মজিদ মাহমুদ
বছর চারেক আগে মহাশ্বেতা দেবী প্রয়াত হয়েছেন, কিন্তু পরিবর্তন হয়নি কিছু। তার জীবনাদর্শ, বৈষম্যহীন সমাজের আকাঙ্ক্ষা আর লেখক হিসেবে পরিশ্রমী কর্মকাণ্ড আমাদের সামনে রয়ে গেছে। তাকে পাঠ বর্তমান সমাজ–বাস্তবতায় আরো জরুরি হয়ে পড়ছে।
যারা শুধু লিখতে এসেছিলেন, লেখার সঙ্গে জীবনকে বেঁধে ফেলেছিলেন, লেখার জন্য নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন, যাদের জীবন ও লেখা একাকার হয়ে গিয়েছিল, যাদের সৃষ্ট চরিত্রের সঙ্গে তাদের জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল– তাদেরই একজন মহাশ্বেতা দেবী। লেখক পরিবারে, লেখার পরিবারে যাঁর জন্ম; বাবা মণীশ ঘটক– কবি, কল্লোল যুগের ডাকাবুকোদের একজন। কবিতা লিখছেন, গদ্য লিখছেন, অনুবাদ করছেন– সবখানেই তাঁর শৈল্পিক পদচারণা। মা ধরিত্রী দেবী– তিনিও কম যান না; কবিতা রচনার পাশাপাশি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়, নারীর অধিকার সচেতনতা নিয়ে কাজ করেছেন; তাঁরই মেজমামিমা অনিন্দিতা দেবী কবি অমিয় চক্রবর্তীর মা। বাবা ও মায়ের পরিবারে অনেকেই সাহিত্য শিল্পকলা ও সম্পাদনার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। সেদিক দিয়ে রাবীন্দ্রিক সাহচর্য তো ছিলই। এদিকে বাবার ভাই কিংবদন্তি চিত্রনির্মাতা ঋত্বিক ঘটক, স্বামী বিজন ভট্টাচার্য, সন্তান নবারুণ ভট্টাচার্য। সাহিত্যের জন্য এমন একটা পরিবার– এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায়। সেই মহাশ্বেতা দেবীকে নিয়ে দু’এক লাইনের এই ভূমিকা কখনো অবহেলার নয়। মহাশ্বেতার পরিবার, তাঁর শ্বশুরের পরিবার, কবি অমিয় চক্রবর্তীর পরিবার এসেছিলেন বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা পাবনা থেকে।
দীর্ঘ একটা জীবন– যিনি সাহিত্যের জন্য বিছিয়ে রেখেছিলেন, মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য, অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকণের জন্য যিনি সারাটা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন– তাঁকে নিয়ে যে কোনো আলোচনা কেবল শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের প্রয়াস ছাড়া কিছু নয়। ১৯৫৯ সালে প্রথম গল্প–সংকলন ‘কি বসন্তে কি শরতে’ প্রকাশের পর প্রায় ছয় দশক ধরে তিনি শতাধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। বিশেষ করে প্রান্তিক জীবন, ক্ষুদ্র–নৃগোষ্ঠীদের টিকে থাকার লড়াই, নিম্নবর্গের ইতিহাস আর আদি বাঙালির সংগ্রামী জীবন তাঁর রচনায় বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। তিনি উপন্যাস লিখতে গিয়ে যেমন নিছক উপন্যাস লেখননি, তেমনি নিরস ইতিহাস ও নীতি বর্ণনা তাঁর রচনার উদ্দেশ্য ছিল না। আমাদের জীবন ও সমাজের মধ্যে বেঁচে থাকার যেসব লড়াই সংঘটিত হয়ে ওঠে, আবার মিলিয়ে যায়, আবার নতুন লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হতে হয়– সে সবের একটি তাত্ত্বিক প্যারাডাইম তৈরি করার চেষ্টা করেছেন তিনি সারা জীবন। এ সব ক্ষেত্রে নিজের সাহিত্যিক–চেতনার সঙ্গে মার্কসীয় দর্শন, সার্ব–অলটার্ন হিস্ট্রি, গ্রামসির তত্ত্বকে কাজে লাগিয়েছেন।
তাঁর রচনা বিপুল বিষয়–বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ হলেও ১৯৭৪ সালে ‘হাজার চুরাশির মা’ রচনার আগে লেখক হিসেবে ততটা জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেননি। সত্তর দশকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নকশাল আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে এই উপন্যাসটি রচিত হয়। এটি উপন্যাস হলেও ‘ব্রতী’ নামের এক নিহত বিপ্লবীর জীবন–দর্শন ও তার আত্মোৎসর্গের কাহিনী নিয়ে এর আখ্যান রচিত হয়। যদিও এটি একটি উপন্যাস তবু এর মধ্যে রয়েছে লেখকের নিজস্ব জীবন–অভিজ্ঞতার ছাপ। নারী হিসেবে নানা অনাচারের সমাজ ও পরিবারের মধ্যে নিজের নিষ্ক্রিয় পর্যবেক্ষণ। এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ব্রতীর মা সুজাতার দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার– নারী হিসেবে একটু বাড়তি সুবিধা লেখক হিসেবে তিনি পেয়েছেন। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে নিহত এক হাজার চুরাশিতম বিচারবহির্ভূত হত্যাণ্ডের শিকার তরুণ বিপ্লবীকে নিয়ে এই উপন্যাসের আখ্যান রচিত হয়েছে। লেখক নিজেই মনে করেন তিনি ‘হাজার চুরাশির মা’ বইয়ের মধ্যে সেদিনের সে বিজয়গড়কে ধরে রাখতে পেরেছেন। বিজয়গড় কলেজে চাকরি সূত্রে তিনি ছিলেন এর কিছুটা প্রত্যক্ষদর্শী।
শ্রীনিকেতন কলোনির সেই গণত্যায় অনেকের সাথে ‘বিজিত গুপ্ত’ নামে যে ছাত্র নিহত হয়েছিল– ব্রতী চরিত্রের মধ্যে রয়েছে তার ছায়া। নকশাল দমনের নামে এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে কিছু একটা লেখার জন্য মহাশ্বেতা দেবীর কাছে অনুরোধ আসে। যদিও নকশাল আন্দোলনের ভোট না নিয়ে ক্ষমতায় আসার ব্যাপারটি লেখকের কাছে প্রশ্নবোধক হয়ে ছিল। তবু এইসব বিপ্লবীর সমাজের শ্রেণিবৈষম্যের বিরুদ্ধে মৃত্যুভয়হীন অভিযাত্রা লেখককে দারুণভাবে আলোড়িত করেছে। লেখকের মতে, ‘আমি সময়কে দলিলীকরণে বিশ্বাসী!’ বর্তমান ও ভবিষ্যতের মধ্যে যে পার্থক্য মহাশ্বেতা দেবী তার চিত্র নির্মাণ করে যান। আজকের বিজয়গড়। সেদিনের ‘লাশ ফেলার মাঠ’ আজকের গলফগ্রীন। ওই মাঠ নিয়ে তিনি লেখেন ‘অনন্ত খাটুয়া’ নামে একটি গল্প। বিজয়গড়ের কলেজের সামনের মাঠ নিয়ে লেখেন ‘এপার বাংলা, ওপার বাংলা’।
‘হাজার চুরাশির মা’ ও ‘অরণ্যের অধিকার’ মহাশ্বেতা দেবীর সর্বাধিক পঠিত ও আলোচিত উপন্যাস। নানা ভাষায় এ উপন্যাস দুটি অনূদিত হয়েছে। এই উপন্যাস দুটি রচনার প্রাক্কালে লেখক এই সত্যে উন্নীত হয়েছেন যে, ‘প্রকৃত খুনি কখনো হাতে বন্দুক ধরে না।’ এই সব হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের নায়করা সর্বদা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। হাজার চুরাশির মা উপন্যাসে মূলত তিনটি প্রধান চরিত্রে আন্দোলিত। সুজাতা, ব্রতী ও দিব্যনাথ। মা পুত্র ও পিতা। সমাজের তিনটি শ্রেণির প্রতিনিধত্ব করছেন তারা। একটি পরিবারের মধ্যেও যে নানা কায়েমী স্বার্থের উপস্থিতি, শোষক ও শোষিতের অবস্থান হতে পারে দিব্যনাথের পরিবার তারই উদাহরণ। বাড়ির কর্তা দিব্যনাথ ন্যায়–অন্যায়ের বালাই নেই, ব্যবসায়ের প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন, তার রয়েছে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সির অফিস, মদ্যপান ও বহুগামিতা, ক্লাব আড্ডা মর্যাদার প্রতীক হিসেবে মনে করেন। সমাজের কায়েমী ব্যবস্থাকে রক্ষা করা, নারী–পুরুষের অধিকারের মধ্যে ফারাক– এটি ঈশ্বর প্রদত্ত ন্যায় বিবেচনা করা– দিব্য চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। তার বড় সন্তান জ্যোতিও হয়েছে তার চরিত্রে হুবহু, তারও চাকরি ব্রিটিশ নামাঙ্কিত বড় কোম্পানিতে। এমনকি কন্যা নীপা তুলি নিজে ও তাদের স্বামী– পিতার চরিত্রের অনুরূপ। বহুগামিতা, মদ্যপান ক্লাবকালচার সোসাইটি করা– সবই শখের বশবর্তী হয়ে। অথচ এই নষ্ট সমাজের পাশেই যে অন্য একটি না–খাওয়া রোগশোকে আক্রান্ত, অন্যায়–অত্যাচারে অবহেলিত আরেকটি সমাজ রয়ে গেছে– সেদিকে তাদের ভ্রুক্ষেপ নেই। ব্রতী যে সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য আত্মাহুতি দিয়েছিল, তার পিতার কাছে তা ছিল অসম্মানের। এমনকি যে বিশ্বাসঘাতক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার জন্য ব্রতী ও তার সঙ্গীদের মৃত্যু ঘটেছিল– সেই তালিকা থেকেও নাম মুছে দিতে দিব্যনাথের কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। কারণ এমন একজন তথাকথিত সমাজ বহির্ভূত পুত্রের পিতা হওয়া তার জন্য অসম্মানের। এমনকি এ সব মেনে নেয়ার অর্থও এই শ্রেণির অবৈধ সুখবৈভব ভেঙে পড়া। তাই ‘স্মৃতি ফলকে সমু–বিজিত–পার্থ লালটুদের নাম নেই। ব্রতীর নাম তো থাকবেই না।’ কারণ ব্রতী সেই সমাজের না হয়েও সেই সমাজের জন্য কাজ করেছিল। আর ব্রতী হয়ে উঠেছিল মাদার চাইল্ড। মায়ের নীরব কষ্টের নীরব সাক্ষী। সুজাতা নামের যে নারী ব্রতীর মা– হারিয়ে ফেলেছিল নিজস্ব অস্তিত্ব। হয়ে উঠেছিল এই সমাজ রাষ্ট্র পরিবারের অনুগত, অনুগামী নীরব অস্তিত্বহীন। সেই ব্রতীই তার অস্তিত্বকে আবার ফিরিয়ে দিয়েছিল। অথচ সেই মুক্তির দশকে এক হাজার তিরাশিজনের পরে সেও নিহত হয়েছিল– বন্ধুদের রক্ষা করতে গিয়ে যাদের বিশ্বাস করেছিল তাদের বিশ্বাস ঘাতকতায়। সেই মৃত্যুই রাষ্ট্রের সায় ছিল, নাম পরিচয়হীন গণপিটুনি ক্রসফায়ার। তাদের অপরাধ ছিল– তারা এই ঘুণেধরা সমাজের প্রতি আস্থা হারিয়েছিল, তারা সমাজটিকে মেরামত করার পণ করেছিল। এক পুত্রহারা মায়ের মমতার দৃষ্টিতে, প্রতিবাদের আগুনে এই উপন্যাস লিখিত হয়েছিল। যার প্রাসঙ্গিকতা এখনো ফুরিয়ে যায়নি। রাষ্ট্রীয় দমন পীড়ন ও শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতা ধরে রাখার কৌশলের কাছে পরাভূত হয়েছিল শুভ ইচ্ছা।
ব্রিটিশ শোষণের বিরুদ্ধে মুণ্ডাদের যে সংগ্রাম– তারই প্রেক্ষাপটে মহাশ্বেতা দেবী লেখেন ‘অরণ্যের অধিকার’। এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে এসেছে মুণ্ডাদের ত্রাণকর্তা বলে বিবেচিত ‘বিরসা মুণ্ডা।’ এখানেও প্রান্তিক মানুষকে নানাভাবে শোষণ ও নির্যাতনের চিত্র ফুটে উঠেছে; তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করার নানা চেষ্টা লক্ষ করা যায়। বিদেশি বেনিয়ারা কেবল শাসন করেই ক্ষান্ত থাকেন না, তারা এটিও বুঝিয়ে দিতে চেষ্টা করে– যেসব সংস্কৃতি ও ধর্মে উত্তরাধিকার তারা সেগুলো তাদের তুলনায় অতি নিকৃষ্ট, অতএব তাদের মুক্তির জন্য পূর্বপুরুষের অযৌক্তিক ধর্মপালন থেকে বেরিয়ে এসে খ্রিস্টধর্মের অনুসারী হতে হবে। কিন্তু বিরসার এ ধরনের প্রশ্নের কোনো জবাব খুঁজে পায় না গির্জার ফাদার, তাদের জমির অধিকার থেকে কারা তাদের বঞ্চিত করেছে– বাইবেলের বিনিময়ে। মুণ্ডাদের সব ছিল, কিন্তু তাদের কোনো ত্রাণকর্তা ছিল না; তাই বিরসা ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। মহাশ্বেতা দেবীর পরিশ্রমে একান্ত আগ্রহে মুণ্ডা জনগোষ্ঠীর আন্দোলনের ত্যাগের ইতিহাস আমরা জানতে পারি। কিন্তু এ উপন্যাসেও রয়েছে সেই দমন লোভ আর বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস। কারণ পেটের ক্ষুধার কাছে একদিন সবকিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। কারণ মানুষ মরলেও ক্ষুধা রেখে যায়। ‘অরণ্যের অধিকার’ রচনায় বিভূতিভূষণের ‘আরণ্যক’ উপন্যাস কিছুটা উত্তমর্ণ রয়েছে। মহাশ্বেতা দেবী মনে করেন– এ সব খাঁটি অভিজ্ঞতা। অরণ্যে বসবাসকারী মানুষের খাদ্যাভ্যাস, সংস্কৃতি ও সংগ্রামের সঙ্গে জনপদের মানুষের খুব কমই সম্পর্ক আছে।
মহাশ্বেতা দেবীর লেখাগুলোর মধ্যে ‘হাজার চুরাশির মা’ ও ‘অরণ্যের অধিকার’ সর্বাধিক পঠিত ও অনূদিত হলেও লেখার বিষয়বস্তু, শৈলী ও ভাষার পরীক্ষা–নিরীক্ষা এবং পটভূমির ঐতিহাসিক বিস্তৃতি ধরলে ‘আঁধারমাণিক’, ‘অমৃতসঞ্চয়’, ‘কবি বন্দ্যঘটী গাঞির জীবন ও মৃত্যু’, ‘বিবেক বিদায় পালা’, উল্লেখযোগ্য রচনা। এ ছাড়াও ‘চোট্টি মুণ্ডা এবং তার তীর’, ‘শ্রী শ্রী গণেশ মহিমা’, ‘অগ্নিগর্ভ’, ‘জগমোহনের মৃত্যু’ এই ঔপন্যাসিকের গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর জীবন নিয়ে তিনি এই উপন্যাস রচনা করেছেন। কিন্তু প্রাচীন জনপদ ও প্রাচীনকালের কোনো কবির নিছক জীবনী–অঙ্কন করা মহাশ্বেতা দেবীর উদ্দেশ্য ছিল না। তিনি আসলে সর্বদায় দেখতে পান প্রাচীন মানুষের লড়াইয়ের সঙ্গে আধুনিক মানুষের রয়েছে অদ্ভুত মিল। মুকুন্দরাম দামিন্যা ত্যাগ করেছিলেন শাসকের জুলুম অত্যাচারে। কিন্তু এতে তার কবি জীবনের ক্ষতি হয়নি। নতুন দেশে নতুন পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি নতুন করে কবিখ্যাতি অর্জন করেন। এটি অনেকটা জন্মান্তরেরই নামান্তর। তেমনি কবি বন্দ্যঘটী অথবা বন্দ্যোপাধ্যায় পদবিধারী ব্রাহ্মণ ইচ্ছে করে নিজের মিথ্যা পরিচয় বিধৃত করেন। কারণ তৎকালীন সমাজ তার বিদ্যাশিক্ষাকে ক্ষমা করতো না। সে সময়ে চৈতন্যের প্রবল প্রভাবে নির্যাতিত জাতিগুলো ব্রাহ্মণদের নির্ধারিত জাতপাতের বেড়াজালে আর আটকে থাকতে চাচ্ছিল না। অনেকেই আদি পরিচয় ত্যাগ করে নতুন পরিচয়ে নিজেকে গৌরবান্বিত করতে চাইল। কবি জন্মসূত্রে প্রাপ্ত জীবন ত্যাগ করে এক নতুন জীবন অর্জন করতে চান। পরিণামে দুটি জীবনই তাকে ত্যাগ করে।
মহাশ্বেতা দেবীর জীবনও ছিল কবি বন্দ্যঘটীর মতো এক জীবনে নানা জন্মান্তর। নিজের জীবন হারিয়ে মানুষের জীবন খুঁজে পাওয়া তার অন্যতম কীর্তি। উত্তর উপনিবেশকালের লেখক হিসেবে কখনো নিজের শেকড়কে ভুলে থাকতে পারেননি মহাশ্বেতা। সর্বাদায় তাঁর ভাবনা পীড়িত করেছে সেই সব মানুষের প্রান্তিক অবস্থান– কীভাবে আধুনিক সভ্যতা তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল; এবং তাদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার আর কোনো উপায় থাকল না। তাই তিনি অন্তত সেই জীবনের নানা উপাদান আধুনিকালের মানুষের জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে চাইলেন। কিংবা সেই জীবনের সংগ্রাম, বেঁচে থাকার লড়াইয়ের উপায় ও উপকরণে কিছুটা পরিবর্তন আসলেও শোষণের মাত্রার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। একদিকে তথাকথিত সভ্য মানুষের এগিয়ে যাওয়ার উল্লাস আর অন্যদিকে বিজিত গুপ্তদের মানুষের খেয়েপরে বেঁচে থাকার অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে জীবনোৎসর্গ করার কোনো পরিবর্তন নেই।
বছর তিনেক আগে মহাশ্বেতা দেবী প্রয়াত হয়েছেন, কিন্তু পরিবর্তন হয়নি কিছু। তার জীবনাদর্শ, বৈষম্যহীন সমাজের আকাক্সক্ষা আর লেখক হিসেবে পরিশ্রমী কর্মকাণ্ড আমাদের সামনে রয়ে গেছে। তাকে পাঠ বর্তমান সমাজ–বাস্তবতায় আরো জরুরি হয়ে পড়ছে।
মজিদ মাহমুদ: আশি দশকের অনন্য কবি ও চিন্তক।