লিজ রোজেনবার্গ এর পাঁচটি কবিতা


বাঙলায়ন : বদরুজ্জামান আলমগীর


পুবাকাশ


একসুতোয় বাঁধা জীবন

জীবনের মধ্যগগনে এতো একাকিত্ব কেন?
ছোট ছোট সাদা সাদা  বাড়ির উপরে
ছড়িয়েছে গাছের বিস্তার,
প্রাণ চুবিয়ে ডাকছে গরমকালের পাখি
মিহি আর শিথিল তাদের স্বরের ভাঁজ
পলকেই হয়তো সরে যাচ্ছে আরেক বনের দিকে।পৃথক নয়, একসুতোয় সকলে বাঁধা।

আমরা যখন বাড়ির পিছনে নিশুতি রাতে
চুপচাপ এসে বসি
শুনি কেমন সহস্র রাত্রির অন্তর চিরে অগুনতি
পোকারা সুর কাটেআমরা যাদের সরিয়ে দিয়েছি;
আমরা তো অকৃতজ্ঞ নাফরমান বরযাত্রী হয়েছি
যারা কেবল সেরা খাবারটাই খায়, পিছুটান রাখে না।
মূল কবিতা: The common life.

পরমার্থ জীবনের বাঞ্ছা

আজ রাতে এক পশলা বৃষ্টির পর
সব ঝিমধরা সুনসান স্থির, কনকনে শৈত্য প্রবাহ চিরে
পোকামাকড়ের ঝিঁঝিট নিরন্তর শ্রবণে আঘাত হানে খানিক কান পাতলেই শোনা যায় ট্রাফিক লাইট ধীরে আলগোছে বিধি চিহ্ন বদলায় 

অতি ধীর লয় গাড়ির চাকা আলো আঁধারি মুখে ডান বাঁয়ের গলিতে ঢোকে।

আমার বাটির পিছন বারান্দায় বাতির দ্যোতি
তারা ঝিকমিকের সাথে একজোটে লাউ জুকিনির পিঠে আলতো স্পর্শ বোলায়।

সহজ নিরাভরণ বেঁচে থাকা কেন এতোটা হুলুস্থুল কাদায় পা আটকে কাঠবিড়ালি সমুখে শান্তি পারাবার 

পরমার্থ অসীমের দিকে দাঁড় টানে।
আমি বিশ্রাম নিতে নিজের উপর জোর কাটাই হাতের মুঠি ছেড়ে আলুথালু হই
আর শুনি গরীয়ান এক পোকা অন্তরাল অবসাদে ডেকে যায় টিক টিক আলোর সংসারে পাড়ায়।

মূল কবিতা: The longing for eternal life.

তুমি কোথায় ছিলে

আমি বাগানে চারাবীজ লাগাচ্ছিলাম
হাতে মাটি খুঁড়ে তুলছিলাম বেজান
আর আমার মাথায় দুলছিল ভবিষ্যতের ফুল
এর মধ্যেই পড়িমরি দৌড়ে মেয়েটি আমার কাছে এলো
সে একটি শীর্ণ সাঁকো পেরিয়ে আসে।
পুলের নিচে কালো আলকাতরা দেখা যাচ্ছিল
মনে হচ্ছিলএখনও ঘটেনি, তবে তা একপলকে ঘটবে
ঠিক দাঁড়ানো ট্রেনের মতএই আছে আবার নিমিষেই
ছুটে চলে গেল।
কিন্তু আমি হনহন সামনে এগুতে থাকলাম একদিশায় ছুটি, কোনদিকে ভ্রূক্ষেপই করি না আমি আমার অফিসে এসে পৌঁছুই
আর আমার চারপাশে সবুজ পত্রালি লমলম করে।

আসি আসি শীতসন্ধ্যার খয়েরি হিমের ভিতর
রাস্তার কিনার ধরে ছুটে যাই ধাবিত হই
আমার চুল ঘাড় বরাবর কেশরের মত লাফাতে থাকে
জানলা জুড়ে তোমার প্রাণের শীরিষ জমে ওঠে বেশ
খপ করে তোমার বোনের হাতটি ধরে ফেলি আমি।বিষণ্ন বিলাপে তুমি বুঝি বিলিয়ে যাও একটি কথাতোমরা কেউ চোখ তুলে দেখছো না

আমি কী দাগ ছড়িয়ে দিয়েছি তোমাদের চোখের আগে। 

বসন্তে আমি ছিলাম দূর বহুদূর বিচ্ছুরিত 

কোথাও হাওয়ায় ছিল না বেগুনি আবীরের পোঁচ আমি পৌঁছুলাম নিরুত্তাপ শীতল নিসর্গ পাড়ায় বীজের গোটা বুক চিরে বেরোয়নি আকুল স্পন্দনে মুখ বাড়ায়নি জীবনের পুঁইফুটে বেরোওনি তুমিও।

মূল কবিতা : Where were you?

সাসকোয়েহানা

বিয়ের পর আমাদের রাত্রিগুলো একতরফা নিকষ শত জোনাই পোকা বুঝি বিন্দু বিন্দু কালো ফোঁটা শান্ত নিরেট রাস্তার উপর ওরা ফুটে থাকতো 

রাত গড়িয়ে ভোর অবধি

কিন্তু সে যে রাত দুপুরে চুরমার বিধ্বস্ত 

তড়বড়িয়ে সিঁড়ি ভেঙে আমাকে 

একগ্লাস পানি এনে দিতোতা বেমালুম ভুলে গ্যাছি। 

সেসময় আমাদের কুকুরটি এক ফাঁকে 

দরজা গলিয়ে নিজেকে মেঝেতে কাত করে দিতো।আমি জানি সবাকেই মৃত্যুর শীতলতা গ্রাহ্য করতে হবে 

কিন্তু সে দিনগুলোতে ভুলেও তা মনে আসেনি সামনে অফুরান দিন– 

দিন কখনও ফুরিয়ে যাবেতা একবারও ভাবিনি।

মূল কবিতা: Liz Rosenberg : Susquehanna.

 শহরতলির শৈশব

ওই নেহায়েত জিনিসগুলো কেমন 

কলজে ধরে টান দেয়– 

ইশকুলের টিফিন ঘন্টা, জংধরা মেটে শস্যের মাঠ কেমন যেন ঝিকমিকিয়ে ওঠে 

একটা খিটখিটে ছেলে মলিনে মালিন্যে হেঁটে যায়।আচম্বিত লাগেমনে হয়, আমি একটা অচেনা বাসে উঠে পড়েছি, আবার ঘাবড়ে গিয়ে নেমে পড়েছি আর নিরুদ্দেশ হেঁটে যাচ্ছি আমি 

দেখি একটি ঘরে আলো জ্বলছে, পাড়ায় বুঝি 

সব ফুলের নামে নাম। 

আর কে যেন গাইছেসে মন দিয়েছে, মন সঁপেছে সে 

আদতে মন কী গলেছে, গলেছে তার… 

পাতা জমে জমে যে ঠেকি হয়ে উঠেছে 

সেই ঢিবি পুড়ছে দাউদাউ, পুড়ছে তাদের জঙ্গম তৃষ্ণা তাদের জ্বলতে দেখি যতক্ষণ না সন্ধ্যার আবীর আমাকে তামাটে ছায়ায় ঢেকে না ফেলে 

আগুনের হল্লার খানিক বাদেই আমার মা গাড়ির চাকায় হুড়মুড়িয়ে ঠেস দিয়ে ছটফট করে 

গাড়ি বুঝি উড়াল দিতে দরজা খুলে ঘামছে 

তারস্বরে চিৎকার করছে দরজার পাশে, মা আমার।

মূল কবিতা: A suburban childhood.

কবি পরিচিতি : লিজ রোজেনবার্গ কবি, লেখেন উপন্যাস আর শিশুসাহিত্যও। প্রকৃতি মানুষ মিলেমিশে আমাদের যে আটপৌরে চারপাশতারই অনায়াস রূপকার তিনি। অত্যন্ত চেনা প্রাত্যহিক ঘটনার নির্বাচন থেকে বিন্যস্ত করেন দৃশ্যমানের এক অদৃশ্যময়তা, বর্ণনাকেরূপান্তরিত করেন চিত্রকল্পের আলোআঁধারি মেধায়। তাঁর কবিতা ফুঁ দিয়ে উষ্ণায়িত করে ভরা শহর উপশাহরিক জীবনের মৃদু কোলাহল আর পরম্পরা। নিজেকে বহুতের সঙ্গে মিলাতে পারঙ্গমলিজ, আবার বৈচিত্র্যকে নিজের ভাবনার সঙ্গে ঘরকন্নায় তুলে আনতে জানেন, কেননা তাঁর এক প্রধান নেশা এবং পেশার জায়গাএন্থোলোজি সম্পাদনা করা। কম্পারেটিভ লিটারেচারে অধ্যাপনা করার সাথে সাথে কবিতা লেখার জন্য নিত্য জাগর লিজ রোজেনবার্গ।লিজের জন্ম ১৯৫৫ সনে, বেড়ে ওঠা নিউ ইয়র্কের লং আইল্যান্ড সিটিতে।

বদরুজ্জামান আলমগীর: কবি, নাট্যকার, অনুবাদক।প্রকাশিত বই।। আখ্যান নাট্য : নননপুরের মেলায় একজন কমলাসুন্দরী একটি বাঘ আসে। আবের পাঙখা লৈয়া।

প্যারাবল : হৃদপেয়ারার সুবাস।

কবিতা : পিছুটানে টলটলায়মান হাওয়াগুলির ভিতর। নদীও পাশ ফেরে যদিবা হংসী বলো। দূরত্বের সুফিয়ানা।

ভাষান্তরিত কবিতা : ঢেউগুলো যমজ বোন।

ছিন্নগদ্য : সঙ্গে প্রাণের খেলা।

প্রকাশিতব্য কবিতা : দরজা খুলেই দেখি জেব্রাক্রসিং। মরিয়মফুল দুনিয়া।  সরিষাপুরং শরণং গচ্ছামি।

প্রকাশিতব্য নাটকসংগ্রহ : ঘোড়াউত্রা সংবেদ।

প্রকাশিতব্য নিবন্ধ : আশ্চর্য বতুয়া শাক কাঁচা দুধের ডিসকোর্স।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন