পান্থজন জাহঙ্গীর
খুব আশা করে পার্শ্ববতী হিন্দু পাড়ার মন্টু মিয়া কাছ থেকে গরুটা কিনেছিল। যেদিন হাঁট থেকে গরুটা কিনে বাড়ি ফিরল আমজাদ হোসেন সেদিন হত-দরিদ্র সেগুনতাজের ঘরে কি আনন্দ! সাথে সাথে বদনা থেকে আমপাতার জল দিয়ে গরুর গায়ে সোনা-রূপার পানি ছিটাতে লাগল। পাশ দিয়ে ল্যাঙটা ছেলে মেয়েগুলো মহা আনন্দে গরুটাকে ঘিরে ধরল। ছেলে মেয়েদের গায়ে কাপড় নেই। পেটে ভাত নেই। অথচ এই পরিবারে আজ আরো একটা প্রাণী এসে হাজির হল। সেগুন তাজের চোখের কোণে পানি চিক্ চিক্ করে। এই পানি আম্রপাতার ছিটানো পানি যে নয় তা স্পষ্ট প্রমাণ করে সেগুন তাজের নগ্ন গলাটা। পয়ঁত্রিশ বছরের পুরানো নিজ সন্তানের মতো বুকে ঝুলিয়ে রাখা পুরাতন মডেলের সেই গলার হার। বাইন্না পাড়ার আশীষ বণিকের কাছে সে গহনা বন্ধক রেখে আট হাজার চারশত টাকায় কেনা আজকের অন্ধকার সন্ধ্যার কুপির সামনে বেধে রাখা এই ভূখা, হাড্ডিসার একখানা গাই। সেগুন তাজের ছেলে মেয়েদের সাথে এই হাড্ডিসার, গায়ের কোন তফাত নেই। দুই পাশের পাজরের হাড়গুলো তাই প্রমাণ করে। শুধু একখানা লেজ ব্যতীত আর শিং তো নেই। হঠাৎ সেগুন তাজের ছোট ছেলেটি বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল।
‘বাবা এই গরোডার তো শিং নেই!’
‘হ-বাবা শিং নেই।
‘কেন?’
‘কারণ গরুডা যখন ছোট ছিল তখন দুষ্টু ছেলেরা আদর কইরা এর মাথায় হাত বুলাইছে আর ছোড অবস্থায় এই শিংয়ের গোড়ায় হাত দিলে গরুর শিং ওঠেনা। গরু ঢুঁয়া হয়।’
‘ঢুঁয়া গরু আমার ভাল লাগে না।’
‘কি করব বাপ, শিং অলা গরুর যে অনেক দাম! ঠিক আছে এই গরুর যখন বাচ্চা হবে তখন তাদের শিং গজাবে। তখন আমাদের শিংঅলা গরু হবে। মন খারাপ করিসনে। যাও কাল সকালে তাজা তাজা ঘাস কেটে নিয়ে আইসো।’
উত্তেজনায় সারারাত ঘুম হল না সেগুন তাজের। কিছুক্ষণ পর পর বিছানা থেকে কুপিটা জালিয়ে বের হয় আর খোলা আকাশের নিচে বাধা গরুটার দিকে একটু নজর দেয়। দেখে গরুটা জাবর কাটছে। মাঝে মাঝে পেটরা থেকে তার সেই গহনাটা বের করে হাতের তালুতে নিয়ে যে উচ্ছ¡াস উদ্দীপনা নিয়ে ছেলে-মেয়েদের দেখাতো ঠিক সেই রকম উচ্ছ্বাস তার মনে।
সকালে আমজাদহোসেন যাওয়ার সময় সেগুন তাজকে জোরে জোরে ডাক দেয়।
‘ শুনছ?’, ওগো শুনছনি? ছেলে-মেয়ে সবাইকে বলবা খাঁচা খাঁচি ঘাস নিয়ে আইস্তে নাইলে ভাত দিবা না কইলাম।’
ভাত মানে আলু। সেগুনতাজের সংসারে দু’মাস ধরে আলু চলছে। ভাতের বিকল্প হিসেবে। মাঝে মধ্যে যেদিন ভাল রোজগার হয় সেদিন দিনে ভাত আর রাত্রে আলু চলে। ভাত যেদিন রান্নআ হয় সেদিন আসমান থেকে ঈদের চাঁদ তাদের ঘরে নেমে আসে।
প্রতিদিন রাতে আমজাদ হোসেন ঘরে ফিরে আগে গোয়াল ঘরে ঢুকে। তারপর গরুর পিঠে হাত বুলায়।গরুটিও একনজর মনিবের দিকে তাকায় তারপর ঘাস চিবোতে থাকে। কখনো কখনো বউ বাচ্চাদের বক-ঝকা করতে করতে ঘরে ঢুকে।‘কি খাওয়াইচ, গরুর পেট তো ভরে নাই। পেট খড়ির উপরদি উঠতে অইব। গরুর গোহাল অপরিস্কার ইত্যাদি ইত্যাদি।’
সেগুনতাজ শব্দ করে কিছু বলে না। যা বলে তা মনে মনেই বলে। ‘এখন কি তোমার বাপের দিন্না সেই রাজত্তি আছে? দশ বিঘা-বিশ বিঘা জমি জমা আছে? ধান- চাইল-তুষ গোলা ভরা আছে?’ সেগুনতাজ ভাল করেই জানে সেই সময় আমজাদ হোসেন ইয়া বড় বড় বলদ পালছে। ক্ষেত খামার গড়ছে সেই যৌথ খামারের তুলনা এখন করলেই তো হবে না। গরুর জন্য আমজাদ হোসেনের এতই দরদ যে পোলাপাইন খাইছে কিনা সেটা দেখবে না কিন্তু গরুর পেট ভরা থাকা চাই। গরু খেয়ে আরো দু’খাচি ঘাস জমা থাকতে হবে তাহলে সেদিন তার ঘুম হবে। বাবার বকা-ঝকা, মায়ের কড়া শাসনে শেষ পর্যন্ত ছেলে-মেয়েরা জন্তু পালনে পারদর্শিতা অর্জন করল। ঘাস রাজ্যের বিশালতা ধীরে ধীরে তাদের হাতছানি দিয়ে ডাকল। পাহাড়ের না না প্রকার তৃণ, গুল্ম, লতা নদীর চরের হেলানো ঘাস সবুজ মাঠের ছড়াইল্লা ঘাস জমির আইলে নরম পুষি, দুধ ঘাস,প্রতিবেশিদের ফেলে দেয়া আম কাঠালের সুস্বাদু বাকল ইত্যাদির প্রাচুর্যে গরুর উচ্চতা ও চওড়া বৃদ্ধি পেল। গরুর গায়ের
ধুসর মলিন কেশরাজী ঝরে নতুন লাল কেশরাজি গজাল। ঘোলা চোখ গাঢ় কালো হল। গলায় ঝুলানো চামড়া আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেল। পাজরের হাড়গুলো ভেতরে ঢুকে গেল। লেজের গোছার কালো কেশের গুচ্ছের ভেতর কতিপয় সোনালী কেশদাম চিক্ চিক্ করছে। হৃষ্ট-পুষ্ট যেন একটি চেম্রি গাই। কিন্তু সমস্যা একটাই। গরুটা আজ পর্যন্ত গাভীন হল না। পাড়ার লোক বলে এটা বাজা হয়ে গেছে। এটা বাজা গাই। কথাটা শুনে সেগুনতাজের বুকটা যেন হু হু করে উঠল। ছেলে-মেয়েদের গা ভাঙ্গা পরিশ্রম ও একটা গো-বাচ্চার আহলাদ, গরুর প্রতি স্বামীর অকৃত্রিম ভালবাসা ও অপরিসীম যত্ন ইত্যাদিকে সে বৃথা যেতে দেবে না। তাই পরদিন রশিদ মোল্লা থেকে পানিপড়া একটা তুরের তাবিজ নিয়ে আসলো সে। পানিপড়া দিয়ে গরুটাকে গোসল করালো আর তাবিজটা হাঁসুলি দিয়ে গলায় বেঁধে দিল। এরপর পরম মমতায় গরুর গলায় নিজের গলায় লাগিয়ে সেগুনতাজ ফুঁফাতে লাগল আর অনুভব করতে লাগল যেন কোন রজঃশীলা রমণীর বুকের উষ্ণ আলিঙ্গন। অনেকক্ষণ পর গরুটা তার মাথায় একটা ফোস করে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ঘাড় ফিরিয়ে নিল।
না ঝাড়-ফুঁক পানি পড়া-তাবিজ কোন কিছুতেই কাজ হয়নি। বেশ দিন পর বুধবারের গরুর হাটে আমজাদ হোসেন তার, গরুটাকে বিক্রির জন্য তোলে। প্রথম ধাক্কাতেই মোটা-তাজা দেখে কাষ্টমার জেঁকে ধরল কিন্তু কিছু দূর থেকে ভুইল্লা কসাই ভিড় ঠেলে ঢুকে গরুর রানে দুইটা ঠাস ঠাস চাপড় দিয়ে বলে, ‘আরে এটা তো বাজা গাই। কও দেহি কত লইবা। ‘ভুইল্ল্যার একটা কথাতেই সবাই সটকে পড়ল। আর চল্লিশ হাজার টাকা থেকে গরুর দাম সাথে সাথে বাইশ হাজারে নেমে আসে। আমজাদ হোসেনের মাথা থেকে ঘাম ঝরতে লাগল। তার ইচ্ছে হচ্ছে ভুইল্ল্যার চান্দিতে গরুর খুঁটি দিয়ে একটা জোরসে বারি দিতে। তার বেফাঁস মন্তব্য চরম অপমানের আর গাক তাড়ানোর পুরানো কৌশল। ভুল্ল্যা আমজাদ হোসেনের অবস্থা বুঝতে পেরে বলল, ‘ঠিক আছে দিলেও তোমার খুশি। না দিলেও তোমার খুশি।’
রাতে গরু নিয়ে ঘরে ফিরলেন আমজাদ হোসেন। সেগুনতাজ হাসি মুখে জিজ্ঞেস করে কত মুলাইচে? আমজাদ হোসেন বললেন, ‘প্রথমে চল্লিশ হাঁকছে পরে হালারপুত ভুল্ল্যা তা বাইশে নামিয়ে দিচে। থাক, ঐ ফকিন্নির পুত কসাইরে গরু বিক্রি করুম না। সামনে কোরবানীর হাঁটে বেঁচলে এই বাজা গরুর চড়া দাম পাওয়া যাইব।
যেই কথা সেই কাজ। অবশেষে পাশের বাড়ির সাহেব মিয়ার কাছে চুয়ান্ন হাজার টাকায় বাজা গাইটা বিক্রি করে দিল আমজাদ হোসেন। তবে শর্ত একটাই কুরবানীর আগের রাত পর্যন্ত যথাযথভাবে গরুর আদর যত্ন চালিয়ে নিতে হবে। তাতে সেগুনতাজ আরো খুশি। কারণ, এমনিতেই গরুটির সাথে তার একটা আত্মিক সর্ম্পক গড়ে উঠেছে। তারপর প্রিয় গরুর জন্য ছেলে-মেয়ে কান্না-কাটি তো আছেই।
‘শুনছ’, ওগো শুনছ?’
‘উফ্! কি বইলবা বলো তো।’
‘গরুকে দুইটা রশি দিয়ে টাইট করাই বাঁধিছ তো?’ ‘না। একটা দিয়ে বাঁধছি।’
‘ তাতে কি অইচে?’
‘কি অইচে মানে? কোরবানীর আগের রাতে গরুরা অনেক স্বপ্ন দেহে। মাঝে মধ্যে রশি ছিড়া পালাই যায়।’
‘স্বপ্ন দেহে অ্যাঁ, স্বপ্ন দেহে? কোন বিজ্ঞানী কইচে আপনারে? পালাইয়া যাইবো না। আমার গরুর ওপর আমার বিশ্বাস আছে। আমার গরু কোনদিনও পালাইবো না। এমন কি গলায় ছুরি দেওয়ার সময়ও আমার দিকে চাইয়্যা থাইকব। তুমি ঘুমাও।’
এবার মাঝরাতে হঠাৎ সেগুনতাজ বেগম একটা চিৎকার দিয়ে উঠল।
‘দেখ দেখ, আরে দেখোনা!’
` কি দেখাইতেছ অন্ধকারে?’
সেগুনতাজ স্বামীর হাতটা টেনে তার তল পেটে রেখে বলে, দেখ আমাগোর গরুর বাছুর অইচে।’ আমজাদ হোসেন বুঝতে পারে যে তার স্ত্রী স্বপ্ন দেখছে। সে তার তলপেটে হাত বুলিয়ে বলে, ‘ঘুমাও।’
সকালে ওঠে সেগুনতাজ গরুকে গোসল দেয়। তারপর সারা গায়ে সরিষার তের মালিস করে। এরপর কিছু শুকনো খড়- বিচালি দেয়। তারপর গায়ে হাত বুলায়। কিন্তু গরু খড় খায় না। গরুটি সেগুনতাজের দিকে চেয়ে থাকে। তার চোখ দিয়ে জলের ধারা ছুটতে থাকে। ঈদের নামাযের পর যখন গলায় ছুরি দেওয়ার জন্য গরু নিয়ে যায় তখন পিছে পিছে সেগুনতাজও ছুটতে থাকে। আর আঁচল দিয়ে চোখ মুছে।
সোবান মিয়া যখন গরুর গলায় ছুরি চালাচ্ছিল তখন সেগুনতাজের ছেলে মেয়েদের কান্নায় আকাশ ভারি হয়ে উঠল। তাদের কান্নায় আরো কিছু ছেলে মেয়ে দৌঁড়ে আসলো। কিছুক্ষণ পর সোবান মিয়া লম্বা ছুরির গায়ে শুকনো পাতা দিয়ে রক্তের দাগ মুছতে মুছতে বলতে লাগল, ‘কান্দ ক্যান এ্যাঁ। গরুর টাকা লইছো না? গরু কি হারা জীবন পাইলবা? ভাত খাইতে অইবো না? কাপড় পিন্দন পইরবনা? কথাগুলো অদূরে দাঁড়ানো সেগুনতাজের কানে গেলেও তার দৃষ্টি কিন্তু অন্যদিকে। চোখের জলে তার চিবুক ভিজে যায়। ঘন্টাখানিক পর সাহেব মিয়া ‘সোবান ’বলে চিৎকার দিয়ে ওঠল। সোবান দৌঁড়ে গিয়ে দেখে সাহেব মিয়ার হাতে একটি জন্তুকার মাংস পিন্ড। সাহেব মিয়া কাঁচু মাচু করে বলে, ‘যাও তাড়াতাড়ি মাটির মটকা তাতে লুকিয়ে আসো।’ তারপর সাহেব মিয়া জিহবায় কামড় দিয়ে অসমানের দিকে চেয়ে থাকে। যখনই সোবান মিয়া মাংস পিন্ডটি সরানোর জন্য দ্রুত পায়ে এগুতো লাগল ঠিক তখনই সেগুনতাজের বুকের বামপাশে একটা মোচড় দিয়ে উঠল। সে “আমার স্বপ্ন সত্যি অইছেরে” বলে হু হু কেঁদে উঠে সোবানের দিকে জোরে একটা দৌঁড় দিল। আর তার পেছনে যোগ হল পাড়ার কিছু উৎসাহী ছেলে-ছোকরার দল।
পান্থ জাহাঙ্গীর: কথাশিল্পী