শামসুর রাহমানের বাছাই দশটি কবিতা
১.খেলনার দোকানের সামনে ভিখিরি
বড়াে রাস্তা, ঘুপচি গলি ঘিঞ্জি বস্তি, ভদ্রপাড়া আর
ফলের বাজার ঘুরে খেলনার দোকানের সামনে,
দাড়ালাম। কাচের আড়ালে দেখি কাঠের পুতুল,
রেলগাড়ি, ছককাটা, বাড়ি, আরবী ঘােড়া এক জোড়া,
উড়ন্ত পাখির মতাে এরােপ্লেন, টিনের সেপাই।
ভালুক বাজায় ব্যান্ড, বাকা-শিং হরিণের পাশে
বাঘের অঙ্গার জ্বলে, বিকট হা করে আছে সিংহ ও
সারি সারি রয়েছে সাজানাে ওহাে হরেকরকম
বাজনা বাশি বাদশা বেগম আর উজির নাজির।
আমার পিরান নেই, পাগড়ি নেই লালমুখাে সেই
উজিরের মতাে, নাগরা নেই পায়। এখন দুপুর
লেপ্টে আছে পৃথিবীর গায়। কয়েকটি যুবককে
ধরে নিয়ে যাচ্ছে ওরা—লােকে বলে রাত্রিদিন তারা
নেহাই হাতুড়ি দিয়ে ইচ্ছেমতাে চেয়েছে গড়তে
কত কিছু দেশকে নতুন করে গড়ে পিটে নিতে
চেয়েছে হুজ্জত সব জ্বলন্ত জোয়ান। বুঝি তাই।
ঢিট করে দেবে ওরা যৌবনের গোয়ার ইচ্ছাকে।
“গান বন্ধ কর তােরা নর্তকী নাচের মুদ্রা ভােল”—
“এমন হুকুমনামা জারি হলে সংস্কৃতি সদনে
আমরা গােল্লায় যাবাে এবং দাতাল বর্বরতা
পেঁ তুলবে মাথা প্রাগৈতিহাসিক কূপ থেকে
হেটে যেতে যেতে বললাে কয়েকটি সুবেশ যুবক।
ইচ্ছে হয় মুখ ঘষি খেলনার দোকানের কাচে
বড়ে ইচ্ছে হয় ঘষি দুটি চোখ। যে-বিড়িটা কানে
গুজে ভারে বেরিয়ে পড়েছি পথে তাই টানি সুখে
এখানে দাড়িয়ে ঠায় দুপুরের ঠাঠা রােদে। যদি
ছুঁয়ে দেখি স্বচ্ছ কাচ সূর্যসেঁকা আত্মায় আরাম
পাবাে কিছু মনে হয়, দেখি মেঘেরা পালায় দৌড়ে
যেমন ছেলের দল ছুটে যায় পাঠশালা ছুটি
হয়ে গেলে। এ-দুপুরে নিজের ছায়াকে দেখে কাচে
ঘুরে-ফিরে কেন শুধু গায়ের নদীকে মনে পড়ে?
গায়ের নদীর তীরে একজন বাউল আমাকে
একদিন এদেশে আলাের কথা ভুলে থাকে লােক;
বড়াে বেশি অন্ধকার ঘাটে আর নখের আঁচড়ে
গােলাপ কলিজা ছেড়ে পরম্পর’বলেছিলাে হেসে।
নৌকোর গলুইয়ে বসে বুঝিনি সেদিন তার কথা,
আমি শুধু মাথা নেড়ে সায় দিয়েছিলাম তাকিয়ে
তার দু’টি উদাস চোখের দিকে; শুনতে পেলাম
নদীর শব্দের সাথে মিশে গেছে বাউলের স্বর।
ডেপুটি হাকিম নই, নই কোনাে ভবঘুরে কবি;
পথের গােলাম আমি, বুঝেছাে হে, অলীক হুকুমে
চৈত্ররাতে ফুটপাতে শুই। ঠাং দু’টি একতারা
হ’য়ে বাজে তারাপুঞ্জে, মর্মরিত স্বপ্নের মহলে
বাউলের কথামৃত স্বপ্নে হয় আমের বউল।
দ্যাখাে দ্যাখাে হাড্ডিসার লােকটার মুখের কী ছিরি,
কেমন বিচ্ছিরি লাগে দ্যাখাে কতাে নােংরা’ বলে দুটি
তরুণী কলের পুতুলের মতাে হেঁটে গেলাে চলে।
উচু বুক দেখে ভাবি পেশােয়ারি উজ্জ্বল দোকানে
দূর থেকে দেখছি তাজ্জব হয়ে টসটসে ফল।
নিজেকে কুচ্ছিত ভেবে লজ্জা পেলে সদর রাস্তায়
আমাদের চলে ? উপরে আকাশ জ্বলে নির্বিকার।
যে ভদ্দরলােক এ-মুহূর্তে এক খিলি পান কিনে
পুরলাে শৌখিন মুখে সে অশ্লীল গল্পের নায়ক
হতে পারে সহজেই, হতে পারে বেশ্যার দালাল।
বেইমান দুনিয়ায় খুনসুটি, ভালােবাসাবাসি
বুঝি না কিছুই নাকি বিলকুল বুড়াে হাবড়া আমি
হয়ে গেছি এতদিনে। কী যে ভাবি এত হাবিজাবি।
আমার জীবন নয় সুখের পানসি ঢেউয়ে ঢেউয়ে
ভেসে যাবে অথবা নেইক’ কোনাে তালুক মুলুক
দুহাতে ওড়াবাে বসে। পুণ্যলােভী দাতার দয়ায়
জীবনে সম্বল শুধু কয়েকটি তামার পয়সা।
গতকাল ফ্ৰকপরা যে-মেয়েটি একটি দু’আনি
হাসিমুখে দিয়েছিলাে এই হতচ্ছাড়া ভিখিরিকে,
কাচের আড়ালে রাখা ফুটফুটে পুতুলের মুখে
হঠাৎ পেলাম খুজে রাঙা তার মুখের আদল
—আমার মাবুদ তাকে খােশােল বেগম করুন।
যে-লােকটা সারাদিন পাখি বেচে গড়েছে সংসার,
হলুদ পাখির মতাে যার বউ সে কেন গলায়
পরে ফাস ? সে লাশ পচার আগে মৃত এক পাখি
বউটিকে নিশীথে কাদাতে এসে দ্যাখে, হা কপাল,
আনন্দে উচ্ছল নারী হয়েছে উৎসব দ্বিধাহীন,
আয়নায় কাজল পরা দুটি চোখ ক্ষুধায় উজ্জ্বল।
‘দূর হ এখান থেকে হা-ভাতে ভিখিরি কোথাকার
আস্তাকুঁড়ে বেছে নে আস্তানা, নােংরা খুঁটে খা-গে’–
দোকানি খেকিয়ে ওঠে। খেলনা ফেলনা নয় জানি,
এখন এখান থেকে, আল্লা, যাবাে কোন্ জাহান্নামে!
ফেলানা ফেলনা নয়। ফলের বাজার পুতুলের
স্থির চোখ পীরের মাজার, হৈ-চৈ মানুষের ভিড়,
গারের নদীর তীর গুঞ্জরিত বাউলের স্বরে
গেরপাড়ায় বেশ্যাবৃত্তি, ভালুক বাজায় ব্যান্ড,
বাজনা বাজে, ফলের বাজার,
ফ্রশ ফুটফুটে মেয়েটির একটি আনি
হাতের চেটোয় নাচে, কাচের আড়ালে দুই যােদ্ধা,
সেপাই রাঙায় চোখ, ভদ্দরপাড়ায় বাজনা বাজে।
‘আস্তাকুঁড়ে বেছে নে আস্তানা’, খেলনা ফেলে নয়…
২. বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা
নক্ষত্রপুঞ্জের মতাে জ্বলজ্বলে পতাকা উড়িয়ে আছে আমার সত্তায়।
মমতা নামের দ্রুত প্রদেশের শ্যামলিমা তােমাকে নিবিড়
ঘিরে রয় সর্বদাই। কালাে রাত পােহানাের পরের প্রহরে
শিউলি শৈশবে ‘পাখী সব করে রব’ বলে মদনমােহন
তর্কালঙ্কার কী ধীরােদাত্ত স্বরে প্রত্যহ দিতেন ডাক। তুমি আর আমি,
অবিচ্ছিন্ন, পরস্পর মমতায় লীন,
ঘুরেছি কাননে তার নেচে নেচে, যেখানে কুসুমকলি সবই
ফোটে, জোটে অলি ঋতুর সঙ্কেতে।
আজন্ম আমার সাথী তুমি,
আমাকে স্বপ্নের সেতু দিয়েছিলে গড়ে পলে পলে,
তাইতাে ত্রিলােক আজ সুনন্দ জাহাজ হয়ে ভেড়ে
আমারই বন্দরে।
গলিত কাচের মতাে জলে ফাৎনা দেখে দেখে রঙিন মাছের
আশায় চিকন ছিপ ধরে গেছে বেলা। মনে পড়ে, কাচি দিয়ে
নক্সা কাটা কাগজ এবং বােতলের ছিপি ফেলে।
সেই কবে আমি ‘হাসি-খুশি’র খেয়া বেয়ে
পৌছে গেছি রত্নদ্বীপে কম্পাস বিহনে।
তুমি আসসা, আমার ঘুমের বাগানেও
সে কোন বিশাল
গাছের কোটর থেকে লাফাতে লাফাতে নেমে আসাে,
আসসা কাঠবিড়ালির রূপে,
ফুল্ল মেঘমালা থেকে চকিতে ঝাপিয়ে পড়াে ঐরাবত সেজে,
সুদূর পাঠশালার একান্নটি সতত সবুজ
মুখের মতােই দুলে দুলে ওঠো তুমি
বারবার কিংবা টুকটুকে লঙ্কা-ঠোট টিয়ে হয়ে
কেমন দুলিয়ে দাও স্বপ্নময়তায় চৈতন্যের দাড়।
আমার এ অক্ষিগােলকের মধ্যে তুমি আঁখিতারা।
যুদ্ধের আগুনে,
মারীর তাণ্ডবে,
প্রবল বর্ষায়
কি অনাবৃষ্টিতে,
বারবনিতার
নূপুর নিক্কণে,
বনিতার শান্ত
ঘৃণায় ধিক্কারে,
নৈরাজ্যের এলাে-
ধাবাড়ি চিৎকারে,
সৃষ্টির ফাল্গুনে
হে আমার আঁখিতারা তুমি উন্মীলিত সর্বক্ষণ জাগরণে।
তােমাকে উপড়ে নিলে, বলাে তবে, কী থাকে আমার ?
উনিশ শশা বায়ান্নোর দারুণ রক্তিম পুষ্পাঞ্জলি
বুকে নিয়ে আছাে সগৌরবে মহীয়সী।
সে-ফুলের একটি পাপড়িও ছিন্ন হলে আমার সত্তার দিকে
কত নােংরা হাতের হিংস্রতা ধেয়ে আসে।
এখন তােমাকে নিয়ে খেঙরার নােংরামি
এখন তােমাকে ঘিরে খিস্তি-খেউড়ের পৌষমাস!
তােমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানাে,
বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা।
৩. কবিকে দিও না দুঃখ
কবিকে দিও না দুঃখ দিলে সে-ও জলে-স্থলে
হাওয়ায় হাওয়ায়
নীলিমায় গেঁথে দেবে দুঃখের অক্ষর। কবি তার নিঃসঙ্গতা
কাফনের মতাে মুড়ে রাখে আপাদমস্তক, হঁটে
ফুটপাতে একা,
দালানের চূড়ায় চূড়ায়, দিগন্তের অন্তরালে
কেমন বেড়ায় ভেসে, চাদের নিকট যায়, নক্ষত্র ছিটোয় যত্রতত্র
খােলামকুচির মতাে। তাকে দুঃখ দিও না, চৌকাঠ থেকে দূরে
দিও না ফিরিয়ে।
ফেরালে নক্ষত্র, চাদ করবে ভীষণ হরতাল, ছায়াপথ তেজস্ক্রিয়
শপথে পড়বে ঝরে, নিমেষেই সব ফুল হবে নিরুদ্দেশ।
প্রায়শ পথের ধারে ল্যাম্পােস্টে হেলান দিয়ে খুব
প্রচ্ছন্ন দাড়িয়ে থাকে, কখনাে বা সীমাহীন রিক্ততায়
রেস্তোরায় বসে
বান্ধববিহীন বিষাদের মুখােমুখি
নিজেই বিষাদ হয়ে। মাঝে-মধ্যে চৌরাস্তায় খুঁড়ে তােলে এক
গােপন ফোয়ারা পিপাসার্ত পথিকেরা আঁজলা ভরবে বলে।
আবার কখনাে তার মগজের উপবনে লুকোচুরি খেলে
খুনী ও পুলিশ!
মধ্যরাতে শহরের প্রতিটি বাড়ির দরজায় কিছু ফুল
রেখে আসে নিরিবিলি কাউকে কিছু না বলে। কবি সম্মেলনে
রাজধানী আর মফস্বলে স্টেজে কয়েক ডজন
পঙক্তির জ্যোৎস্নায় রৌদ্রে পুনরায় স্নান সেরে স্বকীয় গােপন
ঘুলঘুলিটার
দিকে চোখ রেখে নীলিমার সঙ্গে বাণিজ্যের কথা ভাবে, ভাবে
সুদূর অনন্ত তাকে চোখ টিপে বেঘােরে ঘােরাবে কতাে আর ?
কবি সম্মেলনে তেজী যুবরাজ, প্রেমের নিকট বাস্তবিক
বড়াে নগ্ন, বড়াে অসহায় !
কবিকে দিও না দুঃখ, স্বপ্নের আড়ালে তাকে তীব্র
আত্তি করতে দাও পাথর, পাখির বুক, গাছ,
রমণীয় চোখ,
হঠাৎ যেতে দাও ছায়াচ্ছন্ন পথে, দাও সঁতার কাটতে
বায়ুস্তরে একা,
অথবা থাকতে দাও ভিড়ে নিজের ভেতরে। রােজ
হােক সে রূপান্তরিত বার বার। নিজস্ব জীবন রেখেছে সে
গচ্ছিত সবার কাছে নানান ধরনে অকপট।
কবিকে দিও না দুঃখ, একান্ত আপন দুঃখ তাকে
খুঁজে নিতে দাও।
৪. আমিও তােমার মতাে
আমিও তােমারই মতাে রাত্রি জাগি, করি পায়চারি
ঘরময় প্রায়শই, জানালার বাইরে তাকাই,
হাওয়ায় হাওয়ায় কান পাতি, অদূরে গাছের পাতা
মর্মরিত হলে ফের অত্যন্ত উৎকর্ণ হই, দেখি
রাত্রির ভেতরে অন্য রাত্রি, তােমার মতােই হু-হু
সত্তা জুড়ে তৃষ্ণা জাগে কেবলি শব্দের জন্যে আর
মাঝে মাঝে নেশাগ্রস্ত লিখে ফেলি চতুর্দশপদী,
শেষ করি অসমাপ্ত কবিতা কখনাে ক্ষিপ্র ঝােকে।
কোনাে কোনাে দিন বন্ধ্যা প্রহরের তুমুল ব্লিজার্ডে
ভুরুতে তুষার জমে, হয়ে যাই নিষ্প্রাণ জমাট
রাজহাস যেন, দিকগুলি আর হয় না সঙ্গীত।
অবশ্য তােমার তটে উজ্জ্বল জোয়ার রেখে গেছে।
রত্নাবলি বার বার। যখনই তােমার কথা ভাবি,
প্রাচীন রাজার সুবিশাল তৈলচিত্র মনে পড়ে।
তােমার অমিত্রাক্ষর হিরন্ময় উদার প্রান্তর,
তােমার অমিত্রাক্ষর সমুদ্রের সুনীল কল্লোল,
তােমার অমিত্রাক্ষর ফসলের তরঙ্গিত মাঠ,
তােমার অমিত্রাক্ষর ধাবমান স্বপ্ন-অশ্বদল,
তােমার অমিত্রাক্ষর নব্যতন্ত্রী দীপ্র বঙ্গভূমি,
তােমার অমিত্রাক্ষর উন্মথিত উনিশ শতক।
হেনরিয়েটার চোখে দেখেছিলে কবিতার শিখা ?
কি কবিতাই প্রিয়তমা হেনরিয়েটার চোখ ?
হাসপাতালের বেডে শুয়ে সে চোখের অস্তরাগে।
তুমি কি খুঁজেছে কোনাে ট্রাজেডির মেঘ? হয়তােবা
অভ্যাসবশত বেডে অসুস্থ আঙুল ঠুকে ঠুকে
আস্তেসুস্থে বাজিয়েছে ছন্দ মাঝে মাঝে, বাষ্পকুল
চোখে ভেসে উঠেছিলাে বুঝি দূর কাব্যের কানন।
কখনাে দেয়ালে ক্লান্ত চোখ রেখে হয়তাে ভেবেছাে—
কি কাজ বাজায়ে বীণা ? এ-আঁধারে কিবা মাইকেল
কি মধুসূদন কার প্রকৃত অস্তিত্ব অনন্তের
নিরুদ্দেশে রেণু হয়ে ঝরে, কে বলে দেবে, হায় !
আমিও তােমারই মতাে প্রাদেশিক জলাভূমি ছেড়ে
দূর সমুদ্রের দিকে যাত্রা করি, যদিও হোঁচট
খেয়ে পড়ি বারংবার। রক্তে নাচে মায়াবী য়ুরােপ
ইতালী ভ্রমণ করে, সুদূর গ্রীসের জলপাই
পল্লবে বুলিয়ে চোখ, বুলেভার ছেড়ে ফিরে আসি
সতত আপন নদে তােমার মতােই কী ব্যাকুল
আমাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত কপােতাক্ষ আছে।
৫. নিজের কবিতা বিষয়ে কবিতা
আমার কবিতা নিয়ে রটনাকারীরা আশেপাশে
নানা গাল-গল্প করে। কেউ বলে আমার কাব্যের
গােপনাঙ্গে কতিপয় বেঢপ জড়ল জাগরুক,
ওঠেনি আক্কেল দাত আজো তার, বলে কেউ কেউ
আমার কবিতা নাকি বাউণ্ডুলে বড়াে, ফুটপাথে
ঘােরে একা একা কিংবা পার্কের বেঞ্চিতে বসে থাকে,
ইন্দ্রিয়বিলাসে মজে বন্ধ কুঠুরিতে, মাঝে মাঝে
শিস দেয়; আমার কবিতা খুব বেহুদা শহুরে !
একরত্তি কাণ্ডজ্ঞান নেই তার, সবার অমতে
সােৎসাহে চাপিয়ে গায়ে আজব জ্যাকেট, কেয়াবাৎ,
সুনীল লণ্ঠন হাতে দিন-দুপুরেই পর্যটক
এবং অভ্যাসবশে ঢােকে সান্ধ্য মদের আড্ডায়।
মদের বােতল রুক্ষ গালে চেপে অথবা সরােদে
চুমু খেয়ে অস্তিত্বহীনতা বিষয়ক গান গায়,
এবং মগজে তার নিষিদ্ধ কথার ঝাক ওড়ে
মধুমক্ষিকার মতাে সকালে কি রাত বারােটায়।
আমার কবিতা অকস্মাৎ হাজার মশাল জ্বেলে
নিজেই নিজের ঘর ভীষণ পুড়িয়ে দেখে নেয়।
অগ্ন্যুৎসব; কপােতীর চোখে শােক; এদিকে নিমেষে
উদ্বাস্তু গৃহদেবতা, কোথাও করবে যাত্রা ফের।
বিদ্যের জাহাজ দ্রুত চৌদিকে রটিয়ে দেয়, ওর
পদ্যটদ্য এমন কি ইকেবানা নয়, এইসব
আত্মছলনার অতি ঠুনকো পুতুলটিকবে না,
ভীষণ খুঁড়িয়ে যাবে কালের কুড়ুলে শেষমেষ।
যখন পাড়ায় লাগে হঠাৎ আগুন ভয়াবহ,
আমার কবিতা নাকি ঘুমােয় তখনও অবিকল
গাছের গুড়ির মতাে ভাবলেশহীন। আর ঘুম
ভাঙলেও আত্মমগ্ন বেহালায় দ্রুত টানে ছড়!
আমার কবিতা করে বসবাস বস্তি ও শ্মশানে,
চাড়ালের পাতে খায় সূর্যাস্তের রঙলাগা ভাত,
কখনাে পাপিষ্ঠ কোনাে মুমূর্ষ রােগীকে কাধে বয়ে
দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে পৌছে যায় আরােগ্যশালায়।
আমার কবিতা পথপ্রান্তে দুঃখীর চোখের মতাে
চোখ মেলে চেয়ে থাকে কার পায়ের ছাপের দিকে,
গা পােয় ঝরনার জলে। স্বপ্ন দ্যাখে, বনদেবী তার
ওষ্ঠে ঠোট রেখে হু হু জ্বলছেন সঙ্গম-লিপ্সায় !
৬. বাইবেলের কালাে অক্ষরগুলাে
জো, তুমি আমাকে চিনবে না। আমি তােমারই মতাে
একজন কালাে মানুষ গলার সবচেয়ে
উচু পর্দায় গাইছি সেতুবন্ধের গান, যে-গানে
তােমার দিলখােলা সুরও লাগছে।
জো, যখন ওরা তােমার চামড়ায় জ্বালা-ধরানাে
সপাং সপাং চাবুক মারে আর
হাে হাে করে হেসে ওঠে,
তখন কালসিটে পড়ে সভ্যতার পিঠে।
যখন ওরা বুটজুতােমােড়া পায়ে লাথি মারে তােমাকে,
তখন ধূলায় মুখ থুবড়ে পড়ে মানবতা।
জো, যখন ওরা তােমাকে
হাত-পা বেঁধে নির্জন রাস্তায় গার্বেজ ক্যানের পাশে।
ফেলে রাখে, তখন ক্ষ্যাপাটে অন্ধকারে
ভবিষ্যৎ কাতরাতে থাকে
গা ঝাড়া দিয়ে ওঠার জন্যে।
যদিও আমি তােমাকে কখনাে দেখিনি জো,
তবু বাইবেলের কালাে অক্ষরের মতাে তােমার দু’ফোটা চোখ
তােমার বেদনার্ত মুখ বারংবার
ভেসে ওঠে আমার হৃদয়ে, তােমার বেদনা
এশিয়া, আফ্রিকা আর লাতিন আমেরিকায় ব্যাপ্ত, জো।
আমি একজন ফাসির আসামীকে জানতাম,
যিনি মধ্যরাতে আবৃত্তি করতেন রবীন্দ্রনাথের কবিতা।
আমি এক সুদর্শন যুবাকে জানতাম,
যে-দয়িতার মান রাখার জন্যে জান কবুল করেছিলাে।
আমাদের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে,
আমি একজন যাবজ্জীবন কারাবন্দী তেজী।
নেতাকে জানতাম, দুঃস্বপ্ন থেকে জেগে উঠে
যিনি কোনাে কোনাে রাতে তার শিশুকন্যাকে একটু
স্পর্শ করার জন্যে, ওর মাথার ঘ্রাণ নেয়ার জন্যে উদ্বেল আর
ব্যাকুল হয়ে আঁকড়ে ধরতেন
কারাগারের শিক।
আমি এমন এক তরুণের কথা জানতাম,
যে-তার কবিতায় আলালের ঘরের দুলাল, মেনিমুখাে শব্দাবলি ঝেড়ে ফেলে
অপেক্ষা করতাে সেদিনের জন্যে,
যেদিন তার কবিতা হবে মৌলানা ভাসানী
এবং শেখ মুজিবের সূর্যমুখী ভাষণের মতাে।
যখন তাদের কথা মনে পড়ে,
তখন তােমার কথা নতুন করে ভাবি, জো।
জো, যখন তােমার পাচ বছরের ছেলের
বুক থেকে রাস্তায় ওরা ঝরায় টক্টকে লাল রক্ত,
যেমন পিরিচে ঢেলে দ্যায় কফি,
জো, যখন তােমার পােয়াতি বউ হায়নাদের
দৃষ্টি থেকে পালানাের জন্যে দৌড়াতে দৌড়তে
মাঝপথে হুমড়ি খেয়ে পড়ে,
জো, যখন তােমার সহােদরকে ওরা
লটকিয়ে দ্যায় ফাসিতে,
তখন কাচা দুধের ফেনার মতাে ভােরের শাদা আলােয়
বাইবেলের কালাে অক্ষরগুলাে আর্তনাদ করতে করতে
হঠাৎ বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
৭.নূহের জনৈক প্রতিবেশী
লােকশ্রুত মহাপুরুষের অলৌকিক জেল্লা নেই
আমার সত্তায়, আমি আটপৌরে ছাপােষা মানুষ,
কোনােমতে সংসারের হাল ধ’রে আছি দাঁতে দাঁত
চেপে সামান্যের ভরসায়, কিছু আয় ক’রে আর
কিছুবা দেনার টানে। সন্ধ্যেবেলা গৃহিণী ভাজেন
রুটি, আমি, কাজ-থেকে-ফেরা, পুরনাে জোব্বাটা রেখে
এক কোণে ক্লান্ত গা এলিয়ে খাটে আমার নিজস্ব
অতীতের অভ্যন্তরে আস্তেসুস্থে আঙুল চালাই,
যেমন ধার্মিক ধর্মপুস্তকের পাতা ক্রমাগত
উল্টে যান ভাবাবেশে নিরিবিলি। এইমতাে কাটে
দিন কায়ক্লেশে, থাকি প্রাতঃস্মরণীয় মহাপ্রাণ
নহের বাড়ির পাশে সন্তান-সন্ততিসহ আর
বৈয়মের তৈলসিক্ত জলপাইয়ের মতন আমি
শুষে নিই, যতদুর পারা যায়, উচ্ছল আরক
জীবনের প্রায়শই বন্ধুর ডেরায় যাই, করি
গলগাছ, মাঝে-মধ্যে ও ৪রণময় বাজারের
আশপাশে শুনি সদ্য প্রত্যাগত মাঝি-মাল্লাদের
সরস কাহিনী কত। কখনাে কখনাে মধ্যরাতে
অতীত সম্ভোগ করি গৃহিণীর সঙ্গে কিংবা ভাবি
যুগ্মতায় কিভাবে কতটা ব্যয়সঙ্কোচন করা
যায়, কেনা যায় কিছু শস্যদানা এবং একটি
পাহাড়ী দুধালাে ছাগী। জালার শীতল পানি শেষ
হয়ে এলাে কি না, দেখি কখনাে-সখনাে। এভাবেই
দিন যায়, দিন আসে জন্ম-মৃত্যুময় এই নাটে।
অকস্মাৎ পথে পথে মজলিসে হট্টরােলে শুনি।
নুহের জাহাজ নাকি জোড়া জোড়া নানা পশুপাখি,
হরেকরকম শস্যবীজসমেত ভেসেছে আজ
ভয়ানক ফুঁসে-ওঠা সমুদ্রে। কেননা গর্জমান
মহাপ্লাবনের নূর তাণ্ডব হয়েছে শুরু আর
চতুর্দিকে দিশাহারা বিপন্ন মানুষ অগ্নিদগ্ধ
মৌমাছির মতাে পলায়নপর। কে এক পায়রা
চকিতে আসবে ব’লে নুহের ব্যাকুল দৃষ্টি গাথা
পানি-ধােয়া দিগন্তের দিকে। জনসাধারণ থেকে
বহুদূরে নিরাপদে এই অবস্থান, একি নয়
পলায়নীমনােবৃত্তি ধীমান নূহের ? আমি এক
সাধারণ নগণ্য মানুষ, আছি অতি উপদ্রুত
মানুষেরই মাঝে ; কাদামাখা হাতে সকলের
সাথে মিলে নিয়তির বিরুদ্ধে নিয়ত অনলস
লড়ে বাঁধ গড়ে মহাপ্লাবনের এব্যাপক রােষ
আকুল থামাতে চাই। যদি যাই ভেসে, তবু নেই
কোনাে খেদ। পাড়া-পড়শীকে, হাজার হাজার আর্ত-
মানুষকে বিপর্যয়ে ফেলে আমি সুদূরে হইনি
পলাতক এই গৌরবের কিরীটি জ্বলবে হিংস্র
ফউমের চূড়ায় নৃত্যপর প্রদীপের মতাে দ্রুত
মন আমার মাথায় আর এই হস্তদ্বয়,
অঙ্গে এঙ্গে ‘ফু হস্তদ্বয়া, ক্রোশ ক্রোশ ব্যাপী
পর পুরুষের আর্তনাদে, ভয়ঙ্কর চোরাটানে।
আল খুঁজবে শুধু বিপন্ন ডুবন্ত কোনাে হাত।
৮. টানেলে একাকী
একটি টানেলে
কাটিয়ে ছিলাম হিমযুগ এবং প্রস্তরযুগ, তাম্রযুগ,
লৌহযুগ খুব একা একা
কাছাকাছি কেউ নেই এবং দূরেও ঘন কুয়াশায় কারাে
অস্তিত্ব ফোটে না, শুধু ব্যর্থ যৌবনের মতাে একটি কুকুর আজো
সঙ্গে সঙ্গে থাকে।
কতকাল আমি সূর্যোদয়
দেখিনি, শুনিনি কোনাে দোয়েলের শিস। কালেভদ্রে
যেন কোনাে বাজিকর টানেলের দেয়ালে ফোটায়
আলাের গােলাপ, ঝিল্লীস্বর শুনে টের পাই রাত।
যদিও প্রায়শ শ্বাসকষ্ট হয়, তবু নিশ্বাস নেবার মতাে
অবশ্য থেকেই যায় কিছু অক্সিজেন।
টানেলের ভেতরে হঠাৎ
কখনাে চিৎকার শুনে আতঙ্কে শরীর শজারুর
কাটা হয় আর চোখ ফেটে যায় আনারের মতাে। চতুর্দিকে
দৃষ্টি ছােটে, ঘুরি দুটি হাত প্রসারিত করে, অথচ আমার
নিজস্ব অস্পষ্ট ছায়া ছাড়া কাউকে পাই না খুঁজে
কোথাও এখন।
কখনাে কখনাে
মনে হয়, কী যেন কিসের ঘােরে চলে গেছি সুদূর কোথাও
স্বপ্নচর পাখির পাখায় ভর করে, কাছে আসে।
বাহাদুর শাহ জাফরের গজলের মতাে এক
বিরান বাগান আর মােগল মিনিয়েচর কিছু অস্তরাগে কান্নারুদ্ধ
রক্তাভ চোখের মতাে পুরাণসম্ভব।
অপরাহে ডিভানে শায়িতা
মহিলা আমাকে ডেকে পিকাসাের ত্রিমুখী রমণী হয়ে যান
চোখের পলকে, আমি তার স্তনদ্বয়, অভিজাত নাভিমূল,
রমণীয়, উল্লসিত যােনি থেকে দূরে, ক্রমশ অনেক দূরে
চলে যেতে থাকি ; তিনি কবিতার পঙক্তির মতন
কেবলি ওঠেন বেজে অস্তিত্বে আমার।
এ কোথায় এসে
দাড়ালাম অবশেষে? তবে কি প্রকৃত রবটের
কাল শুরু হলাে আজ? সকলেই রবট তাহলে ইদানীং ?
কান্তিমান লাইনাে টাইপগুলি করেছে নির্মাণ
অদ্ভুত জগৎ এক ; রাশি রাশি টাইপ কী দ্রুত
বেলা-অবেলায়
অবলীলাক্রমে
মিথ্যাকে বানায় সত্য, সত্যকে ডাগর মিথ্যা আর
রমণ, বমন, বিস্ফোরণ, যূথবদ্ধ আত্মহনন ইত্যাদি
শব্দাবলি দশদিকে সহজে রটিয়ে দেয় এবং সাজায়।
সুচারু যান্ত্রিকভাবে কবিতার পঙক্তিমালা মিল-
অমিলের উদ্ভট নক্শায়।
অসম্ভবে হয়েছি সওয়ার
আকৈশাের; অতিকায়, মৎস্যপৃষ্ঠে করেছি ভ্রমণ
সমুদুরে বহুকাল, জলপরীদের দিব্যলালিম স্তনাগ্র ছুঁয়ে-ছেনে
গেছে বেলা পাতালের জলজপ্রাসাদ আর খসিয়ে নিজের
বুকের পাজর থেকে হাড় বানিয়েছি দেবতারও
ঈর্ষণীয় বাশি।
অথচ উচ্চাভিলাষহীন
গৌরবের হেমবর্ণ চূড়া থেকে বহুদূরে আছি,
দেখি কয়লার গুঁড়াে, স্বপ্নবৎ উর্ণাজাল, কীট-পতঙ্গের
ঘর-গেরস্থালি, দেখি জানু বেয়ে ওঠে নীল পােকা, মাঝে মাঝে
বাদুড়ের ডানা কাপে, সিল্কের রুমাল যেন ; থাকি দীর্ঘ কালাে
টানেলে একাকী।
৯.শিরােনাম মনে পড়ে না
স্বপ্নে দেখলাম, মেহগনি কাঠের টেবিলে ঝুঁকে
লিখছি তন্ময় আমি বিশ শতকের
সর্বশেষ কবিতা আমার
শিরােনামহীন। এ কবিতা ভিলানেল
নাকি সেসটিনা ? এর ছন্দ
সংহত অমিত্রাক্ষর অথবা মরুভূমির বুকে
উটের যাত্রার মতাে গদ্যের দুলুনিময়—কিছুই স্মরণে
নেই, শুধু মনে পড়ে
কী দ্রুত চলেছি লিখে একটানা, যেমন কর্মিষ্ঠ, অনলস
মাঝি গুণ টানে পাড়ভাঙা
নদীর কিনারে ধনুকের বাকানাে ছিলার অবয়বে।
কলমের নিব সারসের চঞ্চু, অবলীলাক্রমে
গেথে নেয় মাছ,
কখনাে পালক খোটে উড্ডয়নপ্রিয়
স্বপ্নময়তায়, কখনাে বা তাকায় চরের দিকে,
পানিতে নিজের ছায়াটিকে ভালােবাসে কিছুক্ষণ।
স্বপ্নে দেখলাম, সর্বশেষ কবিতা আমার কুয়াশায় ঘেরা
স্টিমারের ডেক ; কতিপয় ছায়া করে আসা-যাওয়া,
রেলিঙে হেলান দিয়ে কেউ ঢেউয়ের মাস্তানি দ্যাখে,
কেউ ডেক চেয়ারের
আশ্রয়ে সায়ন্স ফিকশন হাতে ঝিমায়, কেউবা
চুরুটের ছাই ঝাড়ে, খালাসী তাতারি নাচে মাতে। অকস্মাৎ
হরিণের কাটা মুণ্ডু, পােড়া গন্ধময় মােমবাতি
এবং স্বলিত আংটি, ছুরি ডেকে গড়াগড়ি যায়।
বিশ শতকের সর্বশেষ
কবিতা আমার ভূর্জপত্রে কালিদাসী হস্তাক্ষরে গড়ে ওঠে,
আবার লাইনাে টাইপের ছাদে, কিছু রাবীন্দ্রিক
মায়া লেগে থাকে, পিছুটান মৃত বিহঙ্গের মতাে
গলায় দোদুল্যমান। তুলােট কাগজে অক্ষরের পরে কত
অক্ষর সাজাই সুশৃঙ্খল, কিন্তু সব ওলটপালট হয়ে যায়,
পঙক্তিমালা গায়েব এবং বালিয়াড়িময় পড়ে থাকে
উটের গলিত চোখ, খুলি, বিধ্বস্ত বেহালা আর ছেড়া তসবিহদানা।
বিশ শতকের সর্বশেষ কবিতায়।
সুচেতা দাড়ায় এসে খােলা চুলে, মেহগনি কাঠের টেবিলে
বসে পা দোলায় ঘন ঘন, পরনে গাউন তার, কথা বলে।
অবােধ্য ভাষায় আর তার দিকে লক্ষ লক্ষ শীর্ণ হস্তপ্ত
শূন্য থালা, সে বিহুলা ব্যর্থ অন্নপূর্ণা লহমায়
উধাও এবং আমি ভীষণ পদদলিত, হাতে
ছেড়া পাণ্ডুলিপি; একটি বেড়াল, কালাে, চুচুক্
চাটে শূন্যতাকে দুধ খাওয়ার ভঙ্গিতে।
স্বপ্নে দেখলাম, মেহগনি কাঠের টেবিলে বসে।
কবিতা আমার আজরাইলের সঙ্গে পাশা খেলে, মাঝে মাঝে
জেনে নিতে চায় কত ব্যাপ্ত জ্ঞানের বলয় আর
সুবিশাল ছত্রাকের মতাে কী যেন ছড়িয়ে পড়ে দশদিকে।
সর্বশেষ কবিতা আমার তেজস্ক্রিয় আবর্জনা-স্যুপ থেকে
আবার গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে আর বিশ শতকের
শেষ সূর্যরশ্মির চুম্বন খেতে খেতে বেহুলার ভেলার মতন যায়
ভেসে যায় উথালপাথাল গাঙ্গুড়ের ঢেউয়ে ঢেউয়ে।
১০. আমার অভিযােগের তর্জনী
আমার অভিযােগের তর্জনী এখন তােমার দিকেই
উদ্যত। নিঃসঙ্গতা
জ্বলজ্বলে মণিহারের বদলে লােহার শেকল হয়ে উঠলেই
উত্তুঙ্গ চূড়া ছেড়ে নিচে
নেমে আসতে হবে, এ-কথা
কে বলেছিলাে তােমাকে? কেন তুমি
প্রাচীন ইরানী চিত্রকরের
ছবির মতাে পাখার বৈভব আর চঞ্চুর কিরিচে
স্বপ্নের সওগাত গেঁথে এই নচ্ছার মৃত্যুমাখা
ভাগাড়ে নেমে এসেছিলে ?
তােমার পাখায় ছিলাে নীলমণির মতাে আকাশের
নিঃসীম উল্লাস, চারণ কবির
মেঠো গাথার মতাে বন্দনা-মুখর সহজ সৌন্দর্য,
আর সুকণ্ঠ মুয়াজ্জিনের আজানের মতাে অনাবিল আহান।
তােমার চোখে আশ্রয় পেয়েছিলাে
সেই বিপ্লবীর অন্বেষা, যে তার চিরকালীন ঘর ছেড়ে
ঘুরে বেড়ায় পথে পথে ভ্রষ্ট পথিকদের
অভীষ্ট উদ্যানের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
তােমার এই নিরুপম ঐশ্বর্য ভীষণ বেমানান
এখানে, এখন এ-কথা
তােমার বুঝতে বাকি নেই নিশ্চয়। মড়াখেকোদের ভিড়ে
কী গান গাইবে তুমি ? ইতিমধ্যেই কি আবর্জনায়
রুদ্ধ হয়ে আসেনি তােমার কণ্ঠনালী ?
তােমার হৃৎপিণ্ড কি বেরিয়ে আসতে চাইছে না
এক দুঃসহ চাপে,
যার উৎস দুর্বিনীতের আস্ফালন, নির্বোধের ক্রোধ ?
ইচ্ছে হলেই এখন তুমি তােমার চিত্রিত পাখা মেলে
ফিরে যেতে পারবে না দূরের আকাশে,
যেখানে তুমি সাতার কাটতে পারাে স্বচ্ছন্দে নানা রঙের
মেঘের রেণু ওড়াতে ওড়াতে,
যেখানে পবিত্রতার মতাে শূন্যতা ছড়িয়ে আছে
তবকে তবকে। বস্তুত এই মুহূর্তে তােমার
পাখা দুটোকে ছন্দিল করে তােলার
কোন উপায় নেই। কেননা তােমার পদদ্বয়
আর পাখা শােচনীয়ভাবে আটকে গিয়েছে
রাশি রাশি তারের মতাে নাড়ি-ভুড়িতে।
আস্তে আস্তে চতুর্দিক থেকে এগিয়ে আসছে
শেয়াল-কুকুরের পাল,
আর তােমার বুকের ভেতর ছড়িয়ে পড়ছে অন্ধকার,
যেমন কোন শহরে চড়াও হয় দখলদার সেনাবাহিনী।
এক্ষুণি ওরা ঘিরে ধরবে তােমাকে। এই আগ্রাসী
ব্যুহ ভেদ করবার সাধ্য তােমার নেই।
তােমার একদিকে মাথা-ডােবানাে গলিজ জঞ্জাল,
অন্যদিকে ক্ষমাহীন শত্রতা। বলাে, হে-স্বপ্নলালিত সৌন্দর্য,
কোথায় পালাবে তুমি ? কোথায়।
তােমার পরিত্রাণ ?
আমি দেখতে পাচ্ছি।
ডানদিকে শােকের মতাে ছড়ানাে
তােমার ছেড়া-খোড়া যাবতীয় পালক, বায়ে
গড়াগড়ি যাচ্ছে তােমার মুণ্ড আর তখনও স্পন্দিত
হৃৎপিণ্ড বিদ্ধ শেয়ালের দাতে আর
নিষ্পত্র গাছে বসে হাসছে কতিপয় শকুন।
শ্মশানের ঠাঠা রৌদ্রের মতাে সেই অট্টহাসি
ব্যাপ্ত হলাে দিগন্ত থেকে দিগন্তে
এবং আমার অভিযােগের তর্জনী এখন তােমার
ধ্বংসাবশেষের দিকে উদ্যত। কে তােমাকে
উদার আকাশের মেঘমালার সঙ্গ ছেড়ে,
পর্বতচূড়ার সখ্য ছেড়ে
এই ভাগাড়ে নেমে আসতে বলেছিলাে ?