নাসির উদ্দিন আহমদ

ফিরোজ শাহ কোটলা। নামটি ছোটবেলায় ইতিহাসে পড়েছিলাম। দিল্লীর ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থানগুলোর নাম বললে প্রথম কাতারে এসে যায় কোটলাটির নাম। শনিবার, AIIMS -এ অর্ধবেলার অফিস। দুপুরের মাঝেই Young onset diabetes সব রোগীদের দেখে পুরো বিকেল ফ্রি। কি করা যায় ভাবছি—তখনই মাথায় এলো ফিরোজ শাহ কোটলার কথা। কিছু দিন আগেই এখানে স্টেডিয়ামে ভারত বাংলাদেশ প্রথম টি-২০ খেলা দেখতে এসেছিলাম। সেদিনের পরিকল্পনায় ও ছিলো খেলা দেখার আগে ঘুরে দেখব কোটলা। তা আর সেদিন হয়ে উঠেনি। আজ মওকা মিললো। আর চলে এলাম একাকীই।

১৩৫৪ সালে ফিরোজ শাহ তুঘলক—তদানীন্তন দিল্লীর সুলতান এই দূর্গটি নির্মাণ করেন। ভিতরে ছিলো রাজপ্রাসাদ। বিশাল উদ্যান, জুমা মসজিদ, অশোক স্তম্ভ, বিশাল এক কূপ। ছিলো সুলতানের দরবার।এখন এখানে নাকি ঘুরে বেড়ায় অনেক জিন—বিশেষত বৃহস্পতিবার রাতে জিনের আসর বসে এখানে।

একদিনের সেই ঝলমলে রাজপ্রাসাদ আজ ভগ্ন ইট-পাথরের জীর্ণ স্তূপ। সুলতানের বালাখানার অস্তিত্বের জন্য কিছু কাঠামো এখনো টিকে আছে। আড়াই শত রূপী দিয়ে টিকেট কেটে তবেই ভিতরে প্রবেশ করা যায়। তোরণ দিয়ে প্রবেশ করলেই লাল ইট-পাথর আপনাকে স্বাগত জানাবে। কিছু মানুষজন এসেছে। ছবি তুলছে। বিশাল এলাকা।চারিদিকে উঁচু পাঁচিল। ঘুরে ফিরে ইতিহাস ছুঁয়ে দেখার মতো একটি জায়গা।

পূর্ব প্রান্তরে মসজিদ। এখনো দাঁড়িয়ে আছে বহু শতাব্দীর ইতিহাস ধারণ করে। সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক ১৩৫৪ সালে এই ঐতিহাসিক মসজিদ নির্মাণ করেন। কথিত আছে তৈমুর লং এখানে এক ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেছিলেন। এর নির্মাণ শৈলী দেখে এত বেশী মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তিনি দিল্লী থেকেই সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন মসজিদের কারিগরদের—ঠিক একই আদলে মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন সমরকন্দে। মসজিদটি এখনো আবাদ হচ্ছে। তিন ওয়াক্ত নামাজ হয়—জোহর, আসর এবং মাগরিব।ফযর আর এশার সময় বন্ধ থাকে মসজিদ। জুমার নামাজও হয় এখানে। মসজিদের ইমাম আছে। তাঁর সাথে কিছুক্ষণ আলাপ হলো—আছর নামাজের পর। কি মনে করে এক-দু কথা শেষে বললাম—আপনি কি সরকারী ইমাম। আমার কথা শুনে তার ক্ষেদ ঝরে পড়লো। সরকার তো মসজিদ বন্ধ করে দিতে চায়—ইমাম দিবে আবার? আমি বললাম—কি বলে তারা। তারা বলে যে এটা নামাজের জন্য নয়—দেখার জন্য। আমি আর কথা বাড়ালাম না। মসজিদটি বেশ বড়। পশ্চিমের বেশ উঁচু দেয়াল এখনো অক্ষত রয়েছে। উত্তর-দক্ষিণের দেয়াল ধ্বংস প্রায়। পূব দিক পুরোটাই ফাঁকা।ছাদের কোন অস্তিত্ব নেই। মেঝে বড় বড় পাথর দিয়ে তৈরী। বিভিন্ন আকৃতির নানা রঙের মসৃণ পাথর জুড়ে তৈরী করা হয়েছে মসজিদটি। প্রায় সাতশত বছরের পুরনো এই বিরাট ঐতিহাসিক মসজিদটিতে নামাজ পড়ে বিকেলটা ভালোই কাটলো।মসজিদের নিচে অনেকগুলো কামরা। একই আদলে গড়া কামরাগুলোর সামনে বিরাট বারান্দা।

মসজিদের উত্তর পাশেই অশোক স্তম্ভ। তিন তলা পাথরের পিরামিড আকৃতির ভিত্তি বানানো হয়েছিলো এই বিশাল স্তম্ভকে দাঁড় করিয়ে রাখার জন্য। রাজা অশোক খৃষ্টপূর্ব ২৭৩-২৩৬ সালে নির্মাণ করেছিলেন অনেকগুলো স্তম্ভ। ভয়াল কলিঙ্গ যুদ্ধের অনুশোচনায় তিনি বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহন করেন। এই স্তম্ভে তিনি খোদাই করেন ধর্মীয় উপদেশ বাণী। কিন্ত এই ভাষার পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি বহুকাল। ১৮৩৭ সালে জেমস প্রিন্সেপ নামক এক ইংরেজ প্রত্নতাত্ত্বিক এর পাঠলিপি উদ্ধার করেন।সেই আম্বালা থেকে তখনকার দিনে ৪২ চাকার যানে করে দুইশত মানুষ সুলতানের নিজস্ব তত্ত্বাবধানে নিয়ে আসে এই স্তম্ভ।

এখানে তিন তলায় সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে নজরে আসবে খোপে খোপে অসংখ্য মোমবাতি আর ভষ্মিভূত আগর বাতি। এখানে শুনা যায় জিনের আসর বসে প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে।মানুষ এখানে এসে চিঠি লিখে রেখে যায় জিনের উদ্দেশ্যে। জিনেরা চিঠিতে লিখা মানুষের এসব মনোবাসনা নাকি পূর্ণ করে দেয়। গোলাপ, রজনীগন্ধা আরো নানা ফুল ছড়ানো রয়েছে আলো-আঁধারির খোপে খোপে। নিচে মাটির ছোট পাত্রে তেল। সলতের আগুন জ্বলছে সেখানে।জিনের জন্য বাতাসা, খৈ পড়ে আছে মেঝেতে।দেয়ালে সেঁটে দেয়া আছে চিঠি।হিন্দী পড়তে পারি না বলে চিঠি খুলে দেখা হলো না।এসব লোক-বিশ্বাসের প্রতি আমার আস্থাও নেই। আর বাংলায় লেখা চিঠি জিনেরা পড়তে পারবে না বলেই আমার ধারণা। সে কারণে আমি চিঠি লিখা থেকে বিরত থাকলাম। শুনেছিলাম দিল্লী জিনের শহর তা আজ সচক্ষে দেখে গেলাম—অবশ্য জিন দেখার জন্য নাকি রাতের বেলায় আসতে হবে। তবে জিনের এই জায়গাটি ছেড়ে যখন প্রকৃতির ডাকে পাশে গণ শৌচাগারের দিকে যাচ্ছি তখন কেমন যেন গা ছমছম করছিলো। মানুষজন নেই এপাশে। বড় বড় বট, মান্দার আর নিম গাছ। টয়লেটের ভিতরে অন্ধকার। মোবাইল-টর্চের সাহায্য নিয়ে ভিতরে ঢুকতেই কাকতালীয় ভাবে খট্টাস এক শব্দ হলো। আমি বাইরে এসে দেখলাম কিচ্ছু নেই। তবে কি দিনের বেলায়ও এখানে জিন আসে? ফেরার সময় দেখলাম প্রবেশ পথের ত্রিশ গজের ভিতরেই এক দেয়ালের গায়ে কতগুলো চিঠি—প্রবেশের সময় তা আমার নজরেই আসেনি। বুঝলাম এখানকার পুরো এলাকাটিই জিন বিশ্বাসের সাথে জড়িত। ভাগ্যিস আগে জানতাম না—নইতো একা একা এই পড়ন্ত বিকেলে নির্জন যে সব ভগ্ন-স্তূপের কোনায় কোনায় ঘুরে দেখেছি নিশ্চিত গা ছমছম করে উঠতো তাহলে।

অশোক স্তম্ভের পশ্চিম-উত্তর প্রান্তে একটি বিশাল কূপ। এটাকে বলা হয় বাওলি। কয়েক তলা বিশিষ্ট কূপ। এখন দর্শনার্থীদের জন্য এটি উন্মুক্ত নয়—চারিদিকে ঘেরাও করে রাখা। কূপের চারপাশ দিয়ে হাঁটলাম আর ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে দেখে নিলাম একদিনের হেরেমখানার রাজকন্যা আর দুহিতাদের হিম-শীতল পরশ ছড়ানো কূপটি। তীব্র গরমের সময় রাজ-পরিবারের লোকজন স্নান করার জন্য এখানে আসতো। এই কূপের সাথে যমুনা নদীর সংযোগ করা হয়েছিলো নালার মাধ্যমে। এখনো এই কূপটির পানি ব্যবহার করা হয় ভিতরের বাগানের জন্য।

এখানে বড় বড় তেঁতুল, বট, নীম আর অর্জুন গাছ। টিয়ে পাখির ভিড়। আছে শালিক, ঘুঘু, কাক, ঈগল। আছে কাঠবিড়ালী। পাখিগুলো একান্ত পরিচিত। গাছগুলোও পরিচিত—পরিচিত ইতিহাস। শুধু এখানে আমিই আগন্তুক—অপরিচিত। তাই সন্ধ্যা নামার আগেই প্রত্যাবর্তন করলাম নিজের আলয়ে।
৩০.১১.১৯/ দিল্লী।

নাসির উদ্দিন আহমদ: কবি ও প্রাবন্ধিক। প্রকাশিত গ্রন্থ ৪টি।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন