মসনবী সম্পর্কে অনুবাদকের উপলব্ধিগুচ্ছ…।।
মাঈন উদ্দিন জাহেদ ।। পুবাকাশ
বিশিষ্ট অনুবাদক-কবি ও মনীষী মনির উদ্দীন ইউসুফ গদ্য ভাস্যে অনুবাদ করেছেন ফারসি-সাহিত্যের এক বিশ্বজয়ী গ্রন্থ মসনবী। নাম দিয়েছেন ‘রুমীর মসনবী’।এর আগে অনেকেই খণ্ডিত ভাবে তা করেছেন।
‘মসনবী’ (আরবি উচ্চারণে মথ্নবী’)। রুমী’, ‘মৌলবী’ বা ‘মৌলানা’ আখ্যায় পরিচিত জালালুদ্দীন (১২০৭-১২৭৩) সুদীর্ঘ বার বছর ধরে একাগ্র সাধনায় নিমগ্ন থেকে এই অসাধারণ কাব্যগ্রন্থটি রচনা করেন।
পঞ্চাশ হাজারেরও বেশী চরণের এই বিশাল কাব্যটি ছয় অসমান খণ্ডের। এর খণ্ডগুলাে যেমন এক সময়ে রচনা হয় নি, তেমন রচনাভঙ্গিও সব জায়গায় একরূপ নয়। দীর্ঘকাল (১২৬১-১২৭৩)ধরে রচনা বলে তা ভিন্নতা স্বাভাবিক।
ফারসি-সাহিত্যে ‘মসনবী’ এক প্রকার বিশেষ প্রকৃতি ও আকৃতির কবিতা। এর মেজাজও ফারসি অন্যান্য কবিতার মেজাজ হতে স্বতন্ত্র । এর ছন্দ একাধারে শান্তি ও হাস্যরস পরিবেশনে সমার্থ। ‘মসনবী’ শব্দের মৌলিক অর্থ ‘দ্বিচরণিক’ অর্থাৎ দুই চরণযুক্ত। তবে ফারসি কাব্য-জগতে মস্ নবী” বললে এমন এক দু’লাইনের দীর্ঘ কবিতা বোঝায়, যা বাংলা“পয়ার’-ছন্দের কবিতার মতাে যা প্রতি দুই লাইনের শ্লোক হলেও, এমনরূপ একাধিক শ্লোকের সামূহীক ‘মসনবী’ রচিত হয়। সুতরাং, ‘মসনবী’র দীর্ঘতার কোনাে সীমা নেই।
বিশিষ্ট কবি- চিন্তক অনুবাদক মনির উদ্দীন ইউসুফ বাংলা ভাষায় ক্লাসিক ফারসি ভাষা থেকে
‘মসনবী’ অনুবাদ করে অসাধ্য সাধন করেছেন। এটা যেমন সাহিত্য কীর্তিতে অনন্য, ভাব সম্পদেও এ প্রাচ্যের অমর হৃদয় সম্পদে সমৃদ্ধ করা।
‘মসনবী’ অনুবাদ করতে গিয়ে এ বিশিষ্ট মনীষী এর ভাব ও ভাবনা নিয়ে তাঁর বিবেচনাগুলো ব্যক্ত করেছেন ‘রুমীর মসনবী’তে।
ভূমিকার উপান্তে জনাব ইউসুফ লিখন:
…মসনবী কাব্যের বিষয়বস্তুরূপে মানুষের দুইটি রূপকে দেখিতে পাইবে- ব্যক্তি মানুষ ও সমাজ মানুষ। কবি ব্যক্তি মানুষের মধ্যে মানব-হৃদয়ের অনবদ্যতা, উতুঙ্গতা ও রহস্যের সন্ধান পাইয়াছেন আর সমাজ মানুষের মধ্যে দেখিয়াছেন, ধর্ম, নৈতিকতা, কল্যান ও করুণাকে। মানুষের এই দুই রূপের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানই মানবতার চর্চা- এই দুই প্রবণতার সীমা নির্ধারণই আত্মিক সাধনা বা মারেফতের পরিণতি। এই সত্যের স্বীকৃতি ও তার সঠিক রূপায়ণ আধুনিক মানুষের কাম্য।’
ইরানের প্রখ্যাত সাধক কবি মোল্লা নুরউদ্দীন আবদুর রহমান জামী(১৪১৪-১৪৯২) তাই মসনবী ও রুমী’র প্রশংসায় লিখেছিলেন:
মসনবীয়ে মৌলবীয়ে মানবী
হস্ত কুরআঁ দর জবানপ পাহলবী
অর্থাৎ
মৌলবীর মসনবী তত্ত্বে বলিয়ান
এটা ফারসী ভাষার অমর কোরআন।’
মনীষী মনির উদ্দীন ইউসুফ বাংলা ভাষায় ‘মসনবী’ উপস্থাপন করতে গিয়ে যে চুম্বক মন্তব্যগুলো করেছেন তা রুমী ও মসনবী উপলব্ধি’র জন্য অনন্য সহায়ক হবে। সাতটি মন্তব্য এ প্রজন্মের পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো:
১. এই সব গুরুবাদী সম্প্রদায়ই খ্রিস্টান ও ত্রিত্ববাদ ও সম্ভবত ভারতীয় উৎস ‘হামাউস্ত’ (সােহহং বা অবতারবাদ) তত্ত্বকে ইসলামী চিন্তার অঙ্গীভূক্ত করিয়া লইয়াছে। অবতারবাদ ব্যতিরেকে “ইমামবাদকে প্রতিষ্ঠিত করা যায়
।’…পরম শ্রদ্ধের জুনায়েদ বাগদাদীর শিষ্য মনসুর হল্লাযের ‘আনাল হক ‘ বাণীকে হামাউস্ত-এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্তরূপে মুসলমান ধরিয়া লইয়াছে (পৃ-৩৮)
২. নানা উপাখ্যানের ভিতর দিয়াই তিনি তাঁর বক্তব্য উপস্থিত করিতে চাহিলেও মূলত তিনি ছিলেন কবি এবং গীতিকবি। তাই কাহিনির ফাঁকে ফাঁকে তাঁর আবেগপূর্ণ উচ্ছ্বসিত কবিমনের গীতিকবিজনােচিত মেজাজটি ফুটিয়া বাহির হইয়া পড়িয়াছে। রুমী যদি হাফেজের মতাে কেবলমাত্র গীতিকবিই হইতেন, তবে কাহিনি হইতে এ সকল প্রয়াণের মধ্যে শুধু স্বগতােক্তিই ধ্বনিত হইত। কিন্তু রুমী একজন প্রথম শ্রেণীর গীতিকার হওয়া সত্ত্বেও দার্শনিক ছিলেন (পৃ-৪৩)।
| ৩. প্রাচীরের ছায়া যেমন দীর্ঘতর হইয়া পুনরায় ছােট হইতে হইতে প্রাচীরের নিচেই ফিরিয়া আসে, কণ্ঠস্বর যেমন পর্বতের গাত্র প্রতিহত হওয়া।উচ্চারণকারীর কাছেই প্রত্যাবৃত্ত হয়, তেমন প্রত্যেক কর্মের প্রতিফলও কর্মীর কাছে ফিরিয়া আসিবে (পৃ-৫০)
৪. মসনবীর অনুবাদ : বুদ্ধি জিবরাইলের মতাে বলে হে মুহম্মদ (সা.) শুনুন, আমি যদি আর একপদও অগ্রসর হই তাহা হইলে পুড়িয়া ছাই হইয়া যাইব।
স্বর্গীয় দূত জিবরাইলের সঙ্গে কবি বুদ্ধিকে উপমিত করিয়াছেন। বুদ্ধি সম্পর্কে মৌলানার অভিমত যে বিরূপ নয় তাহা এই উপমা প্রয়ােগেই বেশ স্পষ্ট হইয়া উঠিল। অধ্যাত্মপন্থীদের মধ্যে বুদ্ধিকে নস্যাৎ করিয়া দেওয়ার একটি প্রবণতা দেখা যায়। বুদ্ধি স্বর্গীয় জিবরাইলের মতােই সত্যের সংবাদ বহন করে ও মেরাজের পথ প্রদর্শক হয়। শুধু মানবাত্মার চূড়ান্ত সম্ভাবনার সামনেই তার গতিপথ সীমিত করে (পৃ-১০৬)
৫. ফল যেমন কুড়ি হইতে পুষ্প পরাগে বিকশিত হইয়া নিজেকে সফল করে, মানুষকেও তেমনি হইতে হইবে। কেন বিকশিত হইতে হইবে, তাহা
জানিবার প্রয়ােজন ফুলের নাই। এই জানায় তার বিকাশের আনন্দই মাটি হইবার সম্ভাবনা (পৃ-১২৪)।
৬. বৈরাগ্য ও ভােগবাদ এই দুই মনােভাবের একটিও ইসলামী মনােভাব নয়–রুমীর এই মত। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও সার্বজনীন দায়িত্ব- পার্থিব জীবনের এইসব দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করিতে গিয়া ক্ষুদ্র অহংসত্তা
হইতে ব্যক্তির যে মুক্তি লাভ ঘটে ও জীবন সম্পর্কেও তার মধ্যে যে এক বিশ্বজনীন নতুন অনুভূতির জন্ম হয়, তারই বিকাশ ইসলামের লক্ষ্য। এই লক্ষ্যে পৌছবার সাধনাই ধর্মের সাধনা, ইহা একান্তভাবেই বৈরাগ্যের পরিপন্থী
ও জীবনের সহায়ক। (পৃ.-১৩৫)।
৭, চির অশান্ত মানবাত্মার এই বিরহবােধ যার মধ্যে জাগিয়াছে। মসনবী কাব্য তারই জন্য। তার জন্য এর অসংখ্য কবিতা কাহিনিও সাদৃশ-উপমা। তারই জন্য আত্মিক শিক্ষক ও জ্যোতির্ময় মহাপুরুষের অনুসন্ধানের সমস্যা।
মসনবী কাব্যের পাঠকের চোখে জাগিয়া উঠিতেছে অতিক্রান্ত এক দীর্ঘ পথরেখা সেই পথের পাশে জাগিয়াছে অজ্ঞনতা ও লােকাচারের অন্ধকার অরণ্যানী, সেই পথে আছে নরকদৃশ প্রবৃত্তির ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, ছলনা, মােহ,লােভ ও লালসার জাল পাতা রহিয়াছে সেই পথের দুধারে । কিন্তু পাঠকের মনে
সেই অতিক্রান্ত পথের যে স্মৃতি জাগে তা ভয় কিম্বা আত্মনিগ্রহ নয়, সেই স্মৃতি ফোরাতের অমল জলধারার মতাে-, সুগন্ধবাহী দখিনা বাতাসের মতাে। সেই স্মৃতির সঙ্গে মিশিয়া রহিয়াছে এক মধুর বেদনা, এই অপার্থিব পরম
আকাক্ষা । (পৃ.-১৬৮)। মনীষী মনির উদ্দিন ইউসুফের চুম্বক মন্তব্যগুলোর সাথে সাথে যদি মসনবী’র পাঠক হয়ে উঠি তাহলে আমরা বুঝে পারবো কেনো -রুমীর এ জীবন দর্শন পাশ্চাত্য জগতেও এখন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সব জায়গায় মসনবীর আলোচনা তত্ত্ব বিশ্লেষণ হচ্ছে। মানুষের হৃদয় মাঝে প্রেম-আস্বাদনের যে মৌলিক আগ্রহ গোপন হয়ে আছে- তা দিন দিন গভীর রহস্যের উন্মোচন করে প্রকাশিত হয়ে পরছে বিশ্বময়। রুমির পঙক্তি দিয়েই বলতে হয়:
সীনা খাহাম শরহে শারহা আয ফেরাক
তা বগোয়ম। শারহে দরদে ইশতিয়াক।
অর্থাৎ
বুক আমার বিচ্ছেদে ছিন্নভিন্ন ও মুক্ত হোক
তবেইতো বেদনার ব্যাখ্যা করতে সমর্থ হবো।
তাই বলতে হয়,
প্রযুক্তি জীবনের তীব্র বিচ্ছিন্নতায় মানুষ যতই বিচ্ছিন্ন হয়ে উঠবে মানুষ থেকে, ততই মানুষ উপলব্ধি করতে পারবে মসনবীকে, রুমীকে, আধাত্মবাদ ও ইহজাগতিকতার যৌথ মন্থনে বেড়ে ওঠা মরমী ইসলামকে। মুল সুফীকে, আহলে সোফ্ফাকে। রিয়াজুল জান্নার আসল সুফী ধারাকে।
মাঈন উদ্দিন জাহেদ : কবি ও প্রাবন্ধিক। সম্পাদক, পুবাকাশ।