সুলতানা কাজী
‘লকডাউন’ বেশ আলোচিত একটা শব্দ বর্তমান বিশ্বে। এর শাব্দিক অর্থ হলো তালাবদ্ধ করে দেয়া। আবার লকডাউন’ শব্দটির সরল বাংলা– ‘অবরুদ্ধ’ কিংবা ‘প্রিজনে রাখা’ বলে মন্তব্য করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের সহযোগি অধ্যাপক খন্দকার মুনতাসীর হাসান।
আমরা পুরো পৃথিবীবাসীই অবরুদ্ধ এখন। স্তব্ধতা, নির্জনতা, গুমোটতা.. আমাদের মানিয়ে নিতে হচ্ছে এখন।অন্য রকম বেঁচে থাকার এ লড়াইয়ে বড়দের পাশাপাশি শিশুরাও বর্তমান। আচ্ছা, ওদের কেমন কাটছে প্রহরগুলো?? আনন্দে নাকি বিষাদে? ভালোলাগায় নাকি অবসাদে?? ভাবছি কি আমরা!!
আমার মতে, যন্ত্রমানবের মতো প্রোগ্রামিং মেনে কাজ করা শিশুদের জন্যই এসেছে ‘লকডাউন’! বিস্মিত হচ্ছেন!! ভাবছেন? এ আবার কেমন কথা!
আসলেই সৃষ্টিকর্তার এক আশীর্বাদ হয়েই এসেছে.. শিশুদের জন্যই এ লকডাউন!! এতে আমাদের অত্যুক্তি হওয়ার কথা না!
ভাবুন তো একবার, এই শিশুরা শেষ কবে এতটা সময় বাড়িতে থাকতে পেরেছে? পরিবারের সাথে সময় কাটাতে পেরেছে? নিজের সব কাজ করেও পেয়েছে অবসর? নিজের “শখ” নিয়ে মেতে উঠতে পেরেছে? পেয়েছে পর্যাপ্ত বিশ্রাম?? সাময়িকের জন্যও পেয়েছে মানসিক প্রশান্তি? না, পায়নি, হয়নি!!
এই লকডাউনই সে সুযোগ করে দিয়েছে শিশুদের অপ্রত্যাশিতভাবে।
উদাহরণ হিসেবে আমার মেয়ের কথায়ই বলছি। পুরো লকডাউনের এ সময়টায় সে তার মনের কথা লিখে প্রকাশ করছে! এতে আমার কোনো ধরণের সহযোগিতা সে চায়না! ওর ভাবনাগুলো ও লিখে প্রকাশ করার কথা সে লকডাউনের আগে ভুলেও মাথায় আনতে পারেনি। কারণ সিডিউল অনুযায়ী তাকে চলতে হতো বলে।
আরো অনেক উদাহরণ আছে, ঘটছে ও।।
আমার মনে হয় বাসায়/ বাড়িতে থেকে তারা একঘেয়েমির শিকার তো হচ্ছেইনা বরং অনেকটা সময় তারা নিজের সাথে কাটাচ্ছে। যা আসলে তাদের সবসময়ই পাওয়া উচিত। লকডাউন প্রকৃত অর্থেই ফিরিয়ে দিয়েছে শিশুদের শৈশব। প্লে শ্রেণি থেকে শুরু করে ইঁদুর দৌঁড়ে নাম লেখানো তারপর আর কোনো যতিচিহ্ন পড়েনা তাদের। পড়ালেখার পাশাপাশি বাবা-মার বাড়তি প্রত্যাশা পূরণের চাপও থাকে।
আত্মবিশ্বাস, আত্মনির্ভরশীল শব্দগুলো ওদের কাছে অজানা, অচেনা। নিজের ওপর ভরসায়ই করতে শিখেনা ওরা। আর তা হচ্ছেনা আমরা বড়দের জন্যই!! আমরা তাদের ওপর একের পর এক বোঝা চাপিয়ে দিই। তাদের সামগ্রিক বিকাশে বাধা দিই আমরা। স্বকীয়তা, স্বাধীন চিন্তার বিকাশ ঘটছেনা ওদের মধ্যে। তৈরি হচ্ছেনা কল্পনাপ্রবণ মন– যা শিশুদের বেড়ে উঠার জন্য একান্ত প্রয়োজন। আমরা বড়রা মনে করি, আঁকতে শেখা, গান, আবৃত্তি, নাচ, সাঁতার, ক্যারাতে–ইত্যাদি ক্লাসে গেলেই বুঝি আমাদের শিশুরা আর পিছিয়ে থাকবেনা।
আমরা শিশুদের সর্বাঙ্গিন বিকাশের জন্য যা যা প্রয়োজন সবই দিই কিন্তু কাজের কাজ কতটুকু হয়?!! ওরা রুটিনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে শুধু। ওদের মঙ্গলের জন্য প্রয়োজন চাপমুক্ত পরিবেশ। সে মুখ্য জিনিস থেকেই ওরা বঞ্চিত হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে একটু হলেও ওরা এখন মুক্তির স্বাদ নিচ্ছে। সুযোগ করে নিচ্ছে নিজেদের জগৎ তৈরির। পাচ্ছে অবাধ স্বাধীনতা— যা তাদের জন্মের পর থেকে অধরাই ছিল।
“স্বপ্ন দেখব বলে আমি দু’চোখ পেতেছি”…
ছোট- বড় সকলেই স্বপ্নবাজ! শিশুরা রাতে স্বপ্ন দেখে চকোলেট চিবোচ্ছে। আর বড়রা!! রাতারাতি…..
একটু ভাবি আমরা!! এই লকডাউনের সময়টায় যদি শিশুরা কিছুদিনের জন্য হলেও চাপ মুক্ত হয়, শৈশবকে উপলব্ধি করতে পারে, নিজেদের প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে পারে—-তাহলে তাদের সেভাবেই বেড়ে উঠতে দিই লকডাউন উঠে গেলেও!! হুম, পারি আমরা। তার জন্য প্রয়োজন আমাদের মানসিকতার উন্নয়ন। কারণ, চাবিতো আমাদের হাতেই!!
নিরাপদ, জঞ্জালমুক্ত সুস্থ পরিবেশ বিনির্মাণে আমাদের সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা যেমন জরুরী তেমনই শিশুদের বাস্তবসম্মত সৃজনশীল ও উদ্যমী মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে আমরাই সহায়ক।।
ভালো থাকুক পৃথিবী। নিরাপদ ও সুস্থ থাকি আমরা সকলেই।।
সুলতানা কাজী: শিক্ষিকা,অংকুর সোসাইটি স্কুল।