সাজিদুল হক’র
একগুচ্ছ কবিতা
পুবাকাশ
🔵 কেটে ফেলো ডানা
পাখিটাকে ছেড়ে দিও না মুক্ত হাওয়ায়
সকল গোপনীয়তা জেনে যাবে প্রতিপক্ষের শত্রুরা;
ডানা কেটে ফেলো নির্মমভাবে
বন্ধুবেশে খুলে না দেয় আবার খাঁচার দুয়ার;
বিশ্বাসঘাতকের সঙ্গে কাটালে প্রেমহীন
অনুর্বর এক ভূখণ্ডে
অশ্রুজলে ভেসে যায় না অভিমানী ঢেউ
অশ্রুজলে নদী হলেও
মাছের উৎসবে পাবে না হতভাগ্য জেলেকে;
আলাদা হলে আত্মা, বুঝবা শরীর কতটা পচনশীল!
অনুতপ্ত হও অবিলম্বে চূড়ান্ত ভালোবাসার অপরাধে
গ্রহজগতে যে প্রভুর শাসন দেখে তুমি অভ্যস্ত
তার সাথে দাজ্জালের অদ্ভুত মিল।
🔵 লাশবাহী ট্রেন
কুলীন রাজত্বে নিরাপদ থাকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে,
ক্ষমতা ও সন্ত্রাস
অভুক্ত রেখে পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ
কলিঙ্গ যুদ্ধ বাঁধাতে সিদ্ধহস্ত;
অনুতপ্ত অশোকের ধর্মে বিশ্বাস
কবে ছিলো যুদ্ধবাজ ফেরিওয়ালার?
অসম যুদ্ধে দু‘একজন দেখিয়েছে
গুলির মুখে দাঁড়ানোর সাহস
দুর্বল প্রতিরোধে হারিয়েছে দুধের শিশু এবং জননীদের;
রাজধানীর দিকে ছুটে চলা ট্রেনে
চালকের আসনে গলিত লাশ
সবগুলো বগিতে পোড়া লাশের গন্ধ
বেঁচে যাওয়া ইঁদুরটা লাফিয়ে জানালার বাইরে;
শকুনের শ্যেনচক্ষু পেছনে ফেলে
পঁচাগলা লাশবাহী ট্রেন
ছুটছে রাজধানী অভিমুখে
🔵 বুলেট নিজেই একটি পক্ষ
মা ও মেয়ের ঘুমপাড়ানি গল্পটা তোমাকে ঘিরে হলেও
শুধু মা–মেয়ের নয় এই গল্প
দৃশ্যপট বদলে ফেলার শপথ অর্বাচীনের মুখে
জনারণ্যে জনরোলে চিনে নাও মিত্রকে
ভাঙা আর্শিতে ক্ষত–বিক্ষত চেহারায়
সহজ মানুষ যায় না চেনা সহজে;
ধোঁয়াশা সময় কী দিয়েছে তোমাকে?
রাখি পরানোর হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি
কুরুক্ষেত্রে প্রেম মানে পরাজয় নিশ্চিত;
বাজি ফুটছে
বাজিকরের নির্ভুল নিশানায় আছো;
তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে
প্রকাশ্য দিবালোকে
প্রস্তুতি চলছে,
বুলেট নিজেই একটি পক্ষ;
মরুভূমির ঝড়ে রাষ্ট্র কীভাবে নিরপেক্ষ থাকে?
প্রতিপক্ষের দাবার চাল থেকে কিছুই শেখোনি?
হারামির হাতে যখন বন্দুক
তোমার হাতে নেই কেন সুদর্শন চক্র?
প্রতিবেশীর ছায়া যে কোনো মুহূর্তে রূপ নেবে শরীরে।
🔵 ভায়োলিনই ভালো, ভায়োলেন্স থেকে
কেমন প্রেম ছিলো গোলাপ ফুলের সাথে?
অবিরলধারা রক্ত ঝরে কাঁটার আঘাতে
সম্পর্কের জটিল চোরাবালিতে থামলো
দিবসের ধবল প্রহরে অমানিশা নামলো;
আমি যাবো কোন পথে, অজানা ঠিকানা
সশব্দে এসে যে দাঁড়ায় সে নয় প্রেমিকা।
চন্দ্রমল্লিকার কাছে যাই যদি পাই আলো
পলায়নপর সময় দুয়ারে এসে দাঁড়ালো
নির্বাসনে আছে একাকীত্বের ভীষণ ভয়
প্রেম–অপ্রেমের জীবন, সে শুধু অপচয়।
ভায়োলিনই ভালো, ভায়োলেন্স থেকে
শরতের জ্যোৎস্না দেখেছি আমি চোখে
আমার ভেতরের অচেনা কারো উচ্চারণ
কাশফুলের পোশাকে তুমি দেখতে দারুণ।
🔵 মৃত মানুষের স্বপ্নজগত
(আমাদের কিশোর বয়সে কবিতার অক্ষর চেনা শুরু হয় আসাদ চৌধুরীর কবিতা পাঠ শুনে।
তবক দেয়া পান… সত্য ফেরারির কবি।
শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির মেরুদণ্ড হয়ে বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে)।
টবের ফুল–গাছের আলতো সবুজ পাতাটা পিপাসার্ত ছিলো
বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রতিদিন ভোরের হাওয়ায় নিয়েছি নি:শ্বাস
মুখিয়ে থাকে ফুল–পাতা আমার একটু মনোযোগ পাওয়ার লোভে
জল দিতে ভুলে যাই
হঠাৎ এক বিকেলে নজরে আসে বিবর্ণ সবুজ
বুকের ভেতর হু হু কান্না
টবের ফুল–পাতায় ঢেলে দিলাম আমার অশ্রুজল
একদিন
দুইদিন
সাতদিনই অনুতপ্ত আমি সিক্ত করি চোখের জলে
লকলকে জিভ কেটে আমাকে জানিয়ে দিলো
টবের ফুলপাতা বেঁচে আছে;
অল্প আগেও জীবিত মানুষটি এখন লাশ
সঙ্গে স্মৃতিরাও পেখম মেলেছে
কোথায় গেলো স্মৃতিরা, জানতে পেরেছো?
অবিনাশী আয়োজন নিয়ে বসে আছি আমি মৃত মানুষের স্বপ্নজগতে।
🔵 যাদুর বিস্ময়ে ফিরেছে জন্মদিন
যাদুর বিস্ময়ে ফিরেছে জন্মদিনের উৎসব, সদ্য ভূমিষ্ঠ
শিশুর কান্নার অন্য রূপান্তর; প্রিয়জনের হাসিতে শব্দের অনুরণন কেউ কী কখনো টের পায় সহজে?
খুব ইচ্ছে, জন্মদিনের পোষাকে স্নান করি মধ্য সমুদ্রে। ক্লান্তিকর দুর্গম যাত্রায় বিন্দু বিন্দু ক্লেদ, অপরাহ্ণ শেষে জমে সিন্দুসম পাপ; সমুদ্র কী নেবে ক্লেদজ–কুসুমের এই গুরুভার?
অচল একটি আধুলির বিনিময়ে পাওয়া দুর্বোধ্য জীবনের কবিতা তুলে দিয়েছি প্রিয়ার হাতে। সীমানা যতটা ছোট হয় হোক, কররেখাছুঁয়ে কবির পক্ষে কাটিয়ে দেয়া সম্ভব আমৃত্যু। অতিবাহিত সে কাল যদি ক্রীতদাসের হয়, নরকের বন্ধনে কেটে যাবে দুই ভুবন। চিঠিআসে, পড়ে আছে লেটার বক্সে। একটাও আমাকে উদ্দেশ্য করে লেখা না। পাশের বাড়ির মেয়েটির প্রেমে মজনু যুবকের আর্জিতেভরা ওসব চিঠি। ভেবেছিলাম, জন্মদিনে দু‘কলম লিখে জানাবে, শুভেচ্ছা, প্রিয়তম।
🔵 অনুভূতিহীন চোখ
পথ চলতে গিয়ে থমকে দাঁড়াও
এক নজর দেখলে মনে হবে বাংলাদেশের মানচিত্র
ক্ষত–বিক্ষত বলদের ঘাড়ে কয়েকটি মাছি
অনুভূতিহীন রাধাপদের চোখ তাকিয়ে থাকে
দৃষ্টিতে নেই দ্রোহের অনল;
অবাধ্য সাপের বিষথলি ফেটে রক্তক্ষরণ হচ্ছে
রক্তাক্ত ঐ ঠোঁটে কেউ চুমু খেতে যেও না,
একবার কণ্ঠরোধ হলে কখনো কদমতলায় গিয়ে
বাঁশিতে তুলতে পারবে না পরকীয়া সুর;
পরকীয়ার অপরাধ এ গাঁয়ে নিষিদ্ধ
পান খেয়ে ঠোঁট লাল করা যাবে না জখমী চরাচরে;
রক্তে লাল করার অনুমতি আছে
গায়েনের উদোম পিঠে চাবুক মেরে।
🟥 কবি সাজিদুল হক: অভিন্ন দহন ও দোহনে
কবি কে কখনো উপেক্ষা নয়, কবি ও কবিতার জন্য নিরন্তর অপেক্ষা করতে হয়। গোটা মানব জীবন একটা স্টেশনে দাঁড়িয়ে। অথচগন্তব্যে আস্থা নেই। কারণ নির্দিষ্ট স্টেশনে নেমে গেলে জীবনানুভূতির মৃত্যু ঘটে। কবির জীবন অনিশ্চিত অনির্ণীত। সে–ইঅনিশ্চিত চলমান ভুবন ডাঙার সাধক সাজিদুল হক। মধ্য আশির দশক থেকে নিভৃতে অবিরাম লিখে চলেছে। তিনি সে–ই কবি, সূ্র্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত কবিতার সঙ্গে লগ্ন থাকেন। কবিতার মধ্যে জীবন আর জীবনের জঙ্গমে খুঁজে ফিরেন গভীরতা এবংনানা মাত্রিক অন্তর্দাহন। এ –সবের যাবতীয় প্রশ্ন –উত্তরে সাজিদুল হক জীবন ও জগতের বহুমাত্রিক স্বপ্নের নির্মাতা। মাঝখানেরজীবিকার যে লড়াকু মানুষ সে টুকু বাদে সারাক্ষণ, সারারাত তিনি কবিতার দগ্ধ জীবনহরকরা বললে অতিবাদ হবে না। সাজিদেরকবিতার আকাশ অনেক বড়, অনেক প্রশস্ত। ভাবনা বিশ্বের কাদামাটি মাখা বাংলাদেশের লাল সবুজের মানচিত্র থেকে শুরু করেনানাবিধ বৈশ্বিক প্রবণতা তাঁর চিন্তায় জড়িয়ে আছে। ছাত্রাবস্থায় প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকারসুবাদে কবিতার অন্তর্জালে, ইতিহাস ও ঐতিহ্য চেতনার মুগ্ধ অভিষেক ঘটেছিল। খুব খোলাসা নয়, আড়াল আবডালে প্রতিনিয়তঢুকে পড়ে রাজনীতি ও রাজনৈতিক অবক্ষয়ের বিবিধ দুরাচার। তবে, নিরতিশয় দুর্মুখরাও কখনো বলবে না রাজনীতি মনস্ক কবিতায়তিনি শ্লোগান সর্বস্ব। একটি শিল্পিত আড়াল তাঁর কবিতার বিষয় বৈচিত্র্যে সার্বক্ষণিক নান্দনিক উন্মেষ দিয়ে থাকে। উত্তাপেউন্মোচন হতে থাকে নানাবিধ দহনের – যেখানে ব্যক্তি প্রেম, মানবিক আশা, বিপন্নতা, বিপর্যয়, বৈষম্য, বৈশ্বিক সংকট দল বেঁধে হয়েউঠতে চায় ভিন্ন সঙ্গীত।
ঔপনিবেশিক উত্তর বাংলা কবিতার অনুষঙ্গ যাপনে তিনি আমাদের পূর্বজ অভিভাবক কবিদের ভাষা ও দৃষ্টিভঙ্গির নতুন বিনির্মাণঘটান সুকৌশলে। আর সেখানেই পক্ষ হয়ে উঠে সৃজনশীলতার আবরণে এ–ই ভূগোলের প্রান্তিক নিম্নবর্গের মানুষ। তিনি লেখেন, অন্য কোনো সুরঞ্জনা, লেখেন নাটোরের মির্জাকন্যা। আমাদের সন্তাপের কবি, শব্দের কবি, জীবন ও বৈদগ্ধ্যের কবি, নারী প্রেমেরকবি। জীবনানন্দ দাশ কে গভীর গোপনে বিনির্মাণ করে ফেলেন নিজস্ব ভাষিক কল্পলতায়।
সাজিদের ৪০ বছরের কাব্য জীবনের সাক্ষী হয়ে আছে এ–সব গ্রন্থে ;
অন্য কোনো সুরঞ্জনা
মহলের উল্টো দিকে
নাটোরের মির্জাকন্যা
আততায়ীর অপেক্ষায়
পা রেখো না বারান্দার বাইরে
প্রত্যেকটি কাব্যগ্রন্থে তিনি পাল্টাতে চেয়েছেন কাব্যস্বর, দৃষ্টিভঙ্গি এবং আনতে চেয়েছে ভাষার ভিন্ন মুগ্ধতা। বিষয়ের বিস্তৃত প্রেক্ষাপটেকবিতাকে কথার ওপর সাজিয়েছে অকপটে। চিত্রকল্প ও রূপকল্প হয়েছে বিবিধ মাত্রিকতায় ব্যঞ্জনাঋদ্ধ। মাঝেমধ্যে কথার ওপরছন্দহীনতা কখনো বা মূলের চেতনায় বাধাগ্রস্ত করেনি–এমন নয়, তবে বাক্যের সুবোধ বুননে সে–সব খুব বেশি লক্ষ্যযোগ্য হ‘য়েওঠেনি। যেহেতু কবিতাগুলো বিষয় নির্ভর কথন স্পন্দিত। সমগ্রতার ওজন নির্মাণ প্রতিসাম্যে স্থানিক ভাবনা সঞ্জাত অনুষঙ্গ স্বাপ্নিকহতে চেষ্টা করছে নিয়ত। আমার আজকের এ–ই পর্যবেক্ষণ ভাবীকালের পাঠকদের কাছে ছেড়ে দিয়েছি। তবে, কবিতার দর্শন, মাটিও মানুষ, এ – কথা তাঁর কবিতার ক্যানভাস সাক্ষ্য দেবে। ৯০ এর দশকে উত্তর আধুনিক কবিতা আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে তাঁরকবিতার বিষয়বস্তু হয়েছে আমাদের সংস্কৃতি, ইতিহাস, লোকায়ত দর্শন, মিথ সে–ই সাথে নানা অনিয়ম সামাজিক অসংগতিররাজনীতি। সর্ব আনুষ্ঠানিকতা বর্জন করে উল্লাস ও উল্লম্ফনে মেতে না থেকে তিনি কবিতার একনিষ্ঠ ডুবুরি। আড়ালে আবডালেকবিতা কর্ষিত হয়েছে ডানে – বামে না তাকিয়ে। তিনি সাধক মানুষের। কবিতার জয়ে উল্লাসে ভীষণ নিভৃতে ফেটে পড়েন নিজস্বমনোদেবালয়ে। কাব্য বিবেচনায় নিজস্বতা তাকে করেছে একরোখা, মেজাজি। আবার একটা ভালো কবিতা–কে অ–ভালো বলেকসুর করেন না। শিল্পসাহিত্য ভাবনা– চিন্তায় আপতিক নন, সর্বরোগ – সার্বক্ষণিক কবিতা ভাবনায় আবিষ্টমন। সাধারণত, কবিদের বন্ধু হয় সমকালীন ও অগ্রজ অনুজ লেখকরা। তবে অনেকক্ষেত্রে একে অপরের ভালো বন্ধু হতে পারে না। সাজিদের কাছেদীর্ঘকালের বন্ধুর অস্তিত্ব–ও ক্ষুদ্র হতে থাকে এক চক্ষু জেদের কারণে। আমরা যারা কিছুটা কোমলপন্থী ছাড় দেয়া স্বভাবের, জাতীয়ও অজাতীয় বিষয় ভাবনায়, সেখানে তিনি অনড় অকম্পিত এক সত্তা। মান্ডেইন ( mundane) অস্তিত্বনুভূতির মধ্যে মানুষেরমুক্তি ও আলো তার দর্শন ভাবনার পরিশিষ্ট। সাম্প্রতিক সময়ে ফেসবুকে পোস্টকৃত উপর্যুপরি কিছু কবিতার দিকে মনোযোগ দিলেকবিতার এস্থেটিক্স (aesthetics) ভেলু নজর এড়ায় না। সাবলীল স্বতঃস্ফূর্ত জোয়ার কবিতার গায়েগতরে লেগে ভিন্ন দ্যোতনাসৃষ্টি করছে, লক্ষ্য করেছি। এ–ই কান্তিবিদ্যা মানব শরীরে যেমন উন্মাদনা লাগায়, তদ্রূপ কাব্য শরীরে শব্দবিদ্যা এক রকমের মোহতৈরি করে। সাজিদের ভাবনা উম্মুল নয়, মাটি ও নিড়ানিজাত গন্ধবকুল বাঁশ বাগানের। ঘোর সন্ধ্যায় অন্ধকারে চেরাগ জ্বালিয়েপ্রার্থনায় ডুবে থাকা কবি–র নাম সাজিদুল হক। সবুজ কচু পাতায় টলে টলে এক ফোঁটা জলের মতো নির্ভার স্বাধীন তিনি। সততশুভ কামনা।
রিজোয়ান মাহমুদ : আশিদশকের খ্যাতিমান কবি।