মুক্তগদ্য ।। বৃষ্টি ।। সুলতানা কাজী

ত ডাকা আমারা যাকে। কিন্তু আমার তিন বছরের মেয়ের ভাষায় “চাঁদের বুড়ির তান্না” (কান্না)!! বড় মেয়ের ভাষ্য, তাজ্জব ব্যাপার!! কি করে মেঘ সমুদ্র থেকে পানি নিয়ে যায়!! বৃষ্টির সঙ্গে কি এক মায়াবি সম্পর্ক মানুষের!!

বৃষ্টি আমার বড়বেলার ভালোবাসা। ছোটবেলার বৃষ্টি!!! বয়স যত বাড়ছে জীবনের আকাঙ্ক্ষা বাড়ছে প্রতিনিয়ত। আমার প্রতিও জগতের চাহিদা বাড়ছে। এই আকাঙ্ক্ষা আর চাহিদার মাঝে পিষ্ট হয়ে মাঝে মাঝে দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়! পাগল পাগল লাগে। ঠিক সেইসময় অকস্মাৎ মেঘ ডাকার আওয়াজ পাই। জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখি, দিগন্তের কোলে কালো মেঘ খেলা করছে! বাতাস এসে আমাকে দোলায়। বৃ্ষ্টির ঘ্রাণ নাকে এসে লাগে। আমি হারিয়ে যাই এমন এক জগতে, যেখানে আমি অনেক ছোট!!

আমার গ্রামীণ ছোটবেলা! এক পশলা বৃষ্টি যেখানে অনেক আনন্দের। উঠোনে ইচ্ছে মতো ভেজার কি অপার আনন্দ!! কিন্তু একটু ভারী বৃষ্টি হলেই সবার চোখ মুখ আতঙ্কে নীল হয়ে যেতো। শহুরে তরুণী যেখানে বর্ষাকে বেছে নেন তথাকথিত ক্রিয়েটিভ ফ্যাশন কিংবা নান্দনিক স্টাইলের কোলে বসনকে!! সেখানে নিজের দেখা গল্পের নায়িকারা ঠিক মতো কাপড় শুকাতে না পারার কারণে ভেজা কাপড় কেই আবার গায়ে জড়াতেন। কী নিদারুণ কষ্টে কাটতো গরীবদের জীবন! আমাদের বাড়িতে দেখেছি, অনেক মানুষ নিজেদের গরু,ছাগলসহ নিয়ে আশ্রয়ের আশায় চলে আসতো।

মা’ সবার জন্য রান্নায় ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। একটুও বিরক্ত হতেন না। বাড়ির সামনের খালে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষগুলো সাঁতার কাটতো ভয়কে তুচ্ছ করে। পাহাড়ী ঢলে কিছু লাকড়ি পাওয়ার আশায়ই এ সাঁতার!! এটাই হয়তো ওদের সারা বছরের জন্য জমানো লাকড়ি!! আমাদের এই প্রজন্মের জন্য যা রূপকথার গল্প ও হতে পারে!!

রাস্তাঘাট পিচ্ছিল হয়ে যেতো দেখে কতবার আমি আছাড় খেতাম! স্কুলে যাচ্ছিলাম একদিন… পথেই হঠাৎ বাজ পড়া শুরু হলো। কি ভয় পেতাম এই বাজকে!! মাথার ওপরে ছোট্ট ছাতাটা দিয়ে মাটিতে গুটিশুটি মেরে কতক্ষণ যে বসে ছিলাম জানিনা! শেষে এক চাচা পথ দিয়ে যাওয়ার সময় আমায় উদ্ধার করে বাড়িতে দিয়ে আসেন। কলা গাছের ভেলায় (ভোর) চড়তাম আমার দস্যিপনা ভাইদের কল্যাণে!! এত মজা পেতাম!! কিন্তু আমাকে কোনোদিন ওরা বেশিক্ষণ চড়াতো না। এখনও মনে পড়ে বৃষ্টির দিনে ওরা জাল দিয়ে মাছ ধরতো! আমি থাকতাম মাছের ডুলা বাহক! মাছ ফেলে দেয়ার অপরাধে কত লুকানো পিটুনি যে খেয়েছি মনে পড়লে এখনও কান্না পায়!!

আমার মা’ আমাদের বেশি বাইরে যেতে দিতেন না বৃষ্টির সময়! মা’কে ঘুম পাড়িয়ে আমরা বের হতামই। শেষে সন্ধ্যার সময় সব উসুল হয়ে যেত বেতের বাড়িতে!! আমার কাদা, জোঁক কখনোই ভালো লাগতো না। আমার সেজ ভাই কায়দা করে ওসবই আমার গায়ে লাগিয়ে মজা পেতো!! বেশি কান্না করলে, ও আরও বেশি করতো। শেষে টপাস টপাস কয়েকটা দিয়ে মা’র ভয়ে লুকিয়ে থাকতো!!

শৈশবেই আমরা গ্রাম ফেলে শহরে চলে আসি। অন্য রকম পরিবেশ! ভালো স্কুলে ভর্তি যুদ্ধ। শহুরে বৃষ্টির সাথে খাপ খাওয়ানো শিখে গেলাম। স্কুলে যাওয়ার পথে ইচ্ছে করেই হুট ফেলে রাখতাম, বৃষ্টিতে ভেজার জন্য। শুরু হলো আমার বড়বেলার বৃষ্টি প্রেম।

মহাদেব সাহার মতে, কাগজ আবিষ্কারের আগে মানুষ প্রেমের কবিতা লিখে রেখেছে আকাশে। বৃষ্টির সময় কলেজ থেকে ফেরার পথে পুরো পথ আমরা কোমড় পর্যন্ত ডুবে যাওয়া অবস্থায় এসেছি কতবার!! আষাঢ়ের ঘনঘটা শুরু হলেই মা’ খুব একটা কলেজে যেতে দিতেন না। আর আমি কত পরীক্ষার বাহানা সৃষ্টি করে কলেজে যাওয়ার পথ রচনা করতাম। বৃষ্টি আমার কাছে অন্য রকম ভালো লাগা একটা বিষয়। বৃষ্টির সাথে মিশে আছে আনন্দ, আছে বিরহ। প্রকৃতি তার বিচিত্র স্বভাবের অভিব্যক্তি ঘটিয়ে শিল্পরসিক মানুষ মাত্রকেই অভিভূত করে।

রবি বাবু তাঁর “ছিন্নপত্র” গ্রন্থে লিখেছেন,
যখন যা সাজে ভাই
তখন করিবে তাই;
কালাকাল মানা নাই।

এই আকাশের, নদীর,শ্যামল পৃথিবীর একজন হয়ে জন্ম গ্রহণ করেছি বলেই আমার অহংকার। অতীতকে নিয়ে নস্টালজিক হতে যেমন ভালোবাসি, তেমনি ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতেও। স্বপ্নীল সময়টা যাচ্ছে বয়ে। আজ এই বৃষ্টির অপরূপ দৃশ্য আমার মনে কুহক জাগায়। বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটা নতুন নতুন অনুভূতির সৃষ্টি করে মনের গহীনে। আমি হারিয়ে যাই আমার অতীতে। যা আমার জীবনকে পূর্ণতা দিয়েছে পুরোপুরি। আমার নিজের মধ্যে ধারণ করি আমার পথচলাকে।

দিন রাত বৃষ্টি আর বৃষ্টি কয়দিন ধরে। আমার উপলব্ধিগুলো এলোমেলো হয়ে সাঁতরে বেড়ায় শুধু। কেউ খুঁত ধরুক, কেউ নিন্দে করুক… আমি আমাতেই যাপন করি। আনন্দ বা দুঃখকে যুগপৎভাবে গ্রহণ করার প্রক্রিয়া সকলের এক নয়। যে যার মতো করে বসবাস করে এদের সঙ্গে। কেউ আনন্দের মাঝেও দুঃখ খুঁজেন কেউ বা দুঃখের ভিতর আনন্দ। তাই, মেঘ দেখলেই কেউ কেউ ঘরে ফিরে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে, কেউ আবার বৃষ্টি ভেজার অপেক্ষায় থাকে। কার যে কিসে আনন্দ তা অন্যেরা জানে না।

আমার আনন্দ বেদনার অণুগল্প হয়ে থাকুক বৃষ্টি দিনের বিলাস। সবাই সুস্থ থাকুন, নিরাপদে থাকুন। হিংসা, লোভ, অহংকারকে পায়ে ঠেলে ভালোবাসুন– নিজেকে, সমাজকে, দেশকে।।

সুলতানা কাজী : সহকারী শিক্ষিকা, অঙ্কুর সোসাইটি স্কুল, চট্টগ্রাম।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন