কাজী জহিরুল ইসলাম 

গ্রীষ্ম

সকালে সোনালু ফুল মেলে দেয় রোদের ঝালর 
কাঠগোলাপের ঘ্রাণে ম ম করে গ্রীষ্মের সকাল
রোদের ছেলেরা এসে তীব্র দাহে পোড়ায় গতর
দাবদাহে ঘন হয় আম, জাম, লিচু ও কাঁঠাল।

কাঠগোলাপের ঘ্রাণে ম ম করে গ্রীষ্মের সকাল
দুপুরে নিরাক তাপদাহে পোড়ে জলশূন্য বিল
ধূলিওড়া মেঠোপথ জড়ায় কৃষ্ণচূড়ার লাল
ঈশানে তামাটে মেঘ, ছুটে আসে ভয়ের মিছিল।

দুপুরে নিরাক তাপদাহে পোড়ে জলশূন্য বিল
দুধহীন শুকনো ওলান, উঠানে করুণ গাভী
তা বলে কী জৈষ্ঠ্যের জামাই ষষ্ঠী হয়েছে বাতিল?
কিষাণীর চোখে জাগে স্বপ্ন, বর্ষণ অবশ্যম্ভাবী।

দুধহীন শুকনো ওলান, উঠানে করুণ গাভী
সবুজ পাতার ফাকে ‘বউ কথা কও’ পাখি ডাকে
হিমালয় থেকে নেমে তোলে চাতক বৃষ্টির দাবি। 
মাঠের ফসল ‘মেঘ দে পানি দে’ আওয়াজ হাঁকে।

সবুজ পাতার ফাকে ‘বউ কথা কও’ পাখি ডাকে
খা খা শুষ্ক মাঠ, বিরাণ প্রান্তরে বিষন্ন প্রহর
সন্ধ্যার তামাটে মেঘ ভয়ের বিকট ছবি আঁকে
সকালে সোনালু ফুল মেলে দেয় রোদের ঝালর।

হলিসউড, নিউইয়র্ক। ১১ জানুয়ারি ২০২০

 
বর্ষা

টিপটিপ ঝরঝর অবিরাম দিন ভর ঝরে
মেঘের পাহাড় ভেঙে মাঝে মাঝে সোনারোদ হাসে
জলে ডোবে অলিগলি জলের রাজত্ব এ-শহরে
কত পাপ, শোকতাপ জমে থাকা ঘোলা জলে ভাসে।
 
মেঘের পাহাড় ভেঙে মাঝে মাঝে সোনারোদ হাসে
দূর থেকে ভেসে আসে ছোটো ছোটো কদমের বোল
কর্মহীন সব লোক বন্দী আজ বর্ষণ-সন্ত্রাসে
আষাঢ়ে-গল্পের ধুম, চলে খুব আবোল-তাবোল।
 
দূর থেকে ভেসে আসে ছোটো ছোটো কদমের বোল
গৃহিনী উনুনে তোলে চাল-ডাল, খিচুড়ির পাক
দুপুর গড়িয়ে গেলে জল ভেঙে ওঠে শোরগোল
ও-মা এ-কী এ-দিনে কুটুম! সকলে অবাক।
 
গৃহিনী উনুনে তোলে চাল-ডাল, খিচুড়ির পাক
পুকুরে কচুরিপানা ফুল, শাপলা, হেলেঞ্চা দোলে
নরোম হলুদ রঙ মেলে ধরে চন্দ্রপ্রভা-ঝাঁক
বৃষ্টি থেমে গেলে সন্ধ্যায় দোলনচাপা চোখ খোলে।
 
পুকুরে কচুরিপানা ফুল, শাপলা, হেলেঞ্চা দোলে
বর্ষাপ্রিয় শুমচা পাখিরা ফেরে ঝিঙে-মাচা-ঘরে
সফেদ হাঁসের ঝাঁক ডেকে ওঠে হর্ষ-কোলাহলে
টিপটিপ ঝরঝর অবিরাম দিন ভর ঝরে…
 
হলিসউড, নিউ ইয়র্ক। ১২ জানুয়ারি, ২০২০।
 

শরৎ

কালো মেঘেদের ডানা ঢেকে দেয় সুনীল আকাশ
পুনর্ভবা তীরে ঢেউ তোলে শুভ্র কাশফুল বন
কৃষকের সাথে গলা বেঁধে হাসে সন্ধ্যার কার্পাস
শিষ দিয়ে নামে উঠোনেতে রাত জ্যোৎস্না-প্রবণ।

পুনর্ভবা তীরে ঢেউ তোলে শুভ্র কাশফুল বন
বিধবার শাদা থান দোলে, গায় শোকের বিলাপ
যে বঁধুর স্বামী দূরদেশে তার উচাটন মন
হেফাজত হে মাবুদ এড়িয়ে চলেন যেন পাপ।

বিধবার শাদা থান দুলে গায় শোকের বিলাপ
পাল তোলা নাও, কার ঝিয়ে যাও, কোন গাঁয়ে ঘর?
হাসে খিলখিল লাজ নাই বুঝি, নাই শোক-তাপ!
এ-কী কলিকাল আজ ভগবান, হে-খোদা, ঈশ্বর!

পাল তোলা নাও, কার ঝিয়ে যাও, কোন গাঁয়ে ঘর?
লক্ষ্ণীচরে ছাতিম ফুলেরা অপরূপ চক্র আঁকে
ছৈয়ার ভেতরে বঁধু-নাইওরি কাটেনা প্রহর 
সন্ধ্যার প্রকাণ্ড চাঁদ ঝিকিমিকি শাপলার বাঁকে।

লক্ষ্ণীচরে ছাতিম ফুলেরা অপরূপ চক্র আঁকে
শিউলি, কামিনী ফুল কী দারুণ ছড়ায় সুবাস
ফোটাবে নতুন ভোর সারারাত ডাহুকীরা ডাকে
কালো মেঘেদের ডানা ঢেকে দেয় সুনীল আকাশ।
 
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ১৭ জানুয়ারি ২০২০।

হেমন্ত

ধুসর কৃত্তিকা যেটুকু জৌলুস করেছে হরণ
আর্দ্রা ঢেলে দেয় তারও চেয়ে ঢের সোনার বরণ।
দুপাশে সোনার ধান দুলে দুলে করে নিমন্ত্রণ
অগ্র কেড়ে নেয় কৃষকের ঘুম, দুচোখে হায়ন।
 
আর্দ্রা ঢেলে দেয় তারও চেয়ে ঢের সোনার বরণ
নতুন ধানের ঘ্রাণে জেগে ওঠে বাঙালি-আবেগ।
ঘরে ঘরে শুরু নবান্নের কী বিপুল আয়োজন
উঠানে মাড়াই সারারাত, উনুনে ধানের ডেগ।
 
নতুন ধানের ঘ্রাণে জেগে ওঠে বাঙালি-আবেগ।
ভাপা, পুলি, ক্ষীর, ঝুরি, মালপোয়া, লবঙ্গ-লতিকা
কত শত পিঠা-স্মৃতি, হৃদয়-আকাশে জমে মেঘ
দূর থেকে উঁকি মারে বেলী, সহাস্য চন্দ্রমল্লিকা।
 
ভাপা, পুলি, ক্ষীর, ঝুরি, মালপোয়া, লবঙ্গ-লতিকা
কুয়াশায় ভেজা শিউলির গায়ে সতেজ সকাল
উঠোনের রোদে মুখর শিশুরা, যজ্ঞ-দীপালিকা।
নৈবেদ্য প্রণতি ঢালে শুভ্র-তারা হিমঝুরি-ডাল।
 
কুয়াশায় ভেজা শিউলির গায়ে সতেজ সকাল
নাইওরি আনার লাগি বাপ-মায় খোঁজে দিন-ক্ষণ
রক্তকাঞ্চন হেমন্ত-অঙ্গে ঢালে অবিরল লাল
ধুসর কৃত্তিকা যেটুকু জৌলুস করেছে হরণ।

হলিসউড, নিউ ইয়র্ক। ২২ জানুয়ারি ২০২০।
 

শীত

কুয়াশা-নেকাবে মুখ ঢেকে হাঁটে কে-গো ভোরবেলা?
নগ্ন পায়ে লুটোপুটি খায় শিশিরের জল-কাদা
কাঁখে বুঝি তার জলের কলস চলে সে একেলা
কার লাগি এতো ভোরে ছোটে কোন কৃষ্ণের সে-রাঁধা?

নগ্ন পায়ে লুটোপুটি খায় শিশিরের জল-কাদা
কোচড়ে হুড়ুম গুড়ের পাটালি আহা কী-যে স্বাদ
সকালের রোদে উঠোনেতে মুড়ি আর চলে ধাঁধাঁ
সোনাবউ ডেকে ডেকে দেয় কুটুমের সংবাদ।

কোচড়ে হুড়ুম গুড়ের পাটালি আহা কী-যে স্বাদ
বাঁশঝাড়ে বসে তিলাঘুঘু শোনায় করুণ সুর
শোকের সে-সুরে নীল হয় আরো আকাশের ছাদ
দ্বিপ্রহরে গাঁয়ের গোপাটে দেখা যায় বহুদূর।

বাঁশঝাড়ে বসে তিলাঘুঘু শোনায় করুণ সুর
নাড়া-পোড়া খেতে কৃষক ছিটায় রবিশস্য-বীজ
কালো ছাই-তলে ফসল তো নয় স্বপ্নের অঙ্কুর
পান-তামাকে সান্ধ্য-আসর মুখরিত দহলিজ।

নাড়া-পোড়া খেতে কৃষক ছিটায় রবিশস্য-বীজ
সকালে শীতল সরপরা বৈচা মাছের সালুন
পিঁড়ি পেতে উঠানের রোদে ছেলে-বুড়ো গিজগিজ
কড়কড়া ভাতে ফেলি এক চিমটি অমৃত-নুন।

সকালে শীতল সরপরা বৈচা মাছের সালুন
উঠোন পেরিয়ে দেখি কী-হলুদ সরিষার চক
রক্তজবাদের গায়ে লেগে আছে বুঝি তাজা খুন
ডোবার কিনারে বসে শিকারের খোঁজে ধ্যানী বক।

উঠোন পেরিয়ে দেখি কী-হলুদ সরিষার চক
চিকন গোপাটে গাছি, কাঁধে দোলে রস ভরা ভার
গোঁফের আড়ালে হাসি, কে-গো তুমি রসের যুবক
গবাদি-কাফেলা, হাঁট হাঁট, পিঠে পাঁজন-প্রহার।

চিকন গোপাটে গাছি, কাঁধে দোলে রস ভরা ভার
নাড়া-পোড়া খেতে মটরের সীম আহা কী অমৃত
নাড়া খেতে আজও লুকোনো রয়েছে ঐতিহ্য-সম্ভার
সেই দিন ফিরে ফিরে আসে, হই কী-করে বিস্মৃত?

নাড়া-পোড়া খেতে মটরের সীম আহা কী অমৃত
ধুপি, মেরাপিঠা, রসের পায়েশ, ক্ষীর, মালপোয়া 
ধোয়া ওঠা ভাতে অমৃতসম দু’ফোটা গব্যঘৃত। 
মাঝরাতে শিস দিয়ে নামে কুয়াশা জ্যোৎস্না-ধোয়া।

ধুপি, মেরাপিঠা, রসের পায়েশ, ক্ষীর, মালপোয়া 
মেঠো সড়কে নাইওরির ধুম পাল্কির কাফেলা
সীমের মাচায়, নীল-সাদা ফুলে, ভালোবাসা রোঁয়া
কুয়াশা-নেকাবে মুখ ঢেকে হাঁটে কে-গো ভোরবেলা?
 
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ২৩ জানুয়ারি ২০২০।

বসন্ত

পলাশের ডালে হে কালো কোকিল কিসের ঘোষণা?
এসেছে ফাগুন, রক্তের অক্ষরে লিখেছে শিমুল
হে শুভ্র পায়রা ওই ডালে তুমি আজকে বসোনা
ওখানে কেবল ফুটে থাক রক্তের হাজারো ফুল।

এসেছে ফাগুন, রক্তের অক্ষরে লিখেছে শিমুল
খরচৈত্রের বাওকুড়ানি ধূলিধুসরিত মাঠে
পোড়ে মাঠ খেতের ফসল জলবায়ু প্রতিকূল 
সংক্রান্তি-মেলা রসে ভরপুর ঐতিহ্যের ঠাঁটে।

খরচৈত্রের বাওকুড়ানি ধূলিধুসরিত মাঠে
মিলনোন্মুখ গবাদি পশু ফিরানির ডাক ডাকে
অন্ধকারে জোনাকির বাতি শ্বাপদ নীরবে হাঁটে
“বস্তিঅলা জাগো” বলে বলে গ্রামের পাহারা হাঁকে।

মিলনোন্মুখ গবাদি পশু ফিরানির ডাক ডাকে
মাথার ওপর ঘোড়ানিম ফোটে তারাপুষ্প-ঝাঁক
হিমঝুরি, গাব, মহুয়ার লাল, বাদ দেই কাকে
এ-খরচৈত্রে বিচিত্র পুষ্প মনোরম কী-অবাক।

মাথার ওপর ঘোড়ানিম ফোটে তারাপুষ্প-ঝাঁক
ঔষধিগাছ উদালপুষ্প ছড়িয়েছে কাঁচা সোনা
শুক্লপক্ষ তের তিথি-চৈত্ররাতে রসালো মৌচাক।
পলাশের ডালে হে কালো কোকিল কিসের ঘোষণা?
 
হলিসউড। নিউইয়র্ক। ২৪ জানুয়ারি ২০২০।

কাজী জহিরুল ইসলাম: কবি। আমেরিকা প্রবাসী।

১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন