পাঠ অনুভূতি-১ ।। পান্থজন জাহাঙ্গীর।। পুবাকাশ

বই।।  স্বয়মাগতা
কবি ।। মোস্তাফিজ কারিগর
প্রচ্ছদ ।। মোস্তাফিজ কারিগর
প্রকাশক।। অগ্রদূত এ্যান্ড কোম্পানি, ঢাকা
পৃষ্ঠা ।।৮৮
মূল্য।।১২০ টাকা

মোস্তাফিজ কারিগর।। জল ও জীবনের শিল্পী

স্বয়মাগতা মুস্তাফিজ কারিগরের সিরিজ কবিতার বই। বইটিতে মোট আটাত্তর টি কবিতা রয়েছে। কবিতাগুলোর ভাষা সহজ কিন্তু যাপনের শব্দগুলো তিনি ব্যবহারে এতো চাতুর্য দেখিয়েছেন যে যেকোন পাঠককে কবিতাগুলো মোহাবিষ্ট করে রাখবে। কবিতার মুগ্বতা ও চৌম্বুকত্ব যে কোন পাঠককে মোহময় আবেশে ধরে রাখতে সক্ষম। মোস্তাফিজ কারিগর কুষ্টিয়াতে শৈশব ও কৈশোর যাপন করলেও কুষ্টিয়ার জল, হাওয়া,পরিবেশ এই কবিতাগুলোতে তেমন প্রভাব পড়েনি।
হয়তো সিরিজ কবিতা বলে কবি সচেতনভাবে বিষয় ও ভাষা নির্মাণে হয়তো স্বাতন্ত্রতা দেখিয়েছেন। জীবন- মৃত্যু- মুক্তি  বিষয়ক শব্দগুলো বার বার ফিরে এসেছে শ্বশান,শববাহক,বিজনের ওপার , মৃত্যু মায়াময়,আরতি,মন্দির  করবীর ফুল, একাকিত্ব-

তবে এ কবি জীবন ; বশ্যতা স্বীকার করি গহন একাকিত্ব/ ব্রক্ষান্ডের আলোরুপ, কেবলই শূন্য শ্মশানের/ পূন্যভূমে পূজাস্নাতক তুলশী সামান্য যদি।

স্বয়গামতা-৫২

মৃত্যু থেকে যায় জীবনের নিয়মে-
সমুদ্রের পাড়ে ডুবে যায় প্রতিদিন একটি লালবেণি বউ/ আর আর সুর করে নিশীথ গভীরে/আমি জীবন ঘষে ঘষে মরণের চামড়া তুলে ফেলি।

স্বয়মাগতা-৫০

তারপরপর সে একাকিত্বের দেয়াল ভেঙ্গে কদমের গা বেয়ে জল ঝরে-

স্বয়গামতা-৫২

জল কত দেখেছি আমি
নিঝুম রাত্রিকালে কদমের গা বেয়ে ঝরিছে
কাহার প্রাণধবনি কান্না হয়ে বাজিল বাতাসে যেন-…

স্বয়গামতা-৬২

প্রাচীন দর্শনের জনক থেলিস বিশ্বভ্রমান্ড উৎপত্তি ও স্বরূপ বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছিলেন এই পৃথিবী জলময়। জলই এই পৃথিবীর উৎপত্তির কারণ। সুতরাং,জলেই পৃথিবীর সলিলসমাধি। পৃথিবীর সর্বত্র রয়েছে জল। এই জলই পৃথিবীর মানুষের জম্ম মৃত্যু ও মৃত্যুর কারণ। তবে জল নিয়ে যে যাই বলুক মোস্তফিজের জল একান্ত নিজস্বতার ধারায় বহমান। যা বিশ্বাসী কেউ অবিশ্বাস করতে পারে না। তাই কবির বোধের দীপ্ত উচ্চারণ-

জল হয়ে জন্মেছিলাম, জলেই ভাসিতেছি।

স্বয়মাগতা-১৩

যাপিত জীবনে মানুষ আর জল একাকার। তার কবিতায় এ জলই সকল  আবেগ,বেদনা,আশা নিরাশা,ঘাম,কাম  বীর্যও দু:খের বিভিন্ন ভার্সন হিসেবে ধরা দিয়েছেন –
চোখের জলের সাথে পৃথিবীর সকল সরোবর-
কুলু কুলু বহে ঢেউ জলের দেহে দেহে- পদ্মিনী জাগো।

স্বয়মাগতা- ২৯ 

অথবা,
স্নানের দৃশ্য রহে মনে-সমস্ত শরীর জল মেখে মেখে স্নান করি চিরদিন আমি,
চিরদিন শ্রাবণ ভালোবাসি তবে
আকাশে আকাশে মেঘের নয়নে চোখ রেখে।
মেঘফুল হয়ে যেন অন্ধকারে ঝরি-

স্বয়মাগতা- ২৮

মেঘফুল হয়ে জল নিয়ে ভালোই খেলছেন কবি। জলকে ভালোই পর্যবেক্ষণ করছেন কবি। হয়তো চিত্রশিল্পী বলেই জল কখনো কখনো বিভিন্ন রং বেরঙ ঢেউ তুলেছেন কবির যাপন সমুদ্রে। জলের কোন রং না থাকলেও জল ছাড়া তো কোন রং হয়না।

বোশেখ  এবার তেমার বৃষ্টিকে ভিজিয়ে দেবো আমি/কুয়ো পাড়ের তুলশীর চোখে দিয়ে দেবো প্রাত:জল…

স্বয়মাগতা-৩৪

নতুবা
এমনও পাথর আছে বুকে নিয়ে সুমিষ্ট জল
আরো কোন পাথরে ঘুমানো আগুন
এমনও পাথর আছে কেবলই পাথর,কালগামী তার কোন জন্ম নেই,না মৃত্যু/ কোন বেদনায় যদি জল পাথর হয়ে ওঠে তবে পাষানতর/ ওগো পরমা বেদনার  বরফ  হয়ে ওঠি যেন / একদিন আবার জল হয়ে বয়ে যাবো/ আমাকে দিয়েছো ব্যাথা তোমারই অশ্রু হয়ে.

স্বয়মাগতা-৪৮

‘‘কবিতার কাছে কি চাই আমরা?কেনো আমরা কখনো চাওয়াহীন হতে পারিনা!যদি পারি তবে এই কবিতা আমাদের কাছে ডেকে নেবে,একান্ত নিকটে-জানাবে একটি পাখির গান কী রকম ভালো,দেখবে নিঝুম রাত্রিকালে কদমের গা বেয়ে ঝরে পড়া জল…’’
জল বলতে গেলে সাহিত্যের একেবারেই সাদামাটা একটা শব্দ। অথচ সেই শব্দই হয়ে উঠেছে জীবন মৃত্যু  সংগ্রাম কিংবা ভালোবাসার নমুনায়  বাঙময় কবি মুস্তাফিজ কারিগরের কবিতায় কি অসাধরণ দার্শনিক ছোঁয়ায়। কবি নিজস্ব পরিমন্ডলে শব্দকে নিপুণভাবে খেলাতে পারেন।যেমন,

আর এই তো হৃদয় হনন হলে,পর
রাত্রির ক্রমাসন্ন আধারের নাটকে-
তবে তাই হোক-খনন গভীর হোক’
বুক ও হৃদপিন্ডের ভেতর
জল সমুদ্র যোগ,

স্বয়মাগতা-৫৪, 

যে জলের ছোয়ায় থেলিস হয়েছিলেন দার্শনিক কিংবা দর্শনের জনক সেই জলেই স্বয়মাগতার কারিগর হয়ে উঠেছেন নিপূন কাব্যিক,আর এভাবেই জল হয়ে রসের সাগরে ডুবসাঁতার দিয়েছেন কবি পাঠককে নিবিষ্ট-নিমগ্ন রেখছেন জলে আর জালে।রহস্যের সেই জালেও জল ভেদ করে যায়।তাই-

জল গিয়াছ শুকায়ে,আমরই নয়ন কুলে আসি;থির/ বহমান ধারা তবে ছিলে -বেদনারে আপ্লূত করি/ বিষাদ মনক্ষয় হৃদয়ে/ জাগায়ে রেখে ছিলে তুমি জল
অশ্রু হয়ে নিতি-
আর আরতি তবুও।
জল জীবন অশ্রু
আনত প্রনামে রহি থির,আয়ুকালে যেন-

স্বয়মাগতা-৫৫

মুস্তাফিজ কারিগর হয়তো মৃদশিল্পের ছাত্র বলে জলের অপ্রাচুর্য দেখেছেন চারদিকে!  তাছাড়া জল বিহীন মাটি আর শিল্প হয়ে ওঠেনা। তাই শুধু শ্বশান-চন্ডালের মদ বেঁচে থাকে কিন্তু নদীরা থাকেনা। নদী শুকিয়ে যায়। জলের আকালে শ্ববদাহে ভস্মও ভাসে না আর।

তবু বেঁচে থাকে শ্বশান-চন্ডালের মদ,
নদীরা নেই/কলগীতি নেই আর কোনো
কেবল সে বালুচর- চাতকেরা খু্ঁজিছে জল প্রাণপণ
বন্ধু আমার শবদেহ ভস্ম করে
ভাসাবে কোথায়?

স্বয়মাগতা- ৭৮

 কিন্তু এই প্রশ্ন  স্বয়মাগতার অনেকগুলো কবিতায় কবির বিশ্বাস জন্ম-মৃত্যু  স্বধর্ম ও স্বজাতি এবং সংস্কৃতির নির্মাণে কবি জলকে বোধের বহুমাত্রিক বিপ্লবে ভাসিয়েছেন। এখানেই কবির বিশ্বাস ও সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব। স্বয়মাগতার শেষে পাঠক নিজেও এই দ্বন্দ্বে জড়াতে পারেন। নাহলে কেন কবিকে পূনর্বার জন্মাতে হবে!

শেষবার জন্মাবার পরে এমনতর পুষ্পবৃক্ষ তবে হব/যাকে তুমি টবে রাখবেনা কখনো/ সুবিন্যস্ত বাগানে মালি দিয়ে/কেঁটে ছেঁটে শাসন করবেনা।
সুঘন বনাঞ্চলে / ক্রমবিবর্তিত মানব সভ্যতার সূর্যালোক/পৌঁছেনি কোনদিন / দূর হতে কোন কোন পরিযায়ী প্রজাপতি/ মাঝে মাঝে এসে কুশল জেনে যাবে/ সেইখানে চুপ হয়ে রব/প্রসব যন্ত্রণার সময় মায়ের চোখের কোণে/ হিরকের মতো জল যেইভাবে/ জ্বল জ্বল করে

স্বয়মাগতা-৭৭

অসাধরণ উপমা! মা সব কিছু নিরবে সয়ে যান। দেবীর মতো। তারপরও সেখানে কোন বীরত্ব নেই। আছে অসহায়ত্ব। শুধু চোখের কোনায় হিরকের মতো চিকচিকে বিন্দু জল। সেই জল অন্ধ ভিখারিনীর চোখেও-

অন্ধ সে ভিখারিনী,অন্ধপৃথিবী তবু তার চোখ দিয়ে / ঝরে জল কান্নার- /
আর সেই কুয়াশার জলে/ আকাশ ছুতে চলে শিশু জবাগাছ,ঘ্রাণ/ দেবে বলে,অর্ঘ্য হবে যদিচ কোন কোন সন্ধ্যা আরতির / পৃথিবীর সব আরতির জবা ঝরে পড়ে চোখ হতে তার/ পৃথিবীতে- / জবাগাছ তোমাতে ঢালি জল অন্ধতা হব যদি

স্বয়মাগতা-২

স্বয়মাগতা নিয়ে যে কথা রসিক সকলের জানা কবির অকপট স্বীকারোক্তি,‘যে কবিতা কেবলই কবিতা,নগ্ন,নবিড়,নিরুদ্দেশ-তেমন কবিতার আধার এই গ্রন্থ। কবিতার কাছে কি চাই আমরা?কেনো আমরা কখনো চাওয়াহীন হতে পারিনা!যদি পারি তবে এই কবিতা আমাদের কাছে ডেকে নেবে,একান্ত নিকটে-জানাবে একটি পাখির গান কী রকম ভালো,দেখবে নিঝুম রাত্রিকালে কদমের গা বেয়ে ঝরে পড়া জল… আসলে কি যাপনের বিচিত্র বিন্দুতে একজন মোস্তাফিজ কারিগরের অনুভব কণা শব্দরূপে আপনি ফুটে ওঠে এইসব কবিতা আমরা কেবল আহা! বলে ওঠব
 
 কবি ও চিত্রশিল্পী মোস্তাফিজ কারিগর ১৪ আগস্ট  ১৯৮৬ সালে কুষ্টিয়াতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের মৃৎশিল্প বিভাগ থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। এটি তার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ। 

মোস্তাফিজ কারিগর সমানতালে লিখে যাচ্ছেন কবিতা  গল্প ও উপন্যাস। তার প্রকাশিত বই, নৌকাখন্ডে দেবীর লাল,( কবিতা), ২০০৯,মিথের পাখিরা,যৌথকবিতা,(২০১১) শালঘর মধুয়া,ছোটগল্প(২০১৩),স্বপ্ন আঁকার জাদু,শিশুতোষ, (২০১৬),বস্তুবর্গ,উপন্যাস,(২০১৭) এবং স্বয়মাগতা ( সিরিজ কবিতা),বইমেলা,২০১৭,প্রকাশ করেছেন অগ্রদূত এ্যান্ড কোম্পানি, প্রচ্ছদ করেছেন কবি নিজেই।
বইটির বহুল প্রচার ও সাফল্য কামনা করি।

পান্থজন জাহাঙ্গীর : কথাশিল্পী ও অনুবাদক।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন