সাবিনা পারভীন লীনা
বাজার থেকে গাছপালায় ঢাকা রাস্তা দিয়ে কয়েক মিনিট হাঁটার পর যে একটা খাড়া মােড় পড়ে সেই মােড় পর্যন্ত গিয়ে খানিকটা দ্বন্দ্বে পড়তেই হবে। কেননা দুটো রেইনট্রি গাছের নিবিড় ছায়ায় প্রায় অন্ধকার ওই মােড় থেকে রাস্তা হঠাৎ সরু হয়ে দুই দিকে চলে গেছে; একটা গেছে সােজা আরেকটা ডান দিকে। মােড় থেকে যে রাস্তাটা ভান দিকে গেছে তার একপাশের বাড়িটা লােকমানের, অন্য পাশেরটা রাজ্জাকের। রাস্তার দুদিকে পিঠ করে দুটো মাটির ঘর, তার বিপরীতে সুপারির খােলের ঝাপড়া; গাছগাছালির মধ্যে ঘরগুলাে দেখলে প্রথমে মনে হবে এখানে একটা বাড়ি বা বাড়ির মতাে কিছু আছে, দুইটা মানুষ এখানে থাকে বুঝাই যায় না।
রাজ্জাক মােটাসােটা হলেও পিটানাে শরীর, গায়ের রঙ কালাে, মাথাভর্তি লম্বা চুল, চওড়া গালে লম্বা দাড়ি;
বাজারে মুদি দোকান সঙ্গে ফ্ল্যাক্সিলােডের কারবার। আশ্চর্য স্মরণশক্তি তার, নিয়মিত সব কাস্টমারের সেল নাম্বার তার মুখস্থ। কেউ এসে টাকা এগিয়ে দিয়ে বলল
‘ রাজ্জাক ভাই লােড দিই দিয়ুন “তাতেই হয়ে গেল, মাথা তুলে একবার চোখের দিকে তাকিয়ে বলবে ‘ ছলি যাইবু ছিন্তা ন গইরগুন’। দীর্ঘ দিন রাজ্জাকের পিছনে ঘুরে ঘুরে শেষে এক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি কোমলপানীয় ভর্তি ফ্রিজ দিয়ে গেলে দোকানটার চেহারাটাই পাল্টে যায়। রাজ্জাক শান্ত স্বভাবের মানুষ, তার ব্যাপারে কাস্টমারের একটাই অভিযােগ হঠাৎ হঠাৎ রাজ্জাক উধাও হয়ে যায়; সে নিয়মিত না। আরাে অনেক কিছুর মতাে কে কি বলল তা নিয়ে রাজ্জাক কান দেয় না, ঠিকানা হিসেবে একটা দোকান তার থাকলেও সে আসলে জাত ফড়িয়া, এখানে ওখানে মাল কেনাবেচা নেশা পেশা দুটোই; তাই সংসারের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে তার খেয়াল কম। রাজ্জাকের বউ ইয়াসমিন হয়েছে তার বিপরীত; সংসারটা এখনাে যে টিকে আছে সেটা কেবল ইয়াসমিনের বিপরীত স্বভাবের জন্যই।
গাছের গুঁড়িভর্তি মহিষের গাড়ি মােড় ঘুরতেই আটকে গেল; একটা লম্বা গুঁড়ি গিয়ে লাগল রাজ্জাকের মাটির
ঘরের সঙ্গে; এর মধ্যে একটা মহিষ শুয়ে পড়েছে অতিরিক্ত বােঝা বইতে না পেরে।
অনেক সময় ধরে বিষয়টা নিয়ে হন্তদন্ত গাড়ােয়ান ছােকড়াটা আর বেলাল হােসেন; পেয়ারা বাগান থেকে
আগাছা কাটতে কাটতে খেয়াল করেছে ইয়াসমিন; আস্তে আস্তে রাস্তায় উঠে এসে দা-টা শুন্যে ঘুরাতে ঘুরাতে বেলালের দিকে এগিয়ে আসে।
‘অডা… বেলাইল্লা ঘরর হনাে ক্ষতি অইলে এই হোঁডা দা দেইখুছ না, ইয়ান দিয়েরে হল্লা নামাই ফালাইয়ুম।
বেলাল ইয়াসমিনের দিকে তাকিয়ে থাকে।
‘আঁর মিক্ষা কি ছঅদ্দে? তােরে কি হইলাম ন হুনছ? ঘরর ক্ষতি অইলে হবর আছে। মইষ তো মারি ফালাইয়ুছ।
তুইতাে মানুষ ন, আস্ত জানােয়ার। ‘
ইয়াসমিনের কোন কথাই বেলালের কানে যায় না, রাজাকের সঙ্গে উঠাবসা না থাকলেও সম্পর্ক ভালাে। কালাে ধুমসা একটা মানুষের বউ এমন লাল টকটকে সুন্দর; এই এলাকায় এমন সুন্দর মেয়ে মানুষ সে দেখেনি।
রাজ্জাকের শরীরে কোন দয়ামায়া নেই, এমন একটা সুন্দরী বউ পাওয়া তার ভাগ্যের ব্যাপার, তাকে কিনা
বাগানে বাগানে খেটে মরতে হচ্ছে এমন অসহ্য গরমের মধ্যে।
‘ভাবী, রাজ্জাক ভাই হন্ডে গেইয়ে?
“ভাইয়র চিন্তা ফরে গরাে, মইষউয়া তো মরি গেলগুই, ইবারে আগে বাঁচাও। ‘
গাড়ােয়ান ছেলেটার দিকে তাকিয়ে ইয়াসমিন বলে,
“ এই ফোয়া তুই ছাই কা তাইক্কুছ, হারামজাদা! হয়েকগুয়া ফালাই দে বলে, নিজেই একটা গুঁড়ি ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়।’
তার দেখাদেখি বেলাল আর গাড়ােয়ান ছেলেটা হাতে আরাে কয়েকটা গুড়ি ফেলে দেয়।
‘এইবার মইষরে তােল, আহা বেচারা, নাক মুখ দিই ফ্যানা বাইর অই গেয়ি।’
মহিষ উঠে দাঁড়ালে ফেলে রাখা গুঁড়ি ছাড়াই মহিষের গাড়ি চলে গেলেও বেলাল যায় না, পুরানাে মডেলের
লক্করঝক্কর মটরসাইকেলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
‘ভাবী, রাজ্জাক ভাই হন্ডে গেইয়ে, তুই হাইল্লাগায় বাগানত হাম গরর কা?’ বলে বেলাল ইয়াসমিনের দিকে
তাকিয়ে থাকে বিস্ময়ভরা চোখ নিয়ে তার কোন ভাবান্তর নেই।
ইয়াসমিনের হাতের দা-টা তার সামনে উঠানামা করতে থাকে; অনেকক্ষণ ধরেই উঠানামা করে তবে বেলালের
সেদিকে হুশ নেই।
” কি অইলাে বেলাল?’
হঠাৎ চমকে উঠে লাফিয়ে কয়েক কদম পিছনে গিয়ে বেলাল বলে, তুই এই ধারালাে অস্ত্রগান এন্ গরি দুলাইতা কা লাইগ্গু?
‘ডর লাগের? ”
ভ্রু নাচিয়ে ইয়াসমিন বলে,“ হারে? আঁরে না এই জিনিষরে? ”
‘ দুনােয়ারে, এহন ইয়ান চোগর সামনত্তুন সরাও।
ইয়াসমিন মটরসাইকেলের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালে বেলাল নিজে থেকেই বলে,“ নতুন এক খান কিন্নুম
নিয়ত গইরগি, ইয়ান বেশি পুরাতন নয়, যত্ন লইলি পুরানমালও চকচক করে। ‘
‘ গাছর ব্যবসা গরি টেঁয়াপইসা ভালাই হামাইতা লাইগ্গু।
ঘাড়টা বাঁকিয়ে অকারণে চুলকাতে চুলকাতে বেলাল বলে, “ বেয়াগ্গিন আল্লাহর ইচ্ছা আর তোঁয়ারার দোয়া,
নিয়ত যহন গইরগি নতুন মটর সাইকেল কিনি ফেলন দরহার, কি হঅ ভাবী?”
আবার ইয়াসমিনের হাতের দা শূন্যে দুলতে থাকলে বেলালের পুরাতন মটরসাইকেলটা অস্বাভাবিক শব্দ করতে করতে ছুটতে থাকে ধুলাে উড়িয়ে।
দোকানে একাএকা বসে ঝিমায় বেলাল, পাশে মসজিদ; আসরের আজান শেষ হলাে, একজন দুইজন করে মুসল্লি মসজিদের দিকে যাচ্ছে। নামে মুদিখানার দোকান, দোকানে মালপত্র কিছুই নেই, ঈদ-চাঁদ এলেই কেবল মালপত্র তােলে, আর বছরের অন্য সময় সারাদিন কাঠের ব্যবসা, কাঁচামালের ব্যবসাসহ নানা জাতের ব্যবসা নিয়ে ধান্ধায় থাকে সন্ধ্যায় ঝাপ খুলে বসে হিসাবপত্র করে, আড্ডা দেয়। কারেন্ট চলে গেলে বেলাল ঝাপ ফেলে বাড়ির দিকে রওয়ানা হয়; সড়ক ধরে পনের বিশ মিনিট হাঁটার পর রাস্তার ডান পাশেই বেলালের বাড়ি।
চৈত্র মাসের শুরু কেবল, গাছপালা সব স্থবির হয়ে আছে একবিন্দু বাতাস নেই, অসহ্য গরম; কয়েক লােকমা
ভাত মুখে দিয়ে বেলাল, বউ আয়েশার দিকে তাকিয়ে থাকে। কদমছাট চুল বেয়ে ঘাম ঘাড় হয়ে বুকে পিঠে
নেমে আসে। কুপির নিষ্কম্প আলােয় গরমটা আরাে অসহ্য লাগে। আয়েশা মাঝেমাঝে বেতের হাত পাখা
দিয়ে বাতাস করে, বেলালের আপত্তিতে আবার থেমে যায়। ছােট ছােট চোখ, দুই গালে ছােটবড় বসন্তের
দাগ, কপালের সামনে থেকে চুল উঠে ফাঁকা, মাথার চাদিতেও চুল কমে এসেছে, রূপার নাকফুলটা ছাড়া
আয়েশার চেহারার মাঝে দেখার মতাে আর কিছুই পায় না বেলাল। তবে এটা অস্বীকার করে না বিয়ের আগে কুচকুচে কালাে হলেও আয়েশার শরীরে চিকনাই ছিল, চোখে কি যেন একটা আকর্ষণ ছিল। বাড়ির পিছনে বাঁশগাছের ছায়ার নিচে শায়িত দাদীর কথা মনে পড়ে বেলালের, মৃত ব্যক্তিকে দোষারােপ করতে নেই, আল্লাহ তাকে জান্নাতবাসী করুক, আয়েশা দাদীর পছন্দ। মেয়ে কুচকুচে কালাে বলায় দাদী রেগে যায়; একদিন কানের কাছে মুখ এনে ফোকলা দাঁতে ফিসফিস করে বলে, “ অ-ভাই বাতি নিবাইলি হালা ধলা বেয়াগ এক।’
অবশ্য দাদীকে দোষ দিয়ে কি লাভ, বিয়ের জন্য সে এতােটাই দিশেহারা হয়ে গেল যে, বউ যেমনই হােক
তার একটা বিয়ে, মানে একটা শরীর জরুরি; দাদী কেবল সেই জরুরি কাজটাই সহজ করে দেয়। ডালে চুমুক দিতে দিতে বেলাল ভাবে, তার সামনে ল্যাপ্টে বসে থাকা এই কুৎসিত মহিলার সঙ্গে সে এতােটা বছর একসঙ্গে থাকলো কি করে?
এক বিকেলে সেই মােড় পেরিয়ে শব্দওয়ালা মটর সাইকেল থামিয়ে রাস্তার পাশের কাঁঠাল গাছের সঙ্গে ঠেস দিয়ে রেখে সােজা হয়ে দাঁড়ায় বেলাল। কয়দিন আগে যে জমিতে ঝোপজঙ্গল ছিল সেটাতে আজ থকথকে কাদা, রাজ্জাকের রান্নাঘরের পাশ থেকে বগবগিয়ে পানি উঠছে, সেই পানি কলের লাঙ্গলে চাষ দেয়া মাটির ভাজে ভাজে ছড়িয়ে পড়ছে; গরম ভাত ডাল দিয়ে ভিজিয়ে দেয়ার মতাে। সারাদিনের তীব্র রােদে তেতে থাকা মাটি শীতল পানি পড়ায় গরম ভাপ আসে জমি থেকে; সঙ্গে কেমন একটা গন্ধ এসে লাগে, ভেজা মাটির গন্ধ; এই গন্ধে কেমন একটা নেশা নেশা ভাব থাকে, গরম ভাতে যেমন থাকে। গরম ভাতের সঙ্গে কাঁচা লঙ্কা চটকে নিলে যে গন্ধ বের হয় সে গন্ধের কথা মনে পড়ে যায় বেলালের।
একটা স্টার সিগারেট বের করে ঠোঁটের ডগায়় আটকে রেখে পকেট হাতড়ে দেশলাই বের করে; একটা মাত্র
কাঠি, জ্বলন্ত কাঠি মুখের কাছে এনে দম বন্ধ করে সিগারেট ধরিয়ে স্বস্থির নিশ্বাস ছাড়ে; যেন ছােটখাটো
একটা সাফল্য এইমাত্র পেয়ে গেছে যা আরাে সাফল্যের সােপান হিসেবে জরুরি ছিল।
রাজ্জাকের রান্নাঘর লাগােয়া গর্তের তলানিতে লাগানাে ধানের চারা তােলে ইয়াসমিন। মটর সাইকেলের শব্দ শুনে একবার তাকালেও আর পাত্তা দেয় না। লম্বা করে ধোঁয়া ছেড়ে বেলাল উদাস হয়ে আকাশের দিকে চেয়ে থাকে; পশ্চিম আকাশের লাল রঙ এখনাে পুরােপুরি গােধুলির অন্ধকারে মিলে যায়নি।
গলা খাঁকারি দিয়ে বেলাল ইয়াসমিনের মনােযােগ আকর্ষণের চেষ্টা করে।‘ভাবি, অঁনে হতাে ফরিশ্রম গরিবান? এইল্লা এক খান সুন্দর শরীর শেষ গরি দিলা, রাজ্জাক ভাইর শরীরত দয়ামায়া নাই। রাজ্জাকভাই গেইয়েদে হয় দিন অইয়ে? ‘
ইয়াসমিনের কোন ভাবান্তর নেই, বেলাল অপমান বােধ করলেও গায়ে মাখে না, অস্বস্তি কমানাের জন্য
পায়চারি করে।
কিছুক্ষণ পরে ইয়াসমিন খাদের পাড় বেয়ে উঠে আসে রাস্তায়, হাতে ধারালাে কাস্তে, ‘ আলার ফুত্ আলা, তাের
আর মরার জায়গা নাই? এন্ডে আই মরছ কেয়া?
অন্যকোন মেয়েমানুষের মুখ থেকে এমন গালি শুনলে বেলালের মাথার ছাদ ফুঁড়ে গরম বাতাস বের হতাে,
কিন্তু ইয়াসমিনের মুখ থেকে বের হওয়া গালি ভালাে লাগে; সুন্দরী মহিলার মুখ থেকে কুৎসিত গালি কোনদিন শুনেনি, যতাে খারাপ খারাপ গালি বের হয় কালাে, ধুমসি, বোঁচা কুৎসিত মেয়ে মানুষের মুখ থেকে। মনে হয় আরাে কিছু গালি যদি সে শুনতে পেত কানে শান্তি পেত।
ইয়াসমিন গালি না দিয়ে বাতাসে কাস্তে ঘুরাতে থাকে।
মেঠো ইঁদুরের দাঁতের চেয়ে সূক্ষ্ম কাস্তের দাঁতগুলাে স্পষ্ট বেলাল দেখতে পায়, হাঁচিগান মুখর সামনত্তুন সরাও তাে।’
‘ তাের রাজ্জাক ভাইরে তাের কি দরহার?
‘ দরহার বেশি নাই, সামনে ফাইলে ফুছ গইরতাম .. ‘
‘ গইরতাম দে, তোঁয়ার মতাে মাইয়া মানুষরে কষ্ট দিই কি সুখ ফায় মানুষ? এতাে টেঁয়া হামাই গরি কি গরিবু?”
‘ বেলাল, তাের হতা শেষ ?, শেষ অইলে এহন যা, নইলে এই ভটভটি এখনই গাত্তার ভিতর ফালাই দিয়ুম।
সকালবেলা রাজ্জাক ঢিলা কুলুখ নিয়ে দ্বিতীয় চক্কর দেয়ার সময় দেখে ভটভট শব্দ করে মটরসাইকেল চালিয়ে বেলাল এগিয়ে আসছে, রাজ্জাককে দেখে বেলাল থামে।
‘ সিদ্ধান্তগান ভালাই লইয়ু রাজ্জাক ভাই, জমিন ফালাই রাহনতুন ধানের আবাদই ভালা, লাগাইয়ুদে বেশি দিন ন অয়। কিন্তু কী সুন্দর মাশাল্লাহু, লগলগাই বাড়ের।
কয়েক কদম পেছনের দিকে হেঁটে ঢিলা কুলুখ দূরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে আবার বেলালের কাছে এসে বলে,
‘গাছর ব্যবসা ক্যান ছলের বেলাল?
‘আলহামদুলিল্লাহ, আল্লার রহমত আর তোয়ারার দোয়ায় ভালই ছলের।
“তইলে তাে তোঁয়ার দিনহাল বালাই যার।”
রান্না ঘরের পাশে দাঁড়িয়ে ইয়াসমিন সকাল সন্ধ্যা কচিকচি চারার উচ্ছাস দেখে, দূরের রেইনট্রি গাছের উপর থেকে আকাশ আলাে করে রূপালী চাঁদ উঠতে থাকে; এতাে আলাে এতাে বড় চাঁদ ইয়াসমিন জীবনে কোনদিন দেখেনি, বা দেখার মতাে পরিস্থিতি তৈরি হয়নি বলে তার নজরে পড়েনি।
দূরের হিন্দু পাড়া থেকে থেমে থেমে দ্রিম দ্রিম শব্দ ভেসে আসছে; রমেশ, নন্দা, সুশীল ওদের বাড়িতে আজ দোলের উৎসব; দুইদিন ধরে চলবে আবির খেলা। রঙ মেখে মেখে এক একজন ভুতের মতাে হয়ে যাবে।
বিয়ের আগে সে-ও দু’একবার রং খেলেছিলাে।
চাঁদের আলাে ধান ক্ষেতের তিরতির পানিতে পড়ে মাছের পিঠের মতো চিকচিক করে। এমন অপরূপ শােভা, যা কখনােই দেখেনি, তার চোখ জুড়িয়ে যায়। হালকা বাতাসে কঁচি কঁচি চারাগুলাে দুলে দুলে উঠছে, মনে হচ্ছে হাত বাড়িয়ে ডাকার অপেক্ষায় আছে; সামান্য ডাক দিলেই হামাগুড়ি দিয়ে শতশত সন্তান হয়ে তার কোলে এসে উঠবে।
সমস্ত দিন পড়ে পড়ে ঘুমানাের পর সন্ধ্যার সময় রাজ্জাক ঘুম থেকে উঠে মেসওয়াক্ করতে করতে ছােট উঠানটাতে কয়েক চক্কর দিয়ে ইয়াসমিনের পাশে এসে দাঁড়ায়। ইয়াসমিনের সে দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই, তার দৃষ্টি জোছনা টলমলে ধানের খেতের দিকে। হঠাৎ ইয়াসমিন বলে উঠে, ছন ছন, কী সােন্দর। খেতর মিক্কা
চঅন। লাগেদ্দে, চাঁদ ধান ক্ষেতততুন উডি আইস্সে। ‘
ওয়াক থু… বলে এক দলা থুথু ফেলে, খাকারি দিয়ে গলা সাফ করে নিয়ে রাজ্জাক কিছুক্ষণ উদাস হয়ে খেতের
দিকে তাকিয়ে থাকে।
যেন গরি হইতা লাইগ্গু জীবনত চাঁদ ন দেহ ফানলার?
কিছুক্ষণ থেমে দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে রাজ্জাক আবার বলে,“ দুনিয়ার যত সৌন্দর্য, বেয়াগ তার রহমত।
তেঁই সােন্দর যেন সৃষ্টি গইরগে বিশ্রী জিনিষও সৃষ্টি গইরগে। নইলে বালা মন্দর তফাৎ বান্দা বুঝিবু ক্যানে?
সােন্দর দেহি এতাে ফাল দেঅনর কিছু নাই। আখেরাতর হতা চিন্তুা গরো, কবর আযাব উত্তুন ক্যানে বাঁচিবা
ছিন্তা গরো। ফড়িয়া-পাইকারদের সাথে উঠাবসা তার, এতাে কথা গুছিয়ে কি করে বলতে পারলো মেসওয়াক
করতে করতে ভাবে রাজ্জাক।
রাজ্জাক বদনা হাতে টয়লেটের দিকে চলে গেলে ইয়াসমিন কিছুটা দমে যায়।
দেখতে দেখতে জমিতে ধানের পাক ধরেছে কাঁচাপাকা ধান, কান পাতলে বাতাসে ধানের সঙ্গে ধানের সংঘর্ষে
বাজনা শােনা যায়, ধান ক্ষেতের বাজনা- শােনা যায় পাতার ফরফর আওয়াজ। ভােরের মিষ্টি আলাে, দুপুরে গনগনে রােদ আর বিকেলে রক্তিম আভা ছড়ানাে আলাে, কাঁচাপাকা ধান একএকবার একএক রূপ ধারণ করে। ইয়াসমিন উঠানে দাড়িয়ে এই দৃশ্য দেখে।
তার পর নিশ্চুপ, থৈ থৈ নৈঃশব্দ, মখমল কাপড়ের মতাে নরম নরম জোছনা। রাতের খাওয়া শেষে ইয়াসমিন রান্না ঘরের পেছনে, যেখানে শখ করে গাঁদা ফুলের বাগান লাগিয়েছে সেখানে দাঁড়িয়ে জোছনা দেখে।
রাজ্জাক ছােট উঠানে কয়েক চক্কর দিতেই ইয়াসমিনের দিকে চোখ পড়ে, দেখে ইয়াসমিন গলা বাড়িয়ে কি যেন দেখছে। ধীরে ধীরে ইয়াসমিনের কাছে গিয়ে তার গতিবিধি বােঝার চেষ্টা করে।
এন্ডে আঁন্দারত থিয়াই থিয়াই কী চাইতা লাইগ্গুদে?
‘ছান্নি ফঅর ছাইদ্দি “।
রাজ্জাক মনে মনে ভাবে অনেক রাত হয়েছে, এখন বউয়ের বিছানা ঠিক করার কথা, তা না করে বক পাখির মতাে গলা উঁচিয়ে জোছনা দেখছে, জোছনার মধ্যে দেখার কি আছে? এটা খারাপ লক্ষণ! সে থাকে টাকার ধান্ধায়, বাইরে বাইরে বউকে এর মধ্যে জ্বিন-ভুতে পায়নি তাে আবার!
রাজ্জাক ইয়াসমিনের দিকে বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ ইয়াসমিন রাজ্জাকের একটা হাত ধরে
টানতে টানতে ঘরের পিছনের দিকে নিয়ে যেতে থাকে।
‘ আইয়ুন আইয়ুন .. একখান জিনিষ অনরে দেহাই। চ’অন, আঁর ফুল বাগান, গেঁজাফুলর বাগান। চ’অন, কি সুন্দর ফুল ফুইট্টি, গােলাপ লাগনর ইচ্ছা আছিল কিন্তু গােলাপর দাম বেশি। হালিয়া বেইন্না বালা গরি চাইয়ুন।
এহন ফুল গাছ গুম যার, আর আম্মা হইতু ফুলর ঘুম ভাঙ্গন ঠিক ন। অনে বিছানাত যাই শুই ফড়ন, বেইন্না
বাজারত যওন ফরিবু। আই একখানা ছান্নি ফর ছাইয়েরে আইর।
বরাবরই ফজরের আজানের পর ইয়াসমিনের ঘুম ভেঙে যায়, কিন্তু আজ একটু দেরিতে ঘুম ভাঙে তার। পাশ ফিরে দেখে বিছানা খালি, দরজার একটা পাল্লাও কিছুটা খােলা। ইয়াসমিন দরজার পাল্লা দুইটা খুলে বাইরে পা দিতেই দেখে উঠানের এক পাশে দা-টা চিৎ হয়ে পড়ে আছে, কুয়াশাভেজা তার শরীরজুড়ে গাঁদাফুলের গাঢ় কমলা পাপড়ি ল্যাপ্টে আছে।
ইয়াসমিন একদৃষ্টিতে আগাছা কাটার দা-টার দিকে তাকিয়ে থাকে। একসময় তার চোখ ঝাপসা হয়ে এলে সে হঠাৎ দেখতে পায় তার শখের গাঁদা ফুলের বাগান থেকে লাল টকটকে রক্তের স্রোত ভােরের হালকা বাতাসে কম্পমান ধান ক্ষেত নেমে যাচ্ছে।
সাবিনা পারভীন লীনা: কবি ও কথাশিল্পী।