আলমগীর মোহাম্মদ
‘অনুর পাঠশালা’ মাহমুদুল হকের প্রথম উপন্যাস। বারবার পড়ি এটা আমি। ভালো লাগে পড়তে। শেষবার পড়েছিলাম ফোর্থ ইয়ারে থাকতে। প্রায় সবকিছুই ভুলে গিয়েছিলাম। আজ আবার পড়লাম। পড়তে গিয়ে চোখ আটকালো পিংক কালারে দাগানো একটা বাক্যে।
”মনগড়া দুঃখের কোন ওষুধ নেই।”
দুঃখ সংক্রান্ত উক্তিগুলো আমি লাল বা অন্য কালি দিয়ে দাগাই। যদিও ছোটবেলা থেকে নীল কালির কলমে লিখতে ভালোবাসি। একবার ক্লাস ফাইভে সেকেন্ড টার্ম পরীক্ষায় ইংরেজি পরীক্ষা দিয়েছিলাম নীল কালির কলমে। পেয়েছিলাম সাতানব্বই। কিন্তু, মনজুর স্যার অজানা এক কারণে ক্ষেপে ছিলেন আমার উপর। খাতা দেওরার দিন ঘোষণা দিলেন নীল কালিতে কেউ লিখে থাকলে বিশ নম্বর মাইনাস! আমারো হলো। পরে পেলাম সাতাত্তর। সেটা অন্য আলাপ। অবশ্যই সেদিন থেকে নীল কালির কলম ব্যবহারে সাবধান আমি। বেদনার রং নীল ব’লে হয়তো।
মাহমুদুল হকের জন্ম বারাসাতে। দেশভাগের সময় সরকারি চাকুরেদের জন্য অপশন ছিল পাকিস্তান না ভারত বেছে নেয়ার। মাহমুদুল হকের বাবা পাকিস্তান বেছে নিয়েছিলেন। তবে তাঁর মা রাজি হননি সহজে। দেশে ঘর উঠানো শুরু ক’রে দিয়েছিলেন তাঁর মা। তাঁর বাবার জোরাজুরিতে অবশেষে দেশভাগের তিন বছর পর তাঁরা চলে আসতে বাধ্য হন কারণ বাবা পাকিস্তানে থাকায় স্থানীয়দের সাম্প্রদায়িকতার শিকার হতে হয়েছিল মাহমুদুল হকের পরিবারকে। মা’র প্রতি অগাধ ভক্তি ছিল মাহমুদুল হকের। এক সাক্ষাৎকারে উনি বলেছিলেন, ‘মা চলে যাবার সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়।’ তাঁর মা’র নাকি ইচ্ছে ছিল মাহমুদুল হক তাঁকে নিয়ে একটা উপন্যাস লিখবেন। উপন্যাস লেখা না হলেও অনুর পাঠশালার অনুকে মায়ের খুব কাছাকাছি রেখেছেন লেখক।
অনুর পাঠশালায় অনুকেও আমরা সেই মাতৃভক্তির জায়গায় দেখতে পাই। অনু তাঁর বাবাকে ভয় পায়। বাবার সাথে স্বাভাবিক একটা দুরত্ব তৈরি হয়। অনুর মা স্বামীর ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত। তাঁর সুপ্ত ইচ্ছে ইংরেজি শিখে চাকুরী নিবেন। ছেলেকে নিয়ে আলাদা সংসার করবেন। এখানে ডিএইচ লরেন্সের গাট্টুড আর পল মোরেলকে মনে ক’রা যেতে পারে।
সেই লক্ষ্যে টিচার রেখে পড়াশোনা শুরু ক’রে দিয়েছিলেন তিনি। বাবা ব্যস্ত পেশাগতভাবে, মা ব্যস্ত পড়ালেখা নিয়ে। মাঝখানে অনুর অবস্থা নাজুক। মাহমুদুল হক নিজেও একাকিত্বে ভুগতেন। তো, একাকিত্বের মরণ ছোবল থেকে বাঁচতে সে বেঁচে নেয় পাড়ার ছোকরাদের সাথে মেলামেশা। অবশ্যই গেন্দুদের সাথে মিশে উঠতে পারে না তার অনভ্যস্ততাহেতু। তাদের ভাষাও বুঝে না সে। সরুদাসীর সাথে এক বিকেলে ঘটনাক্রমে পরিচয়, অলৌলিক এক উত্তাল সন্ধ্যা কাটিয়ে নিজেকে হারিয়ে খুঁজতে শুরু ক’রে সে। অবশ্যই সেই সরুদাসীকে আর খুঁজে পায় না অনু। পাড়ার ছোকরাদের কাছ থেকে অনু জীবনের পাঠ নেয়। বুঝতে শিখে তাদের দু’তলা বাড়ির বাইরে জগত আলাদা। তার কাজিনদের সেই ফুটানি মার্কা কুইজবন্দি জীবনের বাইরে ও জীবন আছে। সেখানে বাস ক’রে মুচি, ঢোম ও নীচু জাতের মানুষেরা যাদের দু’বেলা দু’মুঠো খাবার জোটাতে হিমশিম খেতে হয়। আর অনুদের দালানে চলে ঘরে খিল দিয়ে ইংরেজি শিক্ষার কসরত আর তার খালা ব্যস্ত হিরে জহরব্রত জীবনে।
মাহমুদুল হকের উপন্যাসের ভাষা পদ্যছন্দে প্রভাবিত। অবশ্যই এর কারণে হিসেবে লেখক নিজেই একবার ব’লে ছিলেন, বেশি বেশি কবিতা পড়ার কারণে তাঁর সিন্টেক্সের এই অবস্থা। তাঁর লেখায় একাকিত্ব একটা অন্যতম অনুষঙ্গ। বোদলেয়ারের প্রভাব স্বীকার ক’রেছিলেন এক সাক্ষাৎকারে। অনু একাকিত্বে ভুগে, তার মা- ও ভুগেন। প্রাচুর্যের মাঝে বসবাস ক’রে কি যেন নেই। কোথায় কিসের যেন অনুপস্থিতি চোখে পড়ে অনুদের বাড়িতে।
অস্তিত্বের সংকট, এলিনিয়েশন, প্রেম হতে গিয়ে ব্যর্থ হওয়া মাহমুদুল হকের উপন্যাসের নিয়মিত থিম। অনুর পাঠশালায় অনুর সাথে সরুদাসীর প্রেম শুরু হয়ে চিরতরে হারিয়ে যায় এক ঝগড়ায় যেখানে অবলীলায় উঠে আসে জাতপাতের কথা। শ্রেণী বৈষম্য দুইজনের মাঝে বাঁধা হয়ে এসে দাঁড়ায়। শ্রেণী বৈষম্য অনুকে সহজে মিশতে দেয় না পড়শী ছোকরাদের সাথে।
অনুর পাঠশালা মাহমুদুল হকের প্রথম উপন্যাস। প্রথম বলতে প্রকাশিত প্রথম। তাঁর প্রথম উপন্যাস দুই কিস্তি প্রকাশিত হবার পর আর আলোর মুখ দেখেনি। বেখেয়ালি লেখক আর কোন পান্ডুলিপি ও রাখেননি।
মাহমুদুল হকের নাম খুব বেশি উচ্চারিত হতে দেখা যায় না আমাদের চারপাশে। আগাগোড়া আধুনিক এই লেখকের লেখা পড়লে পাঠক বুঝতে পারবেন ভদ্রলোক অসম্ভব পড়ালেখা করতেন এবং দর্শন বিষয়ে তাঁর পড়ালেখা ছিল অন্য পর্যায়ের। তাঁর লেখায় মার্ক্স, সাঁত, নীৎসে অনায়াসে ঘুরে বেড়ান গল্পের ভেতর। ইতিহাস, স্মৃতি ও গল্প এই তিনের সমাবেশ তাঁর উপন্যাস।
আলমগীর মোহাম্মদ:প্রভাষক,ইংরেজি বিভাগ,প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি,চট্টগ্রাম।