অন্ধকার উঠোনে অপরূপ শ্রীঃ কবিতার স্নিগ্ধতায় ধোয়া উপলব্ধি
রেদওয়ান খান
পুবাকাশ
কবিতা নিয়ে অনেক কথা বলা হয়। সে–সব কথা নিয়ে মাতামাতিও হয়। কোন কবিতা যুগধর্ম অথবা কোন কবিতা কবিতার বাঁক বদলেদিচ্ছে,কোন কবিতা পুরনো ধারা অথবা কোনটাই–বা,নতুন ধারা– এসব নিয়ে তত্ত্ব,আলোচনা,সমালোচনা,গ্রহণ–বর্জন বহু কিছুই হয়েথাকে। কিন্তু কবিতাটি পাঠ করার পর,একজন সাধারণ পাঠক উপলব্ধির জোয়ারে ভাটায় কি–রকমভাবে দুলে ওঠে– সেটি ব্যাখ্যা করাঅসম্ভব হলেও কাঙ্খিত।
আমাকে যদি বলা হয় কবিতা কী? আমি বলব– কবিতা হচ্ছে ফুলের অন্তর্নিহিত সুবাস যা শুধুমাত্র উপলব্ধি করা যায়,কখনো ব্যাখ্যা করাযায় না। তবে ব্যাখ্যা করার একটা অপ্রতিরোধ্য আকাঙ্খার নামই সম্ভবতঃ কবিতার বোধ– শিল্পবোধ। শোয়েরা সারওয়ারকে আমি আগেচিনতান না,পড়িওনি তাঁর লেখা। গত ২০২২ এর একুশে বইমেলায়–ই প্রথম তাঁর কবিতাগ্রন্থ অন্ধকার উঠোনে অপরূপ শ্রী হাতে আসে।কবিতাগুলো পাঠ করি খুবই আস্তে আস্তে সময় নিয়ে বারবার।
গ্রন্থভূক্ত কবিতাগুলো পাঠ করে মনে হয়েছে স্নিগ্ধ শিশিরে স্নান করে উঠলাম। ব্যক্তি জীবনের খন্ড খন্ড দুঃখ–বেদনা–সুখ–অভিমান ওপ্রত্যাশাগুলো ধরা দিয়েছে নাতিদীর্ঘ কবিতাগুলোতে। পড়তে পড়তে চমকে ওঠার মতো কিছু পংক্তি কবির অন্তর্নিহিত শিল্পসৌন্দর্য্যে জ্বলেওঠে, দ্যুতি ছড়ায় এবং পাঠককে ভাবতে অবসর দেয়, কবিতাসিক্ত মন নিয়ে পাঠক বেশ সময় ধরে অবগাহন করেন কাব্যরসে। কবি যখননির্মাণ করেন,“ভীষণ কষ্টে জল আর আগুনে মিশে আছি”(আলোড়ন) তখন পাঠকও সেই জলে ভেজে,সে–আগুনে পোড়ে।
পুরুষ কবিরা কবিতা ও নারীকে সমার্থক করে তোলার সব চেষ্টাই করে থাকেন। তবে কবি শোয়েরা নিজে নারী হয়ে যখন লেখেন,“শব্দহীনমন তোমার অক্সিজেনে প্রভাতরূপিনী নারী!”(সিঁথিতে শিশির) তখন এই প্রতিতুলনা সত্যে রূপান্তরিত হয়ে আমাদেরকে জারিত করে। নারীতখন হয়ে ওঠেন সেই মোহন গন্তব্য– “এটাতো সুবর্ণপুর স্টেশন”(সিঁথিতে শিশির)
কিন্তু মানুষের মন বড়ো বেশি বোহেমিয়ান উড়নচন্ডী– কোথায় যেন সে এক গৃহহীন পরিযায়ী। কোথায় যেন তার বন্ধন–শিকলটিআলগা–ভঙ্গুর,ক্ষণজীবী।‘ঘর’ কবিতায় দেখতে পাই “শেষ অবধি ঘরে ফেরা হলো/ফিরলো না মন(ঘর)। আর সুখের অণ্বেষায়প্রকৃতি,ঘর–সংসার সবকিছুই হয়ে ওঠে প্রশ্নবোধক চিহ্নের মতো “বকুল মালা বুকে রেখে যে রাতে স্বপ্ন দেখেছি/সেই আঁধারে জন্মেছিল একটানদ/নদীতে প্রেম ডুবেছে,সুখ কই?”(ঘর)। কবিতা জীবনের বাইরের কিছু না। জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধিকে শৈল্পিক তথানান্দনিকভাবে উপস্থাপন করাই প্রকৃত কবির শক্তি। সংসারে আনন্দযাপনের আড়ালে মানুষ কেবলই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। দূরের নক্ষত্র যেনতাকে ডাকে একাকিত্বে। তাই কবি রচনা করেন “সংসার হচ্ছে প্রমাণিত নিষ্ঠুর অভ্যাস/চুমু খেতে খেতে দূরে সরিয়ে দিতে জানে।”(ঘর)
আমাদের কর্মচাঞ্চল্যে আমরা সাধারণ মানুষেরা ইহকাল–পরকালের দর্শনের ভিতর দিয়ে যাই,সেই ভাবনা ভাষা খুঁজে পায় না। কিন্তু কবিরকাজ সেই মর্মদর্শনের ভাষা দান। এই সুচারু দেহলতার মায়ায় পড়ে কবিকে ভাবিয়ে তোলে মৃত্যুচিন্তায়। তখন রচিত হয় অমোঘ পংক্তিমালা“মৃত্যুর পর আঙুলগুলো কবরে পচবে ভেবে কত রাত চমকে উঠেছি…/এই মৃত্যু কোনো পাহাড় কিংবা সমুদ্রের আলিঙ্গনে হোক।”(মনস্তাপ)
কবিতাকে তো এক অর্থে বলাই যায়,যাপিত জীবনের অনুষঙ্গে কবির এক অন্তঃশীল বিরোধ, এই বিরোধের সংঘর্ষে কবির ক্ষরণ যখনসুদীর্ঘতম অভিমান–মোড়ানো পংক্তি হয়ে ঝরে,তখন তা এক অনির্বচনীয় অনুভবের পাখনা মেলে ধরে পাঠকের মনেও,তাকে ভাবিত করে।তাই দেখি–“উঠোন জুড়ে যখন আসমানী অভিমান নামলো/তোমাকে এসেছি নাকছাবি পরাতে/দেখো,আজ অন্ধকার উঠোন অপরূপ শ্রীআর বিনীত/তোমার মন্ত্রে সহস্র বছরেও কাটেনি সেই ঘোর/”(উঠোন) অথবা “দীর্ঘকাল তোমাদের মৌনতায় বুঝিনি/অভিশাপ কত বড়ো”(মহামারি)
আর শত অভিমানের খেয়া পার–হওয়া এই সংসারেই আবার তিনি খুঁজে পান গুল্মের কষ।“তুমি নিশীথে অধররঞ্জনী ঢেলে দিলে/আমিহলাম পাতাজোড়ানো তীব্রগন্ধী ছেঁড়া ফুল।” (গুল্মের কষ)
যেহেতু কবির অন্তর্দৃষ্টিতে যাতনা–যাপনের নানান ছাপ আঁকা,তাই ‘শূন্যতার ভেতর সবুজ মেয়ে’তে পাঠ করি,ভুলে যেতে চাই কেউ কখনোএসেছিল/ছেঁড়া স্বপ্ন নিয়ে কী করে উড়ি?/অল্পভেজা চোখে দুঃখের ক্ষত/এই দেহছাল নিয়ে একা সংগ্রামী।(শূন্যতার ভেতর সবুজ মেয়ে)
কবি শোয়েরা সারওয়ারের কাল এক হননকালেরই সাক্ষী;এই কালের মানুষের ভাষা ব্যবহারেও যে এক শিকড়হীনতার চর্চা দেখা যায় তা উঠেআসে কবিতায়ও,সেই অভিজ্ঞতার শব্দ,পংক্তিতে ভরে ওঠে তাঁর কাব্যগ্রন্থটি। আমরা দেখতে পাই তাঁর চোখে তাঁর কালকে এভাবে– “তুমি,তুমি?/আজ আসবে একগ্লাস কুয়াশাবিষ শরবতে/মানুষের বুকে শোক নেই।” (মহড়া) কিংবা আপেলটা কাটা বন্ধ করি/নিজেকে খুনিখুনি লাগে/পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের মতই হ্যাল্লো জান্টু কী করো? (কয়েকটি অসহা মুহূর্ত)
ছাপ্পান্নটি কবিতা স্থান পেয়েছে এই গ্রন্থে। কবির ভাষারীতি স্বতন্ত্র ও সাবলীল। শব্দ ব্যবহারে পরিমিতিবোধ এবং উপমার শীলিত ঝলক তাঁরকবিতাকে করেছে উপভোগ্য,স্নিগ্ধ এবং গতিশীল। সীমিত পরিসরে কোনো আলোচনাই একটি গ্রন্থের সৌন্দর্য্যকে তুলে আনতে পারে না।সেক্ষেত্রে ‘অন্ধকার উঠোনে অপরূপ শ্রী’ পাঠের দাবি রাখে। আরো দীর্ঘপরিসরে আলোচনার ইচ্ছে জেগে রইল।
🔴
অন্ধকার উঠোনে অপরূপ শ্রী॥শোয়েরা সারওয়ার॥দেয়াঙ পালিশার্স,চট্টগ্রাম॥প্রচ্ছদঃ নির্ঝর নৈঃশব্দ॥প্রথম প্রকাশ ফাল্গুন–১৪২৮,ফ্রেব্রুয়ারি ২০২২॥মূল্যঃ ২০০ টাকা।
🔵রেদওয়ান খান : কবি ও কথাকার ।