মেঘ জমে আকাশে


রাজিয়া নাজমী


পুবাকাশ


মা শুনে মুখ ঝামটা মারে। বাপ শুনে হাসে। বাপ মেয়েরে কোলে টানে। ভেজা চোখ আড়াল করে। চোখের সামনে আরেক বাড়িরকন্যা এখন তার বাড়ির উঠোন নিকোয়নিজের বর নিজের ঘরবুকে ধারণ করে বাপের বাড়ি পর করে। কিছুই তো অস্বাভাবিক মনেহয় নাই তার কাছে। আজো হয় না।

ফিনকি দিয়ে রক্ত ভাসায় জমিনমেঘ জমে আসমানে উঠানে পা দিতেই রমিজ মিয়াঁর অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। কদিন আগের হামাগুড়ি দেওয়া মেয়ে তার মায়ের সাথে রসুইঘরের দাওয়ায় বসে আনাজ কাটছে। নরম মন মেজাজের মানুষ রমিজ এই দৃশ্য সহ্যকরতে পারে না –  অতটুকু আঙুল অত ধারালো বটির উপরে!  রমিজ মিয়াঁ  চিলের মত ধা করে এক ছোবলে  মেয়েকে কোলে নিয়েপা দিয়ে বটি কাত করে ফেলে প্রায় কেঁদেই বলে, ক্যান রে বউ ক্যান আমার মাইয়াটারে ক্যান  আবার  …  দরকার হইলে আমার কও।আমি আনাজ কাইটা দিমু। এইটুক দুধের মাইয়ারে ক্যান বটিতে বহাও? আহা; মাগো রক্তে যে ভাইসা যাইবো আমার মাইয়া।

রমিজ মিয়াঁর সবসময় মাইয়া মাইয়া নিয়ে  আহ্লাদ দেখে বউ  ক্ষ্যাপে। আজ বাপের আহাজারি দেখে একটু বেশিই ক্ষেপে গেলো।একে তো কদিন ধরে সারা গায়ে বিষ ব্যথা। ঘরের কাজ শেষ করতে পারে না। এত কাজের মধ্যে আবার মাইয়ার শখ মিটাইতে বাপবাছুর কিনা আনছে। এখন সেইটার খেদমত করো। মেয়ের আধাকাটা শবজি কাটতে কাটতে রাগ সামাল দিতে না দিতেই  রমিজমিয়াঁ  যখন আবার  আর কোনদিন আমার মুনিয়ারে বটিতে বসাইবা না  বলে  কেঁদে উঠলো তখন বাপের  আহ্লাদ দেখে সে আরমেজাজ মাটিতে রাখতে না পেরে বলেই বসে, বসাইছি, আমি তো ওর সতাইলা  মা, কাম করাইতে করাইতে তোমার মাইয়ার জানপানি করি তো আমি।

রমিজ  টিউবওয়েলের পানিতে মেয়ের হাত ধুয়ে দিতে দিতে  বউয়ের মুখের কথা টেনে নিয়ে বলে, আপন মা হইয়া এতটুকু মাইয়ারেদিয়ে কাম করাও ক্যান। কতদিন না করছি। মাইয়ার হাতের দিকে চাইয়া দেখ,কেমন লাল হয়ে গেছে।

মাইয়ারে ঘরের কাম শিখাইতে হইব না? ঘরের লক্ষ্মী কী এমনে এমনে হইয়া যাইবো?  দুইদিন বাদে স্বামী শ্বশুরের ঘরে যাইবো, না কিসারাজীবন নিজের কাছেই রাখবা, আর তোমার মাইয়া বাছুর লগে লইয়া থাকবো!

বউ, সবে তো  দশবছর, এত তাড়াতাড়ি কেন এমুন কথা। আমার বুকের মধ্যে ছ্যাঁত করে যে।

বাপের আদরের মুনিয়া ততক্ষণে বাপের কোল থেকে নেমে বাছুরের মুখে কচিঘাস তুলে দিতে দিতে বলে, আমার নাম মুনিয়া আরতুই আমার লালমুনিয়া। তুই আমার লগে থাকবিকেউ নিবো না তরেআমার লগে তুইও আমার শ্বশুর বাড়ি যাবি।

মা শুনে মুখ ঝামটা মারে। বাপ শুনে হাসে। বাপ মেয়েরে কোলে টানে। ভেজা চোখ আড়াল করে। চোখের সামনে আরেক বাড়িরকন্যা এখন তার বাড়ির উঠোন নিকোয়নিজের বর নিজের ঘরবুকে ধারণ করে বাপের বাড়ি পর করে। কিছুই তো অস্বাভাবিক মনেহয় নাই তার কাছে। আজো হয় না।

তিন ছেলের পরে তার এই একটা মাইয়া মুনিয়া যে বড় আদরের। তারে একদিন অন্যের কাছে পাঠায় দিতে হবে ভাবলেই যে কান্দনআসে।  জন্ম দেয় নাই যে, সেই তার মাইয়ার বাকি জীবনের  বাপ হইবো। কেমন নিয়ম!  

কন্যা আসে কদিনের জন্য বাপের বাড়িতে মেহমানের মতএই আপ্তবাক্য এই প্রথম মানতে মন সায় দেয় না রমিজের।

মেয়েরে কাছে টানে বাপ, মেয়ে টানে তার চার মাসের লালমুনিয়াকে। মায়ের মুখে দুঃচিন্তার ছাপ পড়ে। সে স্বামীর আড়ালে মেয়েকেগৃহস্থালি কাজ শেখায়। সেলাই শেখায়, সুরা মুখস্থ করায়। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ শেখায়। মেয়ে বারো পার হতেই শাড়ি পরা রপ্ত করে।

বাপ লাল ডোরাকাটা শাড়ি, আলতা,চুড়ি এনে দেয়। মেয়ের আবদারে লালমুনিয়ার জন্য আনে লাল গামছা, সাথে দুইজনের জন্যলাল ফিতা। মা, মেয়ের পায়ে আলতা লাগায়, দুই বেণীতে ফিতা বেঁধে দেয়। কোমরে আঁচল জরায়ে মুনিয়া সাজায়ে তারলালমুনিয়ারে, গলা ধরে আদর করে। রমিজ দেখে গরুটাও কেমন মায়ামাখা ডাগর চোখে তাকায়ে থাকে।

দুইজনই  উঠানময় ঘুরে বেড়ায়। একজন আরেকজনের পিছে ছুটতে ছুটতে বড় হয়। লালমুনিয়া বাছুর থেকে গরু হয়। মুনিয়াযুবতী।

মেয়ের পনেরো শেষ হইতেই বউয়ের এতকাল ধরে অপেক্ষায় থাকা মামাতো বোনের ছেলের প্রস্তাব আসা মাত্র সে স্বামীর মুখের উপরেবলে দেয়এই প্রস্তাবে না করলে আমি গলায় ফাঁস দিমু। এই পোলারে আমি একলা নজরে রাখি নাই। আরও মাইয়ার মায়েরাআল্লাহ্‌ আল্লাহ্‌  করতেছে। বইন আমারে আগে সুযোগ দিছে। তুমি না কইরো না। আমাগো চৈতন্য গ্রাম আর ঢাকা শহর কতদূরেআর। দিনাদিন রেল  যায় আসে।  

রমিজ জানে বলে কিছু লাভ নাই। শুধু বউকে বলে, নিজের মাইয়ারে কমে দেখো কেন। ওই কথা কইয়ো না। মাইয়ার দিকে তাকায়াদেখো, আমার এমন সুন্দর মাইয়ারেই তোমার বইনেও নজরে রাখছে।  

রমিজ তার মুনিয়ারে কাছে ডাকে। বলে দুনিয়ার নিয়মের কথা। মেয়ে মায়ের দিকে তাকায়। তারপর গোয়ালঘরে লালমুনিয়ার গায়েঘেঁসে বসে থাকে। খড় মুখে তুলে দেয়, মালসায় পানি দেয়। দাওয়ায় বসে থাকা বাপকে দেখেবুকের ভিতর কেমন কেমন করে।হাতের তালুতে ভেজা চোখ মোছে রমিজ মিয়াঁ।

বিয়ের তারিখ ঠিক হয়ে যায়। রমিজ মিয়াঁ খরচের হিসাব করে। তার ছোট মনোহারী দোকানের মাল কেনার সবটাকা বউয়ের হাতেতুলে দেয়। বউ লুকিয়ে রাখা মাটির ব্যাংক ভাঙ্গে। আবার হিসাব করে। জিনিসের লিস্টে তখনও টাকার টান পড়ে। বউ তাকায় তারদিকে। রমিজ বুকে পাথর বেঁধে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। বাজারের সবচেয়ে বড় দোকানের সামনে গিয়ে সে থামে। একবার পিছেতাকায়। ফিরে যেতে মন চায়। কয়েক কদম হেঁটে ফিরে আসে। তারপর একদমে ঢুকে কাগজে টিপসই দিয়ে বলে, বিয়ে হইয়া যাওয়ারপরদিন আমি নিজেই নিয়ে আসবো বড় মালিক।

দিন ফুড়ায়ে বিয়ের আসেআয়োজন শুরু হয়   শানাই বাজে, কলাগাছের গায়ে লাল হলুদ কাগজের ফিতা জড়ায় ছেলেরা,উঠানেআলপনা আঁকে মুনিয়ার দুই সই। ঘরের রোয়াকে বসে চাচি খালারা নারিকেলের পুর ভরে পিঠার খালি পেটে। পান সাজায়,হলুদবাটে মেহেন্দি বাটে।

হলুদে মাখা মুনিয়া মাথায় পাঁচ সধবা পানি ঢালে। দোয়া করে স্বামীর ঘরে রাজরানীর আসনের।  

রমিজ ঝাপসা চোখে মেয়েকে দেখে নতুন বউয়ের সাঁজে বসে আছে লালে লাল হয়ে। দেখে অবাক হয়, এই কার মেয়ে? তার? নাযাদের বাড়ি যাবে আজ রাতে, তাদের?

কাজী কলেমা পড়ায়, দোয়া পড়ায়। হাত তুলে আমীন বলে সবাই। রমিজ হাত নামায় না। বিড়বিড় করে কী দোয়া সে করে কেউবোঝে না। বড় ছেলে কানে কানে বলে, বাবা মোনাজাত শেষ।

মেহমানদের খাওয়া শেষ হয়। সকলে তারিফ করে বলে, রমিজ মেয়ে বিদায়ে খরচ করছে দুহাত খুলে। নিজের মেয়ের বিদায়েরপ্রশংসায় রমিজ বোঝে না কী বলতে হবে তারে। সে কেবল মাথা নারে।

সময় ঘনায়ে আসে মেয়ে বিদায়ের পালার। গত দুইদিন ধরে যারা লীলাবালিরে কী দিয়া সাজাইবো তার বরের জন্য, গেয়েছিলো, যারা রুসুমাত করাতে গিয়ে হাসতে হাসতে একে অন্যের গায়ে ঢলে পড়ছিল, তাদের কণ্ঠে এখন কান্নার সুর।

থেমে থেমে বিলাপের মধ্যে মেয়ের মিহি কান্না রমিজের বুকে তীর মারে। দুইছেলে তার কাছে আসে,বাপের বুকে মাথা রেখে কাঁদে। সেতাকায় তার বউয়ের দিকে, বউটা মুখে আঁচল চেপে আছে। কাজী তার হাত ধরে বলে, মেয়েকে সম্প্রদান করো রমিজ। মেয়ে আজথেকে তোমার বাড়ির মেহমান। রমিজ কেঁপে ওঠে। পাঁজরের হাড় ভেঙে খুলে খুলে পড়ে গিয়ে বুক যেন খালি করে দিলো কাজীরকথায়। হাঁটু থেকে পা যেন অবশ হয়ে গেছেতবু টেনে টেনে হেঁটে  গিয়ে মেয়ে আজ থেকে যাকে বাপ ডাকবে তার হাতজোড়া শূন্যবুকের মধ্যে নিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে কেঁদে সে কী বললো সব বোঝা গেলো না। কাশি দিয়ে গলা সাফ করেও বসে যাওয়া কণ্ঠেকোনমতে চেষ্টা করে যা বলতে পারলো তা থেকে সবাই শুধু এইটুকু বুজতে পারলো, রমিজ বলছে, বেয়াই সাব, আমার কলিজাখুউলা আপনারা দিয়ে দিলাম। ছোট মানুষভুল করলে মাফ কইরা  দিয়েন।  

গোয়ালঘরে বেঁধে রাখা লালমুনিয়া গলায় লাল মালা ঝুলানো মাথা এদিক ওদিক করতে করতে জোরে ডেকে উঠলো। মুনিয়াদৌড়াবার জন্য পা বাড়িয়েও তার নতুন বাবার দিকে তাকায়,  বাড়ানো পা থামিয়ে দিয়ে সে পায়ে পায়ে হেঁটে গিয়ে লালমুনিয়ার গলাদুইহাতে জরায়ে ধরে বলে, ফিরানি আইসা তোরে আমি লইয়া যামু।

পিছন থেকে দুইভাই এসে বোনের হাত ধরে বলে, রেল ছাড়ার সময় হয়ে গেছে। সকলের কাছে থাইকা বিদায় নে বইন।  

বিদায়ের লম্বা পালা শেষ করে বাপের বাড়ি থেকে হাঁটাপথের রেলস্টেশনে মেয়ে আজ সাজানো রিকশায় করে গেলো। তারপর রেলেরচিকন বাঁশির সাথে ঝুকঝুক আওয়াজ তুলে রমিজের বুকের ভিতরটা কেটে কেটে রক্তাক্ত করে তার পনেরো বছরের মেহমান চলেগেলো।

সুবেহ সাদিকের আজানের  ডাকে রমিজ আজ জাগে নাই। সে জেগেই ছিলো বাকি রাত। লালমুনিয়ার গোয়ালঘরে বাঁশের গায়েহেলান দিয়ে বসে থেকে। আজ গরুটা সারারাত দাঁড়িয়ে কাটিয়ে দিলো। কতবার ওকে বসাতে চাইলো। বসলো না।

মাঝে মাঝেই লেজ দিয়ে নিজের গায়ে বাড়ি দিতে দিতে ঘাড় ঘোরায়। রমিজ ওর মালা খুলে দিতেই শান্ত হয়ে রমিজের দিকে তাকায়।বড় বড় কালো চোখের কোণায় পানি টলটল। রমিজ ওর পা ধরে বলে, মাফ করে দে আমারে। গরুটা অন্যদিকে তাকায়। পা পিছনেসরায়। খুর জমিনে ঘষে।

চারদিকে দিনের আলো ফোটে। রমিজ লালমুনিয়াকে নিয়ে বাজারের পথে যায়। বউ পিছে পিছে কতটা পথ আসে। লালমুনিয়ারগায়ে হাত বুলায়ে দেয়। সই করা কাগজ হাতে দিয়ে বলে আরেকবার বইলা দেইখো। টাকা ফেরত দিলে অরে ফেরত দেয় কিনা।  

রমিজ বাড়ি ফিরে আসে লালমুনিয়ার বিদায়ের কাগজ নিয়ে। গোয়ালঘর থেকে লালমুনিয়ার গন্ধ ভেসে আসে। মুনিয়ার আঁচলেরছায়া উড়ে উড়ে যায়।  উঠানে মুনিয়ার এক্কা দোক্কা খেলার আওয়াজ নেই,গোয়ালঘর থেকে লালমুনিয়ার ডাক নেই। চারদিকে বিয়েবাড়ির সাঁজ যেমন তেমনি আছে  শুধু যার জন্য করা সে নেই। রমিজ ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। এখন থেকে এই তাইলে তার সংসার –  বাড়ি ফিরলে লাফাইতে লাফাইতে  বাপজান আইছ কইয়া মাইয়াডা আর কাছে আইবো না বুকে হাত বুলাতে বুলাতে রমিজ মিয়াঁভাবে  দিনের পর দিন মাসের পর মাস মাইয়া না দেখার কষ্ট নাকি সয়ে যাইবোএও সত্য হয়!

ফিরানির দিন পার হয়ে যায়। মেয়ে নাইয়র আসে না। স্বামীর ছুটি নাই। মাস চলে যায়। ভাইরা বোনকে আনতে গিয়ে একা ফিরেআসে মুখ কালো করে। মুনিয়ার শ্বশুর শয্যাশায়ী। তার সেবার করার জন্য ছেলের বইয়ের যে থাকা দরকার। জানায়ে দেয় মাস শেষেএকবারে কোরবানি ঈদে আসবে।  

বউ তার নতুন বেয়ানের সাথে ফোনে কথা বলে। মেয়ের সাথে দুইচার কথা হয়। রমিজ পাশে বসে থেকে মেয়ের গলার আওয়াজশোনে। অপেক্ষায় থাকে এই বুঝি মেয়ে বাপেরে চায়। ফোন রেখে দিয়ে বউ বুঝায় বাপনেওয়টা মাইয়া। শ্বশুর বাড়িতে মন বসুকতারপর কথা কইয়ো। রমিজ মিয়াঁ মাথা নাড়ে, মেয়ের সাথে সেও কী কথা কইতে পারবে? লালমুনিয়ার কথা যদি পারে?  কী জবাবদিবে?

মেয়ে আসার দেরীতে যত অস্থির লাগে তার ততই অস্থির হয় ভেবে কী জবাব দিবে যখন অরেও বিদায় করলা বাপজান কইয়া কান্দনশুরু করবো। তার আদরের মাইয়ারের সেও তো আঘাত দিলো।  

রমিজ মিয়াঁ দোকানে আসে যায়, কাজ মন বসে না। ঢাকা থেকে আসা রেলের আওয়াজে বুকে কাঁপে। থেকে থেকে বা চোখের পাতাকাঁপে। রমিজের আড়ালে বউ গোয়ালঘরে বসে চোখ মুছে। বুকের মধ্যে কেমন আনচান করে, মনে কুডাক দেয়। মেয়ে ফোনের ওইপারে চুপ থাকে। কেন কিছুই কয় না। মনেরে মানায়, শ্বশুরবাড়িতে মন বসাইতে যে সবারই সময় লাগে। তারও তো লাগছিলো।

দোকানে বসে রমিজ মিয়াঁ ক্যালেনডারের ঘরে রোজ গুনে গুনে দেখে  হজের রাতের বাকি আছে আর কতদিন। দিন যেন আজকালআর শেষ হয় না। সকাল থেকে দুপুর হতেও এত সময় লাগে। সুর্য উঠলে যেমন ডোবে না সহজে, আবার রাতের অন্ধকারও সরে না। 

ধীর গতির সময় গেলোরমিজ মিয়াঁর দিনের অপেক্ষা শেষ হয়। ঈদের সকাল আসে। মেয়ের শ্বশুরের পাকা কথা মত, ঈদেরনামাজ শেষে জামাই তার মেয়ে নিয়ে আসবে। রমিজ মিয়াঁ মসজিদে ঈদের  নামাজ শেষে বড় ছেলেকে স্টেশনে পাঠায়ে দিয়ে ছোটছেলেকে নিয়ে কোরবানির মাঠে যায়। নতুন জামাই আসবে। কষ্ট করে হলেও মেয়ের মান রক্ষায় এক নাম কোরবানি  দিতেই হলো।

গ্রামের এই ছোট্ট মাঠে কত কিছুই হয়। ফুটবল খেলা, যাত্রাপালা, ইলেকশনের সময় মিটিং, ওয়াজ মাহফিল সবই এই মাঠে। আজএই মাঠের দৃশ্য অন্যরকম। সুন্দর সুন্দর তাগড়া গরুর ভিড়। গলায় কাগজের ফুলের মালা। মালার নিচে দড়ি। লাইন করে দাঁড়ায়েথেকে অসহায় চোখে দেখে চারদিককাকে খোঁজে! একেজনের বিদায়ের সময় আসলেই কসাইর ধারালো চকচক ছুরি দেখে পাদপড়ায়। পালাবার চেষ্টা করে না। দুই পায়ের এতকালের শক্তি বোধহয় থাকে না অথবা থাকলেও বোবা জীবও জানেসব সময় সবযুদ্ধে জেতে যায় না। বোঝে আজ তার কোরবানিসাত নামের মানুষের জীবনের জন্য। তবুও ধারালো ছুরি দেখে ভয় লাগে।এতকালের মনিবের হাত থেকে দড়ি আলগা হয়ে যাওয়ার কথা ভাবে। অচেনা লোক ঘিরে ধরে। ছুরি কাছে আসে। বোবা চোখেটলমল করে পানি।

রমিজ মিয়াঁ  সবার আড়ালে হাতের তালু দিয়ে  চোখ মোছে। কপালের ঘাম মোছে। বুকে হাত ঘষেনিজের অজান্তেই সাতআসমানের দিকে তাকায় বলেমাবুদ!!  

ছোট ছেলেটা হঠাৎ ছুটে যায়। রমিজ মিয়াঁ  পিছে পিছে যায়বাজারের বড় দোকানের মালিক আর কর্মচারীরা কোন গরুকে দড়িরপ্যাচে মাটিতে ফেললো, দুজন পা ধরে মাটিতে চেপে ধরতে চাইছে, পারছে না তাও বাগে আনতে। পাগলের মত পা ছুড়ছে,  ডাকছে।রমিজ কাছে যায়লালমুনিয়া শান্ত হয়ে তাকায়। বড় বড় কালো মায়াময় দুইচোখের কোলে পানি জমে আছে। মালিক কসাইকেঈশারা করেলালমুনিয়ার গরম রক্তে ভেসে গেলো রমিজের মিয়াঁর  পা। লালমুনিয়ার বুক তখনো নিঃশ্বাসে উঠছে নামছে।  

রমিজ বসে পড়ে। লালমুনিয়ার চোখদুটিতে হাত রাখে। বুকে আদর করে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। মেয়েটাকে আজ কী বলবে?

রমিজ রমিজ  রমিজ মিয়াঁ  পিছন থেকে কারো  ডাক শুনে সে চমকে ওঠে।  পাশের বাড়ির চাচা ডাকতে ডাকতে কাছে এসে  হাত ধরেবলে বাড়ি চলো।

কোরবানি হয় নাই তো চাচা।  

পরে দিও।

হতভম্ভ রমিজ মিয়াঁ কিছু বলার আগেই বড় ছেলে দৌড়ে আসে, ছোট ভাইকে জরায়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদে বলে, বইন কাল রাইতেহাতের রগ কাইটা মইরা গেছে। রেলে বইন আসে নাই লাশ আইছে।  

কে একজন  যেনো  বলে, আমাগো অতটুক মুনিয়া রগ কাটলে মরবো জানলো ক্যামনে! এইটা যে মানা যায় না।  রমিজ মিয়াঁ তুমিছাইরা দিও না।

রমিজ আরেকবার পিছনে তাকায়। দেখে লালমুনিয়ার নিস্তেজ দেহ থেকে রক্তের ঢল জমিনে ভাসছে। কোরবানির মাঠে একমুহুর্তে নীরবতা নেমে আসে। সবাই দেখে মুনিয়ার লাশ কাঁধে নিয়ে আসছে গ্রামের ছেলেরা। ওদের পিছনে নতুন জামাই

সে দূর থেকে শুনতে পায় চাচা ডাকছে, রমিজ রমিজ, ছেলেরা ডাকছে, বাপজান বাপজান

রমিজ দেখে আকাশে কালো জমাট মেঘ। ছুরিগুলো সারা মাঠে ছড়িয়ে আছে। রক্তের মধ্যে সবাই ডুবে যাচ্ছে। গরুগুলো বাঁধন ছেঁড়েসর্বশক্তি দিয়ে ছুটছেমানুষের লোকালয় ছেঁড়ে আরও দূরে আরও দূরে কোন ঠিকানায়।  

রমিজ লালমুনিয়ার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। কে যেন তার পিছনে এসে কাঁধে হাত রাখেডাকে বাপজান! রমিজ কাঁধে তুলে নেয়লালমুনিয়াকে,সে হেঁটে যায় মুনিয়ার পিছে পিছেকোথায় সে জানে না!    


রাজিয়া নাজমী : গল্পকারদুটি বই তাঁর : চৌকাঠের বাইরে। জলাগুন।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর।লেখালেখির পাশাপাশি নিউইয়র্ক কেয়ার, বাংলাদেশ পরিবেশ নেটওয়ার্ক, এবং বাপা সদস্য হিসাবে কাজ করেন। নিউইয়র্কেরকুইন্সে ফ্রেন্ডস অব হোলিস লাইব্রেরির ভাইস প্রেসিডেন্টএর দায়িত্বে আছেন।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন