মুর্তজা বশীর: স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল
মুজিব রাহমান
মুর্তজা বশীর, স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল ও স্বকীয়তায় বিশিষ্ট এক অনন্য শিল্পী, আর নেই।
আমার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন কতোবার যে স্যারকে দেখেছি। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লার পুত্র মুর্তজা। আমার কাছে এটিও একটি বড় আকর্ষণ ছিলো তখন। আজ স্যারের মৃত্যু সংবাদ পড়তেই শিল্পী মুর্তজা বশীরের হেঁটে বেড়াবার মূর্তরূপ আবার চোখে ভেসে ওঠলো।
চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমিতে কবিদের কোন একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছি। হঠাৎ-ই ডাক পড়লো মুর্তজা বশীরের। মঞ্চে ওঠে তিনি তাৎক্ষণিক উচ্চারণ করলেন মন্ত্রোপম দু পঙক্তি-
‘ফুটলেই ঝরে যাবে
তাই ফুটলে না’। (স্মৃতি থেকে)
বাংলাদেশের চিত্রকলা আন্দোলনের এই অগ্রণী ব্যক্তিত্ব
‘আলট্রামেরিন’-এর মতো আত্মজৈবনিক উপন্যাস লিখেছেন।
তাঁর বাংলা কবিতা তিনি নিজেই ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। এই স্ব-অনূদিত কাব্যগ্রন্থটির নাম তিনি রেখেছিলেন Fresh Blood, Faint Line ( টাটকা রক্তের ক্ষীণ রেখা)।
তাঁর উল্লেখযোগ্য দুটো বই হলো:
১. মুদ্রা ও শিলালিপির আলোকে বাংলার হাবশী সুলতান ও তৎকালীন সমাজ।
২. মুর্তজা বশীর মূর্ত ও বিমূর্ত।
‘ত্রসরেণু’ মুর্তজা বশীরের প্রথম কাব্যগ্রন্থ।
‘তোমাকেই শুধু’ এবং ‘ফিরে এসো অনসূয়া’ তাঁর আরো দুটি কাব্যগ্রন্থ।
‘কাচের পাখির গান’ তাঁর প্রথম গল্পের বই।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর এই মেধাবী ছেলেটি ছিলো ডানপিটে। একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ছেলেকে বলেছিলেন, “ইউ আর মাই সান, আইদার নটোরিয়াস অর ফেমাস, ডোন্ট বি মিডিওকার।”
মুর্তজা বশীর বাবার কথা রেখেছেন। ফেমাস হয়েছেন।
মুর্তজা বশীর তাঁর একটি সাক্ষাতকারে স্মৃতিচারণ করে বলেছেন –
” আমি পিওনের হাত থেকে চিঠিটা নিলাম। দেখলাম চিঠিটা আমার। বগুড়া থেকে লেখা কোন এক সহপাঠীর। আমি বাবাকে বললাম, চিঠিটা আমার। বাবা বিস্ময়াভিভূত হয়ে বললেন, মুর্তজা বশীর তুমি? আমি বললাল, হ্যাঁ। আমি আপনার নামে পরিচিত হতে চাই না। আমার পুরো নাম যেভাবে আমার সমস্ত শিক্ষা সনদপত্র- সার্টিফিকেটে রয়েছে, তাতে লেখা আবুল খায়ের মুর্তজা বশীরুল্লাহ। ১৯৫২ সাল অবধি আমি মুর্তজা বানানে ম-এর নিচে দীর্ঘ ঊ-কার দিতাম। আমার পিতা আমার হাত থেকে চিঠিটা নিলেন এবং তিনি বললেন মূর্খের দীর্ঘ ঊ-কার হয়। তুমি তো মূর্খ নও। তুমি লিখবে ম’তে হ্রস্ব উ-কার দিয়ে।
এভাবে আমি মুর্তজা বশীরে রূপান্তরিত হয়ে গেলাম।”
উল্লেখ্য, মুর্তজা ছিলেন সমকালীন বিশ্বের একজন আধুনিক শিল্পী। আধুনিক শিল্প বিমূর্ত হয়। কিম্ভূতকিমাকার হয়। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ মুর্তজার কিম্ভূতকিমাকার ছবি আঁকাআঁকি দেখে জানতে চেয়েছিলেন তার আঁকা ছবি এতো কিম্ভূতকিমাকার কেন?
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ চাননি তাঁর ছেলে শিল্পী হোক। এ জন্যে ঢাকায় আর্ট ইনস্টিটিউটে ভর্তির সময়ে আপত্তি জানিয়ে বলেছিলেন –
” আমি প্যারিসে ছিলাম। শিল্পীদের জীবন দুঃখ-কষ্টে ভরা। আমি চাই না তুমি আমার সন্তান সে-রকম অর্থকষ্টে, অনাহারে থাকো। তারপর আমার একগুঁয়েমির কাছে তিনি তাঁর তালাবদ্ধ আলমারি খুলে ল্যুভর মিউওজিয়ামের সেই দুই খণ্ড বই আমার হাতে দিতে দ্বিধাবোধ করলেন না। বইয়ে ছিল বেশ কিছু বিবস্ত্র নারীর চিত্র। সেই রাতে আমার পিতা Dead Lizard অর্থাৎ এই মৃত টিকটিকির ছবির সম্পর্কে বললেন, আমি জানি না এই ছবিতে কী আছে, তবে ছবিটা আমাকে খুব আলোড়িত করেছে। আমি জবাবে পিতাকে বললাম, আমি আপনি সবাই অশরীরী, প্রেতাত্মা। তিনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, তা হয়তো হবে।”
১৯৬১ সালের শেষে লাহোর থেকে ফিরে সমাজের অবক্ষয়ের রূপক হিসেবে ‘ডেড লিজার্ড’ ছবিটি এঁকেছিলেন মুর্তজা আর তখনি তা প্রদর্শিত হয়েছিল বাংলা একাডেমিতে সমকালীন শিল্পীদের একটি প্রদর্শনীতে।
ক্লাস টেনে পড়াকালীন করতোয়া নদীতে ডুবে বন্ধুর মৃত্যু তাঁর অস্তিত্বের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল। তিনি লিখেছেন —
” আমার তখন ভীষণ ভয় করছিলো। পৃথিবী এতো সুন্দর! অথচ এই পৃথিবী থেকে আমাকেও চলে যেতে হবে, তখনই আমার প্রাণে ভীষণভাবে ইচ্ছা হলো আমি বেঁচে থাকব। আমি বেঁচে থাকতে চাই। মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকতে চাই। সেভাবেই আমার শিল্পী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা।”
কতো কথা-ই না আছে শিল্পীর জীবন ঘিরে!
মুজিব রাহমান: সহযোগী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, চট্টগ্রাম কলেজ।