পাহাড়ী ভট্টাচার্য
পশ্চিমবঙ্গের বিভাস রায়চৌধুরী তাঁর সম্পর্কে একটি কবিতায় লিখেছেন:
ভারভারা, আপনার কবিতা পড়েছি।
সে-অর্থে আপনি কবি নন।
পদের গুরুত্ব নেই… ওজনবিহীন…
অনেক মানুষ শুধু ভিড় ক’রে শোনে!
#
নদীকে বাঁচাতে পথে…
পাহাড় বাঁচাতে পথে…
কবি কি এমন হয়?
যে বলে আমার দেশ লুঠ করে নিল উন্নয়নে!
#
ভারভারা, আপনার কবিতা পড়েছি।
কবিতা কোথায়? দূর!
রাজনীতি করেছেন শুধু!
জঙ্গলে-জঙ্গলে অস্ত্রে ‘হ্যাঁ’ বলা কি ঠিক?
কবি নন, কবি নন…সাচ্চা দেশদ্রোহী…
এক কথায় কবির অধিক!
ঐতিহাসিক রোমিলা থাপার-সহ ভারতবর্ষের দেশবরেণ্য চিন্তক, অর্থনীতিবিদ, লেখক, মানবাধিকার সংগঠকেরা তাঁর চিকিৎসা-র দাবীতে পরশু যৌথ-বিবৃতি দিয়েছেন।
রাষ্ট্রীয় প্রোপাগন্ডার অংশ হিসেবেই জেল থেকে ছড়ানো হয় তাঁর মৃত্যু-সংবাদ। ফেসবুকে তা শেয়ার করেন ভারত ও ভারতের বাইরে, অনেকে। তাঁর স্ত্রী-কন্যা, উদ্বিগ্ন নিকট জনেরা মিডিয়াকে বলেছেন, রাষ্ট্র পরিকল্পিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ এবং হ্যালুসিনেশনে ভোগা, শরীরে পটাশিয়াম ও সোডিয়ামের মাত্রা অকষ্মাৎ হ্রাসপাওয়া মানুষটিকে।
মোট ১৫ টি কাব্যগ্রন্হ তাঁর। রয়েছে সম্পাদনাও। অনেক ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিংস, অনুবাদ, আত্মজীবনীও। জেলে বসেই লেখা তাঁর বেশ কিছু গদ্য। ৫ দশককাল দীর্ঘ শিক্ষকতা-পর্ব তো আছেই। আমজনতার সাথে মিছিলে, অগ্রভাগে, মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে বজ্রকন্ঠে শ্লোগান ধরেন এখনো। এক জনপ্রিয় সুবক্তাও তিনি,পাবলিক-স্পিকার, মোটিভেটর।
জেল তাঁর জন্য নতুন নয়। আগেও বিভিন্ন সময়ে তাঁকে গ্রেফতার করে ভারতের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার। গত কয়েকদিন ধরে ভারতীয় গণমাধ্যমে ও নানা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে তেলেগু কবি, এ্যাক্টিভিষ্ট, সমাজচিন্তক, শিক্ষক ও বাম-ঘরানার নেতৃস্হানীয় এক বুদ্ধিজীবী ভারভারা রাও-কে নিয়ে, বিশেষত, তাঁর নাজুক শারিরীক অসুস্হতাকে ঘিরে জেল-কর্তৃপক্ষ, মহারাষ্ট্রের সরকার ও ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকারের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা ও প্রপাগন্ডা, বর্ষীয়ান এই কবি ও বিপ্লবীকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা প্রাপ্তি-র অধিকার হতে বঙ্চিত রাখা, হয়রানী, বিচারের নামে ক্রমাগত ও পরিকল্পিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়ার উদ্বেগজনক সংবাদ ও মতামত ছিল লক্ষ্যনীয়।
ভারতে সশস্ত্র মাওবাদী ধারার রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রতি সহানুভুতিশীল ও তার বুদ্ধিবৃত্তিক সাংষ্কৃতিক ধারার একজন নিবেদিত, সক্রিয় এবং সোচ্চার ভ্যানগার্ড কবি- ভারভারা রাও। সমাজের অন্ত্যজ ও প্রান্তিক জনগোষ্টির স্বার্থ ও অধিকার সংরক্ষণের লড়াইয়ের নিরলস একজন যোদ্ধা এ মানুষটির বয়স প্রায় ৮১। মুম্বই তলোজা জেলে ভারভারা রাও এখন বোধশক্তিহীন, স্মৃতিবিভ্রমের শিকার হয়ে রীতিমত মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। কারাগারের ভেতরে তাঁর জীবন ও চিকিৎসা নিযে যথেষ্ট উদ্বেগ-উৎকন্ঠা তাঁর আত্মীয়-পরিজন, রাজনৈতিক ও সাংষ্কৃতিক শুভানুধ্যায়ী -দের।
ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের ও ভাষার ৪০ জন নেতৃস্হানীয় কবি-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবি-স্বাক্ষরিত সাম্প্রতিক একটি পিটিশনে তাঁকে দ্রূত জেলের বাইরে অন্যত্র, হাসপাতালে স্হানান্তর করে চিকিৎসার দাবী মোদী সরকার প্রত্যাথান করে। উচ্চ আদালত ৫ বার নাকচ করে দেয় তাঁর জামিন আবেদন।
অবশ্য, ভারভারা রাও-এর বিরুদ্ধে খোদ নরেন্দ্র মোদীকে হত্যা ষড়যন্ত্র, কথিত ভীমা-কোঁরেগাও-তান্ডবে ইন্ধনদান, তরুণদের মাওবাদে ও উগ্র বামপন্হী ধারায় সম্পৃক্তকরণ একজন মাওবাদী সমর্থক ও সক্রিয় বুদ্ধিজীবী-এ্যক্টিভিষ্ট হিসাবে বিভিন্ন সময়ে সোচ্চার ভুমিকার সূত্র ধরে বহির্বিশ্ব বিশেষত নেপাল-এর অস্ত্র-সহায়তায় ভারতে সশস্ত্র বিপ্লব পরিকল্পনার অভিযোগ আনা হয়। এসবই তাঁর গ্রেফতার ও জেলবন্দিত্বের কার্যকারণ-দাবী মোদী সরকারের।
ভারভারা রাও চির যৌবনের কবি। আজীবন অনগ্রসর মানুষের কথা বলেছেন, লড়েছেন। জল-জমি-জঙ্গলের উপর আদিবাসীদের অধিকার প্রশ্নে আপোষহীন থেকে কর্পোরেট-আগ্রাসনের বিরোধিতা করেছেন বিবেক, সৎ সাহস নিয়ে। কখনো তাকে রাগতে দেখা যায় নি, খারাপ কোন কথা বলতেও! সদা হাস্যমুখে বিরোধিতা করেছেন যা কিছু অন্যায় ও অন্যায্য মনে হয়েছে-তার। প্রলোভনে নিজের মেরুদণ্ড বিকিয়ে দেন নি তিনি।
বিপ্লব-স্পন্দিত বুকের এ কবির কারামুক্তি, দ্রুত, যথাযথ চিকিৎসা ও দীর্ঘায়ু আরাধ্য।