হারিয়ে যাওয়া দু’নক্ষত্র ।। আবদুল কাইয়ুম মাসুদ ।। পুবাকাশ

৫ অক্টোবর। শিক্ষক দিবস। নানা আয়োজনে অনেকে দিনটি পালন করেছে। আর আমার হৃদয় আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে দু’টি মুখ, দুটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। যাঁদের অনুপস্থিতি অন্য অনেকের মতো আমার হৃদয়ও হাহাকার করে ওঠে। আমাবস্যার অন্ধকার নেমে আসে। কোভিড১৯ প্রাদুর্ভাবের এ সময়ে রবের ইচ্ছায় আমাদের ছেড়ে আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে গেছেন তাঁরা। তাঁদের একজনকে পেয়েছি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে আর অপর জনকে পেয়েছি সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজে।

শিক্ষক কথাটা আমার সামনে আসলেই প্রথমে এ দুটি মুখ ভেসে আসে, এখন। দু’জনেই আমার প্রিয় শিক্ষক। শিক্ষা জীবনে অনেক ধাপ পেরোতে হয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন ধাপে নতুন নতুন অনেক শিক্ষক পেয়েছি। একেক জন শিক্ষক মানেই একেকটা আলোর উৎস। শিক্ষক মহোদয়গণকে একসাথে চিন্তা করলে মনে হয় নক্ষত্র ভর্তি একটি আকাশ। এসব নক্ষত্রের ভেতর কিছু অপেক্ষাকৃত বেশি দ্যূতি ছড়ায়। উনারা ছিলেন সেরকম দুটি নক্ষত্র যাঁদের ব্যক্তিত্ব থেকে যে আলোক রশ্মির বিচ্ছুরণ হয়েছে তা আমার হৃদয়ের অলঙ্করণ হয়ে স্থায়ী আসন দখল করে আছে। তাঁদের সেই আলোক রশ্মির ছিটেফোঁটা ধারণ করতে পেরেছি হয়তো তা এখন আমার পথ চলার পাথেয় হয়েছে।

৬ আগস্ট, ২০২০। বৃহস্পতিবার। রাতে ১০টায় যে মৃত্যু সংবাদ পেয়েছি তা প্রথমে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে ফোন করে নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করেছি। পরিশেষে বুঝেছি, তিনি শুধু আমাদের প্রিয় নন তিনি আল্লাহরও প্রিয়। পবিত্র জুমার দিনে মহান আল্লাহ উঠিয়ে নিয়ে গেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) গণিত বিভাগের অধ্যাপক সফিউল আলম তরফদার (৫৪) স্যারকে। তিনি নগরীর পার্কভিউ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। তিনি কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছিলেন।

সেপ্টেম্বর এর মাঝামাঝি সময়ে স্যারের ইছালে সওয়াবের উদ্দেশ্যে মিছকিন শাহ মসজিদে মিলাদ, জেয়ারত ও কাঙ্গালি ভোজের আয়োজন করা হয়েছে। আয়োজন শেষে স্যারের ড্রাইভার আমাকে জামাল খান পৌঁছে দিয়ে বললো, স্যার থাকলে এতোদিনে আরো অনেকবার আসতে হতো আপনার এখানে। আপনি স্যারের অনেক মহব্বতের মানুষ ছিলেন। আপনার এখানে হয়তো আর আসতে হবে না। আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, পানি ছল ছল করছে। সে স্যারের খুব ভক্ত। তার এবস্থা দেখে আমার চোখও সিক্ত হয়ে ওঠলো।

দ্বিতীয় জন চট্টগ্রাম সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা স্যার। বিগত ২২ জুন ২০২০ মঙ্গলবার ভোরে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। তিনি কোভিড পজিটিভ ছিলেন।

অধ্যাপক গোলাম মোস্তাফার জন্ম ফেনী শহরের শহীদ শহিদুল্লাহ কায়সার সড়কের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। লেখাপড়া শেষ করে তিনি শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন। প্রথমে তিনি ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার একটি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করলেও পরে বিসিএস কোয়ালিফাইড হওয়ার পর তিনি চট্টগ্রামের বিভিন্ন কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। সর্বশেষ চট্টগ্রামের হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজের ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বপালন করেন তিনি। অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা অত্যন্ত অমায়িক, নিরাহংকার ও সাদামনের মানুষ ছিলেন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, দুই কন্যা, এক ছেল্‌ অগণিত ছাত্র ও শুভানুধ্যায়ী রেখে গেছেন।

২৫ বছর আগে স্যারের ছাত্র ছিলাম। মৃত্যুর আগ মুহূর্তেও মনে হয়েছে আমরা উনার কতো আপন। স্যারের বাসায় গিয়েছি। আমরা গিয়েছি ছাত্র হিসেবে উনি আপ্যায়ন করিয়েছেন মেহমানের মতো। একসাথে আমাদের সময়কার ম্যাডাম/স্যারদের বাসায় গিয়েছি। স্যারের সাথে যতক্ষণ থাকতাম স্যার মাতিয়ে রাখতেন, মজার মজার সব বিষয় সাহিত্যরস দিয়ে বলতেন। সেখানে অনেক শিক্ষা লুকিয়ে থাকতো।

স্যারের সাথে সর্বশেষ ফোনালাপ এখনো কানে বাজছে, স্যার বলেছিলেন, ‘কাইয়ুম আমি এখন বাসায় বন্দী। বাসা থেকে বের হওয়া একেবারে নিষেধ। ১৪৪ ধারা জারি হয়েছে আমার চলাচলের ওপর’। কোভিড এর প্রাদুর্ভাবের পর স্যারের বয়স বিবেচনা করে উনার চলাচলে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন পরিবারের লোকজন, স্যার সে কথাই সুন্দর করে বলেছিলেন।
প্রিয় দু’শিক্ষক মহোদয়ের সাথে আমার অনেক স্মৃতি, কখনো বকা দিয়েছেন, কখনো আদর করেছেন, কখনো বুদ্ধি পরামর্শ দিয়েছেন আবার কখনো বন্ধুর মতো আচরণ করেছেন। অনেক মিস করছি প্রিয় স্যারদের। মহান আল্লাহর নিকট কায়মনো বাক্যে দোয়া করছি তিনি যেনো আমাদের প্রিয় শিক্ষকদেরকে জান্নাতুল ফেরদাউসের মেহমান হিসেবে কবুল করে নেন।

আবদুল কাইয়ুম মাসুদ: প্রভাষক, আইডিটি, কর্ণফুলী এ জে চৌধুরী কলেজ, চট্টগ্রাম।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন