সৈয়দ আরিফুল হক

সৈয়দ আলী আহসানের মৃত্যুদিন আজ । বিশিষ্ট কবি, সাহিত্য-সমালোচক, গবেষক, শিক্ষাবিদ, বক্তা ও বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী সৈয়দ আলী আহসান (জন্ম ২৬ মার্চ ১৯২০, মৃত্যু- ২৫ জুলাই ২০০২) আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তি। তিনি শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও মনন-চর্চার ক্ষেত্রে এক বিশাল মহীরূহ হিসাবে বিবেচিত হতেন। এসব ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অভিভাবকতুল্য এক মহান ব্যক্তিত্ব- যার নিবিড় ছায়াতলে সমকালীন কবি-সাহিত্যিক-সংস্কৃতিসেবী-বুদ্ধিজীবীরা শান্তি ও স্বস্তি অনুভব করেছেন।

সৈয়দ আলী আহসান ছিলেন বিরল প্রতিভার অধিকারী এক অসাধারণ সৃষ্টিশীল ব্যক্তি। তাঁর বহুমুখী অবদান ও কৃতিত্বে দেশ ও জাতি নানাভাবে সমৃদ্ধ ও উপকৃত হয়েছে। কবি হিসাবে সমধিক খ্যাতি অর্জন করলেও তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার ধারক। তাঁর অবদানে আমাদের সাহিত্য যেমন সমৃদ্ধ, সমাজ-সংস্কৃতি-শিক্ষা ও বুদ্ধিবৃত্তিক নানা দিক ও বিভাগও তেমনি ঋদ্ধ ও সমুন্নত হয়েছে। এ সকল ক্ষেত্রে তিনি স্বদেশে যেমন বরেণ্য ও সম্মানিত ছিলেন, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও তেমনি ছিলেন বিশেষভাবে সমাদৃত।

অসাধারণ মেধার অধিকারী সৈয়দ আলী আহসান মাগুরা জেলার অন্তর্গত আলোকদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সৈয়দ আল হামেদ। ১৯৩৭ সনে আরমানিটোলা সরকারি হাইস্কুল থেকে মেট্টিক, ১৯৩৯ সনে ঢাকা কলেজ থেকে আই এ ১৯৪৩ সনে স্নাতক ও ১৯৪৪ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে কৃতিত্বের সাথে এম.এ. পাস করে ঢাকাস্থ ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজে কিছুকাল অধ্যাপনা করেন। ১৯৪৫ সনে তিনি কলকাতা রেডিওতে প্রোগ্রাম এসিস্ট্যান্ট হিসাবে চাকরি নেন। ১৯৪৭ সনে দেশ-বিভাগের পর তিনি ঢাকা রেডিওতে যোগদান করেন। এরপর ১৯৪৯ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সিনিয়র লেকচারার, ১৯৫৩ সনে করাচী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে রীডার ও বিভাগীয় প্রধান এবং ১৯৬০ সনে বাংলা একাডেমীর পরিচালক (তখনও মহাপরিচালকের পদ সৃষ্টি হয়নি) পদে যোগদান করেন। ১৯৬৭ সনে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ এবং প্রফেসর এবং সেখান থেকে ১৯৭১ সনে মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতা চলে যান এবং ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে’ নিয়মিত অনুষ্ঠান করা ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বজনমত সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সনে তিনি প্রথমে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর পূর্ব পদে যোগদান করলেও অচিরেই তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর, অতঃপর ১৯৭৫ সনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর, ১৯৭৭ সনে বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা (মন্ত্রীর পদমর্যাদাসম্পন্ন) এবং ১৯৭৮ সনে পুনরায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার অধ্যাপক হিসাবে যোগ দেন। ১৯৮৯ সনে তিনি জাতীয় অধ্যাপক নিযুক্ত হন। ইন্তিকালের পূর্বে তিনি কিছুকাল তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিক্ষাবিদ ও কবি ডক্টর সৈয়দ আলী আশরাফ প্রতিষ্ঠিত দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

এছাড়া, তিনি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যান, ইউনেস্কোর উপদেষ্টা, বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য হিসাবে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহু গুরুত্বপূর্ণ পদ ও দায়িত্বে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি শিক্ষা-সংস্কৃতি-সাহিত্য ইত্যাদি বিষয়ে আয়োজিত বহু আন্তর্জাতিক সভা-সেমিনারে যোগদান উপলক্ষে বহু দেশ পরিভ্রমণ করেন। তিনি মোট প্রায় ৭/৮টি ভাষা জানতেন। বাংলা ছাড়া ইংরেজি ভাষায়ও তিনি বেশ কয়েকটি গ্রন্থ ও অসংখ্য নিবন্ধ রচনা করেন।

বিশাল বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী সৈয়দ আলী আহসানের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা মোট ১০৫টি। এছাড়াও, রয়েছে তাঁর অপ্রকাশিত আরো কিছু মূল্যবান রচনা। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের একটি তালিকা নিচে প্রদত্ত হলো-

গবেষণামূলক গ্রন্থ: ১. বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত (প্রফেসর মুহম্মদ আবদুল হাই-এর সাথে যুগ্মভাবে ১৯৫৪),

২. নজরুল ইসলাম (১৯৫৪), ৩. Essays in Bengali Literature (1956), ৪. কবি মধুসূদন (১৯৫৭), ৫.কবিতার কথা (১৯৫৭), ৬. সাহিত্যের কথা (১৯৬৪),৭. কবিতার কথা ও অন্যান্য বিবেচনা (১৯৬৮), ৮. পদ্মাবতী (১৯৬৮), ৯. মধুমালতী (১৯৭২), ১০. আধুনিক বাংলা কবিতা : শব্দের অনুষঙ্গে (১৯৭০), ১১. রবীন্দ্রনাথ: কাব্য বিচারের ভূমিকা (১৯৭৪), ১২. মধুসূদন : কবিকৃতি ও কাব্যাদর্শ (১৯৭৫), ১৩. আধুনিক জার্মান সাহিত্য (১৯৭৬),১৪. সতত স্বগত (১৯৮৩), ১৫. শিল্পবোধ ও শিল্পচৈতন্য (১৯৮৩), ১৬. সরহপার দোহাকোষ গীতি (১৯৯৩), ১৭. বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস : প্রাচীন যুগ (১৯৯৪), ১৮. আমাদের আত্মপরিচয় এবং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ (১৯৯৬), ১৯. মৃগাবতী (১৯৯৮)।

গল্প : ১. গল্পসংগ্রহ (১৯৫২), ২. গল্প সংকলন (১৯৬৯)।

আত্ম-জৈবনিক উপন্যাস : ১. জিন্দাবাহারের গলি (১৯৮৫), ২. স্রোতোবাহী নদী (১৯৮৯)।

কবিতা :১.অনেক আকাশ (১৯৫৯),২. একক সন্ধ্যায় বসন্ত (১৯৬৪), ৩. সহসা সচকিত (১৯৬৫),৪.উচ্চারণ (১৯৬৮), ৫. আমার প্রতিদিনের শব্দ (১৯৭৪), ৬. কাব্য সমগ্র (১৯৭৪), ৭. চাহার দরবেশ ও অন্যান্য কবিতা (১৯৮৫), ৮. সমুদ্রেই যাব (১৯৮৭), ৯. রজনীগন্ধা (১৯৮৮), ১০. নির্বাচিত কবিতা (১৯৯৬)।

শিশুতোষ: ১. কখনো আকাশ (১৯৮৪)।

ভ্রমণকাহিনী : ১. প্রেম যেখানে সর্বস্ব (১৯৮৭), ২. হে প্রভু আমি উপস্থিত।

আত্মজীবনী: আমার সাক্ষ্য (১৯৯৪)।

অনুবাদ: ১. ইকবালের কবিতা (১৯৫২), ২. প্রেমের কবিতা (যুগ্মভাবে ১৯৫৮), ৩. হুইটম্যানের কবিতা (১৯৬৫), ৪. ইডিপাস (১৯৬৮), ৫. সাম্প্রতিক জার্মান গল্প (১৯৭০), ৬. জার্মান সাহিত্য একটি নিদর্শনী (১৯৭৪), ৭. উইলিয়াম মেরিডিথের নির্বাচিত কবিতা (১৯৮২), ৮. সন্দেশ রাসক (১৯৮৭), ৯. নাহ্জুল বালাঘা (১৯৮৮)।

সম্পাদনা: ১. রূপচ্ছন্দা (যৌথ ১৯৫০), ২. আধুনিক গদ্য সংগ্রহ (গল্প সংগ্রহ, ২য় খন্ড, ১৯৫৩), ৩. গল্প সঞ্চায়ন (যৌথভাবে, ১৯৫৪), ৪. লোক সাহিত্য (১ম খন্ড, ১৯৬৬), ৫. বীরাঙ্গনা কাব্য ঃ মধুসূদন (১৯৬৮), ৬. মেধনাদবধ কাব্য: মধুসূদন (১৯৬৮), ৭. একেই বলে সভ্যতা ও বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ (১৯৬৮), ৮.বাংলাদেশ (১৯৭২), ৯. চর্যাগীতি (১৯৮৪)।

ধর্মবিষয়ক: ১. মহানবী (১৯৯৫), ২. শাহ আলী বোগদাদী (১৯৯৫), ৩. আল্লাহর অস্তিত্ব (১৯৯৫)

সৈয়দ আলী আহসান প্রধানত কবি। সমকালীন বাংলা কাব্যে একজন বিশিষ্ট কবি হিসাবে তাঁর খ্যাতি সর্বজনবিদিত। বিগত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে তাঁর কাব্য-প্রতিভার স্ফুরণ ঘটে। তাঁর সমসাময়িক বিশিষ্ট কবিদের মধ্যে- জসীমউদ্দীন (১৯০৩-৭৬), বে-নজীর আহমদ (১৯০৩-৮৩), আব্দুল কাদের (১৯০৬-৮৪), মহীউদ্দীন (১৯০৬-৭৫), বন্দে আলী মিয়া (১৯০৭-৭৯), সুফী মোতাহার হোসেন (১৯০৭-৭৫), কাজী কাদের নওয়াজ (১৯০৯-৮৩), বেগম সুফিয়া কামাল (১৯১১-৯৯), আ.ন.ম. বজলুর রশীদ (১৯১১-৮৬), মতিউল ইসলাম (১৯১৪-৮৪), আহসান হাবীব (১৯১৭-৮৫), ফররুখ আহ্মদ (১৯১৮-৭৪), তালিম হোসেন (১৯১৮-৯৯), সিকান্দার আবু জাফর (১৯১৮-৭৫), আবুল হোসেন (১৯২১), মুফাখ্খারুল ইসলাম (১৯২১-২০০৭), হাবীবুর রহমান (১৯২২), সানাউল হক (১৯২৪-৮৩) প্রমুখ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তিরিশোত্তর যুগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান আন্দোলনের পটভূমিতে সৈয়দ আলী আহসান বাংলা কাব্য-ক্ষেত্রে আবির্ভূত হন।

রবীন্দ্র-নজরুল প্রভাব-বলয়ে, উত্তর-তিরিশের কাব্যিক আবহাওয়ায় সৈয়দ আলী আহসানের কবি-মানস লালিত হলেও তার সাথে যুক্ত হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর দুর্ভিক্ষ-পীড়িত সামাজিক অবক্ষয়, পাকিস্তান আন্দোলনের উদ্দীপিত চেতনা, ১৯৪৩ সনে কলকাতায় গঠিত ‘পূর্ব-পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি’র প্রণোদনা ইত্যাদি এবং সমসাময়িক অবস্থার প্রক্ষেপ তাঁর মানস-চেতনাকে বিপুলভাবে প্রভাবিত করেছে। এছাড়া, ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য ও অভিজাত মানস-প্রবণতাও তাঁর কাব্যকে দিয়েছে এক ধরনের বিশিষ্টতা। তাই তাঁর কাব্যে স্বদেশপ্রেম, ঐতিহ্য-প্রীতি, নিসর্গ-প্রীতি, প্রেম ও মানুষের প্রতি অপরিসীম মমত্ববোধের পরিচয় পাওয়া যায়।

সৈয়দ আলী আহসানের কাব্যে রোমান্টিসিজম ও আবেগের নিবিড় সংশ্লেষ লক্ষণীয়। রোমান্টিক কবিদের এটা এক সাধারণ বৈশিষ্ট্য। সে অর্থে সৈয়দ আলী আহসান নিঃসন্দেহে একজন আধুনিক রোমান্টিক কবি। নিচে তাঁর ‘একক সন্ধ্যায় বসন্ত’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত সুবিখ্যাত ‘আমার পূর্ব বাংলা’ কবিতা থেকে কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত হলো ঃ

‘‘এখানে নদীর মত এক দেশ
শান্ত, স্ফীত কল্লোলময়ী
বিচিত্ররূপিণী অনেক বর্ণের রেখাঙ্কন
এ-আমার পূর্ব বাংলা
যার উপমা একটি শান্ত শীতল নদী\’’

আমার পূর্ব বাংলা – এক

‘‘আমার পূর্ব-বাংলা একগুচ্ছ
স্নিগ্ধ অন্ধকারের তমাল
অনেক পাতার ঘনিষ্ঠতায়
একটি প্রগাঢ় নিকুঞ্জ
সন্ধ্যার উন্মেষের মতো
সরোবরের অতলের মতো
কালো কেশ মেঘের সঞ্চয়ের মতো
বিমুগ্ধ বেদনার শান্তি
আমার পূর্ব-বাংলা বর্ষার অন্ধকারের অনুরাগ
হৃদয় ছুঁয়ে-যাওয়া
সিক্ত নীলাম্বরী
নিকুঞ্জের তমাল কনক-লতায় ঘেরা
কবরী এলো ক’রে আকাশ দেখার মুহূর্ত’’

আমার পূর্ব-বাংলা- দুই

‘‘আমার পূর্ব-বাংলা অনেক রাতে গাছের
পাতার বৃষ্টির শব্দের মতো
কখনও মৃদঙ্গ, হঠাৎ কখনও বেহালা-
একসময় বাঁশীর সুর
যখন রাত্রে একাকী ঘুম ভাঙে
অনবরত কোমল কোলাহলে
স্বপ্নের মত পাতায় পাতায়
শব্দকে দেখি
তার আকুল বিকাশ
অন্ধকার আকাশের চেতনার মতো
যে-চেতনা এক সময় অতল অবলুপ্তি
এক সময় কালো চোখের তন্দ্রা
এক সময় বিদ্যুৎ-বিকাশ
এক সময় হঠাৎ জাগরিত বজ্র এবং
চোখ-চেয়ে-দেখার কথায় ভরপুর

আমার পূর্ব বাংলা অনেক রাত্রে
গাছের পাতায় বৃষ্টির শব্দের মতো’’

(আমার পূর্ব বাংলা- তিন)

‘আমার পূর্ব বাংলা’ সৈয়দ আলী আহসানের একটি বিখ্যাত কবিতা। এটা বাংলা সাহিত্যেরও একটি উল্লেখযোগ্য কবিতা। অনেকের মতে, তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতা। আমার ধারণা, এটি সৈয়দ আলী আহসানের শ্রেষ্ঠ কবিতাই শুধু নয়, বাংলা সাহিত্যেরও একটি উল্লেখযোগ্য, অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যেমন ‘নির্ঝরের স্বপ্ন ভঙ্গ’, নজরুল ইসলামের যেমন ‘বিদ্রোহী’, ফররুখ আহমদের যেমন ‘সাত সাগরের মাঝি’ তেমনি সৈয়দ আলী আহসানেরও এটা একটি প্রতিনিধিত্বমূলক কবিতা। এ কবিতা সম্পর্কে বিশিষ্ট কবি-সমালোচক হাসান হাফিজুর রহমান বলেনঃ

‘‘(এ কবিতায়) সৈয়দ আলী আহসান অবলীলায় সঞ্চরণের উপযোগী ভিত্তি পেয়ে গেছেন- বিষয়, বক্তব্য এবং বহির্প্রকাশের সঙ্গত যোগাযোগ ঘটে গেছে। একটি করে বাক্যে গঠিত এই কবিতা তিনটি। খন্ড খন্ড চিত্রে ও চিত্রকল্পে একটি অখন্ড রূপকল্পের সৃজন প্রয়াসের মধ্যেই এ কবিতাত্রয়ের আঙ্গিক-স্বাতন্ত্র্য। খন্ডের সমাহারে অখন্ড পূর্ব বাংলার প্রাকৃতিক ও ঐতিহ্যিক দ্যোতনায় একটি সম্পূর্ণতা আনয়নের প্রয়াসে কবিতা তিনটির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একটা শিহরিত আলোড়ন বয়ে গেছে। কবির মনের গভীরে দেশ সম্পর্কে তাঁর আজীবনের ধারণা, দেশের প্রকৃতি ও মানুষকে দেখার অভিজ্ঞতা, দেশবাসী যেভাবে প্রকৃতি ও জন্মভূমিকে ভোগ করে ও ভালোবাসে, সে সম্পর্কে উপলব্ধি এবং প্রকৃতি ও মানুষের মিশ্রিত জীবনসংগ্রাম ও ঐতিহ্যলালিত চিরাচরিত মনোভঙ্গি, রসগ্রাহিতা ও আত্ম-উন্মোচনের বৈশিষ্ট্য প্রভৃতি যেমন করে ছবিতে ও চিন্তায় ধীরে ধীরে সঞ্জাত হয়েছিল, সে সবই যেন এই কবিতায় এক সচ্ছল প্রবাহে একসঙ্গে উৎসারিত। এইসঙ্গে মিলিত হয়েছে কবির আধুনিক দেখার ভঙ্গি, রসচেতনার বৈশিষ্ট্য, মানস-প্রকৃতির নিজস্ব উদ্বেজনা ও শিল্পধারণা।’’ (হাসান হাফিজুর রহমান ঃ আধুনিক কবি ও কবিতা, পৃষ্ঠা-১৬০)।

রোমান্টিক মানস-প্রবণতার অধিকারী সৈয়দ আলী আহসানের রোমান্টিক কবি-কল্পনা তাঁর কবিতার ছন্দে, ভাবে ও অলংকারে সমন্বিত হয়ে এক অপরূপ কাব্য-সুষমা বিনির্মাণ করেছে। যেমন ঃ

‘‘মানুষের কামনায় ধানের শীষে
হলুদ হয়েছে
কত অনুপাত প্রলাপ কত বিষ
অনেক আনন্দে রমণী পদ্মিনী
সময় তো উল্লাসের মতো
হাসাহাসি অথবা সচকিত বাতাস
এবং মুহূর্তের সচেতনতায় আমি
পৃথিবী।’’

(অনবরত, সমকাল ঃ বৈশাখ-আষাঢ় সংখ্যা, ১৩৬৯)

অনেকের মতে, সৈয়দ আলী আহসান অভিজাত শিল্প-চেতনার অধিকারী। তাঁর চিন্তা, কল্পনা ও অনুরণনে এক নৈর্ব্যক্তিক অনুভব সর্বদা তাঁর কবিতার ছত্রে ছত্রে অনুভূত হয়। একটি উদাহরণ ঃ

‘‘অনন্তে বিকশিত আনন্দ
শতদল পদ্মের মতো
কিন্তু মানুষ কি তখন চায় শুধু-
অর্থাৎ এ মুহূর্তে সর্বমুহূর্তে-
যদিও অনবরত নিশ্বাস এবং অস্থি
এবং বিশ্বাস জীর্ণ হয়-
অনন্তের আকাঙ্ক্ষা এবং সমর্থিত বাঁচা ?’’

(সম্পন্ন মানুষ এবং গান। সমকাল, বৈশাখ-আষাঢ় সংখ্যা, ১৩৬৯)

সৈয়দ আলী আহসান একজন শিল্প-সচেতন কবি। আধুনিক কবিতার আঙ্গিক ও প্রকরণ সম্পর্কে তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিল। গদ্য ছন্দেই তিনি অধিকতর স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছেন। শব্দ, অলংঙ্কার, উপমা-রূপক, চিত্রকল্প ব্যবহারে তাঁর নিজস্ব রুচি, দৃষ্টিভঙ্গী ও বিবেচনা কাজ করেছে। তিনি এক্ষেত্রে ইংরেজি সাহিত্যের প্রচ্ছায়ায় আধুনিক শিল্পসম্মত প্রয়োগ-কৌশল অবলম্বন করেছেন। শব্দ ব্যবহারে তাঁর নিজস্বতা লক্ষণীয়। শব্দের মধ্যে সজীবতা ও দ্যোতনা সৃষ্টির পারঙ্গমতা তাঁকে বিশেষ বৈশিষ্ট্য দান করেছে। তাঁর কবিতায় ব্যবহৃত শব্দের মধ্যে এমন একটা ঝংকার বা ব্যঞ্জনা রয়েছে, যা হৃদয়ের অনুভূতিকে তরঙ্গিতভাবে উচ্চকিত করে। তাঁর কবিতার উপকরণ স্বদেশ, সকাল ও স্বজাতির মধ্য থেকে আহরিত বলে সকলের নিকট তা সহজগ্রাহ্য। তাঁর কবিতায় আহরিত উপকরণসমূহ বিন্যাসের ক্ষেত্রে তিনি যে নৈপুণ্য প্রদর্শন করেছেন তা সহজেই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাঁর কবিতায় এক ধরনের মনন-ধর্মিতা, নৈর্ব্যক্তিকতা ও পরিশীলিত-পরিশ্রুত চিন্তা-চেতনার প্রকাশ অনিবার্য হয়ে উঠেছে। তাই তিনি শুধু কবি নন, অনেকের দৃষ্টিতে কবিদের কবি।

সৈয়দ আলী আহসান প্রথম জীবনে চল্লিশের দশকের প্রধান কবি ফররুখ আহমদের অনেকটা প্রভাবিত হয়ে কবিতা-চর্চায় মনোনিবেশ করেন। ফররুখ আহমদ পুঁথি-সাহিত্যের কাহিনী, ভাষা ও উপাদান নিয়ে যে আধুনিক কাব্য সৃষ্টির মাধ্যমে নিজস্ব স্বতন্ত্র ধারা সৃষ্টিতে সক্ষম হন, তা সমকালীন অনেক কবিকেই আকর্ষিত করে। সৈয়দ আলী আহসানও সে ধারা অনুসরণের চেষ্টা করেন। ফররুখের কাব্যে ব্যবহৃত আরবি-ফারসি শব্দের প্রতিও তাঁর অনুরাগ ছিল। তিনি প্রথম দিকে তাঁর কবিতায় কিছু কিছু আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করার প্রয়াস পান। কিন্তু অচিরেই তিনি অনুভব করেন যে, ফররুখ আহমদ যে ধারায় কাব্য-রচনা করে সাফল্য অর্জন করেছেন, তাতে তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন না। ফলে তিনি তাঁর নিজস্ব ধারায় কাব্য-চর্চায় ব্রতী হন এবং তাতে সাফল্য অর্জন করেন। ফলে একজন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন আধুনিক কবি হিসাবে তিনি সহজেই বাংলা কাব্যে তাঁর নিজস্ব স্থান অধিকার করে নেন।

বিশেষভাবে কবি হিসাবে পরিচিত হলেও সৈয়দ আলী আহসান গদ্য-রচনায় অসাধারণ কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন। তাঁর গদ্যের স্টাইল, বর্ণনা ও শব্দ-বিন্যাস বিশেষ বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। তাঁর গদ্যভঙ্গী কবিতার মতোই ছন্দময়, ধ্বনি-মাধুর্যে ও সুর-তরঙ্গে অপরূপ আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। তাই অন্যদের নিকট তা হয়েছে অনুকরণীয়। তাঁর গদ্যের বিষয়বস্তুও বহু বিচিত্র ও আকর্ষণীয়। এতে তাঁর অসাধারণ মেধা, প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতার পরিচয় সুস্পষ্ট। বহু বিষয়ে তাঁর রচনা ও গবেষণা আমাদের মননশীল, সৃষ্টিশীল জগতকে করেছে বিস্তৃত ও নানা বর্ণ-সুষমায় সুসমৃদ্ধ। তাঁর গদ্য রচনাকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা যায়:
১. মননশীল রচনা,
২. গবেষণামূলক রচনা,
৩. কথা-সাহিত্য,
৪. আত্ম-জৈবনিক রচনা,
৫. ভ্রমণ কাহিনী,
৬. শিশুতোষ রচনা,
৭. শিল্প-সমালোচনা,
৮. বিবিধ।

সৈয়দ আলী আহসান শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজ ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে অসংখ্য মননশীল নিবন্ধ-প্রবন্ধ রচনা করেছেন। এগুলো তাঁর জ্ঞান, পান্ডিত্য, অভিজ্ঞতা ও স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচায়ক। এ জাতীয় লেখার মাধ্যমে তিনি সকল শ্রেণীর মানুষের জন্য বিভিন্ন বিষয়ে মানুষের আগ্রহ ও অনুসন্ধিৎসা সৃষ্টিতে সাহায্য করেছেন। জীবন ও সমাজের নানা বিষয়ে তাঁর যে কত গভীর জ্ঞান ছিল এবং এ সব বিষয়ে তাঁর যে একটি নিজস্ব সুস্পষ্ট বক্তব্য ছিল, তাঁর রচনা পড়লে সেটা উপলব্ধি করা যায়। তাই তাঁর এ জাতীয় রচনা কেবল বক্তব্য-প্রধান নয়, তা সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনামূলক এবং সমাজ ও জীবনের জন্য তা নানাদিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো সাহিত্য-রসেও সমৃদ্ধ।

সৈয়দ আলী আহসানের গবেষণামূলক রচনা আমাদের ভাষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতির জগতকে বিচিত্র সম্ভারে ও জ্ঞানালোকে সমৃদ্ধ করেছে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের যথার্থ পরিচয় সন্ধানে এবং সমালোচনামূলক সাহিত্যে তাঁর অসাধারণ প্রজ্ঞা সকলের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তিনি আমাদের দেশীয় সাহিত্যের সাথে বিশ্ব-সাহিত্যের সংযোগ সাধনের ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। ফলে তাঁকে নিঃসন্দেহে আমাদের শিক্ষা, সাহিত্য ও গবেষণা-জগতের অন্যতম পথিকৃৎ হিসাবে বিবেচনা করা চলে।

মননশীল রচনা ও গবেষণাকর্ম ছাড়াও সৈয়দ আলী আহসান উপন্যাস, আত্মজৈবনিক রচনা, ভ্রমণ কাহিনী এমনকি, শিশুদের জন্যও গ্রন্থাদি রচনা করেছেন। শিল্পকলা ও ভাস্কর্য বিষয়েও তাঁর অসাধারণ জ্ঞানগর্ভ রচনাবলী পাঠক তো বটেই এমনকি, এসব ক্ষেত্রে যারা বিশেষজ্ঞ, তাঁদেরকেও বিস্মিত করে। এছাড়া, রন্ধন-শিল্প ও অন্যান্য নানা বিষয়ে তাঁর অসংখ্য প্রবন্ধ ও গ্রন্থাদি রয়েছে। এত বিচিত্র বিষয়ে তাঁর গভীর পান্ডিত্য ও অভিজ্ঞতার দ্বারা বুঝা যায় যে, তিনি লেখক হিসাবে যেমন ব্যক্তি হিসাবেও ছিলেন তেমনি একজন অসাধারণ মানুষ।

বিভিন্ন বিষয়ে লেখা তাঁর গদ্যের ভাষা ও বর্ণনার স্টাইল অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও হৃদয়গ্রাহী। তাঁর গদ্যের ভাষা প্রসাদ গুণসম্পন্ন, সাবলীল, ছন্দ-ঝংকারময়, স্নিগ্ধ স্রোতস্বিনীর ন্যায় প্রবহমান। বাংলা গদ্য-সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর এ বৈশিষ্ট্যময় চমৎকার ভাষাভঙ্গী সকলের নিকট যেমন আকর্ষণীয় তেমনি অনুসরণযোগ্য।

সৈয়দ আলী আহসান বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর অসাধারণ অবদান ও কৃতিত্বের জন্য দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন স্বীকৃতি ও পুরস্কার লাভ করেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোঃ
বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬৭),
দাউদ পুরস্কার (১৯৬৮, প্রত্যাখ্যান),
সুফী মোতাহার হোসেন স্বর্ণপদক (১৯৬৭),
একুশে পদক(১৯৮৩),
নাসিরউদ্দীন স্বর্ণপদক (১৯৮৫),
মধুসূদন পুরস্কার (১৯৮৫),
স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৮৮),
Officer Del Orore Des Arts Et Des Letters, Paris (1992),
হিন্দি ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৭৪ সনে নাগপুর বিশ্ব হিন্দি সম্মেলন থেকে প্রাপ্ত সম্মাননা পত্র। ‘বাংলা সাহিত্য পরিষদ পদক – ১৯৯১’,
‘স্বদেশ সংস্কৃতি সংসদ স্বর্ণপদক’ (১৯৯৮) প্রভৃতি লাভ করেন।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন