তৌফিক জহুর
শাড়ির জমিন
তাজমহল রোডে চোখ আটকে গেলো, দুপুরের ঘোমটায়
শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে ফুটে আছে বিনয়ী প্রেম
দূর থেকে দেখলাম, হাত ধরিনি তাঁর
আমি একটা গোলাপ দিবো বলে মনস্থির করলাম
শাড়ি সবুজ বৃক্ষ হয়ে গেলো
বৃক্ষের পাতাগুলো চর্যাপদের যুবতী মলা মাছ যেন
শাড়ির আঁচলে সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ আছড়ে পড়লো
আমি শিহরিত হলাম পাঁচফুট দুই ইঞ্চি আগুনে
সমুদ্র পিপাসায় শাড়ির দিকে তাকাতেই
ডুবে গেলাম চোখের কাজলে।
এই বৃক্ষকে সোবহানবাগে প্রথম দেখি ভেজা রোদে
তারপর ভোরের আকাশে দেখেছি তাঁর সতেজ রূপ
ধীরে ধীরে ফিরোজা রঙে দেখেছি তাঁর ময়ুরী দেহ
আস্থার নাগরদোলায় চেপে ঠোঁটের স্পর্শে সহসা
আবিষ্কার করলাম রহস্যের সৌরভ,
সেদিন থেকে মাটি মাখা গন্ধে জেনেছি
আমার আয়না তুমি
আমার নিঃশ্বাসের পায়রা উড়তে থাকে
বৃষ্টি ভেজা মাঠে
যেখানে দাঁড়িয়ে আছো শাড়ির জমিন।##
প্রার্থনা
আমাদের একটা নদী প্রয়োজন
এমন নদী,যার স্রোত হাড্ডিসার দেহে
ছড়িয়ে দেবে আয়ুর ঝিলিক।
আমাদের একটা বর্ণময় আকাশ প্রয়োজন
এমন আকাশ,যার কার্ণিশ বেয়ে উড়ে যাবে
সাদা বক আর শান্তির কবুতর।
আমাদের একটা শিশিরের মত সতেজ যৌবন প্রয়োজন
যে যৌবন আমাদের টেনে তুলবে
আলোকিত নগরীর রাজপথে
আসুন, আমরা বাতাসের জন্য প্রার্থনা করি
এমন বাতাস,যার দমকা হাওয়ায়
লন্ডভন্ড হয়ে যাবে
বিপরীত স্রোতের ইলশে শরীর।
আমাদের একজন অগ্নিপুরুষ দরকার
যার তেজে ছারখার হবে ইতনা জঞ্জাল।
রুহ
গভীর রাতে ভাবনার আকাশ বড়ো হয়ে যায়
কতো জোসনার আদর ছিটিয়ে তাকিয়ে থাকে চাঁদ
তারাগুলো জ্বলতে থাকে নিজের রূপে।
পশ্চিমের বারান্দায় আমি একটা চেয়ার পেতে বসি
মাথার উপর রহস্যের দরোজা খুলে দেয় আকাশ
ক্লান্তিতে ঝিমোয় রাস্তার নিয়ন বাতিগুলো
আমার চিন্তার নিউরনে ঘুরছে আকাশের পরে আকাশ,
রাতের নীরবতাকে আমার পাঠাগার বলে মনে হয়
অসংখ্য জ্ঞান সারি সারি থরে থরে সাজানো যেন
চাঁদ কি চিরটাকাল জেগে থাকবে আকাশে
তারাগুলোর জ্বালানি শেষ হলে কি হবে,
কুরিয়ার সার্ভিসের মতো সাইকেলে চেপে
ঘুমেরা পৌঁছে যায় সবার চোখের তারায়
ক্লান্তির ডানার নিচে তলিয়ে যায় ঘুমের আত্মা
তখন আত্মারা ঘুরে বেড়ায় অচেনা দেশে
মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে জেগে ওঠার নাম রুহ ।##
ঘোড়সওয়ার
লেদা বাচ্চা থেকে ধীরে ধীরে প্রথম যেদিন
মগজের দরোজা খুলে বারান্দায় দাঁড়ালাম
দেখি,আম্মা তিনটি ঘোড়া উঠোনে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন
আম্মা, তাকিয়ে বললেন, এই যে ঝাঁকড়া চুল
আর রাশভারী কন্ঠের মানুষটি দেখছো, সে তোমার বড়ো
আর ঐ যে, যাঁর হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছো রেলিঙে
সে তোমার ছোট।
আমি তোমাদের তিনজনকে তিনটি ঘোড়া উপহার দিলাম
এ হলো শব্দের ঘোড়া, এবার এসো, বেরিয়ে পড়ো
চাঁনমারী ঘাটের পাশ দিয়ে যে রাস্তা সোজা দক্ষিণে
ঈদগাহ মাঠ পেরিয়ে ফিশারি অফিসের পাশ দিয়ে গেছে
তারও পরে একটা সবুজ জমিন আছে
তোমরা ও পথে যাও
সে পথ সৃষ্টির রহস্যময় আলিঙ্গনের মোহনা
সেই মাঠে শিহরণজাগা হাওয়া খেলা করে
সে মাঠে প্রবেশের আগে
করতোয়ার জলে মুখ ধুয়ে নিও বাবা,
মনে রেখো বহমান স্রোতে ময়লা থাকেনা
শব্দের ঘোড়াকে ইচ্ছেমতো ডানে বামে চালিও
কিন্তু উড়াল দিওনা, শব্দের চাবুক হিসহিস করে ।
তোমাদের শব্দগুলো যেন অহংকারী রাজার মুকুট না হয়
তোমরা সৃষ্টি করো শব্দের পালতোলা বাদাম।
আম্মার কথা মেনে, শব্দের ঘোড়ায় চেপেছি
পথ চলতে চারপাশে হরেক রঙের ঈর্ষার ঘুড়ি দেখি
কতো ঘুড়ি সুতো ছিঁড়ে হয়েছে নিথর
অথচ তারাও একদিন বিকেলের যৌবনে
আকাশ জয় করেছিলো।
যাযাবর জীবন আর শব্দের ঘোড়া হেসে ওঠে
যখন চোখ আটকে যায় ইতিহাসের নীল দিঘিতে
যে দিঘিতে ডুবে গিয়েছিল সংশয়বাদী সারস।
আম্মা বলে দিয়েছেন,
হৃদয় ভাসিয়ে দাও সন্ধ্যার আকাশে, তারা হয়ে জ্বলবে।
হাটবার
শুক্রবার এলেই আমার বেচাকেনার কথা মনে পড়ে
করতোয়া নদীর পাশে পোড়াদহ মেলায় দেখেছি
মানুষ মাথায় করে নিয়ে যায় এবাদতের নীলাকাশ
মুদ্রায় বিনিময়ে চাষী বিকিয়ে দেয় ঐশ্বর্যের কাঁকন ।
লাঙলের কর্ষণে গজে ওঠা ফসল আর ফুলের ঘ্রাণে
মৌ মৌ করতে থাকে হাটের আঙিনা
আমাদের আত্মা মিশে যায় নীল আকাশের স্রোতে
আমরা খুঁজতে থাকি জীবনের সতেজ পায়রা।
এক শুক্রবারে, সূর্য ডুবে যাওয়ার আগেই
হাট থেকে ফিরবো সওদাগর
নিজেদের কষ্টগুলো ভাসিয়ে দিবো
করতোয়ার জলে। চাঁনমারী ঘাটে এসে
যখন দাঁড়াবে লালোমাঝির কালো নৌকা,
তীরে নামার আগেই করতোয়ার জল থেকে
ওজু করাবো আমাদের মনুষ্যত্বের ঘুঘু।
ঢেউ বশ করে নদী পারাপারের কৌশল জেনে নিবো
নৌকার গলুইয়ে বসে থাকা লালো মাঝির চোখ দিয়ে।
সূর্যমুখী
আকাশের দিকে ঘোরলাগা নজরে সূর্যমুখী ফুল
ভালোবাসার আজন্ম বিপ্লবী ব্যঞ্জনা মনে
সকরুণ প্রার্থনায় রহস্যময় চাতক চাহনি দিয়ে
আকাশের শিহরণ জাগা স্পর্শ চায় সূর্যমুখী।
আকাশ উপুড় হয়ে ছিটিয়ে দেয় রোদের বীজ
উত্তপ্ত কামনার জলন্ত তাপে
পুড়ে যায় সূর্যমুখীর তৃষিত ঠোঁট।
অন্তহীন প্রেমের ভাবনায় ফুটে ওঠে হলুদ যৌবন
রোদের আদরে উত্থিত যৌবনে বেড়ে ওঠা শরীর
ঈশ্বরকে স্বাক্ষী রেখে মেলে ধরে পাপড়ির আতুরঘর
নিজেকে পোড়াতে চায় সূর্যের চিতায় ।
তৌফিক জহুর: নব্বই দশকের কবি ও সম্পদাক:উদ্যানাদি লিটল ম্যাগ।