আবদুল কাইয়ুম মাসুদ
সাইফুল মধ্যবিত্ত পরিবারেরসন্তান। সে এবার দাখিল পাস করেছে। গার্ডিয়ানরা তার ভর্তি নিয়ে খুব চিন্তিত। তার রেজাল্ট খুব একটা ভালো হয়নি। সরকারি পলিটাকনিক ই্নস্টিটিউটে ভর্তির চেষ্টা করেওসফল হতে পারেনি। চট্টগ্রামে প্রথম বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের যাত্রা শুরুহয়েছে। একটি সুযোগ তৈরি হলো। তাদের সাথে আমার পারিবারিক সম্পর্ক। সে হিসেবে আমাকেও টুকটাক ভাবতে হয়েছে, তার ভর্তি নিয়ে। সবাই চিন্তা-ভাবনা করে তাকে প্রাইভেট টেকনিক্যাল কলেজে কম্পিউটার সায়েন্স ডিপ্লোমায় ভর্তি করা হয়েছে।
দুই হাজার সালে খুব কম মানুষের কাছে কম্পিউটার ছিলো। মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে মেয়েরাএকটা কম্পিউটার স্বপ্নে লালন করতো। কম্পিউটার ডিপ্লোমায় ভর্তি হয়েছে, বাসায়কম্পিউটার থাকবেনা তা কেমনে হয়? ভর্তির সাথে সাথে তাকে একটা কম্পিউটারও কিনে দেয়াহয়েছে। তার কৌতূহল এর ভেতরে কি আছে তা চেখে দেখা। যেই চিন্তা সেই কাজ সিস্টেমইউনিট খুলে ভেতরে্র সব দেখলো। এতেও তার তৃপ্তি মিটেনি। সব ডিভাইস খুলে খুলে দেখতেলাগলো। ফলাফল, এক সপ্তাহের মাথায় কম্পিটারের মাদারবোর্ড নষ্ট।
ওয়ারেন্টি ক্লেইমকরলো এবং নতুন মাদারবোর্ড রিপ্লেস পেলো। তবে কম্পিউটার এসেম্বলিং শিখা হয়ে গেছে;ক্লাস শুরুর আগেই।ওখান থেকে ডিপ্লোমা কোর্সশেষ করে সে উচ্চতর প্রফেশনাল ডিগ্রি নিয়েছে। এর মাঝে কয়েকটা বড় বড় কোম্পানির আইটিপেশায় চাকরি করে এখন একটা কোম্পানির আইটি ম্যানাজার। বেতন-ভাতা প্রায় দুই লাখ টাকা।তার গার্ডিয়ানদের সেদিনের শংকা আর আজকের বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। সাইফুল আমার থেকে ৪/৫ বছরেরজুনিয়র। সে যখন ডিপ্লোমায় ভর্তি হচ্ছিলো তখন আমি ভার্সিটি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র।খুব ফুরফুরে ভাব। জেনারাল শিক্ষায় কেমন জানি একটা মোহ আছে। আমরা এখনো সেই মোহ কেটেউঠতে পারিনি।
অপরদিকে কারিগরির চিত্র ভিন্ন। সহজে ভর্তি হতে চায় না শিক্ষার্থীরা;এখনো। সে যাই হোক, দীর্ঘকাল পড়ালেখা করে মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করে আমি কলেজে শিক্ষকতাকরছি; ২০০৪ সাল থেকে। এখন আমি যা বেতন পাই সে তার প্রায় চারগুণ পায়।এবার আসি আমার কাজিননাছিরের কথায়। সেও পড়া লেখায় খুব একটা ভালো না। ইন্টারে পড়া অবস্থায় চিন্তা করছেবিদেশ চলে যাবে। সেখনে কর্ম করে আয় রোজগারের ব্যবস্থা করবে। বিদেশ মানে মিডল ইস্ট।সে আমার কাছে এসে বললো, কম্পিউটার শিখবে। আমার কম্পিউটার সেলস এন্ড সার্ভিসিংসেন্টার আছে। এখানে কাজ শিখার সুযোগ আছে। তাই হলো।
৫/৬ মাস কাজ শিখেছে। এরপর দুবাইপাড়ি জমিয়েছে। ফ্রি ভিসায়। সেখানে একটা কোম্পানিতে ডাটা এন্ট্রি অফিসার হিসেবেইন্টার ভিউ দিলো। চাকরি হয়ে গেলো। শুধু টাকার অংকে হিসেব করলে তাদের দু’জনেই এখনআমার থেকে বেশি বেতন পায়।একটু ভাবুনতো যতোলোক মিডলইস্টে আছেন তারা যদি টেকনিক্যাল কোনো কাজে প্রশিক্ষণ নিয়ে দক্ষ হয়ে যেতো তাহলেতাদেরকে ওড কোন চাকরি করতে হতো না। আয় অনেকগুণ বৃদ্ধি পেতো সাথে সম্মানও। এ সুযোগকিন্তু আমাদের রয়েছে, আমরা এর সদ্ব্যবহার করতে পারছি না। এর দুটি কারণ আছে বলে মনেহচ্ছে এক. উচ্চাকাঙ্ক্ষা দুই. কারিগরি কোর্স সম্পর্কে না জানা। অনেক অভিভাবকের চাওয়াহচ্ছে, তার সন্তান সরাসরি উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা হবে, ফিল্ডে কাজ করবে এটা ভাবতে তারাকষ্ট পান। তাই ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি করাতে চান না। এখান থেকে পড়ালেখা করেও যেধাপে ধাপে ওপরে ওঠা যায়, বড় কর্মকর্তা হওয়া যায় সেই বিষয়টা হয়তো চিন্তা করেদেখেননি। অধিকন্তু বেকারত্বের অভিশাপ থেকে বেঁচে থাকার সুযোগ এখানে তৈরি হয়।সবচেয়ে বড় কথা হলো টেকনিক্যাল থেকে পাস করার পর তাদের জন্য বিশেষায়িত উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও রয়েছে। ডিপ্লোমা পাস করার পর সেখান থেকে তাদের উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনকরার সুযোগ রয়েছে। বাইরের দেশে জনসংখ্যা রপ্তানি শুরু হওয়ার পর থেকে সব সরকারকারিগরি শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়ে আসছে। বাস্তবতা হচ্ছে সাধারণ মানুষ বিষয়টিকেসেভাবে গ্রহন করেনি।
শিক্ষার্থী্দের ছোটবেলা থেকে একরকম মানসিক শক্তি তৈরি হয়।যেখানে কারিগরি শিক্ষার বিষয়টি তার মস্তিষ্কে প্রভাব সৃষ্টি করতে পারছেনা। এটি এখন সচেতন মহলের ভাবনার বিষয়। সামনে মাধ্যমিকের শুরু থেকেই কারিগরি কোর্স সংযুক্ত থা্কার বিষয়ে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।সম্প্রতি আমাদেরশিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব বিবেচনা করে শিক্ষার্থীদেরবয়সের বাঁধা তুলে দিয়েছেন। এখন যে কোন বয়সের শিক্ষার্থী কারিগরির বিভিন্ন কোর্সেভর্তি হয়ে সার্টিফিকেট লাভ করতে পারবে। এ সিদ্ধান্ত আরও আগে নেয়া দরকার ছিলো।দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আমাদের অনেক জনশক্তি চাকরী করেন। তাদের দক্ষতাঅভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও তারা প্রমোশন পান না; সার্টিফিকেট না থাকায়। তাদের এ সমস্যাদূর হবে এ সিদ্ধান্তের কারণে। এ শিক্ষার বিস্তৃতি এখনঅনেক। কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও এখন কারিগরি জ্ঞান অর্জনের সুযোগ রয়েছে।অনেক জেনারাল স্কুল-কলেজেও কারিগরি বোর্ডের কোর্স পড়ানো হয়। এইচএসসি পর্যায়ে ব্যবসায়ব্যবস্থাপনা বা বিএম কোর্স প্রায় কলেজে আছে। খুব চমৎকার সিস্টেম। হিসাব-নিকাশেরক্ষেত্রে কম্পিউটারের প্রয়োগ শিখানোর খুব সুন্দর ব্যবস্থা। এখানে দুই বছরে চারটিকম্পিটারের কোর্স পড়ানো হয়। ৫০% ব্যবহারিক। প্রতি বছর ১০টি করে কোর্স সম্পন্ন করতেহয়, প্রতিটি শিক্ষার্থীকে। এর মধ্যে একটি বাস্তব প্রশিক্ষণ। এটি ছাড়া বাকিকোর্সগুলোতে ৪০% ধারাবাহিক মূল্যায়ণ। প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট শিক্ষকগণ মূল্যায়ণকরে বোর্ডে পাঠান। প্রতি ইয়ারেই পরীক্ষা হয়ে যায়। অর্থাৎ প্রথম বর্ষের পরীক্ষাপ্রথম বর্ষেই শেষ হয়ে যায়। যে কারণে শিক্ষার্থীরা শুরু থেকে লেখাপড়া করে কিন্তুকোন চাপবোধ করে না। ফলে শিখেও বেশি রেজাল্টও ভালো। এখান থেকে পাস করে শিক্ষার্থীরাআর্টস, কমার্স ও বিজ্ঞান বিভাগের অনেক সাবজেক্ট-এ উচ্চতর ডিগ্রি নেয়ার সুযোগও পায়।এ বিষয়গুলো এখনো অনেকে জানেন না।
ইতোমধ্যে সরকারিও বেসরকারি খাতে কারিগরি শিক্ষার যথেষ্ট সম্প্রসারণ হয়েছে। বর্তমানে সারা দেশে প্রায় ৯ হাজারকারগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ১২ লাখের বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। এ ছাড়া বিএম,ভোকেশনাল, কৃষি ডিপ্লোমাতো আছেই। দেখা যাচ্ছে যে, যারা এসব কোর্স সম্পন্ন করছে, তাদেরসহজেই কর্মসংস্থান হচ্ছে। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে ফারাক থাকলেও বড় কথা হচ্ছে তাদের বেকারথাকতে হচ্ছে না।কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষ জনবল তৈরির গুরুত্বঅপরিসীম। বাংলাদেশে কারিগরি শিক্ষাকে যথাযথ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে কিন্তু বিভিন্নকারণে কাঙ্ক্ষিত গুণগত মানের দক্ষতা অর্জন সম্ভব হয়নি এখনো। বাস্তব কর্মক্ষেত্রথেকে প্রায়ই প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবলের অভাবের কথা বলা হয়ে থাকে। ফলে ভারতসহ বহু দেশেরলোক বাংলাদেশে কাজ করছেন এবং বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে যাচ্ছেন।কারিগরিবোর্ডের ওয়েব সাইটের তথ্য মতে, কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশসরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়াধীন কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের একটি অধিদপ্তর।কারিগরি শিক্ষার সম্প্রসারণ ও মানোন্নয়নের মাধ্যমে দক্ষ মানব সম্পদ সৃষ্টিরলক্ষ্যে ১৯৬০ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয় । গত অর্ধ শতকে কারিগরি শিক্ষা ও প্রশাসনেরবহু শাখা-প্রশাখার বিস্তার ঘটেছে। অধিদপ্তরের মূল কাজ ৪টি যথা-মানব সম্পদব্যবস্থাপন, উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালনা, একাডেমিককার্যক্রমের তদারকীকরণ এবং কারিগরি শিক্ষা সংশ্লিষ্ট দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থারসঙ্গে সংযোগ সৃষ্টি করা।অধিদপ্তরাধীনশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা মোট ১১৯টি। তিনটি স্তরে পাঠদান কার্যক্রম পরিচালিত হয়যথা-সার্টিফিকেট, ডিপ্লোমা ও ডিগ্রী স্তর। সার্টিফিকেট পর্যায়ে রয়েছে ৬৪টিটেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ। ১টি ভোকেশনাল টিচার্স ট্রেনিং ইনষ্টিটিউট।ডিপ্লোমা পর্যায় ৪৯টি পলিটেকনিক ইন্সটিটউট এবং ডিগ্রী পর্যায় টেকনিক্যাল টিচার্সট্রেনিং কলেজ-১টি, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ-৪টি।
আবদুল কাইয়ুম মাসুদ :প্রভাষক,আইসিটি,কর্ণফুলী এজে চৌধুরী কলেজ।