স্মরণ
পরানের গহীনে বাজে, ‘সায়োনারা, সায়োনারা’
সরওয়ার মোরশেদ
পুবাকাশ
আলী স্যারের সাথে জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের এক জায়গায় ভীষণ মিল – প্রচন্ড বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তিমত্তার অধিকারী হয়েও তারা সেভাবে লেখালেখি করেননি। তবে প্রফেসর রাজ্জাক চরম সৌভাগ্যবান যে তিনি ছফার মতো একজন শিষ্য পেয়েছিলেন। ছফা তার যদ্যপি আমার গুরুর মাধ্যমে পুরান ঢাকার চির নতুন অধ্যাপককে অক্ষরে প্রায় অমরত্ব দান করেছেন। আলী স্যারের শিষ্যদের মধ্যে যারা একাডেমিয়াতে বা সৃজনশীল কাজকর্মের সাথে সম্পৃক্ত আছেন তাঁরা উদ্যোগ নিলে আমরা আলী স্যারের জীবনী , তাঁর সৃষ্টিকর্ম ও একটি সমৃদ্ধ Commemorative volume হাতে পেতে পারি।
১.
আলবেয়ার কাম্যু আধুনিক মানুষ সম্পর্কে বলেছেন, ‘A single sentence will suffice for modern man. He fornicated and read the(news)papers’। প্রতীচ্যের প্রেক্ষাপটে আধুনিক মানবের মধ্যে সংবাদপত্র পাঠ ও অনূঢ়াগমণের বৈশিষ্ট্য উপস্থিত থাকলেও, ব্যাপকার্থে দ্বিতীয় উপকরণটিরই বিশ্বজনীনতা রয়েছে। আধুনিক কালের একজন মানুষ হিসেবে আমিও খুব ছোটবেলা থেকে সংবাদপত্র পাঠে অভ্যস্ত। অধ্যাপক আলী স্যারের সাথে আমার প্রথম পরিচয়ও ঘটে সংবাদমাধ্যমের বদৌলতে। তখন সম্ভবত ১৯৮৬ সাল। সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি। সাপ্তাহিক বিচিত্রা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের(চবি)তৎকালীন উপাচার্য প্রফেসর মোহাম্মদ আলীর সাক্ষাৎকার ছেপেছিল ক্যাম্পাসের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ে। যদ্দুর মনে আছে, চবি সম্পর্কিত প্রতিবেদন ও সাক্ষাৎকারটির শিরোনাম ছিল – ‘সন্ত্রাসের অভিযোগ অলীক কল্পনাপ্রসূত: অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী।’ সাক্ষাৎকারে আলী স্যারের ব্যবহৃত ‘অলীক’ শব্দটি তখন পুরোপুরি না বুঝলেও পদটি আমার স্মৃতিতে এক ধরণের অলৌকিক অণুরণন তৈরি করেছিল; হয়তোবা এ কারণেই শিরোনামটি দীর্ঘ তিন যুগ পরও ভুলোমনা আমার স্মৃতিতে অম্লান!

২.
বছর আটেক আগের কথা। বিভাগে এমএ পরীক্ষা কমিটির প্রশ্নপত্র সমীক্ষণের কাজ চলছে কাজী মোস্তাইন বিল্লাহ (QMB) স্যারের রুমে। Henrik Ibsen এর উপর একটা প্রশ্নে ব্যবহৃত ‘indictment’ শব্দটাকে আমাদের এক শ্রদ্ধেয় সহকর্মী ‘ইন্ডিক্টমেন্ট’ উচ্চারণ করলে কমিটির সভাপতি QMB স্যার বললেন, শব্দটির সঠিক উচ্চারণ হবে ‘ইনডাইটমেন্ট’। প্রিয় সহকর্মী জানালেন শব্দটির উচ্চারণ ‘ইন্ডিক্টমেন্ট’ও হয়। ছাত্র- শিক্ষক মধুর বাহাসের আবহ তৈরি হলে সভাপতি স্যার মডারেশন কর্ম সাময়িক বন্ধ রাখার ইঙ্গিত দিলেন। বিল্লাহ স্যার ড্রয়ার থেকে Cambridge Dictionary বের করে আমাদের দেখালেন শব্দটির সঠিক উচ্চারণ ‘ইন্ডাইটমেন্ট’। তারপর স্যার যে কথাটি বলেছিলেন সেটাই এই ক্ষুদ্রাবয়ব লেখার মূল প্রতিপাদ্য। স্যার আমাদের উদ্দেশ্য করে বললেন, ” এই শব্দের উচ্চারণ আমিও ভুল করতাম। এর সঠিক উচ্চারণ আমি প্রফেসর আলীর কাছে শিখেছি।” অধ্যাপক আলীর ছাত্র না হয়েও বিল্লাহ স্যারের মতো একজন পন্ডিত ব্যক্তি সেদিন আলী স্যারের প্রতি যে সসম্ভ্রম কৃতজ্ঞতা দেখিয়েছেন, তা একাডেমিশিয়ান হিসেবে প্রফেসর আলীর শালপ্রাংশু ব্যক্তিত্ব আর অর্জনকেই নির্দেশ করে।
৩.
আমি রব হলের আবাসিক ছাত্র ছিলাম। একবার হলের কোন এক অনুষ্ঠানে আলী স্যারকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। ইংরেজি বিভাগের ছাত্র হিসেবে হল মিলনায়তনে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম স্যারের বক্তব্য শোনার জন্য। কাঞ্চনকান্তি সুপুরুষ আলী স্যার যখন বক্তব্য শুরু করলেন, মুহূর্তে সমস্ত কর্কশ কোলাহল থেমে গেল। এর আগে স্যারের বাংলা বক্তব্য শুনেছি বলে মনে পড়ে না। শুঁটকিখেকোদের দেশের একজন ভূমিপুত্র এত সুমিষ্ট উচ্চারণে বাংলা বলতে পারেন, সেটা আমার কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকেছিল। স্যারের বক্তব্য শুনে মনে হয়েছিল, এতো বক্তৃতা নয়, যেনো কোন বহু-চর্চিত কন্ঠাধিকারী বাচিক শিল্পীর পরিশীলিত কাব্যিক উচ্চারণ! এই বক্তৃতা শোনার পর অনেকবার ভেবেছিলাম স্যারের সাথে গিয়ে পরিচিত হবো, দুদন্ড কথা কইবো। আমার বাবার পরিচয় দিবো। উল্লেখ্য, আমার পিতা একাদশ শ্রেণীতে আলী স্যারের সহপাঠী ছিলেন। চবি ইংরেজি বিভাগে ভর্তির পর পিতৃদেব আমাকে অনেকবার তাগাদা দিয়েছিলেন যাতে আমি আলী স্যারের সাথে পরিচিত হই। আজন্ম Escapist আমার পক্ষে সে কাজ হয়ে উঠেনি। হয়ে ওঠেনি প্রফেসর আলীর সাথে একান্তে কথা বলা। অবশ্য এহেন বাচিক শিল্পসুষমার অধিকারী এক Verbal artist এর সাথে আমি কী আর কথা বলতাম! রব হলে স্যারের দেয়া বক্তব্য স্মরণে এলেই আমার মনে পড়ে কনরাডের Heart of Darkness এর রাশান Mr. Kurtz সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছিল, সেটার ইতিবাচক দিকটি: You don’t talk with that man – You listen to him! এমনই এক কথার ঐন্দ্রজালিক ছিলেন আলী স্যার! একেবারে অনুপম Articulate mammal, অননুকরণীয় এক Homo Loquens!
৪.
আলী স্যারের প্রতি আমার ব্যক্তিগত মুগ্ধতা অন্য একটি কারণে। বাংলাদেশের মিডিয়াতে ঢাকাকেন্দ্রিক ইংরেজির অধ্যাপকদের বিশেষ করে সর্ব অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, কবীর চৌধুরী, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীদের যে দেদীপ্যমান উপস্থিতি, সে তুলনায় এ ত্রয়ীর সমমানের বুদ্ধিজীবী প্রফেসর আলীর প্রভাব-প্রাবল্য রীতিমতো শোচনীয়! নব্বই এর দশকে গৃহীত বাংলা একাডেমির অভিধান প্রকল্প আলী স্যারের প্রান্তিক অবস্থান কিছুটা হলেও ঘুচিয়ে দিয়েছিল। আমরা সবাই জানি, বাংলা একাডেমির English to Bengali অভিধানের সম্পাদক ছিলেন প্রফেসর জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী। আর Bengali to English অভিধানের সম্পাদকত্রয়ীর প্রথমজন ছিলেন প্রফেসর আলী। আমাদের আলী স্যার!
৫.
অনেক আগে সাবেক মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি সাহেবের একান্ত ভাবনা শীর্ষক বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম (তখনও অবশ্য তিনি সংসদ সদস্য বা মন্ত্রী কোনটাই হননি।)। চট্টগ্রাম ইন্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটের মঞ্চ আলো করে স্টেজে বসে ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। প্রধান অতিথির বক্তব্য দিতে গিয়ে হুমায়ূন তার স্বভাবসুলভ সরস ঢংয়ে বলেছিলেন, রাজনীতিবিদ-শিল্পপতি নুরুল ইসলামের লেখার চাইতে জননেতার নামের শেষাংশ তাকে বেশি আকর্ষণ করেছে। ‘বিএসসি’ ডিগ্রিটা নুরুল ইসলামের অস্তিত্বের সাথে এমনভাবে একাকার হয়ে গেছে যে মাতৃপিতৃ-প্রদত্ত নাম বাদ দিয়ে মানুষজন তাকে ‘বিএসসি সাহেব’ বলে ডাকে।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদেরকে ‘এমএসসি সাহেব’, ‘পিএইচডি সাহেব’ বলে সম্বোধন করার রেওয়াজ নেই। কিন্ত আলী স্যারের নামের সাথে ‘এমএ (অক্সন)’ এমনভাবে দ্রবীভূত হয়ে গেছে যে ‘মোহাম্মদ আলী এমএ (অক্সন)’ না লিখলে নামটাই অসম্পূর্ণ দেখায়! এর পেছনে, আমার মনে হয়, বাংলা একাডেমির Bengali to English Dictionary-র একটা ভূমিকা আছে।
৬.
আলী স্যারের সাথে জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের এক জায়গায় ভীষণ মিল – প্রচন্ড বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তিমত্তার অধিকারী হয়েও তারা সেভাবে লেখালেখি করেননি। তবে প্রফেসর রাজ্জাক চরম সৌভাগ্যবান যে তিনি ছফার মতো একজন শিষ্য পেয়েছিলেন। ছফা তার যদ্যপি আমার গুরুর মাধ্যমে পুরান ঢাকার চির নতুন অধ্যাপককে অক্ষরে প্রায় অমরত্ব দান করেছেন। আলী স্যারের শিষ্যদের মধ্যে যারা একাডেমিয়াতে বা সৃজনশীল কাজকর্মের সাথে সম্পৃক্ত আছেন তাঁরা উদ্যোগ নিলে আমরা আলী স্যারের জীবনী , তাঁর সৃষ্টিকর্ম ও একটি সমৃদ্ধ Commemorative volume হাতে পেতে পারি।
স্যার নজরুল সঙ্গীত নিয়ে কাজ করেছেন। ইংরজি কবিতা সংকলন করেছেন। হাসান হাফিজুর রহমানের কবিতা ইংরজিতে অনুবাদ করেছেন। আর বাংলা একাডেমির বিখ্যাত অভিধান সম্পাদনাতো আছেই। এর বাইরেও স্যারের আরো কিছু কাজ আছে। কাতেব-বিস্ফোরণের এই যুগে আলী স্যারের হয়তো দৃশ্যমান বহুপ্রজতা নেই কিন্ত কাজের সাংখ্যিক আর গুণগতমানের যুথবদ্ধ বিচারে তাকে অল্পপ্রজ বলাটাও সুবিবেচনাপ্রসূত মনে হয়না। তারপরও যারা স্যারের বিরুদ্ধে লৈখিক জড়তা বা শীতনিদ্রার অভিযোগ তোলেন, তাদেরকে মহাপ্রলয়ের একটা ছোট লক্ষণ মনে করিয়ে দিতে চাই। কেয়ামত নিকটবর্তী হওয়ার অনেকগুলো নিদর্শনের মধ্যে একটি হল লেখকের সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়া। এন্তার লেখাজোকা করে স্যার হয়তো মহাপ্রলয় ত্বরান্বিতকরণে ভূমিকা রাখতে চাননি!
আমাদের বর্ণবাদী (সফেদ-পীত বর্ণের দল) শিক্ষক রাজনীতির আর বিভাজন-প্রবণ দলীয় অপরাজনীতির শিকার হয়েছেন প্রফেসর আলীর মত ব্যক্তিত্বও। অবলীলায় তিনি হতে পারতেন প্রফেসর ইমেরিটাস। আমার মনে হয়, আলী স্যার জাতীয় অধ্যাপক হওয়ার মত যোগ্য ব্যক্তি। উল্লেখ্য যে তার পরিবার থেকে একজন জাতীয় অধ্যাপক হয়েছেনও।জাতীয় অধ্যাপক প্রফেসর ডাঃ নুরুল ইসলাম সম্পর্কে আলী স্যারের ভগ্নিপতি ছিলেন। আমার পরম সৌভাগ্য যে ডাঃ ইসলাম আর আমি একই এলাকার মানুষ ও একই বিদ্যালয়ের ছাত্র। পরিতাপের বিষয়, চবিতে আলী স্যারের সমসাময়িক দুজন অধ্যাপক প্রফেসর ইমেরিটাস ও দুজনের একজন জাতীয় অধ্যাপক হলেও প্রফেসর আলীর বরাতে কোনটাই জোটেনি। চবি কর্তৃপক্ষ চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার (যেটি প্রফেসর আলী উপাচার্য থাকাকালে উদ্বোধন করেছিলেন।) বা যেকোন নুতন একাডেমিক ভবন আলী স্যারের নামে নামকরণ করে তাঁর প্রতি কৃত অবহেলার দায়ভার কিছুটা হলেও লাঘব করতে পারেন। বর্ণভিত্তিক বিভাজনের উর্ব্ধে গিয়ে ইংরেজি বিভাগ ইতোমধ্যেই তাদের বিভাগীয় সেমিনার লাইব্রেরির নাম আলী স্যারের নামে করেছেন। বিভাগের প্রতিষ্ঠাতার প্রতি তাদের সম্মান সাধুবাদযোগ্য। English Alumni Association স্যারের সৃষ্টিকর্ম প্রকাশের উদ্যোগ নিয়ে তাদের প্রিয় অধ্যাপকের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের সুযোগ কাজে লাগাতে পারে। শুধু স্মৃতির প্রত্নলাবণ্যচর্চায় কি আর সবার সব ঋণ শোধ করা যায়?
৭.
সেকালের ইংরেজির অধ্যাপকদের প্রবাদপ্রতিম পোশাক পরিচ্ছদের পারিপাট্য আর আভিজাত্যের গল্প শুনেছিলাম চট্টগ্রাম কলেজের ইংরেজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান স্যারের মুখে। তিনি বিশেষ করে চট্টগ্রাম কলেজের অধ্যক্ষ আবু হেনা, প্রফেসর মোজাফফর ও প্রফেসর আবু সুফিয়ানের কথা বেশি বলতেন। জীবিত অধ্যাপকদের মধ্যে প্রফেসর খান আলী স্যারের sartorial elegance এর ঢের প্রশংসা করতেন। আলী স্যারের বসন এবং বচনের উচ্ছসিত প্রশংসা এই সেদিনও করছিলেন আমাদের বিভাগের বর্তমান সভাপতি ড: সুকান্ত স্যার।
রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি সেভাবে না পেলেও অণুক্ষণ প্রশংসায় ভাসতে ভাসতেই আলী স্যার চলে গেলেন মাধ্যাকর্ষণ শক্তির আওতার বাইরে। পাদপ্রদীপের ঔজ্জ্বল্যে সেভাবে সুস্নাত না হয়েও, পদ-পদবী-পদকভারে মৃত্তিকাচুম্বী না হয়েও শিষ্যদের এমন প্রবলভাবে আবিষ্ট করে রাখা আলী স্যারের মতো একজন মহান অধ্যাপকের পক্ষেই সম্ভব। মনে পড়ছে, বিগত English Alumni Reunion এ বিল্লাহ স্যারের বক্তব্যের একটি ছোট্ট কথা। QMB স্যার তার বক্তব্যে মঞ্চে উপস্থিত আলী স্যারকে ‘Professor of professors’ হিসেবে সম্বোধন করেছিলেন। সত্যিই রাজাদের রাজা যেমন রাজাধিরাজ, তেমনি আলী স্যার অধ্যাপকদের অধ্যাপক (অধ্যাপকাধিয়োধ্যাপক!)। তিনি শিক্ষকদের খান-ই -খানান।
৮.
আলী স্যারের ভক্ত-অনুরক্ত ও ছিদ্রান্বেষীরা প্রায় সময় বলে থাকেন যে, স্যার অক্ষরের অমরাবতীতে নিজের স্থান পোক্ত করতে পারেননি। তিনি অপ্রজ বা বিরল প্রজ ছিলেন। অভিযোগ বা অনুযোগটিকে আমার সর্বাংশে গ্রহণযোগ্য মনে হয়না। স্যার নজরুল সঙ্গীত নিয়ে কাজ করেছেন। ইংরজি কবিতা সংকলন করেছেন। হাসান হাফিজুর রহমানের কবিতা ইংরজিতে অনুবাদ করেছেন। আর বাংলা একাডেমির বিখ্যাত অভিধান সম্পাদনাতো আছেই। এর বাইরেও স্যারের আরো কিছু কাজ আছে। কাতেব-বিস্ফোরণের এই যুগে আলী স্যারের হয়তো দৃশ্যমান বহুপ্রজতা নেই কিন্ত কাজের সাংখ্যিক আর গুণগতমানের যুথবদ্ধ বিচারে তাকে অল্পপ্রজ বলাটাও সুবিবেচনাপ্রসূত মনে হয়না। তারপরও যারা স্যারের বিরুদ্ধে লৈখিক জড়তা বা শীতনিদ্রার অভিযোগ তোলেন, তাদেরকে মহাপ্রলয়ের একটা ছোট লক্ষণ মনে করিয়ে দিতে চাই। কেয়ামত নিকটবর্তী হওয়ার অনেকগুলো নিদর্শনের মধ্যে একটি হল লেখকের সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়া। এন্তার লেখাজোকা করে স্যার হয়তো মহাপ্রলয় ত্বরান্বিতকরণে ভূমিকা রাখতে চাননি!
রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি সেভাবে না পেলেও অণুক্ষণ প্রশংসায় ভাসতে ভাসতেই আলী স্যার চলে গেলেন মাধ্যাকর্ষণ শক্তির আওতার বাইরে। পাদপ্রদীপের ঔজ্জ্বল্যে সেভাবে সুস্নাত না হয়েও, পদ-পদবী-পদকভারে মৃত্তিকাচুম্বী না হয়েও শিষ্যদের এমন প্রবলভাবে আবিষ্ট করে রাখা আলী স্যারের মতো একজন মহান অধ্যাপকের পক্ষেই সম্ভব।
৯.
আলী স্যার বিদগ্ধ পন্ডিত ছিলেন। ছিলেন একজন প্রবাদপ্রতীম সুশিক্ষক। কিন্ত তিনি দিবসরজনী পুঁথির মধ্যে গর্ত খুঁড়ে চলা বিদ্যাভারাক্রান্ত, অহংকারে মৃত্তিকাবিযুক্ত, গজদন্তমিনারবাসী অধ্যাপক ছিলেননা। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পর্ষদে কাজ করেছেন। দায়িত্ব পালন করেছেন বিভাগীয় সভাপতি, কলা অনুষদের ডিন আর সর্বোপরি উপাচার্য হিসেবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহী হিসেবেও আলী স্যার অনন্য নজির স্থাপন করেছেন। পদত্যাগকে আমাদের দেশের কর্তাব্যক্তিগণ যেখানে দেহত্যাগের চাইতেও বেশি ভয় করেন, সেখানে আলী স্যার উপাচার্যের পদ থেকে স্বেচ্ছায় সরে দাড়িয়ে আত্মসম্মানবোধের বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। সামাজিক প্রজাপতি (Social butterfly) না হয়েও তিনি মিশেছেন প্রয়োজনীয় পরিমন্ডলে, কাজ করেছেন চবির বাইরে আরো তিনটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি হিসেবে। দক্ষতার সাথে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করেছেন ইউজিসি সদস্য হিসেবে। এই কর্মবীর আসলে তাঁর নামের মতই অনন্য। আরবীতে আলী অর্থ High, Champion, Exalted ইত্যাদি। স্যার Onomastically যেমন Champion, অনুরুপভাবে professionally-ও তিনি একজন সত্যিকারের চ্যাম্পিয়ন। আমাদের উপমহাদেশীয় লোকজনের নাম ইংরেজিতে টাইপ করলে নিচে লাল দাগ আসে অর্থাৎ কম্পিউটারজি ভুল ধরেন। আপনি Ali টাইপ করে দেখুন, কোন লাল দাগ আসবেনা অর্থাৎ এই নামে কোন ভুল নেই। স্যারের নাম পর্যন্ত তাঁর অধীত বিষয়ের সাথে কী চমৎকারভাবেইনা একাকার হয়ে গেছে!
১০.
আলী স্যারের জানাযা শেষে আমরা কবরস্থান প্রাঙ্গনে দাঁড়িয়েছিলাম। মাত্র ফুট চল্লিশেক দূরেই আয়োজন চলছিল স্যারের শেষের শুরুর। অল্প সময়ের মধ্যেই সূর্যালোককে চির বিদায় দিয়ে স্যারকে অন্ধকারের গর্ভে সমর্পণ করা হলো। প্রাণের গহীনে বেজে চলছিল বিদায়ের সানাই – মৃত্তিকা চাদরে স্যারকে আবৃত করার সময় মনে হলো ইথারে ধ্বনিত হচ্ছিলো ‘আলবিদা, আলবিদা’। আহা! ‘সায়োনারা, সায়োনারা’ হাহাকার যেন প্রাণের গভীরে বেজে মনে করিয়ে দিচ্ছিলো রাবীন্দ্রিক আক্ষেপ – ‘কালের সমুদ্রে এক বিম্বের মত জীবন।’
আলী স্যার আর খালেদা হানুম ম্যাডামের প্রণয়ের সুনাম শুনেছি ঢের। স্যারের ইন্তেকালের মাত্র দশ দিনের মধ্যেই ম্যাডামও তার অনুগামী হলেন। স্বপনতরীর নাইয়া হয়ে স্যার নিয়ে গেলেন ম্যাডামকে। এমন কিংবদন্তীতুল্য যুগলের উদ্দেশ্যেই কি রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘জগতে তারাই যেন আছিল দু’জন’।
সরওয়ার মোরশেদ : প্রফেসর, ইংরেজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।