ময়ুখ চৌধুরীর প্রাসঙ্গিকতা ।। মিজান বিন মজিদ
২২ অক্টোবর নিয়ে স্যারের উচ্ছ্বাসের চেয়ে বেদনা বেশি দৃষ্টিপাত হয়েছে শ্রেণিকক্ষে। তাঁর প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশের প্রয়াণ দিবসও এই ২২ অক্টোবর। একজন পিওর পয়েটের তিরোধান আর একজন প্রাজ্ঞ কবি ও অধ্যাপকের আগমন কাকতালীয়ভাবে সমতারিখে ঘটলেও এর অন্তর্গত ব্যঞ্জনা আছে। অবশ্য আমাদের মতন শ্যালোরিডার এই গুপ্তব্যঞ্জনের বাখান উপস্থাপন কতটা করতে পারবো সন্দেহ আছে!
চবি বাংলা বিভাগের ক্লাসঘর সময়ে সময়ে রূপ পাল্টেছে। কখনোসখনো স্বর্গীয় উদ্যানের নন্দনকানন মনে হয়েছে সাহিত্যরসের উজ্জ্বল উচ্চারণে। আবার বিরসবদনে পরীক্ষায় বসবার কষ্টকসরতরত অর্বাচীন বিদ্যার্থীর সামনে ডাইরি খুলে,চোখ না তুলে লাইনের পর লাইন আওড়ানোর বেদনাদীর্ণ ছবিও ভেসেছে…। প্রথম বর্ণনায় যে প্রতিভাস চিত্রিত করেছি,তারই এক অত্যুজ্জ্বল ক্লাসে স্যার আনন্দ করেছিলেন এই বলে,
” তাঁর পরলোকগমন আর আমার আগমন একই দিনে হবার মধ্যে প্রকৃতির কোন খেয়াল থাকতে পারে!স্প্রিন্টের বাটন চেঞ্জের মতন…।” কথাগুলোকে নিজের ভাষায় উপস্থাপন করেছি। তিনি যখন এই আলাপের মধ্যে সন্তরণ করছেন, মুখাবয়ব ছিলো প্রোজ্জ্বল।
ময়ুখ চৌধুরীকে একটা ক্ষুদ্রকায় নিবন্ধে তুলে আনা অসম্ভব বললে, ভুল হবে। তাঁর দুটো অবিনাশী সত্তা আছে। অধ্যাপক ও কবি। তিনি কবি হিসেবে পরিচিত হতে বেশি পছন্দ করেন। আমরা, তার সাক্ষাৎ শিষ্যরা তাঁকে শিক্ষক, প্রশিক্ষক, প্রভাষক, অধ্যাপক, গবেষক, দার্শনিক হিসেবে ব্যক্ত করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। কারণ, তাঁর কবিত্ব সবার সম্পত্তি। স্যারের কবিত্ব তাঁর সম্পদ। আমাদের কাছে তিনি অতুল অধ্যাপক। বিশেষত, যারা বাংলাবিকিয়ে টিকিয়ে রাখেন জীবিকা তাঁরা আমার বর্ণনায় সহমত পোষণ করবেনই!
আজকেও স্যারের অনেকগুলো কবিতা পড়েছি। কিন্তু দেড় যুগ আগে করে আসা এক একটা ক্লাসকে মনে হচ্ছে শতকবিতার চেয়ে নস্টালজিক ও অজর। ক্লাস করতে অনিচ্ছুক, অথচ সাহিত্যানুরাগী কেউ যদি ময়ুখমৌচাকে একবার ঢুঁ মারতেন…। দুপুর গড়িয়ে বিকেল,মাঝেমধ্যে সন্দ্যাবধি তাঁর বাক্যনিচয়ে বুঁধ পুরাতন কলাভবনের কোন কোন কক্ষ…। গরহাজিরার ভয়, পানিশমেন্ট দেয়ার অভিনব কৌশল উদ্ভাবন করেও বিমুখ যেসব বিদ্যার্থী তাদের কাছে ময়ুখক্লাস হতে পারতো মস্তবড় নিদান।
স্যারের গাম্ভীর্য সৌকর্য আর দেদীপ্যমান চাহনি সাধারণ চোখে পড়বে, মননে পৌঁছুবে না। কত অযোগ্য লোকের পদে পদবীতে পদকে বিব্রত স্যারেরই আশপাশ! অথচ নির্বিকার তিনি সাধনা করে চলেছেন নির্লোভ অন্বেষণ জারি রেখে। বাক্যগুলোকে দুইবার পড়তে হবে, মনের মগজ দিয়ে! ব্যাকরণ এইখানে গৌণ, ব্যক্তিই মুখ্য…।
কেউ কেউ কালেভদ্রে আমার কথার শংসায় ছফাকে আনেন, ময়ুখকে টানেন। কলেজে পড়াচ্ছি যুগ পেরিয়েছে। কিন্তু এই দুইজনের ধারেকাছে ঘেঁষার কোন লক্ষণ দেখছি নে। লোকে যে ভুলে, অজ্ঞতায়, অনবধানতায় এইসব বলে সেটাই পরম প্রাপ্তি আমার মতন অনেকেরই। নয় কী!
জন্মদিনের আন্তরিক ও সশ্রদ্ধ শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করছি। তাঁর দীর্ঘায়ু যাচি, একটা কারণে ; অজস্র অজ্ঞের মুখ বন্ধ থাকবে তাঁর উপস্থিতিতে!
মিজান বিন মজিদ : সহকারী অধ্যাপক, বাঙলা বিভাগ, মীর্জাপুর ক্যাডেট কলেজ।
আরো লিখতে পারতেন। গদ্যোর হাত ভালো