমেরিকার আর্জেন্টিনা, ফ্রান্স, কানাডা, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, বাংলাদেশ ঘুরেছেন; থেকেছেন কোন কোন দেশে।
মূলত প্রথম জীবনে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ এবং যুব ও পরিণত বয়সে ইংল্যান্ডে স্হায়ী হবার ইত্যবসরে অনেকটা নিয়ত ভ্রাম্যমান এক জীবন কেটেছে ন্যয়পলের, ফলে তাঁর সাহিত্যের প্রেক্ষিতটি একদিকে যেমন বৈশ্বিক ও ব্যাপক, তেমনি অন্যদিকে দ্যোতনায় তা বহুমাত্রিক ও বিষয়াশ্রয়ী।
এক বহিরাগত ও অনেকটা নির্মোহ পরিব্রাজকের চোখে রাষ্ট্র-সমাজধারা এবং মানুষকে দেখার, বোঝার, জানার ও বিচারের নিজস্ব ধরনেও ন্যয়পলেের রচনাসমূহ একার্থে, স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত। নিরন্তর উপনিবেশবাদের প্রভাব ও ধর্ম-বর্ণ-জাত-পাতের, কঠোর আইনের ঘেরাটোপমুক্ত একটি স্বকীয় মানবিক পৃথিবীর জন্য আকুতি ও নিয়ত পক্ষপাত আমরা ন্যয়পল ও তাঁর সৃষ্ট সাহিত্যে, তাঁর গল্প-উপন্যাসের চরিত্রদের মধ্যে প্রত্যক্ষ করি।
ন্যয়পলের ভ্রমণবৃত্তান্ত, কলাম, স্মৃতিকথা, গল্প, উপন্যাস, কাহিনী-চিত্রে রাষ্ট্রহীন, অভিবাসীর মনোদৈহিক বেদনাকে আমরা অন্যতম উপজীব্য হতে দেখি। দেখি, শেকড়ের সন্ধানে তাঁর মতই পিতৃভুমিতে (ভারত) পাড়ি দিয়ে হতাশ, দৃশ্যত সূত্র ও সম্পর্ক-হীনতার কষ্ঠে কাতর কোন চরিত্রকে, একার্থে, ন্যায়পল নিজের ও পরিবারের কথা, শৈশব ও পরিণত বয়সের সব যন্ত্রণাবোধ, দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতা ও নৈর্ব্যক্তিক অনুভবকে অনন্য শিল্প-শৈলীতে চিত্রিত করেছেন তাঁর গদ্যে, সাহিত্যে।
ন্যয়পল তাঁর রচনায় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রথাগত ও সমসাময়িক বিবিধ বিচ্যুতি, সমাজে সহিষ্নুতার সংকট, রাজনীতিতে ধর্মাশ্রয়ী উগ্রবাদের বিকাশ, কর্তৃত্ববাদিতা, উপনিবেশবাদের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, গৃহহীন-মানচিত্রহীন মানুষের সংকটকে মানবীয় মর্মবেদনায় তুলে ধরতে প্রয়াসী হন। একটি মুক্ত বিশ্ব ও উদার স্বদেশভুমির অনিবার্যতাকেও প্রকারান্তরে অভিষ্ট বলে তুলে অানেন পাঠকের চিন্তা ও মনোজগতে।
ভি এস ন্যয়পল ছিলেন কালোতীর্ণ এক ব্যতিক্রমী লেখক-সত্ত্বা, জীবনকে প্রকৃতই নানামাত্রিকতায় যাপন করা উদ্যমী এক প্রবল পুরুষ, তাঁর সৃজিত সাহিত্যের মানদণ্ডে ও বৈশ্বিক বিবেচনায় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে সম্ভবত, শেষ সেতুবন্ধন!
পাহাড়ী ভট্টাচার্য: কবি ও প্রাবন্ধিক।