অপরাজিতা ।। সাবিনা পারভীন লীনা।। পুবাকাশ

-মনে আছে,সেই দিনগুলো? জেলা সম্মেলনের আগে আগে কমিটি মিটিংহতো সারারাত ধরে।আপনি তখন বিদায় নিয়েছিলেন।তেমনি এক মিটিং এ নিজের নাম যখন সাংগঠনিক সম্পাদক পদে প্রস্তাব করলাম,আমাদের সহযোদ্ধাদের মুখ থেকে কতো কী শুনতে হলো।প্রথমে আর দশটা মেয়ের মতো নই বলে কতো স্তুুতিবাক্য শোনালো। তারপর  মেয়ে বলে কোন কোন কাজটা পারবোনা,তার লম্বা এক ফিরিস্তি দিয়ে দিল। তবু দমে যাইনি,লড়ে গেছি।ধাক্কাটা জোরে এসে লাগলো কখন জানেন?মানুষের মুক্তির জন্য একসাথে লড়াই করবো বলে,জীবনের পথে একসাথে চলবো বলে যার হাত ধরেছি,তার মন্তব্য শুনে।কখনো কাউকে বলিনি,আজ বলছি আপনাকে।

রিকশা থেকে নামতে গিয়ে মনে হলো অনেক উঁচু জায়গা থেকে নামছে।হাঁটুর পেছনের রগে টান পড়ে ব্যথায় টনটন করে উঠলো।আগেতো এমন হয়নি,সমস্যা কি তবে তার পায়ে নাকি রিকশার কাঠামোয়?

কে জানে, বয়সের দোষও হতে পারে।যাত্রী ছাউনির নীচে দাঁড়িয়ে নিউ মার্কেটের দিক থেকে আসা বাস টেম্পুর দিকে তাকিয়ে আছে সুজাতা।দুই চাকা, তিন চাকা, চার চাকা যার যেখানে খুশি দাঁড়িয়ে আছে।বাসের হেল্পার টেম্পুর পেছনে ঝুলে থাকা ছোট ছোট ছেলেগুলো সমানে চিৎকার করে জায়গাটা ভীষণ সরগরম করে রেখেছে।অফিস ছুটির সময় হয়নি বলে লোকজন কম,তাই কেউ সহজে নড়ছেনা।রিকশা সিএনজি প্রাইভেট কার সব মিলে জটলা বেঁধে আছে।গন্তব্যে যাওয়ার দরকার নেই কারো।বাস ড্রাইভার টেম্পু ড্রাইভারদের আচরণ সেই লেজকাটা শিয়ালের মতো।

বাসগুলোর সামনে চুন দিয়ে লেখা।কোনটায় ২ কোনটায় ৪ আবার কোনটায় ৭ লেখা।কোন নাম্বার কোন দিকে যাবে জানেনা এখন।বাসের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাপ্পড় দিয়ে দিয়ে দ্রুত বলে চলেছে টাইগার পাশ-লালখান বাজার-জি ই সি-মুরাদপুর…… পরের শব্দগুলো কিছুতেই আর ধরতে পারছেনা।আর একটু স্পষ্ট করে বললে কি এমন ক্ষতি!

স্টপেজগুলোর নাম শুনে দুই নম্বর বাসটায় পা রাখলো সে।মাত্র পাঁচ জন বসে আছে, সব আসন খালি।মনে মনে খুশিই হলো,পছন্দমত বসতে পারবে।বামদিকের সারিতে জানালার পাশে বসলো,অন্যরা সবাই ডানপাশে।তিন চার মিনিটের মধ্যেই বাস নিজের চেহারায় ফিরে আসলো।বাস ছাড়ার কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলো,ডানপাশের আসনগুলো কেনো আগে পূর্ণ হলো।এখন সম্ভবত চৈত্রের মাঝামাঝি, ঝাঁঝালো রোদের আঁচে মুখের বাম পাশ আর হাত জ্বলে যাচ্ছে।একটা বিষয় খেয়াল করলো,বাসে উঠার সময় সবাই একবার তার দিকে তাকিয়েছে, তারপর বসেছে।ডানপাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি বারবার তাকাচ্ছে, মনে হচ্ছে কিছু বলতে চায়।হঠাৎ কেমন অস্বস্তি লাগলো,আঁচলের আরেকটা অংশ ডান কাঁধের উপর টেনে নামালাম আরো।লোকটি শেষ পর্যন্ত মুখ খুললো-মহিলা সিটে আরো একজন বসতে পারবে।মাথাটা একটু হেলে দেখলো চারপাশটা। আসলেই তো!আমি মহিলা সিটে না বসে এখানে বসে আছি কেন?আমার জন্য গরম ইঞ্জিনের পাশে উত্তাপমোড়ানো তন্দুরি বরাদ্দ করা আছে।ঠিকই তো,ওরা তাকাবেনা কেন অবশ্যই তাকাবে।কিছু বলবেনা কেন,অবশ্যই বলবে।

আটাশ বছর আগেও এমন কথা কতো শুনতে হয়েছে, কতো আগুন ঝরা দৃষ্টি দেখতে হয়েছে পৃষ্ঠদেশে গরম ছেঁকা খেতে চাইতোনা বলে।পাঁচ পাঁচটা বছর রোদ বৃষ্টি ঝড়ে এমন দৃশ্যই ছিল নিত্যসঙ্গী।মুরাদপুর- অক্সিজেন- বালুছরা-আমানবাজার-বড় দীঘির পাড়-নন্দীরহাট অতঃপর এক নং গেইট।

সেইসব দিন পেরিয়ে এসেছে প্রায় দুই যুগ হলো।শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রাইভেট গাড়িতে অভ্যস্ত হয়ে দিনগুলো ভুলতে বসেছে।ভীড় ঠেলে বাসে উঠতে হয়নি,ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়িতে বসে ঘামতে হয়নি,বৃষ্টি কাদায় শাড়ি জামা নষ্ট হয়নি।তবে কোন রাস্তায় গাড়িটি চলছে,কোথায় যাচ্ছি কবে বাড়ি ফিরবো,গাড়িতে কে কে আছে- সবটাই কারো নজরদারীতে ছিল।এই ‘নজরদারী’কথাটায় হয়তো কারো কারো আপত্তি থাকতে পারে।তারা বলবে ‘নজরদারী’নয় শব্দটি হবে কাছের মানুষের খবর রাখা।খোঁজ খবর রাখাটা যে কারো জন্য সুখের ব্যাপার,ভালোবাসার বহি:প্রকাশ! 

দুই বেডের বাসায় থাকার জন্য আলাদা ঘর কোথায় পাবে সে।পড়ার ছোট ঘরে টেবিল চেয়ার ছাড়াও একটা খাট আর আলনা আছে,থাকতে হচ্ছে এ ঘরেই।পঁচিশ বছর পর আবার ফিরে আসতে হলো পুরাতন আবাসে।

সিঙ্গেল খাটে দুজনের শোয়াটা মুশকিল,পাশে একটা কাঠের চেয়ার রাখে সে,যাতে একটা হাতকে বাইরে না ফেলে চেয়ারে রাখতে পারে।তোষকটা বেশ পাতলা,তবু ভাইজিকে নিয়ে শুতে ভালো লাগে তার।একমাত্র আশ্রয় মাকে হারিয়ে,এই ঘরে এখন সবকিছু শূন্য শূন্য লাগে।রাতে প্রায় দুইঘন্টা লোডশেডিং ছিল, আই পি এস কাজ করছিলনা।হাত পাখা দিয়ে বাতাস করতে করতে কখন ঘুম এসে গিয়েছিল টের পায়নি।

মোবাইল অন্ করে দেখলো সাতটা বাজে।মেয়েটা পাশ থেকে উঠে কখন স্কুলে গেছে,জানেনা।ঘরের সামনের অংশে ছোট বারান্দা।

বারান্দার চেয়ারে বসে রইলো কিছুক্ষণ। সকালে গান শোনার অভ্যাসটাকে আপাতত বাক্সবন্দী করে রেখেছে।আশেপাশে এতো দালানের ভীড়ে তাদের নিচের তলার এই ঘরটিতে সকালের আলো হাত পা ছড়িয়ে আয়েশ করে আসেনা।আলো আসে টবের মানিপ্ল্যান্টের পাতা ছুঁয়ে।

পূবের আকাশে উড়ে যাওয়া এক ঝাঁক পাখিদের সাথে এখন আর দেখা হয়না।

সাত তলার ফ্ল্যাটবাড়ির বারান্দা থেকে লাল সূর্যের ছটায় পাখিদের সাথে উড়ে যেতে ইচ্ছে হতো কতোবার।ঘুমহীন ক্লান্ত চোখের পাতায় হাওয়া এসে ছুঁয়ে দিতো কখনো কখনো।এ সি-র ঠান্ডা হাওয়ায়ও দিনের পর দিন ঘুম না আসা রাতগুলোতে মনে হতো, এ যেন এক রাক্ষসপুরী।আধো ঘুম আধো জাগরণে মাঝেমাঝে দেখতে পেতো,ছাই রঙের পোকারা লাইন ধরে দরজার নিচ দিয়ে এগিয়ে আসছে।আস্তে আস্তে তার খাটের কাছে।খাট বেয়ে, পায়ের পাতা বেয়ে উঠে আসছে পায়ে,হাত বেয়ে মাথার দিকে।ঢুকে যাচ্ছে সারিবদ্ধভাবে, কুটকুট করে কাটছে। কানের ভেতর,কপালের ভেতর,মাথার সামনে,মাথার  পেছনে কাটছে কুটকুট…কুটকুট….. ।

সাড়ে আটটার মধ্যেই রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়তে হবে।অনেকটা পথ হেঁটে রিকশায় চড়ে,দশ টাকা কমে যেতে পারলে মন্দ কি!বেহিসাবি  চলার দিন ফুরিয়ে গেছে।রিকশা থেকে নামতেই তাকিয়ে থাকে সবাই।কয়েকজন অভিভাবকের স্কুলের গেইটে ফিসফাসও  শুনেছে বেশ কয়েকবার।কী বলে তারা কে জানে,হয়তো তার কথা।চোখের ভাষায় তারই ইঙ্গিত যেন।

প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব হোস্টেল আছে,চাইলেই থাকা যায়।কতৃপক্ষের সাথে কথা বলতে গিয়ে টের পেলাম,আমার নিজের মতো করে থাকার কোন সুযোগ নেই।অনেক প্রশ্ন মানুষের—কি সমস্যা, ঘরের বাইরে কেন থাকবে,স্বামী কোথায় ইত্যাদি। 

মুনমুন আপার নামটা মোবাইলে ভেসে উঠতেই কল্ রিসিভ করলো সুজাতা

-ভালো আছো?আগে তোমাকে ফোন করে পেতাম না,ফোন ধরতেই না,আজ মনে হচ্ছে আমার অপেক্ষাতেই ছিলে,হা হা হা হা।

আপা…কতোদিন পর, কেমন আছেন?এখন কোথায়?

-বলছি বাবা,সব বলছি।স্কুল ছুটি হলে ডিলাইটে চলে এসো,চা খেতে খেতে কথা হবে।

ছুটির পরও কলিগদের সাথে রোজ আরো কিছু সময় কাটায়।আজ ছুটির ঘন্টার সাথে সাথে ডানে বামে না তাকিয়ে রিকশা নিয়ে সোজা সদরঘাটের ডিলাইট হোটেলে।একসময় তারা এখানে প্রায়শই আসতো নানরুটি আর চা খেতে।ক্যাশ এ বসা মনসুর চাচা আগের মতো আজো হেসে উঠল,তবে হাসিটা ফাঁকা ফাঁকা।সামনের দিকে উপরে নিচে একটা দাঁতও নেই,বাম চোখটায় ঘোলাটে একটা আস্তরণ।

-আসসালামু আলাইকুম, চাচা।ভালো আছেন?বলেন তো দেখি,আমি কে?

-জ্বি, ভালা আছি।আঁর আম্মা মুনমুন অনর লাই অফেক্ষা গরের,যঅন্ বইয়ুন।আইজকাল মা’র ফেডর বইনও কেউ কেউর লয় সম্পর্ক নঅ রাহে এত্তোদিন।আল্লাহর রহমত আছে অনরার উয়র।এরশাদ হাক্কুরে নামাইবার লাই হতো খষ্ট গইরলান, রাইতদিন ফতে ফতে হতো মিছিল মিটিং,আর এহন এই বুড়া বয়সত কী কী দেহন ফরের।এগিন দেহনর আগে যাইতগুই ফাইরলি বালা অইতো।

পেছন থেকে কাঁধে হাত দিয়ে হালকা চাপ দিল সুজাতা।

ইস্ কতোদিন পর আপা,বলতেই গলার স্বরটা ভারি হয়ে এলো,চোখ ভিজে উঠলো।ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ডান হাতের তালুতে মুখ মুছে চেয়ার টেনে বসলো।চশমার ভেতর মুনমুন আপার চোখ দুটো চিকচিক করছে তখন।

দেশে কখন এলেন,কতোদিন থাকবেন?’বলেই হাতের ইশারায় বয় কে ডাকলো।দুজনেরই প্রিয় খাবার গরম গরম নানরুটি আর চা এর অর্ডার দিল সে।কেউ কারো কাছে কিছু জানতে চাইছেনা আর।আড্ডারত ছেলেগুলোর উচ্ছ্বাস আর তাদের নীরবতা পরষ্পর হাত ধরে আছে যেন।

একপাশে ফুলে থাকা গরম নান্ এ আঙুলের চাপ দিতেই ধোঁয়া বেরিয়ে এলো।

–হা হা হা,তুমি এখনো তেমনই আছো।তবে স্বাস্থ্যটা বেশ খারাপ হয়ে গেছে।সুগার কি কন্ট্রোলে নেই?চোখের নিচে এতো কালি কেন,ঘুম হয়না ভালো?

আমাকে দেখো ভালো করে।দেশে থাকার সময় কতো কী সয়েছি,কাউকে পাশে পাইনি।আম্মু,ভাইয়া কেউ না,একাই লড়ে গেছি।তবু নিজের শরীরকে এভাবে ভেঙে যেতে দিইনি।

–আমি ঠিক আছি এখন।দুমড়ে মুচড়ে যেতে যেতেও উঠে দাঁড়িয়েছি।সবারতো একই রকমের শক্তি থাকেনা,লড়াই করার জায়গাটাও ভিন্ন হয়।তাছাড়া সময়ের কাছে একটা দায় থাকে সকলের,ওটা চুকিয়ে দিতে হয়।

–হুম…চলো, আজ আমরা অভয় মিত্র ঘাটেই যাই।সন্ধ্যা হতে এখনো অনেক দেরি,কাছেই তো।ঐ ঘাট আমাকে খুব টানে,কেন যে টানে, জানিনা।সময় থাকলে নৌকা নিয়ে ঐ পারে  যেতাম একবার।মাঝেমাঝে স্বপ্নেও দেখি ঘাটটা।এখান

থেকে রিকশায় উঠে ফিরিঙ্গী বাজার হয়েইতো যাবো।পুরানো বিল্ডিংগুলো কি আছে এখন,নাকি সব ভেঙেচুরে নতুন?কিছুই সংরক্ষণ করতে শিখিনি আমরা।

রাস্তার কাজ চলছে,লোকজনে জমজমাট। পেঁয়াজুর দোকানে ভীড়, লেবু চা লেবু চা বলে কয়েকটা ছেলে এদিক ওদিক হাঁটছে। একদল তরুণ তরুণী বসে আছে নদীর পাড়ে,গিটারে দ্রিম দ্রিম সুর তুলে গাইছে,”কই গেলারে বন্ধু,কই রইলারে…আমারে ছাড়িয়া বন্ধু……”।

–তোমার ছেলের কি খবর,কথা হয় প্রতিদিন?ছেলেটা যেন সত্যিকারের মানুষ হয়।এতো অপমান, এতো কষ্ট তোমার,যেন স্বার্থক হয়।

–ভালোই আছে, দূরে গিয়ে সে বেঁচে গেলো, আপা।কুৎসিত কিছু দেখতে হলোনা তাকে।

দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো দুজনের একসাথে… -মুখোশের পর মুখোশ ,সুজাতা। আমরা মুখোশ চিনতে পারিনি,বড্ডো বোকা ছিলামরে…।

-মনে আছে,সেই দিনগুলো? জেলা সম্মেলনের আগে আগে কমিটি মিটিংহতো সারারাত ধরে।আপনি তখন বিদায় নিয়েছিলেন।তেমনি এক মিটিং এ নিজের নাম যখন সাংগঠনিক সম্পাদক পদে প্রস্তাব করলাম,আমাদের সহযোদ্ধাদের মুখ থেকে কতো কী শুনতে হলো।প্রথমে আর দশটা মেয়ের মতো নই বলে কতো স্তুুতিবাক্য শোনালো। তারপর  মেয়ে বলে কোন কোন কাজটা পারবোনা,তার লম্বা এক ফিরিস্তি দিয়ে দিল। তবু দমে যাইনি,লড়ে গেছি।ধাক্কাটা জোরে এসে লাগলো কখন জানেন?মানুষের মুক্তির জন্য একসাথে লড়াই করবো বলে,জীবনের পথে একসাথে চলবো বলে যার হাত ধরেছি,তার মন্তব্য শুনে।কখনো কাউকে বলিনি,আজ বলছি আপনাকে।

–কেন বলোনি আমাকে,কি বলেছিল?একটু রাগ দেখিয়ে সুজাতার হাতে হাত রাখলো মুনমুন।

–সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যায় কমিটি ঘোষণার পর সবার সাথে আমাকেও অভিনন্দন জানাতে এসেছিল,জানিয়েছিল।যাওয়ার সময় বলেছিল, “এতো দায়িত্ব নেওয়ার কি আছে,তুমি কি সবদিক সামলাতে পারবে?এর চেয়ে সহ-সম্পাদকের দায়িত্বটা নিলে ভালো করতে।”সেদিনের পরে আরো অনেকবার এই বিষয় নিয়ে রাগ দেখিয়েছে,কথা শুনিয়েছে।মনে মনে কষ্ট পেয়েছি অনেক,তবু নতুন জীবনের স্বপ্নের ভেতর কষ্টটাকে আর বাড়তে দিইনি।পরে বুঝেছি,দিনে দিনে মূল্য দিয়ে জেনেছি।প্রগতির লেবাস আর সমতার লেবাস মোড়ানো পুরুষদের চিনেছি।তাদের সুবিধামতো এঁকে দেওয়া লক্ষ্মণরেখার ভেতর থাকতে পারলে সব ঠিক।ভিন্ন মত পোষণ করলে,এর বাইরে পা রাখতে গেলেই নারী হয়ে  যায় তাদের কাছে স্বেচ্ছাচারী।

–হুম,আরেকটা বিষয় খেয়াল করেছ?আমরা একসময়  জেনেছিলাম অর্থনৈতিক মুক্তি আসলেই তবে নারীর মুক্তি আসবে,ব্যাপারটা আসলে ঠিক তেমন নয়।আমিতো কারো উপর নির্ভরশীল নই,তুমিও নও।তাহলে…..?

–সমস্যা আমাদের কাঠামোতে,আমাদের মানসিকতায়।পরিবার,সমাজ,রাষ্ট্র সবটাইতো সেই কাঠামোতেই চলছে।আপনি যখন রিপোর্টিং করতে গিয়ে অনেক ঝুঁকি নিলেন,পুরষ্কার পেলেন সাহসিকতার জন্য তখন কতো কি শুনলাম।শুনলাম,আপনার চরিত্র ঠিক নেই।ক্যারিয়ারের জন্য আপনি সব বিকিয়ে দিতে পারেন।এমনতরো কথা কারা বলেছে,কিভাবে বলেছে –তারা দূরের কেউ ছিলনা,নিজের।আর যদি শ্রেনীর কথা বলেন,তবে এদের শ্রেনীও একই আমার আপনার মতোই।একই শ্রেনীভুক্তরাই নিপীড়ন করছে,অবমাননা করছে প্রতিমুহূর্তে।

ফিক্ করে হেসেই সুজাতা বললো,”এসব কথা কেন যে আপনাকে বলছি আমি,আমার চেয়ে অনেক বেশি জানেন,বুঝেনও।”

সূর্য ডুবে গেছে কথায় কথায়।ইঞ্জিনের নৌকা ভট্ ভট্ শব্দ তুলে দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে।অনেকেই গন্তব্যের পথে পা বাড়িয়েছে এরমধ্যেই । মধ্য বয়সী দুই নারী তখনো নদীর পাড়ে।ঘাটের কাছে মানুষের আনাগোনা দেখছে। কখনো চুপচাপ কখনো হো হো শব্দে, অনেককেই কৌতুহলী চোখে তাকাতে বাধ্য করছে।ফিরে গেছে সেই আগের দিনগুলোতে, যখন তাদের জবাবদিহি করতে হয়নি কারো কাছে,পাল্টে দেওয়ার স্বপ্নে বিভোর ছিল তাদের প্রতিটি দিন আর রাত।

সুজাতা ব্যাগ থেকে একটা বই বের করে মুনমুনের হাতে দিল,’নিজের হাতে আপনাকে দিব বলে পাঠাইনি বইটা,গত বইমেলায় প্রকাশ করেছি’।

খুব ভালো একটা কাজ করেছ,সময়টাকে নষ্ট করোনি।আরো লিখবে,বেশি বেশি লিখবে।ক’দিন আর বাঁচবো বলো?

মুনমুন বইয়ের পাতা উল্টে দেখলো,তার উদ্দেশ্যে লেখা লাইনদুটি “উঠে দাঁড়ালেন যেমন দাঁড়ায় বন্দিনী এক বাঘিনী চিতা,চিড়িয়াখানায় অসহায় তবু উঠে দাঁড়ানোয় অপরাজিতা”।

সাবিনা পারভীন লীনা: কবি ও কথাশিল্পী।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন