স্বপ্ন ও আলোর পিদিম…।। জগলুল আসাদ
শিক্ষক অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে শিক্ষার্থীদের মধ্য দিয়ে। যোগ্য শিক্ষার্থী বাঁচিয়ে রাখে তার শিক্ষককে। প্ল্যাটোর শিক্ষক ছিলেন সক্রেটিস। প্লাটোর “ডায়ালগস” এ প্রধান চরিত্র হিশেবে হাজির সক্রেটিস। সক্রেটিসের কণ্ঠেই আমরা প্লেটোকে পাই, কোনটি প্লেটো আলাদা করে প্রায়শই বোঝা যায়না, অথবা প্লেটো-সক্রেটিস থাকে জড়াজড়ি করে, পরস্পর প্রবিষ্ট হয়ে। প্লেটোর ছাত্র এরিষ্টটল। ছাত্র উদারভাবে ব্যবহার করেন শিক্ষকের ধারণা, শিক্ষকের ধারণার অস্পষ্টতা দূর করেন, ব্যাখ্যা করেন, আবার নতুন ভাষ্য ও যুক্তিও তৈরি করেন। শিক্ষক এডোয়ার্ড সাপির আর ছাত্র বেঞ্জামিন হর্ফ মিলে তৈরি হয় ভাষা ও চিন্তার সম্পর্ক বিষয়ক তত্ত্ব! “সাপির-হর্ফ” হাইপোথিসিস। তালাল আসাদের চিন্তাকে আরো বেশি সম্প্রসারিত করেন, প্রয়োগ করেন সাবা মাহমুদ৷ আব্দুর রাজ্জাকের সহবত পেয়েছিলেন ছফা। আব্দুর রাজ্জাক নিজে খুব স্বল্পই লিখেছেন, তবে তিনি লেখক ও জ্ঞানার্থী তৈরি করেছেন। আবার, শিষ্য ছফার বয়ানে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক এ-প্রজন্মের অনেকের কাছে হয়ে ওঠেন কিংবদন্তি । ভলতেয়ারের “কাঁদিদ” উপন্যাসে কাঁদিদ ও তাঁর শিক্ষক প্যানগ্লস দুই বিপরীত রকম আশাবাদের প্রতীক, একসাথেই থেকেছেন প্রায় সারা জীবন, উপন্যাসের শেষ পর্যন্ত তাঁদের দেখা যায় একই বাগান-প্রাঙ্গনে। আরো অনেক উদাহরণ আছে এমন।
কোথায় যেন পড়েছিলাম শিক্ষকের কাজ হচ্ছে, শিক্ষার্থীর কাছে নিজেকে অপ্রয়োজনীয় ক’রে তোলা, শিক্ষার্থীকে পথটুকু চিনিয়ে দেওয়া যাতে নিজে নিজে সে চলতে পারে একা । হাতে ঝাড়বাতি ধরিয়ে দেওয়া, সে যেনো স্পষ্ট করে চলতে পারে জ্ঞানের বা জীবনের ছোটবড় সড়ক বা গলিপথে ! পুরোটাসময় নিজের উপর নির্ভরশীল ক’রে চিন্তাদাস করে রাখা শিক্ষকের কাজ নয়। শিক্ষক কখনো শিক্ষার্থীকে নিজের চিন্তার ভারবাহী প্রাণী বানায় না , নিজের অপূরণীয় স্বপ্ন ও ইচ্ছার বাস্তবায়নকারী ভাবে না। অন্যের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করবার দায় বড়ো কষ্টের! ক্ষেত্রবিশেষে আনন্দদায়কও হতে পারে যদিও-বা। বরঞ্চ শিক্ষার্থী যেন নিজে চিন্তার সামর্থ অর্জন করতে পারে সেই আয়োজনের দিকেই থাকে প্রকৃত শিক্ষকের নজর। কিন্তু এটা সবসময়ই আরামদায়ক যে, শিক্ষার্থী আমার চিন্তাকে ধারণ করবে, আমার চিন্তাকে ছড়িয়ে দিবে । এই আপাত আরামদায়ক চিন্তাকে ত্যাগ করতে পারা বিরাট বিষয়ই । কিন্তু এই ত্যাগের মহত্ত্ব খুব কম জ্ঞানসাধকই করতে পারে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক মাতা ও সন্তানের মতো। মাতার ছায়াও একসময় সরে যায়, পুত্র বড় হয়, গড়ে উঠে পুত্রের নিজের পছন্দ-অপছন্দ, পুত্রও একদিন পিতা হয়, কন্যাও একদিন মাতা হয় ! কিন্তু মায়ের নাড়ি ছিড়েই সন্তান সন্তান হয়ে বিচরণ করে পৃথিবীতে। একই সাথে নাড়ির বন্ধন আর একই সাথে এই নাড়িচ্ছেদন —শিক্ষক-শিক্ষার্থীর উপমা।
শিক্ষক শুধু শেখায় না, কি করে শিখতে হয় সেটাও জানায়। শিক্ষক শুধু পড়ায় না, পড়তে অনুপ্রাণিতও করেন, কি করে পড়তে হয় সেটাও শেখান। অন্তত, আমাদের পরিস্থিতিতে তো এটাও বিরাট বিষয় যে, শিক্ষক পরীক্ষার “সাজেশন” দেওয়ার চেয়েও শেখাবেন কি করে “সাজেশন” তৈরি করতে হয়!
ইমাম আবু হানিফা(র:)র ছাত্র আবু ইউসুফ-ইমাম মোহাম্মদ উনারা ইমামের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা রেখেই দ্বিমত করতে পারতেন, উস্তাদের ফতোয়ার ত্রুটি ধ’রে সংশোধন করতে পারতেন। আবার, একই সাথে নিজেকে উস্তাদের জ্ঞানগত পদ্ধতি ও সিলসিলার সাথেও নিজেদের সম্পর্কিত রাখতেন। ইমাম তাইমিয়া(র:)র প্রখ্যাত ছাত্র ইবনুল কাইয়্যেম জাওজিয়া(র:)র তাঁর উস্তাদের প্রতি ভক্তি সুবিদিত, এবং তবুও, উস্তাদের সাথে তার দ্বিমতের ক্ষেত্রও কি নাই?! । আমাদের এই তল্লাটে ভক্ত-আশেকান তৈরি হয় , কিন্তু সেই জ্ঞানার্থী কই? অবশ্য, উল্টো করেও বলা যায়, সেই শিক্ষক কই? শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে গদগদ ভক্তি-সালাম-তাকলিদ এর পিয়াসী আমরা, আর শিক্ষার্থীদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করারও নজির দুর্লক্ষ্য নয় । অথচ, দুনিয়ার চিন্তাজগতকে যারা প্রভাবিত করেছেন, নানামাত্রায় তারা প্রায় সকলেই শিক্ষক ছিলেন। শিক্ষার্থীদের শেখানোর জন্যে তৈরি করা অনেকের লেকচার নোটই পরবর্তীতে বই হিশেবে বিখ্যাত হয়ে ওঠে। ছাত্রদের দর্শন বোঝানোর জন্যে হেগেলের টুকে রাখা পয়েন্টগুলোই তাঁর কিছু বইয়ের উৎস৷
আজকালকার পেডাগোজি বা শিক্ষাতত্ত্বে শিক্ষক ব’লে কিছু নেই৷ আছে ফ্যাসিলিটেটর। যিনি শিক্ষাকর্মে নিয়োজিত তিনি নিজেও হয়ে উঠতে পারেন শিক্ষার্থী ; আর শিক্ষার্থীও হয়ে উঠতে পারেন শিক্ষক। একটা ডায়ালজিক ব্যাপার আছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কের ভেতরে।
শিক্ষক অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে শিক্ষার্থীদের মধ্য দিয়ে। যোগ্য শিক্ষার্থী বাঁচিয়ে রাখে তার শিক্ষককে। প্ল্যাটোর শিক্ষক ছিলেন সক্রেটিস। প্লাটোর “ডায়ালগস” এ প্রধান চরিত্র হিশেবে হাজির সক্রেটিস। সক্রেটিসের কণ্ঠেই আমরা প্লেটোকে পাই, কোনটি প্লেটো আলাদা করে প্রায়শই বোঝা যায়না, অথবা প্লেটো-সক্রেটিস থাকে জড়াজড়ি করে, পরস্পর প্রবিষ্ট হয়ে। প্লেটোর ছাত্র এরিষ্টটল। ছাত্র উদারভাবে ব্যবহার করেন শিক্ষকের ধারণা, শিক্ষকের ধারণার অস্পষ্টতা দূর করেন, ব্যাখ্যা করেন, আবার নতুন ভাষ্য ও যুক্তিও তৈরি করেন। শিক্ষক এডোয়ার্ড সাপির আর ছাত্র বেঞ্জামিন হর্ফ মিলে তৈরি হয় ভাষা ও চিন্তার সম্পর্ক বিষয়ক তত্ত্ব! “সাপির-হর্ফ” হাইপোথিসিস। তালাল আসাদের চিন্তাকে আরো বেশি সম্প্রসারিত করেন, প্রয়োগ করেন সাবা মাহমুদ৷ আব্দুর রাজ্জাকের সহবত পেয়েছিলেন ছফা। আব্দুর রাজ্জাক নিজে খুব স্বল্পই লিখেছেন, তবে তিনি লেখক ও জ্ঞানার্থী তৈরি করেছেন। আবার, শিষ্য ছফার বয়ানে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক এ-প্রজন্মের অনেকের কাছে হয়ে ওঠেন কিংবদন্তি । ভলতেয়ারের “কাঁদিদ” উপন্যাসে কাঁদিদ ও তাঁর শিক্ষক প্যানগ্লস দুই বিপরীত রকম আশাবাদের প্রতীক, একসাথেই থেকেছেন প্রায় সারা জীবন, উপন্যাসের শেষ পর্যন্ত তাঁদের দেখা যায় একই বাগান-প্রাঙ্গনে। আরো অনেক উদাহরণ আছে এমন।
এভাবে শিক্ষক বেঁচে থাকেন শিক্ষার্থীর ভেতর, জ্ঞানের যে-উত্তরাধিকার তিনি তৈরি করেন, তার ভেতর। শিক্ষার্থী যদি জ্ঞানে ও প্রভাবে ছাড়িয়ে যায় শিক্ষককে, সেটা গর্বের, আনন্দের। শিক্ষক যদি জ্ঞানে-গুনে “ছোট”ও হন, তিনি “বড়” স্বপ্ন দেখান শিক্ষার্থীকে। যোগ্য উত্তরসূরী তৈরিতেও পূর্বসূরির মূল্য ও কৃতিত্ব নিহিত থাকে।
আহা! কতো সত্য-মিথ্যে আশা নিয়ে থাকি!
জগলুল আসাদ: শিক্ষক,প্রাবন্ধিক ও চিন্তক। সম্পাদক,চিন্তাযান।