লুইস গ্লাকের দশটি কবিতা।। পান্থজন জাহাঙ্গীর অনূদিত।। পুবাকাশ
১.টেলিস্কোপ
তোমার দৃষ্টি সরে নেওয়ার পরও একটি মুহুর্ত থাকে
যখন তুমি ভুলে যাও তুমি কোথায়
কারণ তুমি বেঁচে ছিলে,মনে হয়,
অন্য কোথাও,রাতের আকাশের নিস্তব্ধতায়।
পৃথিবীর এইখানে আর তুমি নেই।
তুমি আছো ভিনগ্রহে,
যেখানে মানবজীবন অর্থহীন
তুমি আর মূর্ত কোনও প্রাণী নও।
নক্ষত্ররা আছে বলেই তুমি আছো,
তাদের জড়তা,আর বিশালতায় মিশে আছো
তারপর তুমি আবারও পৃথিবীতে ।
রাতের,ঠান্ডা পাহাড়ে,
টেলিস্কোপকে আলাদা করে নিচ্ছো।
পরে তোমার সম্বিৎ ফিরে
ওই চিত্রটি মিথ্যা নয়
তবে সম্পর্কটি মিথ্যা।
তুমি আবার দেখতে পাবে
প্রতিটি বস্তু অন্য বস্তু থেকে কত দূরে।
২.সুখ
একটি সফেদ শয্যায় একজন মানব ও মানবী শুয়ে আছে।
এটা ভোর,আমি মনে করি
শীঘ্রই তারা জেগে উঠবে,
শয্যার পাশে টেবিলের উপর একটি ফুলদানি।
শালুকের সূর্যালোকে
তাদের গলায় ঝর্ণা বয়ে যায়,
তার দিকে ঘুরে আমি তাকে দেখি
যেন তার নাম ধরে ডাকি।
কিন্তু নৈ:শব্দের গভীরে তার মুখ-
জানালার শার্শীতে
একসাথে একবার, দুবার,
একটি পাখি ডাকছে,
এবং তারপর সে আড়মোড়া দিয়ে জাগে
নি:শ্বাসে নি:শ্বাসে ভরে নেয় দেহ,
আমি চোখ খুলছি,তুমি আমাকে দেখছো।
প্রায় পুরো কক্ষে
রোদ ঝলমলে।
তোমার মুখের দিকে তাকাতে বললে,
তোমাকে ছুয়েঁ নিজেকে আয়না বানাতে
আরো কাছে এনে রেখেছি,
তুমি কত শান্ত!
এবং বামিং হুইল রোডটি আলতো করে আমাদের উপর দিয়ে চলে যায়।
৩.তুষারপাত
তুমি কি জানো আমি কী ছিলাম, কেমন ছিলাম?
তুমি জানো হতাশা কি; তারপর তোমার জন্য
শীতের অর্থ থাকা উচিত।
আমি বেঁচে থাকার আশা করিনি,
পৃথিবী আমাকে দমন করছে। আমি আশা করিনি.
আবার জেগে ওঠার, অনুভব করার,
স্যাঁতসেঁতে পৃথিবীতে আমার দেহ
স্মরণ করে আবার সাড়া দিতে সক্ষম হবে।
এতদিন পর আবার কীভাবে খুলবো
শীতল আলোতে
নব বসন্ত,
ভয় করছো,এখনও,কিন্তু আবার তোমার মধ্যে
বিলাপ, হ্যাঁ,বিপদের মধ্যে আনন্দও আছে
নতুন বিশ্বের দুর্মর বাতাসে।
৪.আদিম অন্ধকার
তোমরা কিভাবে বলতে পারো
পৃথিবী আমাকে আনন্দ দেবে?
প্রতিটি জিনিসই আমার বোঝা
আমি তোমাদের সবার সাথে সফল হতে পারি না।
এবং তোমরা আমাকে থামিয়ে দিতে চাও,
তোমরা আমাকে বলতে চাও
তোমাদের মধ্যে কে সবচেয়ে মূল্যবান,
কে আমার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।
এবং তোমরা একটি উদাহরণ হিসাবে তুলছো
বিশুদ্ধ জীবন বিচ্ছিন্নতা অর্জনের তোমরা সংগ্রাম করছো।
তোমরা আমাকে কীভাবে বুঝতে পারো
নিজেরাই যখন বুঝতে পারো না?
তোমাদের স্মৃতিশক্তি যথেষ্ট প্রখর নয়-
তোমরা কখনই ভুলো না তোমরা আমার সন্তান,
একে অপরকে ছুয়েঁ আছো বলে কষ্ট পাচ্ছো না।
তবে তোমরা জন্মগ্রহণ করেছো বলে
কারণ তোমাদের আব্যশক জীবন
আমার থেকে পৃথক।
৫.প্রেমের কবিতা
সবসময় ব্যথা থেকে কিছু তৈরি করা যায়।
তোমার মা বুনে যায়,
সে লাল রঙের প্রতিটি ছায়ায় স্কার্ফ বের করে।
তারা ক্রিসমাসের জন্য ছিল এবং তারা তোমাকে আদরে রেখেছিল
যখন তোমাকে সাথে নিয়ে সে একের পর এক বিয়ে করে যাচ্ছিল,
এটা কিভাবে পারছিল?
যখন সমস্ত বছরগুলো সে তার বৈধব্য হৃদয়ে জমা রেখেছিল
যখন মৃত্যুর প্রত্যাবর্তন হয়েছিল,
অবাক হওয়ার কিছু নেই, তুমিও সেই পথের পথিক।
রক্ত হিম হয়ে আসে,তোমার মা
একের পর এক ইটের দেয়ালের মতো।
৬.ডুবে যাওয়া শিশুরা
তোমরা দেখো,তাদের কোন বিবেচনাবোধ নেই।
সুতরাং তাদের ডুবে যাওয়া স্বাভাবিক,
প্রথমে তুষার তাদের ভিতরে নিয়ে যাবে
এবং তারপরে, সমস্ত শীতকালে,
তাদের পশমের স্কার্ফ ডুবে যাওয়ার সাথে সাথে
তাদের পিছনে ভেসে বেড়াচ্ছে,
তারা নি:সাড় হওয়া পর্যন্ত ।
এবং পুকুরটি তার অজস্র তমস বাহু দিয়ে তাদের তুলে দেয়।
কিন্তু মৃত্যু অবশ্যই তাদের কাছে ভিন্নভাবে আসবে,
শুরুতে এত কাছে,
যেন তারা সর্বদা ছিল অন্ধ এবং ওজনহীন।
অতএব বাকিরা স্বপ্ন দেখে, লন্ঠন সফেদ কাপড়,
টেবিলটিকে ঢেকে দেয়,ঢেকে দেয় তাদের দেহগুলো,
এবং এখনো তারা তাদের ডাকা নামগুলি শুনে
লোরের মতো পুকুরে পিছলে পড়ে যায়;
তুমি কিসের জন্য অপেক্ষা করছো
ঘরে এসো, ঘরে এসো,
নীল আর স্থায়ী জলে,বিলীন হয়ে গেলো তারা।
৭.মশকরা কমলা
তোমাকে বলছি, এটি চাঁদ নয়।
এইগুলি সেই ফুল
যেগুলো উঠোনকে আলোকিত করছে।
আমি তাদের ঘেন্না করি।
আমি তাদের ঘেন্না করি,যেমন ঘেন্না করি যৌনতাকে,
লোকটির ঠোঁটকে,
নিজের মুখটিকে সেলাই করে দিয়ে,নি:সাড় করি লোকটির দেহ
এবং সর্বদা বলাৎকারের উঠোন
থেকে দল বেধেঁ নিচু হয়ে
চিৎকার পালিয়ে যায়,
আজ রাতে মনের মধ্যে একটি প্রশ্নটি শুনেছি
এবং উত্তরটির পেছনে ধাবিত হচ্ছি,
এক শব্দে মিশ্রিত জবাবটি
আরোহণ করছে আর করছে এবং তারপর
বার্ধক্য নিজেদের মধ্যে গড়িয়ে পড়ছে।
ক্লান্ত বৈরিতা। তুমি কি দেখছো?
আমরা বোকা হয়ে গেছি।
এবং মশকরা কমলার সুঘ্রাণ চড়িয়ে যাচ্ছে
জানালা দিয়ে।
আমি কীভাবে বিশ্রাম নিতে পারি?
আমি কীভাবে খুশি থাকতে পারি?
যখন এখনও পৃথিবীর মধ্যে
সেই গন্ধ চড়িয়ে যাচ্ছে।
৮.পুকুর
রাত্রি তার ডানা দিয়ে ঢেকে রাখে পুকুরটিকে।
বৃত্তাকার চাঁদের নীচে আমি তোমার চেহারা বানাতে পারি
তোমার মুখ ছোট এবং ক্ষুদ্র প্রতিধ্বনিত নক্ষত্রের মধ্যে সাঁতার কাটছে।
রাত্রির হাওয়ায় পুকুরের পৃষ্ঠটি ধাতু হয়ে যায়।
তোমার খোলা লোচনে আমি তাদের একটি স্মৃতি চিহ্নিত করতে পারি,
যেমন আমরা একসাথে শিশু ছিলাম।
আমাদের ঘোড়াগুলো পাহাড়ে চরছিল,
ধূসর রঙের ওপর তাদের শাদা দাগ ছিল ।
তারা এখন মৃতের মতো ঘাস খাচ্ছে,
তাদের গ্রানাইট স্তনের প্লেটগুলির নীচে,
সুন্দর এবং অসহায় বাচ্চাদের মতো
যারা অপেক্ষা করছিল:
পাহাড়গলো অনেক দূরে। তারা উঠে যায়
শৈশবের চেয়ে অধিকতর কালো
জলের মধ্যে নিরবে শুয়ে থেকে,কি ভাবছো?
যখন তুমি চেয়ে থাকো ঐ পথের দিকে,
অন্য এক জীবনে আমরা একই রক্তের ছিলাম দেখে,
আমি তোমাকে ছুঁতে চাই,
কিন্তু পারিনা।
৯. জ্ঞান
তারা দুজনেই ছিলেন নিরব-নিস্তব্দ,
মহিলাটি শোকগ্রস্ত, পুরুষটি
তার দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ।
কিন্তু ঈশ্বর দেখছিলেন।
তারা তাঁর অভ্রলোচন অনুভব করেছিল
প্রাকৃতিক দৃশ্যে পুষ্প উন্নয়ন দেখে।
কে জানতো তিনি কি চেয়েছিলেন
তিনি ছিলেন ঈশ্বর এবং প্রকান্ড
তাই তারা অপেক্ষা করেছিল
এবং এই পৃথিবী তিনি প্রজ্ঞা দিয়ে পরিপূর্ণ করেছিলেন
যেমন করে তিনি বুঝতে চেয়েছিলেন।
অনেক দূরে, তিনি যে শূন্যতা রচনা করেছিলেন
সেখানে তিনি তাঁর ফেরেশতাদের দিকে ফিরে গেলেন।
১০.নিশাচর
একটি বন পৃথিবী থেকে উত্থিত।
হে করুণাময়, তাই প্রয়োজন ’ঈশ্বরের উষ্ণ ভালবাসা
তারা একসাথে জন্তু ছিল।
তাঁর অবহেলার সন্ধ্যায় একসাথে শুইয়ে থাকে;
তাদের আতঙ্ক
পাহাড় থেকে যান্ত্রিকভাবে নেকড়ে এসেছিল
তাদের মানবিক উষ্ণতায় আকৃষ্ট হয়ে,
তখন ফেরেশতারা দেখলো
তিনি কিভাবে তাদের ভাগ করেছেন:
পুরুষ, মহিলা এবং মহিলার দেহকে।
মন্থিত শিলার উপরে, একটি ধীরে গলে যাওয়া
রূপার মধ্যে পাতাগুলো ছেড়ে দাও।
লুইস গ্লাক:
এই বছর(২০২০)সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন পোয়েট লরিয়েট,
( Faithful and Virtuous Night ) কবিতার জন্য ন্যাশনাল বুক এ্যাওয়ার্ড বিজয়ী এবং তার সাম্প্রতিক
কল্পবিজ্ঞান, কবিতা: ১৯৬২-২০২১২ সহ এক ডজনেরও বেশি কাব্য গ্রন্থের লেখক। পুলিৎজার পুরস্কার বিজয়ী
রবার্ট হেস তাকে ‘সাম্প্রতিক লেখার সবচেয়ে শুদ্ধ ও সর্বাধিক দক্ষ গীতি কবি’ বলে অভিহিত করেছেন। গ্লাক ২০ বছর ধরে উইলিয়ামস কলেজে অধ্যাপনা করেছেন এবং বর্তমানে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের রোজনক্র্যাঞ্জ আবাসিক লেখক। তিনি আমেরিকান আর্টস অ্যান্ড লেটার্স একাডেমির সদস্য এবং ১৯৯৯ সালে আমেরিকান কবিদের একাডেমির চ্যান্সেলর নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁর অসংখ্য কবিতার বইয়ের মধ্যে রয়েছে অ্যা ভিলেজ লাইফ (২০০৯), দ্য সেভেন এজ (২০০১) এবং দ্য ওয়াইল্ড আইরিস (১৯৯২), যার জন্য তিনি পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছিলেন।
পান্থজন জাহাঙ্গীর : কথাশিল্পী, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক।