আল মাহমুদের জলবেশ্যা বেহুলার ভাসানে একাকী লখিন্দর

পান্থজন জাহাঙ্গীর

“কোনদিন আকাশের চেহারাটা থাকত আয়নার মতো পরিস্কার। নীল রঙের বিশাল একটা বাসন যেন ঝলমলিয়ে উঠেছে। আমি একদৃষ্টিতে অন্তহীন নীলিমার দিকে তাকাতে তাকাতে আমার শৈশব দৃষ্টিশক্তিকো ক্লান্ত করে ফেলতাম। তবুও আকাশের দিকেই তাকিয়ে থাকতাম। মনে হত রহস্যময় এক নীলিমা। কখনো দেখতাম মেঘের কোলঘেষে শকুন উড়ছে। অসংখ্য শকুন। আমি মনে মনে পাখা ছড়িয়ে ভেসে বেড়ানো শকুনগুলোকে গোনার ব্যর্থ চেষ্টায় মেতে থাকতাম। পাখিগুলো বিশাল দুটো করে পাখা ছড়িয়ে স্থিরভাবে ভাসছে। এদের পাখা ঝাপটানো বড় একটা চোখে পড়তনা। কীভাবে ভেসে থাকত পাখিগুলো এ নিয়ে আমার উদ্বেগের সীমা ছিল না।”( যে ভাবে বেড়ে উঠি আতœজৈবনি)। আলমাহমুদ যে কবিতার সাথে সাথে গদ্যসাহিত্য বা কথাশিল্পেও সমান দক্ষতার প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। তার গদ্যের ভাষা সহজ সরল ও প্রাঞ্জল। এ ভাষা সব পাঠকের বোধগম্য। তার কবিতার মতোই উপমার আর অলংকারে সুশোভিত। পাঠক নেশায় বোধ হয়ে রসের সাগরে ভাসার মতো। অথচ এর মাঝেই সচেতন আবার দার্শনিকতায় আড়ালযুক্ত । কবিতার সমানতালে তিনি গদ্যেও স্বাক্ষর রেখেছেন। কখনো গদ্যগ্রন্থের সংখ্যা কাব্যগ্রন্থকেও ছড়িয়ে গেছে। সুতরাং, তিনি শুধুই কবিই নন – একজন সরস ও প্রাজ্ঞ গদ্য লেখকও বটে। গদ্য সাহিত্যে তার গ্রন্থ সংখ্যা চল্লিশটিরও অধিক। তার এ গদ্যসাহিত্যের উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে তার ছোট গল্পগুলো। তার উল্লেখযোগ্য ছোট গল্পগুলো হচ্ছে, পানকৌড়ির রক্ত, কালো নৌকা, রোকনের স্বপ্নদোলা, জলবেশ্যা, বুনোবৃষ্টির প্ররোচনা,মাংসের তোরণ, ভেজা কাফন, নীল নাকফুল, খনন, মীরবাড়ির কুরসি নামা ইত্যাদি। আলমাহমুদের এই গল্পগুলোর শিল্পমান কোনটা কোনটির চেয়ে কম নয়। তারপরও জলবেশ্যা কেমন জানি বার বার মনে দাগ কাটছে। তাই গল্পের নাম তুলতেই জলবেশ্যার কথা মনে পড়ে যায়। আরো স্পষ্ট করে বললে বেউলা। এই গল্পে চাতুর্যে বিজয়ী যদি বেউলাকে ধরি তাহলে বিজিত হচ্ছে আবিদ বেপারী। কবিতার মতো তার গল্পেও ঘুরেফিরে নারী চরিত্রগুলো এসেছে বার বার। সাহিত্যে নারী প্রসঙ্গে আল মাহমুদ বলছেন,”সব শব্দের মনিহারে সাজিয়ে দেয়াা মানায় না। সব গোপন সুর ইচ্ছে হলেই বাতাসে ভাসিয়ে দেবার নয়। তবু অব্যক্ত রহস্যময়, গভীর গোপনের প্রতি মানুষের দুর্বার টান। এই টান থেকেই অপ্রকাশের দিকে শুরু হল অভিযান। সে অভিযানে সফলতা ব্যর্থতা নিয়ে কোন অঙ্কের কথা মাঝপথে আর মনেও থাকেনা। অভিযান ও অভিযানের অভিজ্ঞতায় কখনো কখনো হয়তো বা সামান্য স্পর্শ পাওয়া যায় গোপন সুন্দরের।”( নারী আমাকে উদ্বা¯ুু করেছে) আলমাহমুদের জলবেশ্যা গল্পের নারী চরিত্র বেউলা ক্ষেত্রেও একথা শতভাগ সত্য। কারণ এখানে বেউলার গোপন সুন্দরের স্পর্শের আশায় আবিদ বেপারি তার সফলতার বা ব্যর্থার কথা একবারও সচেতনভাবে মনে আনেন নি। তাই এখানে নারীর কাছে সে পরাজিত এক সৈনিক। শুধু পরাজিত বললে ভুল হবে শেষ পর্যন্ত সে কি জীবন নিয়ে ফিরতে পারছে না সলিল সমাধি হয়েছে তাও রহস্যময়ই থেকেছে। জলবেশ্যা গল্পের সেটিং এ গল্পকার লিখেছেন,” পেয়াজ রসুনের মরসুম লালপুর হাটের চারপাশের গ্রামগুলোতেও পেঁয়াজ রসুনের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। হাঁটের দুমাইল দূর থেকেও বাতাসে কাঁচা পেঁয়াজের ঝাঁজালো গন্ধটা বেপারীদের নাকে এসে লাগে। গন্ধটা আর তখন পেঁয়াজের গন্ধ থাকেনা। রসুনেরও একটা অহংকারী গন্ধ আছে যা বাতাসে পেয়াজের গন্ধের সাথে মিশে বাতাস কে স্বাদযুক্ত করে তুলে। এখান থেকে পাঠকের বুঝতে অসুবিধা নেই লালপুর হাঁটে কি সওদা হয়। এবার আসা যাক কারা এ সওদা করেন। তা বলতে গিয়ে লেখক প্রায় গল্পের অর্ধেক শেষ করেছেন। যেমন -!” হাটের মধ্যে মানুষের পায়ে চলার পথের পাশে পেঁয়াজের খোসার আ¯রণ জমে এমন উচু হয়ে থাকে যে কাঁচা মসলার মরশুম শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রতি মঙ্গলবারের হাঁটের পসারিরা পেঁয়াজ রসুনের ¯ুপকৃত খোসার উপরেই তাদের বেসাত বসায়। এর উপরেই কেনাবেচা চলে। যারা চার পাঁচ মাইল দূর থেকে হাটে তাদের বেসাত নিয়ে আসে তাদের অনেকেই বেচাকেনা শেষ করে রাতে ঘরে ফিরতে পারে না। “এর কারণ হচ্ছে চুরি ডাকাতি, ছিনতাই বা বাটপারি। তাই চার-পাঁচ জনের একটা দল একজন বেপারীর নেতৃত্বে হাটে আসে। এ হচ্ছে যারা দূরদূরান্ত থেকে হাটে কাচামাল নিয়ে আসে তাদের অবস্থা। কিন্তু আরেক প্রকার ব্যবসায়ী আছে যারা নদী পথে হাটে আসে মাল কিনতে। লেখক তাদের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে-” … তাদের কাজ কারবার আবার আলাদা। প্রতি হাটবার তাদের অসংখ্য পালতোলা নৌকা ভাটিয়ালি গাইতে গাইতে তরতর করে বাজারের বি¯ীর্ণ ঘাট অঞ্চলকে ঘিরে ফেলে। এভাবে লেখক দুই প্রকার কেনাবেচা দরদামের লোকদের বর্ণনা দিলেন। এবার লেখক হাটের বর্ণনায় আসলেন সংক্ষেপে বললে, ” মেঘনা ঢেউয়ের বাড়িতে প্রতিটি নৌকা একটু একটু কাঁপছে। আর আহত জলের শব্দ চারদিকে একটা একটানা মাতমের রোল তুলছে। এসব নৌকা আশপাশের বড় বড় বাজার ছাড়াও ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট থেকে আসে। পেয়াজর রসুন, মুগ মসুর আর মিষ্টিজলের শুটকির জন্য এ হাট প্রসিদ্ধ। “… এ ছাড়াও প্রতি হাটবারে চার পাঁচশ বড় নাও এ হাটে মাল কিনতে ভিড় জমায়। দেশের পয়সাওয়ালা মুদি, মরিচ-মসলার দালাল, শুটকির কারবারি, তাতে বোনা মোটা নীলাম্বরী শাড়ি আর লুঙ্গি ব্যবসায়ীদের বেহেশত হল লালপুর হাট। এ হাটে পেয়াজ-রসুনের গন্ধ, সিদল শুটকির খুশবাই নাকে লাগলেই হাটবারে উটকো দালালদের জিভে পানি আসে। ” এবার আসি গল্পের প্রধান চরিত্র আবিদ ব্যাপারির বর্ণায়, লেখক আবিদ বেপারী সম্পর্কে বলেছেন “লালপুর হাটের তরুন দালালদের নেতা হল আবিদ বেপারী। সব হাটেরই নিজের পুঁজি ছাড়া ব্যবসা জমানোর একদল লোক থাকে, লালপুর হাটেও পাটের মরসুমে থেকে শুরু করে পেঁয়াজের মরশুম পর্যন্ত আবিদ বেওারির ইয়ারেরা হাঁক-ডাক করে বেড়ায়। বাইরের বেপারীদের মাল খরিদ করতে হলে দালালের সাহায্যে না হলে চলেনা। এই জন্য অবশ্য মহাজনরা আগেই দালাদের পয়সার দেয়।” আবিদ বেপারী এই দালালি পেশা নিয়ে আছেন। লেখাপড়ায় বেশওদূর এগুতে পারেনি। জেলে পাড়ায় বন্ধুদের সাথে স্কুল পালিয়ে সময় পার করেছে। বাড়ি গিয়ে মা কে বাধ্য ছেলের মতো বলছে লেখাপড়া করে এসেছে। মা খুশিতে ভাল ভাল খাবার নিয়ে আসতো। আদর করে খাওয়াতো। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস মা একদিন ওলা বিবি তে মারা যায়। ফলত কৃষক বাবা আবার বিয়ে করে এবং আবিদ বেপারীকে কোনপ্রকার জমি জমার ভাগ না দিয়ে তাড়িয়ে দেয়। অবিবাহিত আবিদ এখন দালালি করে। বাউন্ডুলে জীবন হলেও দালালিতে কম রোজগার করে না কিন্তু মেঘনার তীরে মহাজনদের সাথে মদ জুয়া কখনো মেঘনার মাঝে বেদের নৌকায় জল বেশ্যার বুকে সেই বিনে পুঁজির ব্যবসার রোজগার ঢেলে দিয়ে আবার রাজ্যের যত সুখ লুটে নেয়। সংক্ষেপে এই হচ্ছ মেঘনা পারের লালপুর হাটের আবিদ বেপারীর যাপিত জীবন। এবার আসা যাক জলবেশ্যা গল্পে বেদে সমাজের বর্ণনায়। আমাদের দেশে বেদেরা সাধারণত যাযাবর জীবন যাপন করে। তারা কখনো একজায়গায় স্থির থাকেনা। তাদের নিজস্ব কোন জায়গাজমি নেই। তাই তারা জলে নৌকা নিয়ে বাস করে। এসব জল যাযাবর হাটে ঘাটে তাবিজ কবজ বিক্রি করে বানর ও সাপ খেলা দেখায় জীবিকা নির্বাহ করে। কিন্ত তারা এই পেশার পাশাপাশি বেশ্যাবৃত্তিও যে করে তা আল মাহমুদের মতো বিচিত্র অভিজ্ঞতার সম্পন্ন লেখকের দৃষ্টিকে এড়িয়ে যেতে পারেনি। তিনি জলবেশ্যা গল্পে বেদেদের যতটুকু বর্ণনা এসেছে তা হল, “…. আর আসে বেদেরা। তাদের ঝাঁকবাঁধা নৌকাগুলো মেঘনার বুকে ভাসমান ছোট গ্রামের মতো দেখায়। তারা সহজে ঘাটে ভেড়েনা। যে পারে হাট তার ঠিক উল্টোদিকে, অপর পারে তীরের মাটি থেকে তিরিশ চল্লিশ গজ নদীর ভেতরে তারা তাদের বহর আটকায়। নদীর পাড়েও নয় আবার নদীর মধ্যেও নয় । এমন একটা জায়গায় তারা অবস্থান নেয়। তার পর ছোট কোষা নৌকায় এরা হাটে- ঘাটে এসে লাগে। বেদে যুবারা হাটে কাঁচের বাংড়ি, আয়না, গন্ধ সাবান আর সাপের তাবিজ, দাঁতের মাজন, চুরিচাকু বিক্রি করে। মেয়েরা যায় গ্রামের। তাদের হলো সাপ নাচানোা, শিঙ্গা লাগানো, আর দাঁতে পোকা খোলার ব্যবসা। হাটের দিন সকালে তারা আসে। পরেরদিন সূর্য উঠার আগোই বহর ভাসিয়ে অন্য হাটের দিকে চলে যায়। কিন্তু এই পেশার আড়ালেও যে তাদের বেশ্যাবৃত্তি আছে , সেটাই জলবেশ্যা গল্পে বিধৃত হয়েছে বেউলা সুন্দরী চরিত্রের মাধ্যমে। সাধারণত বেউলা নামটা ধর্মপুরাণ বেহুলা ও লখিন্দররে চরিত্র থেকে নয়া। এখানে আঞ্চলিক অর্থে গৃহিত হয়েছ। বেউলা সুন্দরীর সৌন্দর্য ও লাস্যপনা বর্ণনায় লেখক লিখেছেন ” এই অবসরে আবিদ মেয়েটির পীঠ, বাহু, কোমর, আর চীনা হাঁসের মতো বাকানো গ্রীবাভঙ্গি দেখার সুযোগ পেল। যদিও লন্ঠনটা ধোঁয়াটে আলো ছড়াচ্ছে। তবুও তার ছৈয়ের বাঁশের চটায় ঝোলানো থাকায় সন্মুখবর্তিনীর সর্বাঙ্গে আলো পড়ছে। পেট আর বুক দিয়ে হাঁটু আর উরতের উপর চেপে বসায় পেছন থেকে তার পিষ্ট ¯ন দুটির ফুলে ওঠা পর্যন্ত আবিদ বেপারী লোভাতুরের মতো দেখতে লাগল।…. বেউলা সুন্দরি তখন ছুরাতার ফাঁকে একটা আস্ত সুপারি রেখে ধীরে চাপ দিয়ে কুচি কুচি করে কাটছিল। আর এই চাপের শিহরণ তার মাংসের উপর এমনভাবে কাঁপন তুলছে যে, বেপারীর মনে হল মেয়েটির ঘাড়ের পেশি আর দাপনার দুলুনি যেন দাঁড়াশ সাপের দ্রæতগামী কামলীলা। পেছন থেকে তার পাছা আর পীটের নিচের অংশ অনেকটা চাল কাড়ার হালকা ঢেকি উলটে রাখার মতো । নিখুঁত আর তেলতেলে। বেউলা সুন্দরীর পরনে মোটা কালো পেড়ে শাদা শাড়ি। এ ধরনের শাড়ি সাধারণত বেদেমেয়েদের পড়তে দেখা যায়না। তারা রঙচঙে কাপড়ই পছন্দ করে। বেউলার সাদাসিধা আর শাড়ির গোঁজন-গাজন দেখে তাকে বেদেনী বলে মনে হচ্ছে না। বরং তার শাড়ির অস্বাভাবিক শাদা জমিন আর কালো পাড় দেখে তাকে কোন পরমাসুন্দরী জেলে বউ বলেই ভুল হবে। দু’হাতের কবজি- ভরা সবুজ বাঙড়ি টুংটাং শব্দ করছে। বাঁ হাতের কনুইয়ের একটু উপরে মোটা কালো তাগায় একটা চ্যাপ্টামতো বড় রুপোর তাবিজ। বাতি নিয়ে নৌকার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকায় সময় যে কেশরাশি বাতাসের সাথে বইতে দেয়ার জন্য ছেড়ে রেখেছিল নৌকার ভিতর তা সংবরণ করে নেয়ায় তার তার মাথার প্রায় সমান সমান এক বিশাল খোঁপার সৃষ্টি হয়েছে। যেন দূর থেকে দেখা নদীপারের কোনো গ্রামের বাড়ি বনের কুঞ্জি। আবার সেই পুকুরে পাওয়া গঙ্গামূর্তির কথা মনে পড়ল বেপারীর। এখন কথা হচ্ছে যে বেউলা সুন্দরীর এত রূপ রস গন্ধ উপভোগ করার মতো যার একটা মন রয়েছে তার মনও সুন্দরের আধার হওয়ার কথা । সুতরাং সে তো কম যোগ্য ছিলনা বেউলা সুন্দরীর কিন্তু কেন তাহলে বেউলার সাথে আবিদের মিলন কেন শেষ পর্যন্ত মহা প্রতারণায় পরিণত হল? তাছাড়া ধরে নিলাম আবিদের কোন গুণ বা যোগ্যতাই নেই। তারপরও বেশ্যার সাথে খদ্দেরের চুক্তি তো টাকায়। তার দৈহিক বা মানসিক সৌন্দর্যে নয়। তাহলে কেন বেউলা আবিদের সাথে প্রতারণা করল? এখানে কি তার দেহদানে অনিহা ছিল? থাকলে তার কারণ কী? এর কারণ হিসেবে আমরা পাই বেউলার সাপের খোপে পা রাখা। “… ওদিকে আবিদের অলক্ষ্যে তার পীঠের ওপর পা রাখা বেউলার ডান পায়ে অগ্রভাগ অর্থাৎ পায়ের পাতা ও আঙুল অকস্মাৎ ক্রুদ্ধ রাজহাঁসের চঞ্চুর মতো ঠোকর মেরে সাপের ঝুড়ির ডালাটা ফেলে দিল। আর চক্ষের নিমিষেই একটা অকথ্য ফোঁসফোঁসানি তুলে ঝুড়ির অধিবাসিনী দ্রæত হিল হিল করে বেউলার পা বেয়ে নেমে এসে আবিদের ডানবাহুতে ছোবল হানল। বাহুর ওপর সাপের মুখের ভেজা শীতল স্পর্শে ঘাড় ফিরিয়েই বেপারীর চোখের তারা স্থির হয়ে গেল। সাপটা বেউলার উরতের উপর থেকে ঘাড় বাঁকিয়ে আবিদের দু চোখের মধ্যিখানে ফনা তুলে একটু একটু ডানে বায়ে দুলছে। আর মুখ থেকে কালো সুতোর মতো সরু¯জিভটা দ্রæত পিছলে পিছলে আসা যাওয়া করছে। বুঝি নড়লেই আবার ছোবল হানবে। বেউলা এক দৃষ্টে সাপটার দিকে থাকিয়েই চোখ বড় বড় করে চিৎকার করে উঠল, “খাইছে মহাজন, আপনারে কালে খাইছে। সব্বোনাশ অইছে -এ সাপের যে দাঁত তোলা অয়নাই গো! ” আসলে এ ছিল বেউলার ভয়ঙ্কর মিথ্যাচার। যা শুনে আবিদ বেপারী অজ্ঞানহয়ে পড়ল। ” তার চিৎকার আর উরুতের কাঁপুনিতে সাপটা ক্রুদ্ধ হয়ে আবিদের দুচোখে মাঝখানে নাসিকার গোড়ায় সজোরে ছোবল মারল। বেপারীর দুচোখের পাতা থরথর করে কয়েকবার কেঁপে শেষে স্থির বিস্ফোরিত হয়ে রইল। তারপর অজ্ঞান দেহটা উবুড় হয়ে পড়ল বেউলার বুকের উপর…।”বেপারী তখনো বেউলার চাতুরী বুঝতে পারেনি। হয়তো পাঠকও। এখানে গল্পটি শেষ পর্যন্ত এমন নাটকীয়তা মোড় নিয়েছে যে মিলনের শুরুতে পাঠকের মনে হবে যে নৈতিক অবস্থান থেকে বেউলা খুবই সৎ। মিলনের মাঝামাঝি সময়ে মনে হবে যে বেউলা দূর্ঘটনার বশত এমন কাজ করেছিল অর্থাৎ সাপের খোপে পা রেখেছিল কিন্তু গল্পের শেষে পাঠকের বুঝতে আর বাকি থাকেনা যে এটি একটি মহা প্রতারণা এবং তা বেউলার কথাতেই স্পষ্ট হয়েছে “….. বেউলা সুন্দরী উঠে বসে এবং জংঘাপ্রান্তে দু হাত রেখে আড়মোড়া ভাঙল। লুটিয়ে পড়া কেশরাশি খোপা করে বাঁধল। কিন্তু তখনো শাড়ি পড়ল না। সাপটাকে তখনো ফনা ধরে থাকতে দেখে হাত বাড়িয়ে কালনাগিনীর ঘাড়টা খপ করে ধরল। তারপর বলল, ‘দাঁত নাাই বাইদানীর আবার আবা ফোঁসফোঁসানি কত! লো নেংটা বাইদানী, তুই আমার লখিন্দরে করলি কী? দিমু মাথা ছেইচা।” আবিদ বেপারী। এ প্রতারণার পেছনে বেউলার ধূর্ততা ও লোভ কাজ করেছিল ভীষণভাবে। তাই ব্যবসায়িক নৈতিকতার আড়ালে বাটপারি, কিংবা ছিনতাইয়ের আশ্রয় নেই। কারণ, আবিদ তার বিবস্ত্রহওয়ার সময় চল্লিশ টাকা তুলে নিয়ে টাকার মূল বান্ডিল খুতিতে যে ভাল করে গুছিয়ে রেখেছিল তা বেউলা দেখে ফেলেছিল। তাছাড়া আগের দিন লালপুর হাটের দালালির সব টাকা প্রায় দুইশোর বেশি লেখকের বর্ণনা মতে আবিদের কাছে ছিল। তাই সবটাকাই এক সাথে কুক্ষিগত করতে পারলে হয়তো বেউলা সুন্দরীর অনেকদিনের দেহব্যবসার রোজগার। তাই আবিদের সাথে এই ভয়ঙ্কর প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছিল। এছাড়াও এমনও হতে পারে হয়তো সমাজ ও ধর্ম নিষিদ্ধ বেশ্যাপনা বা যৌনতাকে লেখক নিরুৎসাহিত করতে চেয়েছিলেন এমন সিদ্ধান্ত টেনে অর্থাৎ, আবিদ বেপারীকে একট শিক্ষা দিয়ে । অথবা ছোট গল্পের ফর্ম অন্তরে “অতৃপ্তি রবে….” এমন ধারাকে বজায় রাখতে গল্পকার অতৃপ্তিকর শেষের আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু তা যদি হয় তাহলে লেখকের আরো অনেক সুযোগ ছিল শেষ নাটকীয়তার। লেখক চাইলে অন্য আরো অনেক নাটকীয়তার যে কোন একটির আশ্রয় নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা নেননি। এখানেই আবিদ বেপারী আফসোসের সমুদ্ আল
হাটের আবিদ বেপারীর যাপিত জীবন। এবার আসা যাক জলবেশ্যা গল্পে বেদে সমাজের বর্ণনায়। আমাদের দেশে বেদেরা সাধারণত যাযাবর জীবন যাপন করে। তারা কখনো একজায়গায় স্থির থাকেনা। তাদের নিজস্ব কোন জায়গাজমি নেই। তাই তারা জলে নৌকা নিয়ে বাস করে। এসব জল যাযাবর হাটে ঘাটে তাবিজ কবজ বিক্রি করে বানর ও সাপ খেলা দেখায় জীবিকা নির্বাহ করে। কিন্ত তারা এই পেশার পাশাপাশি বেশ্যাবৃত্তিও যে করে তা আল মাহমুদের মতো বিচিত্র অভিজ্ঞতার সম্পন্ন লেখকের দৃষ্টিকে এড়িয়ে যেতে পারেনি। তিনি জলবেশ্যা গল্পে বেদেদের যতটুকু বর্ণনা এসেছে তা হল, “…. আর আসে বেদেরা। তাদের ঝাঁকবাঁধা নৌকাগুলো মেঘনার বুকে ভাসমান ছোট গ্রামের মতো দেখায়। তারা সহজে ঘাটে ভেড়েনা। যে পারে হাট তার ঠিক উল্টোদিকে, অপর পারে তীরের মাটি থেকে তিরিশ চল্লিশ গজ নদীর ভেতরে তারা তাদের বহর আটকায়। নদীর পাড়েও নয় আবার নদীর মধ্যেও নয় । এমন একটা জায়গায় তারা অবস্থান নেয়। তার পর ছোট কোষা নৌকায় এরা হাটে- ঘাটে এসে লাগে। বেদে যুবারা হাটে কাঁচের বাংড়ি,আয়না,গন্ধসাবান আর সাপের তাবিজ, দাঁতের মাজন, চুরিচাকু বিক্রি করে। মেয়েরা যায় গ্রামের। তাদের হলো সাপ নাচানো, শিঙ্গা লাগানো, আর দাঁতে পোকা খোলার ব্যবসা। হাটের দিন সকালে তারা আসে। পরেরদিন সূর্য উঠার আগোই বহর ভাসিয়ে অন্য হাটের দিকে চলে যায়।কিন্তু এই পেশার আড়ালেও যে তাদের বেশ্যাবৃত্তি আছে , সেটাই জলবেশ্যা গল্পে বিধৃত হয়েছে বেউলা সুন্দরী চরিত্রের মাধ্যমে। সাধারণত বেউলা নামটা ধর্মপুরাণ বেহুলা ও লখিন্দররে চরিত্র থেকে নয়া। এখানে আঞ্চলিক অর্থে গৃহিত হয়েছ। বেউলা সুন্দরীর সৌন্দর্য ও লাস্যপনা বর্ণনায় লেখক লিখেছেন ” এই অবসরে আবিদ মেয়েটির পীঠ, বাহু, কোমর, আর চীনা হাঁসের মতো বাকানো গ্রীবাভঙ্গি দেখার সুযোগ পেল। যদিও লন্ঠনটা ধোঁয়াটে আলো ছড়াচ্ছে। তবুও তার ছৈয়ের বাঁশের চটায় ঝোলানো থাকায় সন্মুখবর্তিনীর সর্বাঙ্গে আলো পড়ছে। পেট আর বুক দিয়ে হাঁটু আর উরতের উপর চেপে বসায় পেছন থেকে তার পিষ্টন দুটির ফুলে ওঠা পর্যন্ত আবিদ বেপারী লোভাতুরের মতো দেখতে লাগল।…. বেউলা সুন্দরি তখন ছুরাতার ফাঁকে একটা আস্ত সুপারি রেখে ধীরে চাপ দিয়ে কুচি কুচি করে কাটছিল। আর এই চাপের শিহরণ তার মাংসের উপর এমনভাবে কাঁপন তুলছে যে, বেপারীর মনে হল মেয়েটির ঘাড়ের পেশি আর দাপনার দুলুনি যেন দাঁড়াশ সাপের দ্রæতগামী কামলীলা। পেছন থেকে তার পাছা আর পীটের নিচের অংশ অনেকটা চাল কাড়ার হালকা ঢেকি উলটে রাখার মতো । নিখুঁত আর তেলতেলে। বেউলা সুন্দরীর পরনে মোটা কালো পেড়ে শাদা শাড়ি। এ ধরনের শাড়ি সাধারণত বেদেমেয়েদের পড়তে দেখা যায়না। তারা রঙচঙে কাপড়ই পছন্দ করে। বেউলার সাদাসিধা আর শাড়ির গোঁজন-গাজন দেখে তাকে বেদেনী বলে মনে হচ্ছে না। বরং তার শাড়ির অস্বাভাবিক শাদা জমিন আর কালো পাড় দেখে তাকে কোন পরমাসুন্দরী জেলে বউ বলেই ভুল হবে। দু’হাতের কবজি- ভরা সবুজ বাঙড়ি টুংটাং শব্দ করছে। বাঁ হাতের কনুইয়ের একটু উপরে মোটা কালো তাগায় একটা চ্যাপ্টামতো বড় রুপোর তাবিজ। বাতি নিয়ে নৌকার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকায় সময় যে কেশরাশি বাতাসের সাথে বইতে দেয়ার জন্য ছেড়ে রেখেছিল নৌকার ভিতর তা সংবরণ করে নেয়ায় তার তার মাথার প্রায় সমান সমান এক বিশাল খোঁপার সৃষ্টি হয়েছে। যেন দূর থেকে দেখা নদীপারের কোনো গ্রামের বাড়ি বনের কুঞ্জি। আবার সেই পুকুরে পাওয়া গঙ্গামূর্তির কথা মনে পড়ল বেপারীর। এখন কথা হচ্ছে যে বেউলা সুন্দরীর এত রূপ রস গন্ধ উপভোগ করার মতো যার একটা মন রয়েছে তার মনও সুন্দরের আধার হওয়ার কথা । সুতরাং সে তো কম যোগ্য ছিলনা বেউলা সুন্দরীর কিন্তু কেন তাহলে বেউলার সাথে আবিদের মিলন কেন শেষ পর্যন্ত মহা প্রতারণায় পরিণত হল? তাছাড়া ধরে নিলাম আবিদের কোন গুণ বা যোগ্যতাই নেই। তারপরও বেশ্যার সাথে খদ্দেরের চুক্তি তো টাকায়। তার দৈহিক বা মানসিক সৌন্দর্যে নয়। তাহলে কেন বেউলা আবিদের সাথে প্রতারণা করল? এখানে কি তার দেহদানে অনিহা ছিল?থাকলে তার কারণ কী? এর কারণ হিসেবে আমরা পাই বেউলার সাপের খোপে পা রাখা। “… ওদিকে আবিদের অলক্ষ্যে তার পীঠের ওপর পা রাখা বেউলার ডান পায়ে অগ্রভাগ অর্থাৎ পায়ের পাতা ও আঙুল অকস্মাৎ ক্রুদ্ধ রাজহাঁসের চঞ্চুর মতো ঠোকর মেরে সাপের ঝুড়ির ডালাটা ফেলে দিল। আর চক্ষের নিমিষেই একটা অকথ্য ফোঁসফোঁসানি তুলে ঝুড়ির অধিবাসিনী দ্রæত হিল হিল করে বেউলার পা বেয়ে নেমে এসে আবিদের ডানবাহুতে ছোবল হানল। বাহুর ওপর সাপের মুখের ভেজা শীতল স্পর্শে ঘাড় ফিরিয়েই বেপারীর চোখের তারা স্থির হয়ে গেল। সাপটা বেউলার উরতের উপর থেকে ঘাড় বাঁকিয়ে আবিদের দু চোখের মধ্যিখানে ফনা তুলে একটু একটু ডানে বায়ে দুলছে। আর মুখ থেকে কালো সুতোর মতো সরু¯জিভটা দ্রæত পিছলে পিছলে আসা যাওয়া করছে। বুঝি নড়লেই আবার ছোবল হানবে। বেউলা এক দৃষ্টে সাপটার দিকে থাকিয়েই চোখ বড় বড় করে চিৎকার করে উঠল, “খাইছে মহাজন, আপনারে কালে খাইছে। সব্বোনাশ অইছে -এ সাপের যে দাঁত তোলা অয়নাই গো! ” আসলে এ ছিল বেউলার ভয়ঙ্কর মিথ্যাচার। যা শুনে আবিদ বেপারী অজ্ঞানহয়ে পড়ল। ” তার চিৎকার আর উরুতের কাঁপুনিতে সাপটা ক্রুদ্ধ হয়ে আবিদের দুচোখে মাঝখানে নাসিকার গোড়ায় সজোরে ছোবল মারল। বেপারীর দুচোখের পাতা থরথর করে কয়েকবার কেঁপে শেষে স্থির বিস্ফোরিত হয়ে রইল। তারপর অজ্ঞান দেহটা উবুড় হয়ে পড়ল বেউলার বুকের উপর…।”বেপারী তখনো বেউলার চাতুরী বুঝতে পারেনি। হয়তো পাঠকও। এখানে গল্পটি শেষ পর্যন্ত এমন নাটকীয়তা মোড় নিয়েছে যে মিলনের শুরুতে পাঠকের মনে হবে যে নৈতিক অবস্থান থেকে বেউলা খুবই সৎ। মিলনের মাঝামাঝি সময়ে মনে হবে যে বেউলা দূর্ঘটনার বশত এমন কাজ করেছিল অর্থাৎ সাপের খোপে পা রেখেছিল কিন্তু গল্পের শেষে পাঠকের বুঝতে আর বাকি থাকেনা যে এটি একটি মহা প্রতারণা এবং তা বেউলার কথাতেই স্পষ্ট হয়েছে “…..বেউলা সুন্দরী উঠে বসে এবং জংঘাপ্রান্তে দু হাত রেখে আড়মোড়া ভাঙল। লুটিয়ে পড়া কেশরাশি খোপা করে বাঁধল। কিন্তু তখনো শাড়ি পড়ল না। সাপটাকে তখনো ফনা ধরে থাাকতে দেখে হাত বাড়িয়ে কালনাগিনীর ঘাড়টা খপ করে ধরল। তারপর বলল, ‘দাঁত নাই বাইদানীর আবার আবা ফোঁসফোঁসানি কত! লো নেংটা বাইদানী, তুই আমার লখিন্দরে করলি কী?দিমু মাথা ছেইচা।” আবিদ বেপারী। এ প্রতারণার পেছনে বেউলার ধূর্ততা ও লোভ কাজ করেছিল ভীষণভাবে। তাই ব্যবসায়িক নৈতিকতার আড়ালে বাটপারি, কিংবা ছিনতাইয়ের আশ্রয় নেই। কারণ, আবিদ তার বিবস্ত্রহওয়ার সময় চল্লিশ টাকা তুলে নিয়ে টাকার মূল বান্ডিল খুতিতে যে ভাল করে গুছিয়ে রেখেছিল তা বেউলা দেখে ফেলেছিল। তাছাড়া আগের দিন লালপুর হাটের দালালির সব টাকা প্রায় দুইশোর বেশি লেখকের বর্ণনা মতে আবিদের কাছে ছিল। তাই সবটাকাই এক সাথে কুক্ষিগত করতে পারলে হয়তো বেউলা সুন্দরীর অনেকদিনের দেহব্যবসার রোজগার। তাই আবিদের সাথে এই ভয়ঙ্কর প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছিল। এছাড়াও এমনও হতে পারে হয়তো সমাজ ও ধর্ম নিষিদ্ধ বেশ্যাপনা বা যৌনতাকে লেখক নিরুৎসাহিত করতে চেয়েছিলেন এমন সিদ্ধান্ত টেনে অর্থাৎ, আবিদ বেপারীকে একট শিক্ষা দিয়ে । অথবা ছোট গল্পের ফর্ম অন্তরে “অতৃপ্তি রবে….” এমন ধারাকে বজায় রাখতে গল্পকার অতৃপ্তিকর শেষের আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু তা যদি হয় তাহলে লেখকের আরো অনেক সুযোগ ছিল শেষ নাটকীয়তার। লেখক চাইলে অন্য আরো অনেক নাটকীয়তার যে কোন একটির আশ্রয় নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা নেননি। এখানেই আবিদ বেপারী আফসোসের সমুদ্্ের অপলক চোখের জল ফেল ডুকরে ডুকরে কেঁদেছে । এখানেই আবিদের পরাজয় আর বেউলার প্রতারণা সফল হয়। কিন্তু পাঠক? পাঠক কি চাইবেন? নিশ্চয়ই মিলন। কিন্তু হয়নি- এখানেই গল্পের সাহিত্যরসের মহা বিস্ফোরণ। এ রস প্রতারণার। এ রস ছলনার। সুতরাং, আবিদের পরাজয় মানে পাঠকেরই পরাজয়। পাঠক যতবার এ গল্প পড়বেন ততবারই পরাজিত হবেন। আর এ পরাজয়ের কারণ খুঁজতে গিয়ে হয়তো পাঠক জয়ের আনন্দ পাবেন। লেখকও হয়তো তাই চেয়েছিলেন। অতএব, এ পৃথিবী হয়তো পরাজিত আবিদ বেপারীকেই বেশি মনে রাখবে কিন্তু বিজয়ী বেউলাকে নয়।

পান্থ জাহাঙ্গীর : কথাশিল্পী।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন