নাইমুজ্জামানের দিনকাল ।। সাবিনা পারভীন লীনা ।। পুবাকাশ
নাইমুজ্জামান কথার জবাব না দিয়ে জায়নামাজে দাঁড়িয়ে গেল। জান্নাতের চোখের কাজল ধুয়ে যাচ্ছে। রুম থেকে বের হয়ে রান্নাঘরের পাশের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো।গাছের একটা পাতাও নড়ছেনা। বিপরীত দিকের দোতলা বাড়িটার সামনে খোলা জায়গায় কুকুরটি কিছুক্ষণ পরপর ঘেউ ঘেউ করছে। অল্প বয়সের একটা ছেলে মূল ফটকের বাইরে দাঁড়িয়ে মাথা তুলে উঁকি দিল। বাইরের সাইনবোর্ডে লেখা আছে “কুকুর হইতে সাবধান”। ঐদিকে তাকিয়ে জান্নাতের চোখের জল ঠোঁটের কিনারায় আসতেই, হাসির রেখাটা হঠাৎ বেঁকে গেল। মনে মনে ভাবলো, সাইনবোর্ডে লেখা প্রথম শব্দটি পাল্টানোর সময় এসে গেছে।
এই রুবিনা আপা…রুবিনা আপা…,ঘুমিয়ে গেলেন নাকি?দেখেন একবার দেখেন,ঘুম পালাবে আপনার।আমার কথাতো কেউ বিশ্বাস করলেন না,এবার প্রমাণ সহ দেখেন বলতে বলতে মিনারা হামিদ মোবাইলটা ডান হাতের উপর কাত করে রাখা রুবিনা আখতারের মুখের উপর ধরলেন।তার চোখে মুখে শার্লক হোমসের হাসি।পাতলা নাকের একপাশ সামান্য ফুলে আছে,নথের পাশের চামড়ায় ছোট্ট একটা ভাঁজ।
–অফ্ পিরিয়ডেও কি একটু বিশ্রাম নিতে দিবিনা তোরা।চোখের উপর মোবাইল ধরে আছিস কেন, আলো পড়ছে।এতোক্ষন রুমা তার স্বামী নিয়ে বকবক করলো,এখন আসলি আবার তুই।
রুমা হাসতে হাসতে চেয়ার ছেড়ে রুবিনার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো–আপা চোখটা একবার খুলেন দেখেন,তারপর বকা দিয়েন আমাদের।
রুবিনা এবার চোখ মুছে চশমাটা লাগালো। তিন জোড়া চোখ এখন মোবাইলের স্ক্রিনে…..
–এটাতো চা বাগানে তোলা ছবি। মেয়ের বান্ধবী অথবা কোন আত্মীয় হতে পারে। তোমরা এতো নিশ্চিত হচ্ছো কিসের ভিত্তিতে,আর যদি হয়েও থাকে তোমাদের সমস্যা কোথায়?
উনি অস্বীকার করছেন, এটাই আমাদের সমস্যা,আপা-রুমার কণ্ঠ ছেড়ে শব্দগুলো এমন ঝনঝনিয়ে পড়লো যেন কাঁচের প্লেট ভাঙলো।
শাড়ির ভাঁজ ঠিক করলো, ব্যাগ থেকে চিরুনি বের করে চুলে হালকা বুলিয়ে দিতে দিতে বললো-আমি ক্লাশে গেলাম।ঘুরে আবার মিনারার মোবাইলে চোখ রেখে বললো,মুখটা খুব চেনা চেনা লাগছে।কোথায় যেন দেখেছি কিছুতেই মনে আসছেনা। উনি কয়েকমাস আগে সপ্তাহ খানিক ছুটি কাটিয়েছিলেন,বলেছিলেন মেয়েকে নিয়ে বেড়াতে যাবেন।জয়েন করতে যেদিন এলেন সেদিনতো চুল-দাড়ি সব কালো ছিল, মনে আছে?
-হা হা হা,এই নিয়ে তিন রঙের দাড়ি দেখলাম স্যারের গালে।নাজু ম্যাম মারা যাওয়ার পর সাদাকালো, এরপর লালচে কালো। ছয়মাস ধরে দেখছি সম্পুর্ণ কুচকুচে কালো দাড়ি। আর মাথার সব চুল ও কালো। কী এক ভেলকি,বাবারে বাবা।মিনারার এই নিবিড় প্রতিবেদন শুনতে শুনতে ক্লান্ত রুবিনা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
হুম…..জগতের সকল প্রাণী সুখি হোক,শান্তিতে থাকুক।
নাইমুজ্জামানকে কমনরুমে ঢুকতে দেখে দ্রুত তিনি বেরিয়ে যেতে পা বাড়ালেন।
–ফেসবুক পড়তে পড়তে আজকাল সবাই নোটিশ বুক পড়তে ভুলে যায়, আপনারা দুজন নোটিশ খাতায় সাইনটা করলে কৃতার্থ হবো,ম্যাডাম। কাল থেকে খাতাটা এই অবস্থায় পড়ে আছে।
নিজের ডেস্কে বসার আগে পাখাটা ছেড়ে একগ্লাস পানি খেলেন নাইমুজ্জামান। মানিব্যাগ আর মোবাইল টেবিলে রেখে আরাম করে পা দুটো লম্বা করে বসলেন। আজ আর ক্লাশ নেই। মিনারা এখনো মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত,রুমার চোখ পত্রিকার পাতায়। মেয়ের সাথে কথা হয়নি দুদিন,আজই ফোন করবে ভাবতে ভাবতে ফোনটা বেজে উঠলো।হেলান দেওয়া মাথাটা তুলে আবার রেখে দিল,ধরলোনা।কয়েক সেকেন্ড পর আবার রিংটোন বাজতে থাকলো। সামনের টেবিলে বসা দুজনের দিকে একবার তাকালো, মোবাইলটা হাতে নিয়ে বারান্দার দিকে এগিয়ে গেলো।ততোক্ষণে রিং বেজে বেজে থেমে গেছে।কয়েক গজ দূরের বাগানে গাঁদা আর ডালিয়া নিজেদের উজাড় করে দিয়েছে। এদিকটায় ছাত্র ছাত্রীদের আনাগোনা কম,মসজিদটা কাছেই। নাইমুজ্জামান মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে এবার ফোনটা নিজে করলো।
–হ্যাঁ,কেমন আছো? কোন সমস্যা হয়েছে, এতোবার ফোন করছো কেন? আমি তোমাকে কতোবার বললাম সকাল আর রাতে আমাদের কথা হবে,তবুও।আচ্ছা, এবার বলো….।
মোবাইলটা বুকপকেটে ঢুকিয়ে প্যান্টের পকেট থেকে রুমাল আর চিরুনি বের করলো। প্রথমে ঘাম মুছলো,এরপর টাকের দু’পাশের চুলে গোলমতো চিরুনিটা চালালো। গুনগন করে কিছু একটা গাইতে গাইতে সামান্য ঝুঁকে মাটিতে পড়ে থাকা বেলী ফুল নিয়ে কলেজ গেইটের বাইরে চলে এলো।পাঁচ ফুট আট ইঞ্চির দেহটা যখন আয়েশি ভঙ্গিতে হাঁটে,কাঁধের উপরের অংশটা সামান্য ঝুঁকে থাকে। ইদানিং বেশ রঙীন শার্ট গায়ে দেন।বয়স পঞ্চান্ন এর কাছাকাছি।শরীরের কোথাও বাড়তি মেদ নেই,স্বাস্থ্য বেশ ভালোই বলা যায়।বেলী ফুল তুলতে গিয়ে সেই যে ধরেছিলেন,”আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়েছিলে…’এখনো চলছে। কলেজের অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার সুযোগ পেলে হারমোনিয়াম সহজে ছাড়েননা।কেউ অনুরোধ করুক আর না করুক পরপর কয়েকটা গান তিনি করবেন। তার গান শুনলে মনে হবে, সব গানের একই সুর। সেটা জাতীয় সংগীত হোক অথবা আধুনিক গান। ছাত্র ছাত্রীরা মুখ টিপে এজন্য হাসে,তাতে কিছুই যায় আসেনা। পুষ্পিতার মা তার গানের জন্য পাগল ছিলেন বলেই তার বিশ্বাস। মৃত্যুর আগে অসুস্থ অবস্থায় দোয়া দরুদ যেমন পড়েছেন,তেমনি গানও শুনিয়েছেন প্রচুর।
পাঁচ মিনিটের হাঁটা রাস্তা শেষ হলেই সরকারী কোয়ার্টার।ঘরে ঢোকার আধ ঘন্টা পর রান্নার জন্য এক মহিলা আসে। এক ঘন্টার মধ্যে সব কাজ শেষ করে যখন চলে যায়,তখন থেকেই নাইমুজ্জামান একা। পরের দিন কলেজে না যাওয়া পর্যন্ত।মেয়ে থাকে ঢাকায় খালার বাসায়,ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। চট্টগ্রামে ইচ্ছে করেই ভর্তি হয়নি।
রাত আটটার দিকে জান্নাত কে ফোন করে,তার ছেলের খবরাখবর নেয়। ভাড়াটিয়া ঘরভাড়া দিল কিনা,পাশের ফ্ল্যাটে থাকা ছোটভাই বা তার পরিবারের কেউ এসেছিল কিনা জানতে চায়।-‘জামান সাহেব, মামুন সাহেবদের সাথে কথাবার্তা যতো কম বলা যায় ভালো, বুঝছো। কাল আসছি, দুদিন ছুটি নিলাম। বাস থেকে নেমে একটু বাজারে যাবো ঠিক করেছি। বহদ্দার হাটের গরুর মাংস, মাছ, সবজি ফ্রেশ।
অপর প্রান্তের কথায় মাথাটা আস্তে আস্তে নাড়ছে, মুখের ভেতর শব্দ করছে হু-হু-। দাড়িতে আঙুল বুলাতে বুলাতে বাম হাতটা দুপায়ের মাঝেখানে লুঙ্গির স্তুপের উপর রাখতেই দাঁতে দাঁতে একটু কিড়মিড় করে উঠলো।
-হা হা হা তোমার সব ঠিকঠাক আছে, এবার উপোস থাকতে হবেনাতো আমাকে? আচ্ছা, দেখবো। কাল আসছি, খোদা হাফেজ।
টিভি অন্ করে এই চ্যানেল সেই চ্যানেল ঘুরে পুরানো হিন্দি গানের চ্যানেলটায় চোখ স্থির হলো। নায়িকা সাধনার হিট গানগুলো একটার পর একটা চলছেই।হাই তুলতে তুলতে আধশোয়া শরীরটা পুরোপুরি ছেড়ে দিল বিছানায়।চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে,”তু যাহা যাহা চলেগা,মেরা সাঁয়া সাথ হোগা,মেরা সাঁয়া……মেরা সাঁয়া”
নাজমুন হাতে একটা বড় সাদা কাগজ নিয়ে পাশে এসে বসলো,তাঁতের শাড়িতে তাকে বেশ মায়াবী লাগে–‘রাঙামাটিতে বাড়ির কাজে কখন হাত দিবে,কিছু কি ঠিক করলে?বড়ভাইয়া আমার একাউন্টে পাঁচ লাখ টাকা জমা করেছে।আমার মায়ের রেখে যাওয়া ঐ টাকা পেয়ে গেছি, ওরা আমাকে ঠকায়নি। তুমিতো বলেছিলে টাকাটা পাবোনা আমি, দেখলেতো। এবার কাজটা শুরু করো,প্লিজ। আর এই দেখো, ছোট মামা বাড়ির জন্য এই ড্রয়িং টা করে দিয়েছে।কি হলো,কথা বলছো না কেন—‘
সুর করে বাচ্চা দুটো কাঁদছে কোথাও….ওঁয়া….ওঁয়া..ওঁয়াও। নাজু–নাজু, কে কাঁদছে ঐখানে,কার বাচ্চা কাঁদছে? নাইমুজ্জামান বালিশ থেকে মাথা তুলে বসলো।শাড়ির আঁচলে ধবধবেজোছনা নিয়ে চলে গেলো কেউ। অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছেনা, ইলেকট্রিসিটি নেই, সারা শরীরে ঘাম। পায়ে চটি ঢুকিয়ে বারান্দায় এলো। টিনের চালে দুপ্ দুপ্ শব্দ হলো কয়েকবার,অন্ধকারে দুই জোড়া চোখ জ্বলজ্বল করছে তখনো। মোবাইলের টর্চ জ্বালাতে গিয়ে দেখে, রাত সাড়ে দশটা। খানিক আগে দেখা নাজমুনকে বেশ স্পষ্টই মনে পড়লো,পরনে ঘোলাটে সাদা তাঁতের শাড়ি, হাতে বড় সাইজের একটা সাদা কাগজ। কোমর অব্দি লম্বা একটা বেনী তার, ছোট কপালে একটা কালো টিপ।
নাজমুনের মৃত্যুর পর মনে মনে খুব চাইতো, সে তার স্বপ্নের ভেতর অন্তত আসুক। কিন্তু কখনো সে আসেনি।কয়েকদিন যাবৎ স্বপ্নে ঘন ঘন আসছে।আবছা নয়,স্পষ্ট আলোয় আসছে। তার সাথে যেসব কথা হচ্ছে স্বপ্নে,সবকিছু মনে থাকছে। আজও এলো, কেন এলো,আড়াই বছর পর কেন….?
রাঙামাটির জায়গাটা তার চিকিৎসার খরচ চালাতে গিয়ে বিক্রি করে ফেলেছে,সেই কবে। খুব শখ করে জায়গাটা কিনেছিল তারা। দুইজনেরই সরকারী চাকরি, প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে লোন্ নিল নাজমুন। শোধও করেছে টাকাটা প্রতি মাসের বেতন থেকে। বাংলো ধাঁচের একটা বাড়ি করবে, চাকরি থেকে অবসর নিলে পাহাড় নদী ঘেরা এই ছোট্ট শহরটাতে এসে থাকবে। ততোদিনে মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দিবে-এমন কতো ইচ্ছাই ছিল নাজমুনের।
হঠাৎ মনটা খুব অস্থির হয়ে উঠলো। রান্নাঘরে গিয়ে প্লেটে ভাত নিয়ে খাওয়ার আর ইচ্ছে হলোনা তার। নাটি বিস্কুটের প্যাকেট খুলে তিনটা খেলো। তারপর দু’গ্লাশ পানি খেয়ে একটা সিগারেট ধরালো। কয়েক বার টান দিয়ে ফেলে দিল এশট্রেতে, বিস্বাদ লাগছে এটাও। ড্রয়ার থেকে ঔষধের বাক্সটা বের করে একটা ঘুমের ঔষধ খেলো, মনে হচ্ছে ঘুমের সমস্যা হবে আজ। ঘুম কম হলেই প্রেশারটা ঝামেলা করে।কাল আবার ফার্স্ট পিরিয়ড আছে। ক্লাশ শেষ করে বিকেলে দুই ঘন্টার জার্নি করে শহরের দামপাড়া বাসায় যাবে।
নাজমুনের রোগ নিয়ে কোন হেলাফেলা করেনি, স্কয়ারে চিকিৎসা করিয়েছে। দেশের চিকিৎসায় তৃপ্ত না হয়ে থাইলেন্ড ও নিয়ে গেলো চিকিৎসার জন্য। কিন্তু কোন লাভ হলোনা, তিনবছর যুদ্ধ করে হেরে গেলো। এই ঝড়ের তান্ডবে নাইমুজ্জামান লন্ডভন্ড হয়ে পড়লো, সকলেই তার সমব্যথী হলো তখন। স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য ভবিষ্যৎ এর কথা না ভেবে এতোটা ঝুঁকি নিতে কয়জনেই বা পারে।বন্ধু-বান্ধবদের অনেকে আর্থিক সাহায্য করতে চাইলো, কিন্তু কারো সাহায্য নেননি তিনি। একাই সামলেছেন সব, নিজেকে আর একমাত্র সন্তান পুষ্পিতাকে ও ।
প্রিন্সিপালের রুম থেকে বের হচ্ছেন মোতালেব সাহেব। দরোজার কাছেই দুজন মুখোমুখি হলো, নাইমুজ্জামান তাকে না দেখার ভান করে মাথা নিচু করে ঢুকছিল। কিন্তু এড়াতে পারলোনা। কেমন আছেন স্যার’ বলেই হেন্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন। চুপসে যাওয়া বেলুনের মতো মুখটার দিকে তাকিয়ে বললেন ‘আমাকে চিনতে পারেননাই বোধহয়,আমি ট্রেজারি অফিসে আছিলাম। আপনার স্ত্রীর সমস্ত টাকাপয়সা তোলার জইন্য কতো কষ্ট কইরলাম। সজ্জন মানুষ আপনি, আমার কষ্টটা পুষায়ে দিছিলেন।
হেন্ডশেকের পর রুমাল বের করে কপালের ঘামটা মুছলেন মুখটা বেঁকিয়ে।
–ওহহো, খেয়াল করিনি ভাই। যে ভ্যাপসা গরম পড়ছে, মাথা ঠিক থাকে? চিনবোনা কেন, কতো বড় উপকার করলেন আমার। কি খবর,ভালো আছেন? প্রিন্সিপ্যাল স্যারের এখানে কি কাজে….।
দরোজার সামনে থেকে সরে কয়েক গজ এগিয়ে গেলেন দুজন। মোতালেব সাহেব চারপাশটা একনজর দেখে নাইমুজ্জামানের আরো কাছে গিয়ে নিচুস্বরে বলতে লাগলেন–
আ–রে, বইলেন না। করিতো কিছু যে আমাদের হজম কইরতে হয়। স্যারের এক বন্ধুর স্ত্রী মারা গেছেন। তিনি আবার পোস্ট অফিসে ছাক কইরতেন। তার টাকাটা স্বামী তুইলছিলেন। লিখিত দিছিলেন যে আর বিয়া শাদী কইরতো ন। এখন আবার শাদী কইচ্ছেন। এইসব কতা পাঁচ কান হইতে কতোক্ষন। এগিন লই আলাপ কইরতে ডাকছিলেন। আইচ্ছা ভাই, অফিসে যাওন দরকার-আসলামুআলাইকুম।
গলাটা শুকিয়ে আসছে, কান থেকে গরম হাওয়া বের হচ্ছে। বুক ধরফর করছে বলে দ্রুত হাঁটতে পারছেনা।কোনমতে কমনরুমে ঢুকে চেয়ারে ধড়াস করে বসে পড়লো। আর দশ মিনিট পর ক্লাশ। নাইমুজ্জামানকে
আজকাল পছন্দ করেনা রুমা, আগে যে খুব একটা পছন্দ করতো তাও না। তবু সিনিয়র হিসেবে সম্মান দিতে চেষ্টা করতো।ক্লাশে না গিয়ে এভাবে চেয়ারে বসে থাকাটা অস্বাভাবিক লাগছিল বলে চেয়ার ছেড়ে ধীর পায়ে তার টেবিলের কাছে এলো।
–স্যারের কি শরীর খারাপ, ক্লাশের সময় হয়ে এলো।আপনি বললে আমার ক্লাশটা এখন সেরে ফেলতে পারি।পরের পিরিয়ডে না হয় আপনি আসেন।
টেবিলের ওপাশ থেকে কোন সাড়া না পেয়ে একটু ভয় পেয়ে গেল। কমনরুমের বাইরে এলো,দেখলো পিয়নটা কাছেই আছে।রুমে ঢুকে দরোজার পর্দা জানালার পর্দা সরিয়ে দিয়ে আবার এসে ডাকলো,স্যার…। একটা লম্বা শ্বাস ফেলে মাথাটা সোজা করে বসলো চোখ খুললো একগ্লাস পানি খেলো –না,ঠিক আছি। প্রেশারটা মনে হয় একটু বেড়েছে, ক্লাশে আমিই যাচ্ছি, ধন্যবাদ রুমা।চশমাটা টেবিলে রেখেই বের হয়ে যাচ্ছিলেন,দরজা থেকে আবার এসে নিলেন।
হোটেল রসনায় ভাত খেয়ে বাস ধরলেন আড়াইটায়,দেরি করলে অফিস ছুটির জ্যামে আটকে থাকতে হবে ঘন্টার পর ঘন্টা। তার উপর আছে ফ্লাইওভার নির্মাণের ভোগান্তি। এতো ফ্লাইওভার হচ্ছে তবু যানজট থেকে মুক্তি মিলছেনা।
ঘরে ঢোকার আগে মোড়ের দোকান থেকে দুটো চিপস্ আর একটা মেন্গো জুস্ নিলেন। জান্নাত এর ছেলেটা আজকাল তার আশেপাশে ঘুরঘুর করে, কিন্তু কাছে আসেনা। কয়েকবার বাবা ডাকতে শিখিয়ে দিয়েছিল ওর মা।এই ছেলের সাথে ভাব জমাতে হবে, সম্পর্ক ঠিক না রাখলে নিজেরই ক্ষতি।বুড়ো বয়সে তাদেরকে দেখবে এই ছেলেই-এসব ভাবতে ভাবতে দরজার বেল বাজালেন নাইমুজ্জামান।
দরজা খুলেই জান্নাত হাসলো, বাজারের ব্যাগটা হাতে নিয়েই ‘আবির….বাবা আবির…. ডাকতে ডাকতে রান্নাঘরের দিকে গেল। বাজারের ব্যাগ রেখে ছেলের হাত ধরে নিয়ে এসে দাঁড়ালো,–যাও বাবার কাছে যাও।দেখো বাবা কি কি এনেছে তোমার জন্য।
বেসিনের সামনের আয়নায় কয়েক মুহুর্ত নিজেকে দেখলো। কপালের কাছের কয়েকটা চুল আঙুল দিয়ে সরিয়ে দিল,ঠোটের কোণায় লেপটে যাওয়া লিপস্টিক মুছে নিল। নতুন সংসারে তিন মাস পার করে দিল, এখনো বুঝে উঠতে পারেনি স্বামীর ভালো লাগা মন্দ লাগা। কেমন অদ্ভুত মানুষটা, কারো সামনে তাকে নিয়ে যেতে চায়না। গত তিন বছর আবীরকে নিয়ে একাই কাটালো, এখনো বলতে গেলে বেশিরভাগ সময় একাই কাটাতে হয়।
শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে তাকালো মা-ছেলের দিকে।ছেলের গায়ের রঙ জান্নাতের মতো,ধবধবে ফর্সা।শার্ট আলনায় ঝুলিয়ে আবিরের কাছে এলো-চিপস্ আর জুস্ হাতে দিয়ে ছেলেকে নিয়ে বসলো বিছানায়। তুমি আমার বাবা,মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বউয়ের দিকে তাকালো একটু। চোখে কাজল,হালকা ফেইস পাউডার মেখেছে সে। জান্নাতের সাজগোজ দেখে মনে মনে বেশ খুশি নাইমুজ্জামান।ছেলেকে বিছানা থেকে নামিয়ে নিতে ইশারা করে বললো,”যাও বাবা,টিভি দেখে দেখে চিপস খাও। একটু পর বাবা তোমাকে মজার মজার গল্প শুনাবো”।
আবীর বের হয়ে যেতেই বললো-বেশি রাত করোনা,তাড়াতাড়ি খেতে দিও ওকে। এখানেই ঘুম পাড়াবে আপাতত, নয়তো ঝামেলা করবে। ঘুম ভারী হলে পাশের রুমে শুইয়ে দিব আমি।
ওজু করে এসে জায়নামাজ বিছাতে যাবে,এমন সময় মোবাইল বেজে উঠলো।
-আসলামু আলাইকুম হাফিজ ভাই,কি খবর আপনার,অনেকদিন যোগাযোগ নেই।
অপর প্রান্তের কথায় মাথা নাড়তে নাড়তে,
-মেয়ের বিয়ে শুক্রবার,আলহামদুলিল্লাহ। অবশ্যই আসবো,জ্বি ধন্যবাদ।
মুখটা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলো নাইমুজ্জামানের। মাথা না ঘুড়িয়ে চোখের কোণে তাকালো একবার।
–কী বলছেন এসব,আপনার ভাবীকে কিভাবে বিয়েতে আনবো? ঠাট্টা করছেন কেন ভাই, ভাবী কোথায় পাবো?
এসব কথা কে বললো আপনাকে,বিয়ে করলে আপনাদের জানাতাম। আচ্ছা, দেখা হবে শুক্রবার। ভালো থাকবেন।
টেবিলে মোবাইল রাখতে রাখতে বিড়বিড় করছে-মানুষের খেয়েদেয়ে কোন কাজ নেই আর, সারাক্ষণ কেবল আরেকজনের ঘরের খবর নিতে ব্যস্ত।
জান্নাত কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আলনার কাপড় ভাঁজ করছিল, কথাগুলো তার কানে এলো। বিছানার উপরে রাখা লুঙ্গি, প্যান্ট,গেঞ্জি কিছুই আর আলনায় রাখা হলোনা -আপনি উনার সাথে মিথ্যা বললেন কেন, বিয়েতে আমাকে নিয়ে গেলে আপনার সমস্যা কোথায়? আগেও আমি খেয়াল করেছি বিষয়টা। কেন… কেন আপনি আমাকে নিয়ে কোন অনুষ্ঠানে যেতে রাজী না?
নাইমুজ্জামান কথার জবাব না দিয়ে জায়নামাজে দাঁড়িয়ে গেল। জান্নাতের চোখের কাজল ধুয়ে যাচ্ছে। রুম থেকে বের হয়ে রান্নাঘরের পাশের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো।গাছের একটা পাতাও নড়ছেনা। বিপরীত দিকের দোতলা বাড়িটার সামনে খোলা জায়গায় কুকুরটি কিছুক্ষণ পরপর ঘেউ ঘেউ করছে। অল্প বয়সের একটা ছেলে মূল ফটকের বাইরে দাঁড়িয়ে মাথা তুলে উঁকি দিল। বাইরের সাইনবোর্ডে লেখা আছে “কুকুর হইতে সাবধান”। ঐদিকে তাকিয়ে জান্নাতের চোখের জল ঠোঁটের কিনারায় আসতেই, হাসির রেখাটা হঠাৎ বেঁকে গেল। মনে মনে ভাবলো, সাইনবোর্ডে লেখা প্রথম শব্দটি পাল্টানোর সময় এসে গেছে।
সাবিনা পারভীন লীনা : কবি ও গল্পকার।