সাবিনা পারভীন লীনা
টাইগারপাস এর মোড়ে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ। আশ্বিনের বিকেলে জিলাপি পাহাড় থেকে একটা হিম হিম গন্ধ ভেসে আসছে। পরপর দুটো বাস হাঁক ছেড়ে সামনে দিয়ে চলে গেলেও উঠতে পারেনি।
–কি অবস্থা তোর, এই সন্ধ্যাকালে কোন দিকে যাবি?
পরিচিত স্বরে উপমা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো, আজাদ হাসি হাসি মুখ করে তার ডান পাশে দাঁড়িয়ে।
–আ রে, তুই রাজধানী ছেড়ে এই গ্রামে, এই রাস্তায়! কখন এসেছিস, একটা কল করতে কি সমস্যা? আমার নাম্বার কি হারিয়ে ফেলেছিস?” বলতে বলতে পেছনের পেট্রোল পাম্পের কাছে এসে দাঁড়ালো আজাদকে নিয়ে।
–প্রত্যয়কে মনে আছে, ফিলোসফির? সোহরাওয়ার্দী হলে আমার রুমমেট ছিল। একসাথে এতোগুলো বছর কাটালাম,আর এখন…! তার অবস্থা ভালো না,কেমোতেও কাজ হয়নি। গৌতমকে সাথে নিয়ে চলে এলাম হঠাৎ করে।
–বেশি পরিকল্পনা করলে দেখা যায়, পরি উড়ে গেছে কল্পনা থেকে গেছে। হা হা হা, তোর কথাই তোকে ফেরত দিলাম।
–এইসব খুচরো কথাও মনে রেখেছিস দেখছি। তোকে দুপুরে কল করেছিলাম, মোবাইল বন্ধ ছিল।নবললি নাতো, কই চললি এখন?
–যাচ্ছিলাম আমার ফুফুর বাসায়, কিন্তু এখন আর যাবোনা। কাজ না থাকলে চল রিক্সা নিয়ে ঘুরাঘুরি করি কিছুক্ষণ।
আমবাগান এর রাস্তা ধরে রিক্সা এগিয়ে যাচ্ছে। গতরাতে হঠাৎ বেশ বৃষ্টি হলো। রাস্তার ডান পাশের সারি সারি সবুজ যেন অনেকদিন পর প্রাণখুলে হাসছে।
–এই জায়গাটা এখনো আগের মতোই আছে দেখছি।পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে সেই বস্তিগুলোও। মুবিন ভাইয়ের বাসাটা এইদিকেই ছিল, অনেক এসেছি একসময়। মিটিং, আড্ডা লেগেই থাকতো।
–রেলের জায়গা বলে এখনো খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। তোকে একটা নতুন জিনিস দেখাবো আজ। এক অর্থে নতুন বলা যায়না একে, প্রায় আট বছর হয়ে গেল।
উপমা রিক্সাওয়ালাকে তাড়া দিয়ে বললো–অন্ধকার হয়ে গেলে কিছু দেখতে পাবোনা, ভাই। একটু জোরে চালান।
পেছন ফিরে ফিক্ করে হেসে দ্রুত চালিয়ে পাহাড়তলী রেলওয়ে স্কুলের সামনে এসে থামালো।
আজাদ নেমেই পকেটে হাত দিয়ে মোবাইল বের করে ছবি তুলতে লাগলো।
–আন্দোলন তাহলে বৃথা যায়নি, কি বলিস? আজ তুই না নিয়ে এলে হয়তো কাজটা দেখাই হতোনা। নানা ঝামেলায় থাকি, বউ বাচ্চা নিয়ে বেড়াতে আসা হয়না।মেয়েদের বলেছি প্রীতিলতার কথা, চট্টগ্রামের কথা।
রিক্সাটা ছাড়েনি তারা, উপমা সিটে বসেই বললো–শুধু আন্দোলন আর দাবী দাওয়া পেশ করলেই হয়না।বাস্তবায়নেরর জন্য যোগ্য মানুষকে ক্ষমতার কাছাকাছি যেতে হয়। সেই সুযোগ পেয়েও আমরা মাঝেমধ্যে হারিয়ে ফেলি।
উপমাকে থামিয়ে দিয়ে হাসতে হাসতে বললো- বল্ যে, যারা কাছে যায় তারা বিড়াল হয়ে যায়। কেউ কেউ আবার পকেট ভারি করতে ব্যস্ত হয়ে যায়।
অন্ধকার হয়ে গেছে, চারপাশে বাল্বের আলো।সিগারেট ঠোঁটে রেখেই উপমার দিকে তাকালো একবার।
–এতোক্ষন বাইরে আছিস, বাসায় সমস্যা হবেনা? কাল দুপুরে বাস আমাদের, চাইলে সকালে দেখা হতে পারে আরেকবার।
–সমস্যা লেগেই থাকে সংসারে, এর থেকে মুক্তি নেই।তাই মাঝেমাঝে একটু আধটু অনিয়ম হলে কী এমন ক্ষতি আর! আমি ম্যানেজ করে নিব, এতো ভাবতে হবে না। চল্ কিছু খেয়ে নিই, আমার অনেক ক্ষিদে পেয়েছে। দামপাড়া চলেন, ভাই।
ওয়াসা অতিক্রম করার সময় ডানে বামে তাকিয়ে আজাদ জানতে চাইলো–তোর স্কুলটা এই এলাকায় বলেছিলি না? আচ্ছা, ঐ ছাত্রের কি খবর, প্রাইমারি শেষ করতে পেরেছিল সে? পুলিশ কি আর ঝামেলা করেছিল?
–কোন ছাত্র, সবারইতো একটা করে গল্প আছে? ওহ্ আচ্ছা, তোকে মনে হয় ইয়াসিনের কথা বলেছিলাম।হ্যাঁ,পরীক্ষা সে দিয়েছিল অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে।ভোগান্তি আমাদেরও কম হয়নি। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় কি জানিস? পুলিশের চেয়েও বেশি ঝামেলা করেছে এলাকার বড়ভাইরা। এক গ্রুপকে শান্ত করলে আরেক গ্রুপ এসে নতুন সমস্যা তৈরি করে। একটা শিশুকে নিয়ে কী কাণ্ড! খুব বাজে অবস্থা, আ-র বলিসনা। আরো ঘটনা আছে, পরে বলছি সব।
গিটারের সুর ভেসে আসছে। হালকা আলোয় একদল ছেলেমেয়ে বসে আছে ফুটপাথে। গিটারবাদকের আঙুলগুলো চিকন তারকে আঘাত করছে, লম্বাটে মুখের দু’পাশে কাঁধ পর্যন্ত চুল নেমে এসেছে। ভাঙা গালে সরু নাক, আধপাকা গোঁফ উপরের ঠোঁট ঢেকে দিয়েছে। চোখ দুটো মুদে আকাশের দিকে মুখ তুলে গাইছে–” তুমি এবার আমায় লহো হে নাথ,লহো”।
আজাদ জটলার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে দেয়ালের সাইনবোর্ডের দিকে তাকিয়ে বললো– এটা আবার টিএমটি কখন হলো, শাহ আমানত কি আধুনিক নাম ধারণ করলো? হায়রে, পরোটা আর হালিম খেতে সেই পনেরো মাইল জার্নি করে আসতাম এখানে।বেশিরভাগ সময় রুবিনা আপাই খাওয়াতো। এই শহরের অলিগলি একদিন কতো চেনা ছিল। সব পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে, আমরাও বুড়ো হয়ে যাচ্ছি।
নিচের তলায় ভীড় দেখে তারা দ্বিতীয় তলায় এসে বসলো, খাবার অর্ডার করলো।
স্কুলে পড়ানোর চেয়ে এখানে পড়তে আসা ছেলেমেয়েদের জীবন, তাদের প্রতিদিনের বেঁচে থাকার লড়াই অনেকবেশি ভাবায় উপমাকে।সুবিধাজনক অবস্থানে দাঁড়িয়ে অনেককিছু ভাবা যায়।বাস্তবতা বড়ো কঠিন, কল্পনার চেয়েও নির্মম। তাই মানুষের সামান্য কিছু উপকার করতে পারলে স্বস্তি পায় কিছুটা। দিন বদলের স্বপ্ন থেকে দূরে সরে এলেও, ছোট ছোট কাজে সান্ত্বনা খু্ঁজে নেয় এখন।
–দেখ্, আমার চাকরিটা অন্য চাকরির তুলনায় খুব ছোট। কিন্তু আমাদের এই সমাজটাকে তলা থেকে দেখার একটা সুযোগ পেয়ে গেছি আমি।
এক একটা এলাকায় এখন ‘ভাই’দের রাজত্ব, যতো ভাই ততো গ্রুপ। হালুয়া রুটির ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে মারামারি, খুনখারাবি তো লেগেই আছে। আমাদের স্কুলের এক প্রাক্তন ছাত্র খুন হলো, আর ইয়াসিন ছেলেটা মাঝখান থেকে ফেঁসে গেল। বাচ্চা একটা ছেলে, অতো কিছু বুঝেনি। খুনী গ্রুপের ছেলেদের সাথে কথা বলায়, তার নামটা কেউ পুলিশকে বলেছে।আর তাতেই ইয়াসিনের লেখাপড়ার বারোটা বেজে গেছে।
আজাদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উপমার মুখের দিকে তাকালো –ছেলেটা এখন কি করে, ওর বাবা- মা কোথায়? যোগাযোগ আছে তোর সাথে?
— নাহ্, শুনেছি ট্রাক ডাইভারের হেল্পারের কাজ করে।সে নানীর কাছে থাকতো। ওর বাবা আবার বিয়ে করে চলে যাওয়ার পর মা সৌদিআরবে চাকরি নিয়ে চলে গিয়েছিল। টাকাপয়সা মাঝেমাঝে পাঠাতো, ফোন করে ছেলে আর মায়ের সাথে কথা বলতো।
–ওর মা সৌদিআরব থেকে আর আসেনি?
–পুলিশের খাতায় নাম উঠার পর ইয়াসিন স্কুলে আসা বন্ধ করে দিয়েছিল। তখন ওর নানীর সাথে আমার কথা হয়েছিল। এক হোটেলে মশলা পেষার কাজ করতো, কাজ শেষে বাড়ি যাওয়ার সময় দেখা করতে এসেছিল। আমি ছিলাম ক্লাশরুমে, অফিসরুমে অপেক্ষা না করে তিন তলায় যখন এলো, তখন রীতিমতো হাঁপাচ্ছিল। পেঁয়াজ রসুনের গন্ধ তার গায়ে, ডান চোখের মণি ঘোলাটে, ছানি পড়া।
ইয়াসিনের মায়ের কথা সেদিনই জানতে পারি হনুফা বিবির মুখে।
–জুব্বাওয়ালা মানুষগুলানরে দেইকতে কতো বালা মনে অয়। নবীর দেশের মানুষ তারা, বাইবতাম কী ফবিত্র তারা। এইগুলান মানুষ নঅ আফা, এক উগ্গা জানোয়ার। মাইয়া আমারে কাইন্দা কাইন্দা সব কইছে। তাগো অইত্যাছার আর সহ্য কইরতে না ফাইরা কইছে। হেরফর আর কোন ফোন আইয়ে ন। মা-রে, অ মা,কই হারাইয়া গেলি তুই…। তোরে কি আর দেকমুনা,মা।
–আমার মুখ থেকে আর কথা বের হয়নি সেদিন। এই ধরণের কতো নিউজ পত্রিকায় পড়ি আমরা, কতো আর ভাবি, কতোটাই বা মনে রাখি।
গলাটা ধরে এলো উপমার, চুপচাপ চায়ের কাপে চুমুক দিল। আজাদ বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে, বৈদ্যুতিক তারের পিলার আর গাছের সাথে বাঁধা আছে একটা বড় ব্যানার। ব্যানারে জ্বলজ্বল করছে বড় ছোট মিলিয়ে পাঁচটা মাথা।
সাবিনা পারভীন লীনা:কবি ও কথাশিল্পী।