গুচ্ছ কবিতা

মৃধা আলাউদ্দিন

আমাদের সময়

এখন আমাদের এখানে যে সব ভোর বা সন্ধ্যা হয় তা যেনো ছেঁড়া কাগজের টুকরো
অথবা নরম টিস্যুর মতো ছুড়ে ফেলি রাস্তায়, দূরে; বাড়ির পাশে ভাগাড়ে
এবঙ একসাথে আমরা কিছু সময়কে ফাড়ছি-ছিঁড়ছি টুকরো টুকরো করে।
নিত্যদ্রব্যের আস্ফালনে আমরা আর পারছি না আমাদের পিতা ও পিতামহের প্রাণ ওষ্ঠাগত
আবার কী মায়েরা বাসন্তি হবে? এটা একবিংশকাল, মাছ ধরার জাল আর গায়ে জড়াতে পারে না মানুষ।
যদিঅ, এখন আমাদের সামনে থেকে সরে গ্যাছে বর্ষার উদ্ভান্ত মৌ মৌ ঘ্রাণ শ্রাবণ মেঘের দিন।
তবুও বর্ষাকাল বলে একটা কিছু কদম ফুলের মতো সৌরভ ছড়িয়ে দিক আমাদের চারপাশে
বিরান বাগের এখানে-ওখানে, দুপুরে, সন্ধ্যায়।

কিন্তু না, আমরা কেবোলি শাঁই শাঁই করে বেড়ে ওঠা জলন্ত উত্তাপে পুড়ছি।
গলে যাচ্ছে আমাদের হাত-মুখ গ্রীবার সমস্ত সৌন্দর্য। আমাদের কোনো ঈদ নেই।
আমরা একটা সময়কে ছিঁড়ছি-ফাড়ছি কাগজের টুকরোর মতো।
এখন জ্যৈষ্ঠ। গ্রীষ্মের কাল।

তুখ্খার তিশকারী

স্বামীটা জ্বরের চোডে তিয়াশে তিয়াশে পানি খায়। সারা রাইত কান্দে।
নিজেরে তিশকারী দ্যায়। তুখ্খার তিশকারী।
আল্লাহ আমারে লইয়া যাও; এমন তালাখালা আর ভালো লাগে না।
বাড়ির মাইনষের কাকালালা, কষ্টের জীবন, না খাইয়া ত আর থাহা যায় না…
২.
তালিতে তালিতে নষ্ট অইলো বউটা
শাশুড়ি, বউর মাটাও বড় মিরমিইরা, কুটিল।
মাইনষের লগে সারাক্ষণ ফুশুর ফুশুর করে।
গুরুজন প্রায়ই তারে কইতো, মিরমিইরা মানুষ বড়ই খারাপ; মিরমিইরা মানুষ…
৩.
স্বামীডার আমার কোনো শান্তি নাই :
ট্যাহার শান্তি মুহে অয় না
আগে দিন-রাইত কাম করছে, ট্যাহা আনছে
পাও ভাঙার পর আর ট্যাহাও চোহে দেহে না।
৪.
তাগো বিততিবেশাতি নাই; কাম কইরাই খাওন লাগবো।
অথচ ভেউরা মাইনষেরে কেই কাম দেয় না। অভাবী, ভেউরা মাইনষেরে…

পাতা কুড়ানো প্রচণ্ড দুপুর

জীর্ণতা মুছে ফেলে আমরা হেঁটে যাই রৌদ্দুরে; সামনে সমুদ্রের কাছে। সুন্দর ষড়ৈশ্বর্যে…
সানকিতে বাড়া ভাত নুনের সালুন ভাজা ইলিশ পান্তা-পোড়া মরিচ
যেনো শব্দ ও নৈঃশব্দ্যের মধ্যে উড়ে আসে, ডেকে যায় বৈশাখ।
রেশমি চুড়ি লাল ফিতে পুঁতির মালায় হেঁটে যায় সোনালি বিকেল মেঘবালিকা প্রেয়সী আমার…
২.
বারবার ফিরে আসে চৈত্রের দাবদাহ, ঝড়-ঝাপটা তুমুল বৈশাখ।
তুলে রাখি কামানের শব্দের মতো ধ্বংস ও বিনাশ। আকবরের খাজনা আদায়ের সমস্ত ইতিহাস।
চৈত্রের ফাঁকা মাঠ মেঠোপথ নাগরদোলা সন্ধ্যারাত আনন্দ-আবেগে আমরা পার করি
আরো কয়েকটি বসন্ত। ডুগডুগির শব্দের মতো কেটে যায় রাত। আমাদের বৈশাখ।
দূরপ্রবাসে ঘরে-বাইরে- অন্দরে দেখি বৈশাখ। সন্ধ্যায় জ্যামিতির মতো আমাদের ঘরে ফিরে আসে
আনন্দের রাশ রাশ কাটলেট…
চৈত্রের ধূসর প্রান্তরে আমরা পার হয়ে যাই প্রথম বৃষ্টি ফোঁটার রাত।
রোদ ঝলমল দুরন্ত দুপুর। তালপাতায় লেখা প্রেমপত্র। বটগাছের নিচে, মেলায়…
৩.
রঙিন ঘুড়ির মতো উড়ে আসে পাতা কুড়ানো প্রচণ্ড- দুপুর।

ফ্রাঙ্কেনস্টাইন

প্রবঞ্চনা, প্রলোভন আর কালো ফ্রাঙ্কেনস্টাইন
জোঁকের মতোন চোষে রুবাই ও রোশনাই রেশ
দিয়ে দ্যায় ইশারায়, নীল নগ্ন রোদের আবেশ
পৃথিবী ভুলের যজ্ঞপুরী, কালো ফ্রাঙ্কেনস্টাইন।

ব্যভিচারের বিচারে কেবোলি যন্ত্রণা ফিরে পাই
মধ্যরাতে অহরহ উড়ে আসে মূর্চ্ছা তন্দ্রালোক
সভ্যতার সামাজিক শহর, শিশিরে দেখি জোঁক
এনে দাও দার্ঢ্য ঐ মেশকের মরমি মিঠাই।

তেজ-তাজা তলোয়ার আজ থুবড়ানো মূল্যহীন
তাজা তাজা তেজারতি আপেল কাকের কালো জলে;
সব বৈরিতায় ভরা, হরিণ পারে না শক্তি বলে
হিংস্রতায় ছিঁড়ে যায় ঘোড়ায় লাগানো শক্ত জিন।

বৈশাখী বাগানে বড় বড় দ্বীপ, দারুচিনি পাইন
দুমড়ে-মুচড়ে দিয়ে যায় কণ্টকালো ফ্রাঙ্কেনস্টাইন।

এখানে পিঁপড়েগুলো আপনার ধ্বংস চায়

ঘর্ণিত ঘামের মতো ধ্বংস হোক আপনার ক্রোধ
দাগ-দম্ভ, অহঙ্কার আর ভাঙা রোগ-রোষাগ্নীতে
পুড়ে যাক এই নদী। যেহেতু আপনি বিপরীতে
বিপরীতে ঢেলেছেন বিষবৃক্ষ। পঙ্গু, ভাঙা গ্রোথ
নিয়ে আর বাঁচা যায় কতোদিন? বাঁচবে না এই
অনাবিল আদিগন্ত সমাজ; নূহের প্লাবনিক
বন্যা ঢেলে দাও আকাশের অধিপতি। হে মালিক!
তুমি এখনই ঝরনা ঢেলে দাও-খানা-খন্দ অই
পৃথিবী তোমার রৌদ্র চায়, বর্ষা চায়… আদিঅন্ত
নির্দয় নিনাদে কারা বাদশা-বীর আজ পৃথিবীর?
ওরা নির্ভয়ের ফুল; শান্ত-সূর্য-ধীর শুধু ধীর।
নিজের ক্ষতিরে আর পারে না, লাফায় বীর্য-দন্ত।

এখানে পিঁপড়েগুলো আপনার ভরা ধ্বংস চায়
অতএব, নিমজ্জিত হোন ক্লেদ-কৃষ্ণ হুতামায়।

বাজিকর দ্বিধার কিরিচ

হাটে ওয়ে জ্যামিতির ত্বক আর আলোর করাত
খুলে যায় খালি ভোর নিয়মিত নিজের বরাত
আর কাছে, নদী-নারী মোমগলা রূপার শরীর
দেখো ক্লেদ-কষ্ট সরে যায় সংক্রমিত কুষ্ঠ রাত।

যেতে যেতে অন্ধকারে কুয়াশার প্রতিযোগিতায়
ছিদ্রযুক্ত কালোশিরা মাতালেরা নিত্য চলে যায়,
ফিরে আসে পাললিক রাত্রিমগ্ন উন্মোচিত ভোর
আজানের ধ্বনি আসে পারদ পবিত্র মহিমায়।

ঘামের বদলে কিনে নেই নীল নদীর নহর
কিনে নেই সূচিশুভ্র আলোড়িত নিবিড় শহর
সবকিছু খুলে যাবে অলীক রোদের আয়নায়
থাকবে না পাখিদের আশপাশে কঠিন কহর।

বৃষ্টির পানির সাথে ধুয়ে যাবে গন্ধের কিরিচ
ধুয়ে যাবে সবকিছু পোড়াবাড়ি দ্বিধার পিরিচ।

কবির সন্ধানে

পানির গভীরে গাঢ় ডুব দিয়ে আরো নিচে যাও
দীর্ঘ পানি, কড়া নেড়ে পানোচ্ছ্বাস করতে পারো তা-ও
এবঙ নায়ের মতো নদীতে সাঁতার কাটো রোজ
যেভাবে রাতের রোদে আপেলের রস তুমি খাও।

কামের কবিকে ডাকো, শুভ্র সমুদ্রের মতো ডাকো
যে কিনা তন্দ্রার ভোর, রাত্রি কোনো কিছু মানে নাকো;
কোষ থেকে কোষে, বাতিহীন অন্ধকারে-সারারাত
তুমিও কবির মতো অনিবার্য রোদে খেলতে থাকো।

আলোড়িত এ রাত্তিরে নাবিকের লবণের স্বাদ
কবিকে আবারো সিক্ত করে ওই যুক্ত মিশ্র চাঁদ,
অথবা তরল দিনে কবি খোঁজে আলোর কার্পাশ
যেমন বেহায়া রাত্রি এসে নষ্ট করে লৌহ বাঁধ।

উন্মোচিত করো ঘামে ভেজা এই দারুণ কবিকে
যে কিনা স্মরণ করে সবশেষ আলোর নবীকে।

মৃধা আলাউদ্দীন : নব্বই দশকের কবি ও সাংবাদিক:ভোরের কাগজ।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন